রোজা লুক্সেমবার্গ
রোজা লুক্সেমবার্গ ১৮৭১ সালের ৫ মার্চ পোল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জোসেস শহরে এক ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারে ৫ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। প্রতিক্রিয়াশীল উগ্র জাতীয়তাবাদী পোল্যান্ডে বনেদী স্কুলগুলোতে ইহুদী ধর্মাবলম্বী পরিবারের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করা ছিল প্রায় অসাধ্য। রোজা এই অসাধ্যকে সাধন করে স্কুলে পড়াকালীন ১৫ বছর বয়সে মার্কসবাদী গোপন সংগঠনে যোগ দেন। এই সংগঠনে সক্রিয় অংশগ্রণের পর থেকে পোল্যান্ডের সকল মহলে রোজার কর্মতৎপরতা দৃষ্টি কাড়ে। পোল্যান্ড সরকার রোজাকে গ্রেফতার করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তিনি গ্রেফতার এড়াতে পোল্যান্ড সরকারকে ফাঁকি দিয়ে খ্রিষ্টান বেশে এক পাদ্রীর সহায়তায় জুরিখে চলে যান। তখন তার বয়স মাত্র ১৮। তিনি অর্থনীতি ও আইন শাস্ত্রের উপর ডক্টরেট করেন। ১৮৮৯ সালে তিনি জুরিখ ত্যাগ করে বার্লিনে চলে যান এবং জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি (কমিউনিস্ট পার্টি)-তে যোগ দেন। ১৯০৪ সালে জার্মান সম্রাটের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভাষণের কারণে রোজার ৩ মাস জেল হয়। জেলে বসে তিনি বন্দীদের মাঝে ব্যাপক প্রচার চালান। জেল বন্দীদের নিকট তিনি তুলে ধরেন ফ্যাসিস্ট জার্মান সরকারের শোষণ-নিপীড়ন, ইহুদী নিধন, শ্রেণি সংগ্রাম তথা মার্কসবাদকে। বন্দী নারী-পুরুষ রোজার সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন। অনেক বন্দী মুক্তি পেয়ে জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি (কমিউনিস্ট পার্টি)-তে যোগদান করে। ১৯০৫ সালে রাশিয়ার শ্রমিক বিপ্লবকে তিনি উচ্চকণ্ঠে সমর্থন করেন এবং তার ভাষণে তিনি বলেন রাশিয়ার সর্বহারা শ্রেণি এই প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে একটি শ্রেণি হিসেবে। রোজা লুক্সেমবার্গ জার্মান সর্বহারা শ্রেণিকে রুশ সর্বহারাদের মতো বিশ্ব বিপ্লবের নতুন মঞ্চে আবির্ভূত হওয়ার আহ্বান জানান। ১৯০৫ সালে রুশ বিপ্লবের পরাজয়ের পর তিনি ওয়ারশ'তে ফিরে যান বিপ্লবে অংশ নিতে। সেখানে তিনি গ্রেফতার হন। মুক্তির পর তিনি পুনরায় বার্লিনে ফিরে আসেন এবং ১৯০৭ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টির স্কুলে শিক্ষকতা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সাম্রাজ্যবাদীদের কোন্দলে বিশ্ব বিভক্ত হয়ে পড়ে। সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদীরা বিশ্বকে ভাগ-বাটোয়ারার কামড়াকামড়িতে জনগণকে বিভক্ত করে। তখন "সকল দেশের সমস্ত বুর্জোয়া ও প্রতিক্রিয়াশীলদের রুখো"- এই কমিউনিস্ট বিপ্লবী নীতিকে বিসর্জন দিয়ে বার্নস্টাইনের নেতৃত্বে জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি (কমিউনিস্ট পার্টি) জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান নেয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Eduard_Bernstein
তারা নিজ দেশের বুর্জোয়া শ্রেণিকে উচ্ছেদ করে শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতা দখল ও তার আন্তর্জাতিকতাবাদী শ্রেণি ঐক্যের লাইনকে বর্জন করে এবং গ্রহণ করে জার্মানির আগ্রাসন ও অন্যান্য জাতিসমূহকে নিজ জাতির অন্তর্ভুক্ত করার বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী রাজনীতি। বার্নস্টাইনের নেতৃত্বে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক এর অনেক নেতা বার্নস্টাইনের এই বিশ্বাসঘাতক রাজনৈতিক লাইনে অবস্থান নেয়।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Second_International
বার্নস্টাইনের নেতৃত্বে এই সুবিধাবাদী নেতারা সাম্রাজ্যবাদীদের শ্রমিক শ্রেণিকে বিভক্ত করার চক্রান্তের (যার যার দেশ রক্ষা করার নামে নিজ দেশের বুর্জোয়ার লেজুড়বৃত্তির চক্রান্তের) সাথে একাকার হয়ে পড়েন। বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে দুই লাইনের সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়। একদিকে লেনিনের নেতৃত্বে বিপ্লবী অংশ, অপরদিকে বার্নস্টাইন-কাউটস্কির সুবিধাবাদী জাতীয়তাবাদী লাইন- এই দুই লাইনের সংগ্রামে রোজা অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সঠিক মার্কসবাদী লাইনে অবস্থান নেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Karl_Kautsky
তিনি দ্রুত বুঝতে সক্ষম হন বার্নস্টাইনের বিশ্বাসঘাতক সংশোধনবাদী লাইন। বার্নস্টাইনের নেতৃত্বে পার্টি আর কমিউনিস্ট পার্টি নেই তা তিনি বুঝতে পেরে জার্মানিতে একটি সঠিক কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং সে লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে রোজা এবং জার্মান সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী লাইনের নেতা কার্ল লিবনেখট ‘স্পার্টাসিস্ট’ নামে নতুন বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Karl_Liebknecht
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Spartacus_League
সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকতাবাদী অবস্থান (সমস্ত দেশের বুর্জোয়া ও প্রতিক্রিয়াশীলদের রুখো) নেয়ার কারণে রোজা পুনরায় গ্রেফতার হন। ১৯১৮ সালে যুদ্ধ শেষে জার্মান সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের জোয়ার এবং দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রধান নেতারা সংশোধনবাদী হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতিতে রোজা জার্মানিতে দ্রুত বিপ্লবী নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করেন এবং কার্ল লিবনেখটসহ তিনি স্পার্টাসিস্ট সংগঠনকে কংগ্রেসের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ জার্মান কমিউনিস্ট পার্টিতে রূপদান করেন। জার্মানিতে বার্নস্টাইন সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে সঠিক বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলা ছিল অসাধ্যকে সাধন করার মতো যা রোজা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জার্মান ফ্যাসিস্ট শাইডেমান সরকার রোজা এবং কার্ল লিবনেখটের নেতৃত্বে এই সঠিক বিপ্লবী কমিউনিস্ট সংগঠনটিকে অঙ্কুরে ধ্বংস করে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ১৯১৯ সালের জানুয়ারিতে জার্মান ফ্যাসিস্ট ফিলিপ শাইডেমান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে রোজা নেতৃত্ব দেন।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Philipp_Scheidemann
এই বিদ্রোহে তারা ব্যর্থ হলে কার্ল লিবনেখটসহ তিনি গ্রেফতার হন। ১৫ জানুয়ারি জার্মান সেনাবাহিনী রোজাকে গুলি করে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। রোজা লুক্সেমবার্গ কমিউনিস্ট আন্দোলনে শুধুমাত্র সক্রিয় কর্মীর ভূমিকা পালন করেননি, তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের প্রধান নেতারা যখন সংশোধনবাদী হয়ে যায় তখন রোজা সঠিক মার্কসবাদী লাইনের পক্ষে থেকে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালান এবং বিপ্লবী নেতা-কর্মীদের নেতৃত্ব দেন। তিনি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে বার্নস্টাইনবাদ ও মিলেরাবাদের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম পরিচালনা করেন। বার্নস্টাইনের পেটিবুর্জোয়া সংস্কারবাদী ও সুবিধাবাদী লাইনের বিরুদ্ধে তিনি ‘সংস্কার না বিপ্লব’ নামে একটি পুস্তক রচনা করেন।
https://www.marxists.org/archive/luxemburg/1900/reform-revolution/index.htm
তিনি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ঘোষক কমরেড ক্লারা সেৎকিনের সঙ্গে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টিতে নারী বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে লেনিনের অবদান যখন বিকশিত হয়ে উঠেছে, রোজা তখন লেনিনীয় উচ্চতর বিকশিত লাইনগুলোর সাথে নিজেকে উন্নীত করতে পারেননি। যেমন- সাম্রাজ্যবাদ সংক্রান্ত তত্ত্ব, শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্বের প্রশ্ন, পার্টি গঠনের প্রশ্ন, জাতীয় প্রশ্ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে রোজা লেনিনের নতুন অবদানগুলোকে ধরতে পারেননি। লেনিনবাদের নতুনতর অগ্রসর লাইনগুলোর বিতর্কে কখনো ডান, কখনো বামে অবস্থান নিয়েছেন তিনি। নারীমুক্তি প্রশ্নেও লেনিন রোজাকে বিবিধ বিচ্যুতি অনুসরণ করার জন্য সমালোচনা করেছেন। ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লব-পূর্ব রোজা ছিলেন অনেকটা মেনশিভিক লাইনের দ্বারা আচ্ছন্ন। তিনি লেনিনের সাথে বহুবার ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করে বিতর্কে অবতীর্ণ হন। লেনিন রোজার এই ভুল লাইনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাপক সংগ্রাম চালান। রোজা পরবর্তী সময়ে তার এক বন্ধুর নিকট চিঠিতে উল্লেখ করেন-
"মেনশেভিকীয় পন্থা পরিহার করতে আমাকে যতখানি লেনিনের তত্ত্ব ও যুক্তি প্রভাবিত করেছিল, ততখানিই প্রভাবিত করেছিল রাশিয়ার সফল বিপ্লব।"
১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি ফ্যাসিস্ট ফিলিপ শাইডেমান সরকার রোজাকে গুলি করে লাশ নদীতে ফেলে দিলেও ৩১ মার্চ তার লাশ পাওয়া যায় একটি খালের মুখে। শীতের কারণে পচে গলে যায়নি।
Comments