শিবিরনামা [পর্ব-দুই]


তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৮ সাল থেকে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা শুরু করলেও বারবার প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর বাধার মুখে পড়ে। সবাই তাদের একাত্তরের ঘাতক আলবদরদের পূর্বসূরি হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল। শিবির তাদের সংবিধানের দুই ধারা মোতাবেক 'আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (সঃ) প্রদর্শিত বিধান অনুযায়ী মানুষের সার্বিক জীবনের পুনর্বিন্যাস সাধন করে আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের' ডাক দিয়ে আশানুরূপ সাড়া পায়নি সেসময়। ঢাকার মানুষের কাছে, ছাত্র সমাজের কাছে তারা মৌলবাদ আর রাজাকারদের উত্তরসূরির মর্যাদা পেয়েছিল। তাদের ইসলামের ডাককে সবাই ভাওতাবাজি মনে করতো। রাজধানীতে নানা কার্যক্রমে ব্যর্থ হয়ে জামায়াতের নীতিনির্ধারণী মহল শিবিরকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছিল। জামায়াতের কার্যকরী পরিষদের সভায় ১৯৭৮ সালে এই সিদ্ধান্ত হয় যে, 'ছাত্র সংঘ' নাম পাল্টিয়ে যেহেতু শিবিরের কোনো লাভ হয়নি, তাই শিবিরকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। জামায়াতের নেতৃত্ব শিবিরকে ঢাকা কেন্দ্রিক না রেখে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে। তারা শিবিরকে শহর কেন্দ্রিক না রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং মফস্বল আর গ্রাম কেন্দ্রিক রাজনীতিতে বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করে। বিষয়টি পরবর্তীতে শিবিরের উত্থানে সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করেছিল।

ইসলামি ছাত্রশিবিরকে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়ার মূল পরিকল্পনা ছিল মীর কাশেম আলীর। সত্তরের দশকের শেষদিকে রাজাকারদের যখন স্বৈরাচার সরকার এদেশে প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয় তখন পালিয়ে থাকা, আত্মগোপনে থাকা অনেকেই প্রকাশ্যে বের হয়ে আসে। জেল থেকে একে একে ছাড়া পেতে শুরু করে দালাল আইনে আটক থাকা আলবদর রাজাকাররা। চট্টগ্রামে শিবিরের বিস্তারে মীর কাশেম আলী তখন জেল থেকে মুক্তি পাওয়া অনেক আলবদর কর্মীকে ছাত্রশিবিরের স্থানীয় রাজনীতিতে যোগ দেয়ার আহবান জানায়। যেহেতু মীর কাশেম আলী নিজে পাকিস্তান আমলে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র সংঘের চট্টগ্রামের সভাপতি ছিল, তাই সত্তরের দশকের শেষদিকে শিবির যখন চট্টগ্রামে তাদের রাজনীতির সূচনা করে তখন মীর কাশেম আলী চট্টগ্রামের শিবিরের রাজনীতিতে তার বাহিনীর লোকজনকেই প্রাধান্য দিয়েছিলযাদের একাত্তরে এদেশের মানুষের রক্তে হাত রাঙানো ছিল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে বাহিনী বর্বরতায় হার মানায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকেও; সেই বর্বর পিশাচদের অনেকেই নিজেদের বাঁচাতে এবং নিশ্চিত রাজনৈতিক আশ্রয়ের আশ্বাসে ছাত্রশিবিরে যোগ দেয়। চট্টগ্রামে নিজেদের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা শুরুতেই মানুষের মনে একটা আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিতে একাত্তরের মতো বর্বরতার আশ্রয় নেয়। মূলত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজেদের অস্তিত্বের ঘোষণা দিতে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতেই তারা চট্টগ্রাম থেকেই শুরু করে তাদের হত্যার রাজনীতি। এই হত্যার রাজনীতি শুরু করা হয় শিবির নামটি শুনে মানুষ যাতে ভয় পায়, মানুষ যাতে শিবিরকে সমীহ করে চলে; বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংগঠনগুলো যাতে শিবিরকে রাজনীতির মাঠে প্রবেশের সুযোগ দেয়, সমীহ করে, ইসলামি ছাত্র শিবির নাম শুনে যাতে ভয়ে ছাত্ররা শিবিরে যোগ দেয় ইত্যাদি কারণেই

বাংলাদেশে ইসলামি ছাত্রশিবিরের হাতে প্রথম খুন হন চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত এজিএস ও ছাত্রলীগ নেতা তবারক হোসেন। ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য দিবালোকে শিবির কর্মীরা রামদা ও কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে তবারক হোসেনকে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তবারক যখন পানি পানি বলে চিৎকার করছিলেন তখন এক শিবির কর্মী তার মুখে প্রস্রাব করে দেয়। একাত্তরের ওদের পূর্বপুরষদেরও ছাত্রশিবিরের পান্ডারা সেদিন বর্বরতায় হার মানায়। এই একটি খুনের মাধ্যমেই শিবির হিংস্রতার পরিচয় দিয়ে মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। যারা এই খুনের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, পরবর্তী সময়ে অনেক পত্রপত্রিকায় তারা এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বলেছেন; তারা বলেছেন শিবিরের সেদিনের বর্বরতার কথা, পৈশাচিকতার কথা। প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে একজন ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি নাজিমউদ্দিন। এই বিষয়ে একটি দৈনিকের সাথে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন-

"শিবিরের সন্ত্রাসীরা সেদিন তবারক হোসেনকে কিরিচ দিয়ে উপর্যুপরি কোপাতে কোপাতে হত্যা করে। কিরিচের এলোপাতাড়ি কোপে মুমূর্ষু অবস্থায় তবারক যখন পানি পানি বলে চিৎকার করছিলেন তখন এক শিবির কর্মী তার মুখে প্রস্রাব করে দেয়। পরবর্তীতে সাক্ষীর অভাবে এই হত্যাকান্ডে জড়িত সবাই বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। কারণ, এই বর্বর পশুদের বিরুদ্ধে ভয়ে তখন কেউই সাক্ষী দিতে রাজি হয়নি।"

এই ঘটনার পর ছাত্রশিবির সাধারণ ছাত্র ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের মনে ভয় ঢুকিয়ে চট্টগ্রামে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়। তারপর তারা তাদের রাজনীতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিস্তৃত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সেই লক্ষ্যে তারা নিজেদের মতাদর্শে বিশ্বাসী ছাত্রদের দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামি ছাত্রশিবিরের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম নগরীতে কাজ করতে থাকে ছাত্রশিবিরের ভিন্ন ভিন্ন ইউনিট। নগরীর কলেজগুলোর দখল নেয়ার জন্য তারা দফায় দফায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়নের সাথে। তারা চট্টগ্রাম নগরীর কলেজগুলোতে শুরু করে রগ কাটার রাজনীতি। তাদের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলতো তাদের হাত পায়ের রগ কেটে দিতে শুরু করলো শিবিরের পশুরা।

ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে টার্গেট করে তৎকালীন সময়ে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্দিকে নিজেদের আস্তানা তৈরি করে তারা। শিবিরের অনেক নেতা ও কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন আশেপাশের এলাকায় বিয়ে করে সংসার করতে শুরু করে। তারা স্থানীয় অধিবাসীদের নানা ধরণের আর্থিক সুযোগ সুবিধা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্দিকের গ্রামগুলোতে মেস ও ছাত্রাবাস গড়ে তুলে। তারপর সেখানে শিবির নিজেদের দরিদ্র কর্মীদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। প্রথমদিকে তারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বাধার সম্মুখীন হলেও এরশাদ সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরোপুরি নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। আশির দশকে তারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সিরাজুস-সালেহীন বাহিনী গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে তান্ডবলীলা চালায়। এই বাহিনীর নাম শুনলেই তখন দেশের মানুষের চোখে ভাসতো এক হিংস্র বর্বর বাহিনীর কথা, যারা কোনো কারণ ছাড়াই তখন শুধুমাত্র মানুষের মনে আতঙ্ক ঢুকানোর জন্য যার তার হাত-পায়ের রগ কাটতে শুরু করেছিল। এই বাহিনীর তান্ডবের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি রগ কাটার রাজনীতি শুরু না করতো তাহলে শিবির কখনোই নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারতো না। শিবির বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মনে তাদের হিংস্র কার্যকলাপের মাধ্যমে ভয় ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ক্যাম্পাসে তারা খুব সহজেই নিজেদের অবস্থান নিয়ে ফেলেছিলউল্লেখ্য, তখন যারা ছাত্রলীগ বা বাম রাজনীতি করতেন, তাদের অনেকেই চট্টগ্রাম নগরীতে থাকতেন। অন্যদিকে শিবির বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে নিজেদের জনবল ও শক্তি বাড়ায়; বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের এলাকায় ঘর, মেস, ছাত্রাবাস তৈরি করে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে নিজেদের জন্য অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলে। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্রে রেখে বৃত্তাকারে তারা প্রতিরক্ষা দুর্গ গঠন করে। যার ফলশ্রুতিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের এতো মজবুত অবস্থান তৈরি হয়ে যায়।

চট্টগ্রাম কলেজে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ১৯৮৪ সালের ২৮ মে ইসলামি ছাত্রশিবির কর্মীরা চট্টগ্রাম কলেজের মেধাবী ছাত্র শাহাদাত হোসেনকে ঘুমের মধ্যে জবাই করে হত্যা করে। শাহাদাত হোসেন সেই রাতে তার উচ্চ মাধ্যমিকের ব্যবহারিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ঘুমাতে যান। ঘুমের মধ্যেই হারুন ও ইউসুফ গলায় ছুরি চালিয়ে জবাই করে হত্যা করে শাহাদাতকে। শাহাদাতের অপরাধ ছিল সে হারুন ও ইসুফের কথায় ছাত্রশিবিরে যোগ দেয়নি! পরবর্তীতে শাহাদাত হত্যাকান্ডের জন্য এই দু'জনের সাজা হয়। কিন্তু দু'বছর পরই উচ্চ আদালতের রায়ে দু'জনে শাহাদাত হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত অবস্থায় জামিনে জেল থেকে বের হয়ে আসে। পরবর্তীতে এই মামলা থেকে হারুণ ও ইউসুফ বেকসুর খালাস পেয়ে যায় শাহাদাত হত্যাকান্ডের পর চট্টগ্রামের কলেজগুলোতে শুরু হয় শিবির বিরোধী আন্দোলন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবির নামের সংগঠন, যারা ইসলামের পতাকা উড়িয়ে সৎ লোকের শাসনের ডাক দেয়, তারাই হত্যা আর রগ কাটার রাজনীতি শুরু করে ততদিনে চট্টগ্রামে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করে ফেলেছে। তখন তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যারা গিয়েছে তাদের শিবির নামের পশুরা কঠোরভাবে দমন করার চেষ্ঠা করেছে। তাদের বিরুদ্ধে যারা কথা বলেছে, যারাই শিবির হঠাও আন্দোলন করেছে তাদের অনেকের হাত-পায়ের রগ কেটে দিয়েছে শিবিরের সন্ত্রাসীরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির প্রথম হত্যা করে 'ছাত্র মৈত্রী'র নেতা ফারুককে। ১৯৯০ সালের ২২ ডিসেম্বর ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি চালিয়ে তারা ফারুককে হত্যা করে। ১৯৯৩ সালে শিবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এনামুল হকের ছেলে ছাত্রদল নেতা মোহাম্মদ মুছাকে শিবির কর্মীরা নৃশংসভাবে হত্যা করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্য। এরপর তারা এই বিদ্যাপীঠে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করে নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলো হল দখলে নেয়ার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রামগুলোতে মেস ও ছাত্রাবাসের সংখ্যা বাড়াতে থাকে। মূলত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের মিনি ক্যান্টনমেন্ট হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের গ্রামগুলো।

অন্যদিকে সন্ত্রাস ও হত্যার রাজনীতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম
কলেজ ও সরকারি মহসিন কলেজ পুরোপুরি নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় ইসলামি ছাত্র শিবির। ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট দখল করার জন্য ইসলামি ছাত্র শিবিরের ক্যাডাররা ছাত্র সংসদের ভিপি মোহাম্মদ জমির ও ছাত্রদলের সাধারন সম্পাদক ফরিদউদ্দিনকে গুলি করার পর তাদের হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যা করে। একই বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই মোজাম্মেল কলেজে হামলা চালিয়ে শিবির ক্যাডাররা হত্যা করে বকুলকে নামের এক শিবির কর্মীকে। ১৯৯৮ সালের ৬ মে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত আমানত হলে হামলা চালায় শিবির। এসময় তাদের হামলায় হাসপাতালে ভর্তি হন বরিশাল থেকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা ছাত্র আইয়ুব আলী। ২২ আগস্ট, ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী সঞ্জয় তলাপাত্রকে হত্যা করে শিবির ক্যাডাররা। নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে শিবির দেশের সবচেয়ে আলোচিত ও ভয়ংকর হত্যাকান্ড ঘটায় চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে। ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন অবস্থায় শিবির চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট মোড়ে একটি মাইক্রোবাসে থাকা ছাত্রলীগের ৮ নেতাকর্মীকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। এই হত্যাকান্ড দেখে দেশের মানুষ আবার তাদের বর্বরোচিত নারকীয়তার সাথে নতুন করে পরিচিত হয়। এই হত্যাকান্ডের পেছনের কারণ অনুসন্ধানে গিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন অবস্থায় শিবিরের অবস্থান যখন হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছিল তখনই তারা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় একেবারে পরিকল্পিতভাবে শিবির ক্যাডাররা গুলি করে হত্যা করে ছাত্রলীগের ৮ নেতাকর্মীকে। এরপর ২০০১ সালের ২৯ ডিসেম্বর ফতেয়াবাদের ছড়ারকুল এলাকায় শিবির ক্যাডাররা ব্রাশফায়ারে হত্যা করে ছাত্রলীগ নেতা আলী মর্তুজাকে। শিবির ক্যাডাররা ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশনে কুপিয়ে হত্যা করে রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এ এম মহিউদ্দিন'কে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। মহিউদ্দিন খুন হওয়ার পর শিবির মহিউদ্দিনকে নিজেদের কর্মী বলে দাবি করে! এছাড়া শিবির ক্যাডাররা গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীকেও হত্যা করে। ফটিকছড়িতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে তারা পর্যায়ক্রমে ছাত্রলীগের বেশ ক'জন নেতাকর্মীকে হত্যা করে। তাদের এই হত্যা ও রগ কাটা রাজনীতি, সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী কার্যকলাপের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ ইসলামি ছাত্রশিবিরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি'র অধিভুক্ত 'ন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর স্টাডি অব টেরোরিজম এন্ড রেসপন্স টু টেরোরিজম' তৈরি ফাইলে ছাত্রশিবিরের ব্যাপারে বলা হয় 'ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন'। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জঙ্গি তৎপরতা চালানো ছাড়াও শিবির আন্তজার্তিক পর্যায়ের জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাথে নিজেদের একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে

দখলে থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে শিবির নিয়মিত নানা অজুহাতে চাদা আদায় করতো। এছাড়া তারা চট্টগ্রামে অস্ত্রের ব্যবসাও করতো সেসময়। এখনো অস্ত্রের ব্যবসার জন্য তাদের রয়েছে দেশব্যাপী বিশাল নেটওয়ার্ক। চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় রয়েছে তাদের পরিচালিত অনেকগুলো মাদ্রাসা, যেগুলোতে তারা শিবির কর্মীদের নানা ধরণের অস্ত্র তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া ছাড়াও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বা নগরীর অন্যান্য কলেজে যখন শিবিরের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কোনো সংঘর্ষে জড়াতে হয় অথবা তারা যখন প্রতিপক্ষের উপর হামলা করতে যায় তখন এসব মাদ্রাসার ট্রেনিংপ্রাপ্ত ক্যাডাররাই মূলত এসব কাজ করে থাকে।

বর্তমানে চট্টগ্রামে শিবির পরিচালিত অনেক ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যেমন কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে, তেমনি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসাও আছে। আরো আছে শিবির পরিচালিত নানা ধরণের কোচিং সেন্টার। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা কিন্ডারগার্টেনের কোমলমতি শিশুদের হাতে তুলে দেয় রঙ বেরঙের স্টিকার ও কিশোরকন্ঠ নামের ম্যাগাজিন। এই কিশোরকন্ঠ নামের ম্যাগাজিন দিয়েই তারা প্রাথমিকভাবে বশীভূত শিশু কিশোরদেরএছাড়া 'ফুলকুঁড়ি আসর' তো আছেই। 'ফুলকুঁড়ি আসর' নামের শিবিরের সংগঠনটি গড়ে উঠে ১৯৭৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর এরপর ছাত্র শিবিরের কার্যক্রমের সাথে এই সংগঠনটির কার্যক্রমও দেশব্যাপী বিস্তৃত করে শিবির। শিশু কিশোরদের জড়িয়ে ফুলকুঁড়ির নানা ধরণের সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ (ইসলামিক), পাঠাগার থেকে শিশু-কিশোরদের ইসলামিক বই পড়তে দিয়ে তারা পড়তে দিয়ে কোমলমতি শিশু কিশোরদের তারা শিবির নামের ঘৃণ্য সংগঠনে টেনে আনছে। গ্রাম থেকে যেসব ছেলেরা চট্টগ্রাম নগরীর কলেজগুলোতে অথবা যারা চট্টগ্রামের বাইরে থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে তাদের হলে বা মেসে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে, নানা ধরণের আর্থিক সাহায্য সহযেগিতা করে, লেখাপড়া শেষে জামায়াত পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে চাকরির নিশ্চয়তার কথা বলে তারা সহজ-সরল গ্রামের ছেলেদের খুব সহজেই শিবিরের রাজনীতিতে ঢুকিয়ে ফেলে।




Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]