ফরহাদ মজহারের হেফাজতীরা
ফরহাদ মজহার এর লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘অপারেশন ফ্লাশ আউট’, যেখানে তিনি হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির কারণ এবং তাদের উপর হাসিনা সরকারের আক্রমণের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। সেই ব্যাখ্যাতে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রেণী সংগ্রাম এবং ইসলামী বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জিহাদের ধারণা পাশাপাশি ব্যবহার করে প্রথমে অনুষঙ্গ ও পরে প্রতিস্থাপন পদ্ধতির মাধ্যমে এই দুই ধারণার মধ্যে সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পেয়েছেন।
ফরহাদ মজহার তার রচনা শুরু করেছেন হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের উপর আক্রমণের পেছনে নগরবাসী শাসক শ্রেণীর উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে। তিনি লিখেছেন-
"নাম দেয়া হয়েছিল ‘অপারেশন ফ্লাশ আউট’ অর্থাৎ হেফাজতিদের শহর থেকে টিয়ার গ্যাস ছুড়ে, গুলি মেরে, বোমা ফাটিয়ে যেভাবেই হোক তাড়িয়ে দিতে হবে। শহর সাফ করতে হবে।"
অপারেশন বা আক্রমণের উদ্দেশ্যকে বস্তুনিষ্ঠভাবে ব্যাখ্যা করার পরিবর্তে ফরহাদ মজহার অনেকটা গল্পের মতো শাসক চরিত্রের চিন্তাকে অনুজ্ঞাসূচক বাক্য রচনার মাধ্যমে প্রকাশ করে লিখলেন-
"অপারেশান ফ্লাশ আউট টিয়ার গ্যাস ছুড়ে, নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ভীতিকর সাউন্ড গ্রেনেডের আওয়াজে দিগ্বিদিক প্রকম্পিত করে গ্রাম থেকে আসা মানুষগুলোকে মেরে কেটে তাড়িয়ে দাও। শহর নিরাপদ করো সেই গুটি কয়েকের জন্য যাদের কাছে ১৬ কোটি মানুষ তাদের জীবন ও জীবিকা জিম্মি না রেখে বেঁচে থাকতে পারে না।"
ফরহাদ মজহার গ্রামের মানুষের প্রতি ঢাকাবাসী ধনিক শ্রেণীর ঘৃণার বর্ণনা দিয়েছেন সাহিত্যিক সৃষ্টিশীলতায়। কিন্তু তার এই সৃষ্টিশীলতা যে পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠতাকে নস্যাৎ করেছে, তা তিনি লক্ষ্যই করেননি কিংবা তিনি সচেতনভাবেই তা করেছেন। রাষ্ট্রীয় তিন বাহিনীর যৌথ অভিযানকে শুধু গ্রামের মানুষের প্রতি ঘৃণার প্রকাশ হিসেবে মেনে নিলে এটিও মেনে নিতে হবে যে, গ্রামের মানুষ মাত্রই দরিদ্র এবং শহরের সব মানুষ না হলেও বেশিরভাগ মানুষই ধনিক শ্রেণীর। বাস্তবে বিষয়টি মোটেও তা নয়। বস্তুত শহরের বাইরে গ্রাম কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। শহর ও গ্রাম মিলেই বাংলাদেশের শ্রেণী বিভক্ত সমাজ গঠিত। আর সেই সমাজে যে শ্রেণী শোষণ চলছে, তা-ও গ্রামে ও শহরে মিলিয়েই চলছে। পুঁজিবাদী সমাজের অসম বিকাশের সাধারণ নিয়মেই শহর ও গ্রামের মধ্যে পার্থক্য আছে; কিন্তু গ্রামের মানুষ মাত্রই দরিদ্র শ্রেণীর অন্তর্গত, তা সত্য নয়। গ্রামের মানুষ মানেই দরিদ্র বুঝলে কিংবা বুঝালে বস্তত গ্রামীণ শ্রেণী বিভাজন ও শ্রেণী শোষণকে অস্বীকার করা হয়।
মার্ক্সীয় শ্রেণী সংগ্রাম ধারণায় শ্রেণী বলতে যা নির্দেশ করা হয়, তা সম্পর্কে ফরহাদ মজহারের উপলব্ধি একদমই ভ্রান্ত। তিনি শহরের বিপরীতে গ্রাম, আর গ্রামের পরিচয়ই হচ্ছে মাদ্রাসা বলে বুঝাতে চান। ফরহাদ মজাহার তার রচনার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে শুরুতেই গ্রামের মানুষের সাথে মাদ্রাসার সমীকরণ করেছেন। তিনি লিখেছেন-
"শহরে কি তাহলে গ্রামের মানুষের কোনো স্থান নাই? আছে। শহরেও মাদরাসা আছে। কিন্তু তার উপস্থিতি অদৃশ্য। তাকে থাকতে হবে, না থাকার মতো শহুরে ভদ্রলোকদের নজর থেকে দূরে।"
শহরে গ্রামের মানুষ থাকে কিনা প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলতে পারতেন "আছে, লক্ষ-লক্ষ বস্তিবাসী আছে"। কিন্তু তিনি "আছে" এবং "শহরেও মাদরাসা আছে" বলে গ্রামের মানুষকে চিহ্নিত করলেন মাদ্রাসার সাথে। পরক্ষণেই সেই গ্রামের মানুষদের শহরে শোষিত হতে দেখালেন পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে-
"এদের ছাড়াও শহরে সহ্য করা হয় পোশাক কারখানার জন্য কিশোর ও কিশোরী সস্তা শ্রমিকদের। কিন্তু তাদের থাকতে হয় বদ্ধ বস্তিতে এক ঘরে দশ-পনেরো জন। যে মজুরি পায় তা ঘরভাড়া দিতেই চলে যায়। খাবার ঠিকমতো খায় কিনা সন্দেহ। কিন্তু তারাও যখন কারখানায় কাজ করে তখন তাদের তালা মেরে রাখা হয় জেলখানার বন্দীর মতো। কারখানায় আগুন লাগলে যেকোনো দুর্ঘটনায় তারা পুড়ে মরে, হুড়োহুড়ি করে বেরোতে গিয়ে পায়ের চাপায় পিষ্ট হয়ে লাশ হয়ে যায়। ভবন ধসে পড়ে প্রায়ই। তখন তাদের জ্যান্ত কবর হয়। রানা প্লাজা ধসে গিয়ে চাপা পেয়ে মরেছে হাজারেরও বেশি মানুষ।"
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে শোষিত শ্রমিককে গ্রামের মানুষ হিসেবে চিত্রিত এবং গ্রামের মানুষকে মাদ্রাসার লোক হিসেবে চিহ্নিত করার পর ফরহাদ সাহেব তৃতীয় অনুচ্ছেদে লিখলেন-
"যে জালিম ব্যবস্থা গরিবকে নিরন্তর গরিব করে রাখে, যে ব্যবস্থায় পুঁজির কাছে নিজেকে বেচে দিয়ে নগণ্য মজুরির ওপর জন্তু-জানোয়ারের মতো শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া আল্লাহর দুনিয়ায় মজলুমের প্রাণ ধারণের কোনো উপায় আর অবশিষ্ট থাকে না, সেই ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে এসেছিল হেফাজত। কেন এসেছিল? কারণ তার জীবের জীবন থেকে এই ব্যবস্থা যা কেড়ে নিতে পারেনি তা হচ্ছে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, নিজের ইমান-আকিদার প্রতি অঙ্গীকার এবং নবী করিমের (সা:) প্রতি অগাধ প্রেম। কুৎসিত ও কদর্য ভাষায় বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে তার জীবনের শেষ এই সম্বলটুকুরও অবমাননা, অপমানিত ও লাঞ্ছিত করেছে শহরের মানুষ। হেফাজত তার ঈমান-আকিদার জায়গা থেকেই প্রতিবাদ করেছে।"
ঢাকাতে কেন হেফাজতে ইসলাম এসেছিল, তার উত্তর প্রথম বাক্যের সাবঅর্ডিনেইট ক্লজে দেয়া হয়েছে "সেই ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে এসেছিল হেফাজত" দাবি করে। "সেই ব্যবস্থা" যে পুঁজিবাদী শোষণ ব্যবস্থা, তা-ও নির্দেশ করা হয়েছে প্রথম বাক্যের মেইন ক্লজে "পুঁজির কাছে নিজেকে বেচে দিয়ে" বলে। দুই ক্লজে গঠিত ৪১ শব্দের এই বাক্যটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ফরহাদ মজহার "কেন এসেছিল?" প্রশ্নবোধক দ্বিতীয় বাক্যটি বসিয়ে দিলেন প্রথম বাক্যের ঠিক পেছনে। মজহার সাহেব এর মধ্য দিয়ে একদিকে প্রথম বাক্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধ্বংস করে পরক্ষণেই তা উদ্ধার করতে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বাক্যে হেফাজতের ঢাকা আসার কারণ হিসেবে (১) ইসলামী ঈমান ও আকিদার প্রতি শহরের মানুষদের প্রদর্শিত অবমাননা এবং (২) এই অবমাননার বিরুদ্ধে হেফাজতীদের প্রতিবাদ স্পৃহার কথা উল্লেখ করলেন। উপরে উদ্ধৃত ফরহাদ মজহার তার লেখার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে পুঁজিবাদের শোষণের নির্মম শিকার হিসেবে বস্তুনিষ্ঠভাবেই উপস্থাপন করলেন পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের (যাদের অধিকাংশ নারী) মৃত্যুর ঘটনা (যাকে হেফাজতের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা 'আল্লাহ্র গজব' বলে আখ্যায়িত করেছিল)। এর মধ্য দিয়ে তিনি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে পাঠকের মানসিক অবস্থা তৈরী করলেন। কিন্তু তৃতীয় অনুচ্ছেদের প্রথম বাক্যে শ্রমিক উধাও হয়ে গেলেও পুঁজিবাদী শোষণের বর্ণনা অব্যাহত থাকলো এবং এর চ্যালেঞ্জকারী হিসেবে আবির্ভূত হলো হেফাজতে ইসলাম। দ্বিতীয় বাক্যে চ্যালেঞ্জকারী প্রশ্নাতীত, কিন্তু কারণ হলো প্রশ্নবিদ্ধ। তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চম বাক্যে নতুন কারণ হিসেবে হাজির হলো ঈমান ও আকিদা প্রতিষ্ঠার লড়াই বা জিহাদ। এভাবেই ফরহাদ মজহার ‘অপরাশেন ফ্লাশ আউট’ রচনাতে শ্রেণী সংগ্রাম ও ইসলামী জিহাদের মধ্যে সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন।
হেফাজতের ১৩ দফা:
ফরহাদ মজহার যতোই ইসলামী জিহাদ আর পুঁজিবাদ বিরোধী শ্রেণী সংগ্রামের সমীকরণকে একই কাতারে এবং হেফাজতীদের সেই শ্রেণী সংগ্রামের বীর সেনানী হিসেবে দেখাতে চান না কেন; হেফাজতে ইসলাম নিজেদের উত্থাপিত ১৩ দফার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট করেই ঘোষণা করেছিল তাদের দাবিগুলো কি কি-
(১) সংবিধানে ‘আল্লাহ্র উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুন:স্থাপন এবং কোরান-সুন্নাহ্ বিরোধী সকল আইন বাতিল করতে হবে।
(২) আল্লাহ্, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস করতে হবে।
(৩) কথিত শাহবাগী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-র শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী কুলাঙ্গার ব্লগার ও ইসলাম বিদ্বেষীদের সকল অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
(৪) ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার নামে সকল বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সকল বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে।
(৫) ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
(৬) সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সকল অপ-তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
(৭) মসজিদের নগরী ঢাকাকে মূর্তির নগরীতে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করতে হবে।
(৮) জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সকল মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে বাধা-বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করতে হবে।
(৯) রেডিও, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় দাড়ি-টুপি ও ইসলামী কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসি-ঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় খল ও নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করতে হবে।
(১০) পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মান্তকরণসহ সকল অপ-তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
(১১) রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদরাসা ছাত্র এবং তৌহিদী জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করতে হবে।
(১২) সারা দেশের কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ এবং মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধামকি ও ভয়ভীতি দানসহ তাদের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে।
(১৩) অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সকল আলেম-ওলামা, মাদরাসা ছাত্র ও তৌহিদী জনতাকে মুক্তিদান, দায়েরকৃত সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদেরকে বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
...............................................................
১৯৭১ সালে রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সেই বিপ্লব প্রদত্ত বৈধতায় ভিত্তিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতা এই রাষ্ট্রের সকল নাগরিককে দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যে সমান মর্যাদা দান করেছে, সেখানে একটি বিশেষ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি চাওয়া কোনো বিচারেই ন্যায়সঙ্গত নয়। এরকম দাবি একটি ধর্মের জন্য সুখের হলেও অন্য ধর্মের কিংবা ধর্মহীন লোকদের জন্য জুলুম। তাই এই দাবি প্রতিক্রিয়াশীল।
যেকোনো বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার অন্যায়। এমনকি নাস্তিক্যবাদের বিরুদ্ধেও কুৎসা প্রচার অন্যায়।
অন্যদিকে প্রায়শ এক ধর্মের আস্তিক অন্য ধর্মের আস্তিক্যকে অপমান করে থাকে। একজন প্রকৃত নাস্তিকের কোনো ধর্মের ব্যাপারে প্রীতি যেমন নেই, তেমনি হিংসা ও বিদ্বেষও নেই। একজন নাগরিকের যেমন ধর্ম বিশ্বাসের অধিকার আছে, ঠিক তেমনি তার অবিশ্বাসেরও অধিকার আছে। এক ঈশ্বরের বিপরীতে বহু ঈশ্বর কিংবা দেবতায় বিশ্বাস করা যদি অপরাধ না হয়, তাহলে শূন্য ঈশ্বরে বিশ্বাস করলে অপরাধ হবে কেন? নাস্তিকদের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি অবশ্যই অন্যায় ও নিপীড়নমূলক দাবি।
অব্যাখ্যাত ও অসংজ্ঞায়িত "বেহায়াপনা" বন্ধের স্বার্থে মানুষের মত প্রকাশের অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করার এবং নারী-পুরুষের বাধাহীন চলাচল বন্ধ করার দাবি কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের গ্রামে ও শহরে শ্রমজীবী নারী-পুরুষ স্বাধীন বিচরণের মধ্যেই কাজ করে থাকেন। তাই এই দাবি শ্রমজীবীর দাবি হতে পারে না। একমাত্র পরজীবী শ্রেণীই এই দাবি করতে পারে। নারী-পুরুষের শ্রম ছাড়া সভ্যতা টিকতে পারে না। তাই এই দাবি সভ্যতা বিরোধী। এটি হচ্ছে যুগে যুগে ও দেশে দেশে রক্ষণশীল, অপরিশ্রমী ও পরজীবী ধর্মগুরুদের দাবি। এই দাবি বাস্তবায়নের অর্থ হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষের উপর চরম নির্যাতন ও সভ্যতার ধ্বংস সাধনের সনদ।
পুরুষের সমান নারীর অধিকার অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে নারীর উপর পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। এই দাবি সংজ্ঞানুসারেই বৈষম্যমূলক। আর বৈষম্য হচ্ছে উৎপীড়নের পূর্বশর্ত। এই দাবিতে যে বাধ্যতামূলক ইসলাম শিক্ষার কথা বলা হয়েছে তা-ও সংজ্ঞানুসারে নিপীড়নমূলক। কারণ, একটি জাতি রাষ্ট্রে যখন বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসের মানুষ সমান নাগরিক অধিকার নিয়ে বসবাস করে, তখন সবাইকে একটি বিশেষ ধর্মে শিক্ষিত তথা দীক্ষিত হতে বাধ্য করার দাবি রীতিমতো নির্যাতন।
কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণার দাবি একটি ফ্যাসিস্ট দাবি। কাদিয়ানীরা যেখানে নিজদের মুসলমান মনে করে, সেখানে রাষ্ট্রের কোনো অধিকার থাকতে পারে না তাদের আত্মপরিচয় পরিবর্তন করার। এটি মানুষের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। হেফাজতে ইসলামের এই দাবি নির্যাতনমূলক দাবি। এটি মেহনতি দরিদ্র শ্রেণীর দাবি নয়।
ঢাকাকে 'মসজিদের নগরী' বলা হয় রূপক অর্থে, কারণ এখানে বিভিন্ন স্থাপত্য রীতির নির্দশন স্বরূপ প্রচুর মসজিদ আছে। কিন্তু ‘ঢাকা’ নামটি এসেছে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের নাম অনুসারে। এখন যদি হিন্দু ধর্মের হেফাজতকারী নামের কোনো সংগঠন এসে দাবি করে ঢাকেশ্বেরীর ঢাকা শহরে মসজিদ বানানো চলবে না, তাহলে কি এটি গ্রহণযোগ্য হবে? তাই মসজিদের সংখ্যাধিক্যের কারণে অন্য কোনো স্থাপত্য বা ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, এমন দাবি অন্যায়। ভাস্কর্যের সৌন্দর্য উপভোগীকে মূর্তিপূজারী বলা হচ্ছে আরেক অত্যাচার। কেউ মূর্তিপুজারী হলেও নিরাকার উপাসকদের অধিকার নেই তাদের স্বাধীনতা খর্ব করার।
হেফাজতে ইসলামী সংগঠনের পতাকা তলে ব্যাপক দরিদ্র সাধারণ থাকলেও সংগঠনটির দাবির মধ্যে কোথাও পুঁজিবাদী শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে একটি শব্দও নেই। তারপরও ফরহাদ মজহার উপরের ১৩টি দাবির কোথায় দেখলেন "যে ব্যবস্থায় পুঁজির কাছে নিজেকে বেচে দিয়ে নগণ্য মজুরির ওপর জন্তু-জানোয়ারের মতো শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া আল্লাহর দুনিয়ায় মজলুমের প্রাণ ধারণের কোনো উপায় আর অবশিষ্ট থাকে না, সেই ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে এসেছিল হেফাজত"?
দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের সংগ্রাম মানেই কিন্তু শ্রেণী সংগ্রাম নয়। এমনকি শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামও শ্রেণী সংগ্রাম নয়, যদি না তা শ্রেণী নির্ধারক উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বে ভিত্তিষ্ঠিত হয়। উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্ক না বুঝে শ্রেণী কিংবা শ্রেণী সংগ্রাম বুঝা যায় না। যে উৎপাদন ব্যবস্থার উপর সমাজ দাঁড়িয়ে, তার মধ্যেই রচিত হয় মানুষে-মানুষে সম্পর্ক, যা চূড়ান্ত বিচারে উৎপাদন সম্পর্ক। যে সমাজে উৎপাদন ব্যবস্থার শ্রমদান ডাইমেনশনে মুষ্ঠিমেয় মানুষ শ্রম বিযুক্ত আর সিংহ ভাগ মানুষ শ্রমে নিযুক্ত এবং ভোগ ডাইমেনশনে ঐ মুষ্ঠিমেয়রা ভোগে স্ফীত আর অধিকাংশ মানুষ ভোগ বঞ্চিত, সেই সমাজই হচ্ছে শ্রেণী বিভক্ত। উৎপাদনের পাটাতনের উপর দাঁড়ানো সমাজের মানুষেরা উৎপাদনের দুই ডাইমেনশনে যে পরস্পরের বিপরীত মেরুতে বিভাজিত, তার একেকটি ভাগই হচ্ছে একেকটি শ্রেণী। কারণটা হচ্ছে মালিকানা। অর্থাৎ, উৎপাদনের উপায়ের উপর মুষ্ঠিমেয় মানুষের ব্যক্তিগত মালিকানা এবং অধিকাংশ মানুষের নিঃস্বতা। এই দুই শ্রেণীর স্বার্থ পরস্পর বিরোধী হওয়ার কারণে এদের মধ্যে শ্রেণী দ্বন্দ্ব থাকে। এই শ্রেণী দ্বন্দ্ব কেবল তখনই শ্রেণী সংগ্রাম হয়ে ওঠে, যখন তা উৎপাদন সম্পর্কের মাত্রা কিংবা দিক কিংবা উভয়ের পরিবর্তনের দাবি করে। দাসতান্ত্রিক সমাজে শ্রেণী সংগ্রাম হয়েছিল দাস-মালিক সম্পর্ক উৎখাতের উদ্দেশ্য, সামন্তবাদী সমাজে শ্রেণী সংগ্রাম হয়েছিল প্রজা-রাজা সম্পর্ক বাতিলের জন্য, পুঁজিবাদী সমাজে শ্রেণী সংগ্রাম চলছে মালিক-মজুর সম্পর্ক উচ্ছেদের লক্ষ্যে।
হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলাম কিংবা তালেবান থেকে শুরু করে যেখানে যতো জিহাদী আছে তারা কি উৎপাদন সম্পর্কের প্রগতিশীল পরিবর্তন চায়? ইসলামী জিহাদীরা কি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মালিক-মজুর সম্পর্কের বাতিল চায়? ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ চায়? উৎপাদনের উপায়ের উপর মালিকের ব্যক্তিগত মালিকানা উচ্ছেদ করে শ্রমিক তথা সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে চায়?

Comments