বাম রঙ্গ [পর্ব-পাঁচ]
স্তালিন তার সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অসংখ্য জাতির মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে গেছেন, মৃত্যুর পর তার কুলাঙ্গার উত্তরসূরিদের কারণে এই মহান ভ্রাতৃত্ববোধ ভেঙে গিয়ে জাতিগত বিদ্বেষ এর নোংরামি শুরু হয়ে গিয়েছিল। কাজাখস্তানের কমিউনিস্ট নেতা দিনমুহাম্মাদ কুনায়েভকে হয়রানি ও উজবেক কমিউনিস্ট নেতা শারফ রাশিদভকে অপসারণের মাধ্যমে অ-রুশ সোভিয়েতবাসীদের ক্রোধকে বাড়িয়ে তোলা হয়েছিল। অনেকদিন ধরে স্লাভরা অন্য অ-রুশ সোভিয়েত জাতিগুলোর উপর মাতব্বরির চেষ্টা করে যাচ্ছিল, যা স্তালিনের মৃত্যুর পর অনেকটা বেড়ে যায়।
গর্বাচেভ বলেছিলেন-
"আমাদের অভিন্ন ইউরোপীয় স্বদেশ!"
১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে প্যারিসে এক সভায় রেজিস দেব্রে গর্বাচেভকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তার এই 'স্বদেশ' এর সীমা কি? তখন তিনি জবাব দিয়েছিলেন-
"উড়াল থেকে আটলান্টিক পর্যন্ত!"
১৯৫৬ সালের পার্টি কংগ্রেসে নিকিতা ক্রুশ্চেভ এই 'উৎকৃষ্ট পশ্চিমা কমিউনিজম'কে উৎসাহিত করে বলেছিলেন স্তালিনের 'নিকৃষ্ট আফ্রো-এশীয় প্রবণতা' নাকি সোভিয়েতদের জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে! ইনি সেই রেজিস দেব্রে যে একসময় চে গুয়েভারার অনুগামী হলেও পরে ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত সচিব হয়ে আরামে দিন কাটিয়েছেন এবং মার্কিন মুল্লুকের গুণমুগ্ধে পরিণত হয়েছেন, অথচ চে বেঁচে থাকার সময় আমেরিকাকে 'পঞ্চম রাইখ' হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
....................................................................
রকফেলার ফাউন্ডেশন মার্টিন লুথার কিং সিনিয়রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিল। কিন্তু 'দ্য স্টুডেন্ট নন ভায়োল্যান্ট কো-অর্ডিনেটিং কমিটি' এবং 'ব্ল্যাক প্যান্থার' গড়ে ওঠার পর সম্পর্ক ক্রমশ বিলীন হতে থাকে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Student_Nonviolent_Coordinating_Committee
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Black_Panther_Party
ফোর্ড এবং রকফেলার ফাউন্ডেশন কালোদের সংগঠনগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৯৭০ সালে ১৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয় যা খরচ করা হতো কালোদের আর্থিক সাহায্য, ফেলোশিপ, স্কলারশিপ, পড়াশোনা বন্ধ হওয়াদের জন্য পেশাগত প্রশিক্ষণ এবং কালো ব্যবসা মালিকদের জন্য মূলধনী অর্থ দেয়ার পিছে। নিপীড়ন, তহবিলের ভাগ নিয়ে অন্তর্কলহ ইত্যাদি কারণ আমূল পরিবর্তন প্রত্যাশী কালোদের সংগঠনকে ক্রমশ বিলোপের পথে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে ছেলে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বর্ণবিদ্বেষবাদ এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধকে মেনে নিয়েছিলেন নীরবে। ফোর্ড মোটর কোম্পানি, জেনারেল মোটরস, মোবিল, ওয়েস্টার্ন ইলেকট্রিক, প্রোকটের এন্ড গ্যাম্বেল, ইউএস স্টিল, মনসেনটো ও অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠান মিলে ২ মিলিয়ন ডলার তহবিল দিয়ে 'দ্য মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার সেন্টার ফর ননভায়োল্যান্ট সোশ্যাল চেঞ্জ' তৈরি করেছিল।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/King_Center_for_Nonviolent_Social_Change
প্রতিষ্ঠানটি যে সমস্ত কর্মসূচি চালায় সেসব প্রকল্পের কাজের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর, মার্কিন সেনাবাহিনীর চ্যাপলেইন কপস এবং অন্যান্যদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Chaplain_Corps_(United_States_Army)
এরা 'দ্য ফ্রি এন্টারপ্রাইজ সিস্টেম : এন এজেন্ট ফর ননভায়োলেন্ট সোশ্যাল চেঞ্জ' এর পৃষ্ঠপোষণা করেছিল, যা ছিল মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের বক্তৃতামালা।
দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাপারে ১৯৭৮ সালে রকফেলার ফাউন্ডেশন একটি স্টাডি কমিশন গঠন করেছিল। কমিশনের প্রতিবেদনে দক্ষিণ আফ্রিকা কংগ্রেসের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয় এবং বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল ও কর্পোরেট স্বার্থ সবচাইতে ভালো করে রক্ষিত হতে পারে যদি সেখানকার রাজনৈতিক ক্ষমতা সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমভাবে বন্টিত থাকে। ফাউন্ডেশন এএনসি'কে মদদ দিতে শুরু করে। এএনসি অল্পদিনের মধ্যে অধিকতর পরিবর্তনকামী স্টিভ বিকোর 'ব্ল্যাক কনশাসনেস আন্দোলন' এর মতো সংগঠনগুলোর শক্র হয়ে দাড়ায় এবং তাদের অস্তিত্ব লোপ করে দেয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Steve_Biko
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Black_Consciousness_Movement
নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কালো রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের পর তাকে 'মহাপুরুষ' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে তিনি সম্পূর্ণভাবে ওয়াশিংটন কনসেনসাসের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Washington_Consensus
এরপর থেকে এএনসি'র কর্মসূচি থেকে 'সমাজতন্ত্র' বিলুপ্ত হয়ে যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার এই 'শান্তিপূর্ণ উত্তরণ' এর পিছনে কোনো ভূমি সংস্কার, ক্ষতিপূরণের দাবি, কোনো খনি জাতীয়করণের প্রস্তাব ছিল না। এর পরিবর্তে সেখানে ব্যক্তি মালিকানার বিকাশ এবং পরিকাঠামোগত সংস্কার করা হয়েছিল। ম্যান্ডেলা তার বন্ধু ইন্দোনেশিয়ায় হাজার হাজার কমিউনিস্ট হত্যাকারী জেনারেল সুহার্তোকে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান 'অর্ডার অব গুড হোপ' উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Order_of_Good_Hope#:~:text=The%20Order%20of%20Good%20Hope,the%20Republic%20of%20South%20Africa.&text=Foreigners%20for%20promoting%20international%20relations%20and%20the%20interests%20of%20South%20Africa.
দক্ষিণ আফ্রিকায় এখন প্রাক্তন বিপ্লবী ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা মার্সেডিজ গাড়ি চেপে দেশ শাসন করে!
...........................................................................
"....১৯৭৯ সালে অর্থনৈতিক সংস্কারের পর চীনের জাতীয় আয় ভারতের চেয়ে অনেক দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু গত পঁচিশ বছরে ভারতীয়দের গড় আয়ু যে হারে বেড়েছে, সেটা চীনের তিনগুণ। এর কারণ ততটা এই নয় যে ভারত খুব ভালো করছে; ঘটনা হলো চীন বেশ খারাপ করছে। আগের আমলে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের কারণে প্রাথমিক স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার প্রতি চীনের শাসকদের একটা দায়বদ্ধতা ছিল, যার প্রেরণায় তারা এই দুই ক্ষেত্রে অনেক কাজ করেছিলেন। স্বাস্থ্য পরিষেবার মান অনেক ক্ষেত্রেই বেশ খারাপ ছিল বটে, কিন্তু অন্তত সবাই সেই পরিষেবার সুযোগ পেতেন। সকলের জন্য চিকিৎসার যে সামাজিক নিরাপত্তা ছিল, আর্থিক সংস্কার করতে গিয়ে ওরা সেটা তুলে দিলেন। হঠাৎ একদিন সেই নিরাপত্তা উধাও হয়ে গেলো। আগে যেখানে শতকরা একশো জনের চিকিৎসার সামাজিক নিরাপত্তা ছিল, এখন সেখানে শতকরা সত্তর জনের এমন কোনও সুবিধা নেই।...."
- 'বলা যায়', অমর্ত্য সেন
........................................................................
মহান কমিউনিস্ট নেত্রী অনুরাধা গান্ধীর জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল যে এই বেঈমানকে বিয়ে করা তা আসলেই বলার অপেক্ষা রাখে না। তার এই বইটিতে কোবাদ বাবু ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারকে সমর্থন জানিয়েছেন! শুধু তাই নয়, জেলের ভিতর ডলা খেয়ে তিনি দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদের তত্ত্বকে পর্যন্ত অস্বীকার করেছেন বইটিতে! ২০১৯ সালে জেল থেকে মুক্তির পর তিনি যে দলের কোনো নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি তা মাওবাদীরা নিশ্চিত করেছেন। যে কিনা মোদীর সরকারের প্রকাশ্য সমর্থক এবং কমিউনিজমের অতি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বকে অস্বীকার করে, আবার মিথ্যার ছড়াছড়ি যুক্ত বইয়ের জন্য পুরস্কার পায় তার বই মূলত কাদের জন্য রেফারেন্স হয় সেটা নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না!
..........................................................
১৯৬৪ সালে খ্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেমিক পার্টি চিলির ক্ষমতায় আসে। তারা নির্বাচনী প্রচারণার সময় আলেন্দের বিরুদ্ধে জঘন্য সব মিথ্যা প্রচারণা চালায়। খবরের কাগজ, রেডিও, টেলিভিশন, পথসভা থেকে শুরু করে কোনো মাধ্যম তারা বাদ রাখেনি নিজেদের প্রোপাগান্ডা ছড়াতে। তারা বলতো কমিউনিস্টরা যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে প্রথমেই তারা ধর্মযাজক ও সন্ন্যাসিনীদের হত্যা করে গির্জাগুলো ধ্বংস করবে! ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মতো দাড়িওয়ালা কমিউনিস্টরা নাকি তাদের বেয়নেটের ডগা ছোট ছোট ছেলেমেয়ের বুকে বসিয়ে সাম্যবাদী সমাজ গড়বে! দরকার হলে মা-বাবার কাছ থেকে ছেলেমেয়েদের ধরে এনে নাকি সাইবেরিয়ার লেবার ক্যাম্পগুলোতে কমিউনিস্ট হতে পাঠানো হবে! সিআইএ এই নির্বাচনে আলেন্দেকে হারানোর জন্য ২০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল যা তাদের সিনেটের এক বিশেষ সভায় প্রকাশ করা হয়। আলেন্দে চার বারের চেষ্টায় জয়ী হতে পেরেছিলেন এবং এই তথাকথিত বামপন্থী পার্টিকে বামফ্রন্টে নিতে হয়েছিল তাকে।
...............................................................
"...চীন'র শাসক দল এখনও কমিউনিস্ট পার্টি হলেও ক্রমশ তারা কমিউনিজম থেকে দূরে সরে এসেছে। কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার প্রথম শর্ত সমাজতন্ত্র বস্তুত বিদায় নিয়েছে বহু আগে। ব্যক্তিগত ধনসম্পদ গড়ার তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে গত শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে। এর ফলে বেড়েছে দুর্নীতি, খুন, জখম, রাহাজানি। বিপ্লবের পর মানুষের মধ্যে কল্যাণবোধ জাগ্রত করার প্রচেষ্টা অনেকদূর সফল হয়েছিল। চুরি-ডাকাতি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ঘর বাড়িতে তালা লাগানোর প্রয়োজনই পড়ত না।
১৯৯৩ সালে আমার প্রথম চীন সফরের সময় এক তরুণ চাকরিজীবি ও এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী চীন'র সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন একই কথা,"আগে আমরা সবাই সবার কথা ভাবতাম, এখন ভাবি শুধু নিজের কথা"। তখনই হোটেল কক্ষে মূল্যবান জিনিষপত্র ম্যানেজারের কাছে জমা রাখার নোটিশটিও বলে দেয় চীন-এ অবক্ষয়ের পালা শুরু হয়েছে। মাঝখানে আরো একবার চীন গিয়ে বুঝেছি তারা যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একসময় যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল সেই সাম্রাজ্যবাদীদের অনুসৃত 'উন্নয়ন কর্মসূচি' গ্রহণে তৎপর। এই পরিবর্তন এখন পাকাপোক্ত হয়েছে।..."
- চিন্ময় মুৎসুদ্দী (বিডিনিউজ, ২২ নভেম্বর, ২০১২)
..............................................................
নরওয়ের ‘সার্ভ দ্য পিপল’ সংগঠনের সমাজতন্ত্র বিষয়ক একটি প্রবন্ধের সোভিয়েত ইউনিয়ন সংক্রান্ত অংশ-
স্তালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভ এবং সোভিয়েত সংশোধনবাদ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। মাও তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন। ক্রুশ্চেভ স্তালিনের ঐতিহ্যকে জঘন্যভাবে আক্রমণ করেন এবং নতুন রাজনৈতিক লাইন সামনে নিয়ে আসেন। ঐ লাইনের মূল বিষয় ছিল চারটি-
১. ঐসময় থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি সকল জনগণের পার্টি এবং রাষ্ট্রটি সকল জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত হলো- অন্য কথা বলতে গেলে এগুলো আর সর্বহারার অস্ত্র হয়ে থাকলো না।
২. শান্তিপূর্ণভাবে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ- সোভিয়েত ইউনিয়ন নিশ্চিতভাবে জানালো বাকি দুনিয়ায় কমিউনিস্টরা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারে।
৩. শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতা- তারা যে পুঁজিবাদী দেশের থেকে উন্নত, সেটা সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে শান্তপূর্ণ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে।
৪. শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান- সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বশান্তিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেবে এবং পৃথিবীতে অশান্তির আগুন জ্বলতে পারে, এমন কোনো কাজে ইন্ধন জোগাবে না।
প্রতিবিপ্লব এই ধরনের মতাদর্শগত অবস্থান নিয়েছিল। তার ওপর ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে সচেতনভাবে একটি অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। পরবর্তীকালে অর্থনীতির একটি বৃহৎ অংশকে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ম্যানেজারদের বেতন বাড়ানো হয় এবং উৎপাদনের ক্ষেত্রে মুনাফায় আরও জোর দেয়া হয়। কিন্তু সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সংশোধনবাদীদের এই বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণভাবে এবং তাদের নিজেদের জন্যও ছিল বিপজ্জনক। কারণ এর মধ্য দিয়ে তারা সমাজ বিকাশের চালিকা শক্তি হিসেবে শ্রেণি সংগ্রামের ভূমিকা সংক্রান্ত মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিমার্জন করে, সর্বহারার নেতৃত্বকারী ভূমিকাকে তারা সংশোধন করে, তারা বিপ্লবী যুদ্ধের গুরুত্বকে অস্বীকার করে এবং বিপ্লবী যুদ্ধকে প্রত্যাখ্যান ও তার বিরুদ্ধে ভূমিকা নেয়ার মধ্য দিয়ে দুনিয়ার নিপীড়িত জনগণ এবং সারা পৃথিবীর সর্বহারাকে দুর্বল করে দেয়।
..............................................................
সোভিয়েত ইউনিয়নের গর্বাচেভ এবং চীনের দেঙ জিয়াওপিং এর অনুরূপ ভিয়েতনামে হো চি মিন এর মৃত্যুর পর মার্ক্সবাদী অর্থনীতি ধ্বংসের পিছে মাস্টারমাইন্ড ছিলেন ডো মোই৷ যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে যুদ্ধের ময়দানে তার কোনো অংশগ্রহণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷ হো চি মিন এর মৃত্যুর পর তিনি অনেকগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন৷ ১৯৮৮ সালে ডো মোই কাউন্সিল অভ মিনিস্টারস এর চেয়ারম্যান হওয়ার পর পলিটব্যুরো প্রধান ওয়েং ভ্যান লিংকে সাথে নিয়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতি ঢুকানোর কার্যক্রম শুরু করেন। নতুন ব্যবস্থায় সরকারি ভর্তুকি তুলে নেয়া হয় এবং পণ্য ও সেবা গ্রহণের জন্য কুপন ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া হয়। মোই প্রতি মাসে ব্যাংক সুদ ২-৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করেন। ১৯৯১ সালের ৫-১০ নভেম্বর চীনের তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের আমন্ত্রণে তিনি চীন সফরে যান। ১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই বিল ক্লিনটন ভিয়েতনামের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পাশাপাশি দেশটির বিরুদ্ধে নেয়া নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ঘোষণা দেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/%C4%90%E1%BB%97_M%C6%B0%E1%BB%9Di
https://en.m.wikipedia.org/wiki/%C4%90%E1%BB%95i_M%E1%BB%9Bi
.........................................................
শিক্ষা ও প্রলেতারীয় একনায়কত্ব
- বার্ট্রান্ড রাসেলকে মাও সে তুং এর জবাব [প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯২০ - জানুয়ারি ১৯২১]
"চাংশায় রাখা তার অভিভাষণে রাসেল কমিউনিজমের সপক্ষে অবস্থান নিলেও শ্রমিক কৃষকের একনায়কত্বের বিরোধিতা করেছেন। তার মতে কোনো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ না করে বা কারোর স্বাধীনতার অধিকারকে খর্ব না করে, বরং বিত্তশালী শ্রেণীকে শিক্ষিত করে তোলার মধ্য দিয়ে তাদের চেতনার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। রাসেলের এই বক্তব্য সম্পর্কে আমার মতামত কয়েকটি মাত্র শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করবো এবং তা হলো এই যে, ‘তত্ত্বগতভাবে এই যুক্তি শুনতে খুব ভালো লাগলেও এটা আদৌ বাস্তবসম্মত নয়।’ কারণ প্রথমত, শিক্ষার জন্য অর্থ সহ অন্যান্য নানান আনুষাঙ্গিক জিনিস প্রয়োজন। আর বর্তমান সময়ে অর্থের মালিকানা সম্পূর্ণভাবে পুঁজিপতিদের হাতে। বর্তমান সময়ে শিক্ষাব্যবস্থার দু'টি অন্যতম গুরুপ্তপূর্ণ অঙ্গ বিদ্যালয় এবং ছাপাখানা, এই দুইয়েরই নিয়ন্ত্রণ রয়েছে পুঁজিপতিদের হাতে। এক কথায় বলতে গেলে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা হলো পুঁজিবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা। যারা এই পুঁজিবাদী শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়, পরবর্তীকালে শিক্ষকের ভূমিকা পালন করার সময় তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে খুব স্বাভাবিকভাবেই পুঁজিবাদী শিক্ষাতেই শিক্ষিত করে তোলে। আর এভাবেই শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরিভাবে থাকে পুঁজিবাদের নিয়ন্ত্রণে। পুঁজিবাদীরা তাদের পার্লামেন্টে নিজেদের সুবিধার্থে আইন তৈরি করে, সর্বহারার শ্রেণীস্বার্থকে খর্ব করে এবং এই আইনকে প্রয়োগে নিয়ে যাওয়ার জন্য ও জবদরদস্তি করে সমাজের অন্য সমস্ত অংশের উপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য রয়েছে পুঁজিপতিদেরই ‘সরকার’; নিজেদের সুরক্ষার জন্য এবং সর্বহারার উপর শোষণ চালানোর জন্য পুঁজিপতিদের রয়েছে ‘পুলিশ’ ও ‘সৈন্যবাহিনী’; অর্থের চলাচল যাতে নির্বিঘ্নে হতে পারে, তার জন্য পুঁজিপতিদের রয়েছে নিজেদের ব্যাংক তাদের হাতে রয়েছে সামাজিক উৎপাদনের উপকরণগুলোর মালিকানা, যার মাধ্যমে তারা উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই পুঁজিপতিরাই এই শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং যাতে সর্বহারার মতাদর্শ বিকাশ লাভ করতে না পারে, তার জন্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সপক্ষে যত রকমভাবে সম্ভব, তারা প্রচার চালাবে। এরকম পরিস্থিতিতে কি আদৌ কারুর পক্ষে শিক্ষাব্যবস্থাকে সর্বহারা শ্রেণীর স্বার্থে ব্যবহার করা সম্ভব? সম্ভব নয়। তাই কমিউনিস্টদের কাছে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো রাস্তা খোলা নেই।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষার মাধ্যমে পুঁজিপতিদের চেতনার পরিবর্তন করাটা অসম্ভব। মনোবিজ্ঞান সংক্রান্ত জানা বোঝা এবং মানব সভ্যতার ইতিহাস অন্তত সেটাই বলে। শিক্ষার মাধ্যমে পুঁজিপতিদের শ্রেণীচেতনার পরিবর্তন ঘটানো যাবে ভাবলে ভুল করা হবে। শিক্ষাব্যবস্থার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দু'টি স্তম্ভ-বিদ্যালয় আর ছাপাখানা, এই দুটোই সম্পূর্ণভাবে পুঁজিপতিদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। আর কারো কাছে কয়েকটি বিদ্যালয় ও আনুষাংঙ্গিক কিছু বিষয়ের ও সংবাদপত্রের মালিকানা থাকলেও তা দিয়ে কোনোভাবেই পুঁজিপতিদের মানসিকতা এতটুকুও পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতেও এটা যেমন সত্য, তেমনই ইতিহাসের দিকে তাকালেও আমরা দেখবো যে অতীতে কোনো সাম্রাজ্যলোভী শাসক, সামরিক নেতা, কেউই স্বেচ্ছায় ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে দেয়নি। বরং জনগণই বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতার গদি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বারবার। প্রথম নেপোলিয়ন নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করে ব্যর্থ হন এবং পরে তার স্হলাভিষিক্ত হন তৃতীয় নেপোলিয়ন। একইভাবে ইয়ুয়ান শিহ কাই এর পতনের পর ক্ষমতাসীন হন হুয়ান শি হুই। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে মনোবিজ্ঞান বা ঐতিহাসিক দৃস্টিভঙ্গি- দু'টো থেকেই এই সিদ্ধান্তে পৌছানো যায় যে, শুধুমাত্র কিছু শিক্ষাগত উদ্যোগ নিয়ে পুঁজিবাদকে ধ্বংস করা সম্ভব নয়।
এছাড়া তৃতীয় আরেকটা কারণ রয়েছে এবং সেটাই সবথেকে বাস্তব কারণ। যদি সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য আমরা শান্তিপূর্ণ পথ বেছে নিই, তাহলে সেটা অর্জন করতে অনেক সময় লেগে যাবে। ধরে নেয়া যাক এক শতাব্দী লাগবে। তার মানে এক শতাব্দী ধরে সর্বহারাশ্রেণী চরমভাবে শোষিত ও নিস্পেষিত হবে। তাহলে এরকম পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কি? সমাজে সর্বহারারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। বুর্জোয়াদের তুলনায় সংখ্যায় তারা অনেক অনেকগুণ বেশি। যদি ধরে নিই যে মানবজাতির দুই-তৃতীয়াংশ হলো সর্বহারা শ্রেণীর মানুষ, তাহলে পৃথিবীর দেড়শো কোটি জনসংখ্যার মধ্যে একশো কোটি (যদিও প্রকৃত সংখ্যাটা আদতে এর অনেক বেশি) হলো সর্বহারা, শোষিত মানুষ এবং এই একশো কোটি মানুষ এক শতাব্দী ধরে চরমভাবে শোষিত হবে বাকি এই এক তৃতীয়াংশ পুঁজিপতিদের দ্বারা। এটা কি করে মেনে নেয়া যায়? সর্বহারা শ্রেণী আজ এটা উপলব্ধি করছে যে তাদেরও সম্পদের মালিকানা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তারা এই শোষণের শৃঙ্খল চাইলেই ভেঙে ফেলতে পারে। বর্তমান শোষণমূলক সমাজব্যবস্থাকে তারা আর মেনে নিতে পারছে না এবং তারা সমাজতন্ত্রের দাবীতে ক্রমশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠেছে। এটাই বাস্তব পরিস্থিতি এবং কোনোভাবেই এটাকে অস্বীকার করা যায় না। আর যখনই আমরা এই বাস্তব পরিস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠি, তখনই আমরা সেটাকে বদলানোর জন্য উদ্যোগ নিই। আর তাই আমার মনে হয় যত সময় যাবে, রাশিয়া তথা সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রেডিক্যাল কমিউনিস্ট আন্দোলনগুলো আরো বেশি শক্তিশালী ও সংগঠিত হয়ে উঠবে। এটাই স্বাভাবিক পরিণতি।
নৈরাজ্যবাদ সম্পর্কে আমার আরো একটা বক্তব্য রয়েছে এবং সেটা শুধুমাত্র এই নয় যে, ক্ষমতার প্রয়োগ ও সংগঠনবিহীন কোনো সমাজের অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব। আমি কেবলমাত্র এই ধরনের কোন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়ার ক্ষেত্রে বাস্তব সীমাবদ্ধতাগুলোকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি। এতক্ষণ যা কিছু বললাম তা থেকে এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হওয়া যায় যে নৈরাজ্যবাদ, সম্পূর্ণ উদারনীতির অনুশীলন বা সর্বব্যাপী গনতন্ত্র, প্রভৃতি বিষয়গুলো তত্ত্বগতভাবে শুনতে খুব ভালো লাগলেও কোনোভাবেই এগুলো বাস্তবসম্মত নয়।"
Comments