বাম রঙ্গ [পর্ব-চার]



যেসব বাম নিজেদের নির্বাচনে যাওয়ার কুযুক্তি হিসেবে লেনিনকে অপব্যবহার করেন, সেই লেনিন কি বলে গেছেন শুনেন আগে। ম্যাক্সিম গোর্কি এবং লেনিনের স্ত্রী ক্রুপস্কায়া তাদের স্মৃতিকথায় বলেছিলেন লেনিন তার প্রিয় বাজনা শুনতে শুনতে মন্তব্য করেন- 

"একটা সময়ে যখন বৈপ্লবিক দায়িত্ব দাবী করে শত্রুর মাথা ভেঙে দেয়ার প্রস্তুতি নিতে, তখন যেন কেউ মানুষের মাথায় সস্নেহ হাত বুলিয়ে দেয়ার প্রেরণাদায়ক বাজনার সুরে প্রভাবিত না হয়।"
...............................................................

এই অঞ্চলের যেসব 'বাম' তথাকথিত মুক্তমনাদের সাথে তাল মিলিয়ে শ্রেণীগত অবস্থান অনুযায়ী আচরণের বিশ্লেষণ না করে আমজনতাকে 'মৌলবাদী' আখ্যা দিয়ে রাজধানীতে বসে বিপ্লব, বিপ্লব খেলেন; 'বোধিচিত্ত' জাতীয় চ্যানেলে বলে বেড়ান সর্বহারাদের হাতে দেশ চলে গেলে নাকি নৈরাজ্যবাদ দেখা দিবে; তাদের জন্য সোভিয়েতের কমিউনিস্ট পার্টির ১৮ম কংগ্রেসে স্তালিনের বলা কিছু উদ্ধৃতি নিচে দেয়া হলো -

"সব দেশেরই বুর্জোয়ারা জোরের সঙ্গে দাবী করে যে পুঁজিপতি ও জমিদারদের ব্যতিরেকে, ব্যবসায়ী ও কুলাকদের ছাড়া জনগণ এক পা-ও এগোতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণী কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ দিয়েছেন যে শোষকদের বাদ দিয়ে জনগণ যথার্থভাবেই এগিয়ে যেতে পারেন।" 

"সব দেশের বুর্জোয়ারা দাবী করে যে পুরোনো পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে শ্রমিক শ্রেণী পুরাতনের জায়গায় নতুন কিছু গড়তে পারে না। আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণী তাদের কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে তারা কেবল পুরোনো ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতেই সক্ষম নয়, সেই সঙ্গে গড়তে সক্ষম একটি নতুন ও আরও ভালো ব্যবস্থা, একটি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থায় বেকারি ও সংকট বলতে কিছু নেই।" 

"সব দেশের বুর্জোয়ারা জোরের সঙ্গে বলে থাকে যে কৃষক সমাজ সমাজতন্ত্রের পথ অনুসরণ করতে অসমর্থ। আমাদের দেশের কৃষকদের যৌথ খামার বাস্তবে প্রমাণ দিয়েছে যে তারা সফলভাবেই সেই কাজ সম্পন্ন করতে পারেন।"

"সব দেশের বুর্জোয়া এবং তাদের সংস্কারপন্থী লেজুড়দের প্রধান লক্ষ্য হলো শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে তাদের আস্থাকে, বিজয়ের সম্ভাবনা ও অনিবার্যতা সম্পর্কে বিশ্বাসকে ধ্বংস করা ... যদিও আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণীর সাফল্য, যদি তার লড়াই ও বিজয় পুঁজিবাদী দেশগুলোতে শ্রমিক শ্রেণীর প্রেরণাকে উদ্দীপ্ত করে এবং তাদের নিজেদের ক্ষমতা ও জয়লাভের বিশ্বাসকে দৃঢ় করে, তাহলে আমাদের পার্টি বলতে পারে যে তাদের কাজ ব্যর্থ হয়নি। এবং সন্দেহ নেই সেটাই দাঁড়াবে।"
.............................................................

বামেদের চ্যারিটিবাজির ব্যাপারে লেনিনের দৃষ্টিভঙ্গি-

"...অস্বাভাবিক গরমের জেরে ১৮৯১ সালের গ্রীষ্মে খরা হয়েছিল। বহু প্রদেশে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। তার হাত ধরেই আসে একের পর এক মহামারি। এই দুর্যোগ গোটা দেশকে বিপর্যস্ত করে দেয়। গ্রাম কে গ্রাম উজাড় হয়ে যায়, শহরবাসীরা ভয়ে কাঁপতে থাকে। ক্ষুধার্ত ও বেপরোয়া কৃষকরা শহরে ঢুকে শহরের বাসিন্দাদের ঘরবাড়িতে লুঠপা‌ট চালায়। গ্রামের যাবতীয় সম্পদ গ্রীষ্মের দাবদাহে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সরকার হতচকিত হয়ে, পরিস্থিতি সামলাতে নানারকম নির্দেশ জারি করলেও তার কোনোটিই কার্যকর করতে পারেনি। বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু ত্রাণকার্য চলছিল। বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণ কমিটি তৈরি হয়, টাকাপয়সা তোলা হতে থাকে, খাবারদাবারের ব্যবস্থা করা হয়, স্বাস্থ্যকর্মীদের দল গঠন হয়। বুদ্ধিজীবীরা এই ত্রাণকার্যে ব্যাপক সাহায্য করেন। এমনকি শাসকদের চরম বিরোধী অগ্রণী অংশও এই অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে, চরম প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে বিরোধ স্থগিত রেখে এলাকাভিত্তিক ত্রাণ কমিটিগুলির সঙ্গে কাজ করতে থাকেন। অন্যান্য অঞ্চলের মতো সামারাতেও এই ধরনের একটি কমিটি তৈরি হয়েছিল। গঠিত হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের মানুষের ‘পবিত্র’ জোট। এই অবস্থায় কী করণীয় ছিল লেনিনের? তাঁর বোন অ্যানা একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগ দিয়ে অসুস্থদের সেবা করা শুরু করলেন। লেনিন ওইসব ত্রাণ কমিটিগুলিতে যোগ দিতে অস্বীকার করেন এবং ওই কমিটিগুলির বিরুদ্ধে তাঁর গোপন গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচার চালাতে থাকেন। তিনি নিজের পক্ষে লোকজন পাননি। শুধুমাত্র এলাকায় নতুন আসা এক ‘সন্দেহভাজন’ লেনিনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে তাঁর সঙ্গে কাজ করতে থাকেন। যারা নাকি মানবতাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জনগণের সেবা করছে, তাদের প্রতি এরকম চূড়ান্ত বিরোধিতামূলক মনোভাব দেখানোটা কি লেনিনের দিক থেকে যুক্তিসংগত হয়েছিল? হ্যাঁ, লেনিনের অবস্থান মার্কসবাদের বুনিয়াদি নীতির সঙ্গে অবশ্যই সংগতিপূর্ণ ছিল। তাঁর মনে হয়েছিল, এই সমস্ত কার্যকলাপ (যা বিশুদ্ধ ও সোজাসাপটা মানবপ্রেম ছাড়া কিছু নয়) এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে জনগণের দুর্দশা দূর হওয়ার বদলে আরও বাড়বে। এই বিপর্যয়ের ফলে যখন জার শাসনের অনিশ্চয়তা এবং অদক্ষতা প্রকাশিত হয়ে গেছে এবং জনগণের মধ্যে বিপ্লবী রাজনীতি প্রচারের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেছে, তখন এই ধরনের ত্রাণকার্য এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসে শাসকদের নিজেদের গুছিয়ে নিতে সাহায্য করবে।অন্যদিকে একজন বিপ্লবী এরকম পরিস্থিতিতে একজন জঙ্গি রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে, শোষক শ্রেণির সঙ্গে নিজের তফাত বজায় রেখে কাজ করে চলবেন।..."

- 'লেনিন', জেরার্ড ওয়াল্টার
...............................................................

অনেক বাম শিনজো আবে নামক দালালের পক্ষে পোস্ট দিয়েছিল সেসময়। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে পুন:নির্বাচনে প্রায় ল্যান্ডস্লাইড জয়লাভ করেছিলেন এবং জাপানি ও আন্তর্জাতিক মূলধারার মিডিয়ার রেটিং অনুসারে তিনি যুদ্ধোত্তর জাপানে সবচেয়ে সফল রাজনীতিবিদদের একজন! এই বিজয় ইঙ্গিত দিয়েছিল আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী ব্লক যেটি জাপানে কুখ্যাত সামরিক-ফ্যাসিবাদকে পুনরুজ্জীবিত করছে এটিকে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি হিসাবে গড়ে তুলতে, এখন উত্তর কোরিয়া এবং পরবর্তীতে চীনের বিরুদ্ধে জাপানকে দাবার গুটি হিসাবে ব্যবহার করে জনগণের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সামরিক আক্রমণ চালাতে আগ্রহী। আবে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করার পিছনে তার উদ্দেশ্য লুকিয়ে রাখেনি; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বস্ত দালাল হিসেবে তিনি নির্বাচনে জয়লাভের পরই পিয়ংইয়ংয়ের বিরুদ্ধে গুলি চালাতে শুরু করেন। তিনি বলেছিলেন যে তার বিজয় জাপানি জনগণের দ্বারা তার উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে চালিত ভয়ঙ্কর এজেন্ডাকে সমর্থন করার জন্য ক্ষমতা প্রদান। জাপানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ দেশটিতে মার্কিন সামরিক আধিপত্য, আমেরিকান স্বার্থের কাছে জাপানি জনগণের অধীনতা এবং ওয়াল স্ট্রিট দ্বারা জাপানি শিল্পের দাসত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার। দক্ষিণ কোরিয়া-জাপান-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার দুষ্ট সম্পর্ক যাদের প্রতি সমর্থন রয়েছে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় নব্য উপনিবেশের, কোরীয় উপদ্বীপের সমস্যাকে নতুন উচ্চতায় উস্কে দেয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে যাতে সমর্থনের ভিত্তি তৈরি করা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং এশিয়ায় উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের পক্ষে, যারা দৃঢ়ভাবে মার্কিন গুন্ডামীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এবং তাদের সার্বভৌমত্ব ত্যাগ করতে ও কোরীয় উপদ্বীপের দক্ষিণ অংশের মতো আমেরিকান নব্য উপনিবেশে পরিণত হতে অস্বীকার করেছে। জাপানের শ্রমিক শ্রেণি আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে এবং জাপানের সার্বভৌমত্বের মূল্যে আমেরিকা ও তার মিত্রদের কাছে আবে সরকারের সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছে। প্রচুর অর্থ শক্তি ব্যবহার করে এবং মধ্যবিত্ত ও ধনী জাপানিদের মধ্যে ফ্যাসিবাদী নৈরাজ্যবাদী শিখা জ্বালিয়ে আবে তার কাজ আগের চেয়ে সহজ করে তোলে। শিনজো আবে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি এবং একচেটিয়া পুঁজির ধূর্ত এজেন্ট যারা জাপানের অর্থনীতির প্রধান অংশের মালিক এবং নিয়ন্ত্রণকারী। প্রতিটি জাপানি ফার্ম কোনো না কোনোভাবে আন্তর্জাতিক পুঁজির সঙ্গে যুক্ত এবং জাপানি পুঁজির মালিক ও আন্তর্জাতিক একচেটিয়া আর্থিক পুঁজির স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে শ্রমিক শ্রেণী সবচেয়ে অপমানজনক অবস্থার সম্মুখীন হয়। শিজো আবে একই ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করেছে যা ফ্যাসিবাদী তোজো তার শাসনামলে ফ্যাসিবাদী যুদ্ধের নেতা হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় করেছিল। আবে'র কাল্ট রাজকীয়-ফ্যাসিস্ট-সমরবাদীদের দ্বারা নির্মিত যারা অন্য দেশে অভিযানের জন্য সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে জাপানের স্থগিতাদেশের অবসানের দাবি করেছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র শক্তির কাছে অপমানজনক পরাজয়ের পরে টোকিওকে মানতে বাধ্য করা হয়। আবেকে এমন একজন মানুষ হিসেবে দেখা হতো যে তোজোর মতো আধুনিক যুগের সবচেয়ে বড় ফ্যাসিবাদী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের  দালাল যে কিনা পুরানো শত্রু চীনকে মোকাবেলা করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী জাপানের ভাগ্যকে পুনরুজ্জীবিত করবে, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মাও সে তুং এর নেতৃত্বে বিশ্ব আধিপত্যের জাপানি পরিকল্পনাকে খর্ব করেছিল। এই উদ্দেশ্যে আবে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং দক্ষিণ এশিয়ার সমস্ত চীন-বিরোধী শক্তির কাছে গিয়েছিল। ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইনের মতো দেশগুলোর সরকারকে চীন বিরোধী যুদ্ধে সঙ্গে নেয়া থেকে শুরু করে উচ্চ সুদের হারে ভারতের উচ্চাভিলাষী বুলেট ট্রেন প্রকল্পে অর্থায়ন, জাপানের এই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল সহযোগী হিসেবে কাজ করতে কোনো কসরত ছাড়েনি। পুরষ্কার হাতে হাতেই পেয়েছিল জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে জাপানকে তার সেনাবাহিনী তৈরি করতে এবং আন্তর্জাতিক অপারেশনের জন্য ব্যবহার করার অনুমতি না দেয়ার বিষয়ে তার কঠোর নিয়ম শিথিল করেছিল। উল্টো মার্কিন সামরিক মহড়া জাপানের সাথে যৌথভাবে হয়েছে; যেগুলো কোনোভাবেই রক্ষণাত্মক নয়, প্রকাশ্যে আক্রমনাত্মক প্রকৃতির এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম উত্তর কোরিয়ার অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। যুদ্ধাপরাধের প্রতি নগ্ন সমর্থন এবং ফ্যাসিবাদী জাপানের যুদ্ধাপরাধীদের প্রশংসা করার ক্ষেত্রে শিনজো আবের মনোভাবের জন্য জাপান এবং অন্যান্য জায়গার প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক এবং শান্তিপ্রিয় জনগণ তার তীব্র সমালোচনা করেছে। কিন্তু এই ধরনের আচরণের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত দালালকেই দেখতে পেয়েছিল যে সামরিকভাবে চীনকে বিচ্ছিন্ন করা এবং ঘেরাও করার মতলবে ছিল, যেহেতু জাপানি সামরিক-ফ্যাসিবাদের পুনরুজ্জীবন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একে উত্তর কোরিয়া এবং চীনের বিরুদ্ধে ফ্রন্টে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য প্রক্সি হিসাবে ব্যবহার করবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন পাকা ব্যবসায়ী এবং তিনি সতর্কতার সাথে শিনজো আবের উপর বাজী রেখেছিলেন, ইউরোপীয়রাও তাই করেছিল।
...............................................................

বাংলাদেশের অনেক বাম বাফুফে'র দুর্নীতি নিয়ে পোস্টের পর পোস্ট দেয় প্রতিনিয়ত। অথচ এরাই প্রতি বিশ্বকাপে মিনিটে মিনিটে খেলার আপডেট পোস্ট করে আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে এবং নানা কুযুক্তির মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের সাথে বিশ্বকাপের লেজ জুড়ে দেয়ার চেষ্টা করে (এশিয়ার দেশ জিতলে সেখানে পশ্চিমাদের সাথে এশিয়ার ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিকতা ঢুকানোর চেষ্টা, আফ্রিকার কোনো দেশ জিতলে সাম্রাজ্যবাদীদের উপর বিজয় প্রমাণের চেষ্টা ইত্যাদি বহু হাস্যকর লজিক্যাল ফ্যালাসি)। আপনাদের জন্য কাতার বিশ্বকাপ সম্পর্কিত কিছু ফ্ল্যাশব্যাক-

২০১৫ সালের মে মাসের শেষের দিকে এফবিআই পরিচালিত তদন্তে প্রতারণা, কারসাজি এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে ফিফার ১৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এরপর কাতারে ৮টি নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণের সময় ৬৫০০ জনেরও বেশি শ্রমিক নিহত হয়। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান থেকে নিয়ে যাওয়া শ্রমিকদের মৃতদেহের ওপর গড়া স্টেডিয়ামে চলে উন্মত্ত নাচ-গান। প্রখর রোদ ও তাপমাত্রায় পোড়া মানুষগুলোর শ্রমের উপর ভর করে আয়োজিত হয় ঐ বিশ্বকাপ। গ্রীষ্মে কাতারে দিনের তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। শ্রমিকরা ‘কাফালা’ নামক ক্রীতদাস সদৃশ নিয়োগ ব্যবস্থার অধীন ছিল এবং বিদেশি পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে তাদের নিয়োগের কারণে তারা সে দেশে অন্য কোনো কাজে নিযুক্ত হতে পারেনি।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Kafala_system

বিশ্বকাপের আয়োজনের পর কাতারের নারীদের অবস্থা প্রকাশ্যে আসে। প্রকাশ্যে আসে তাদের ওপর ভয়ানক নিপীড়ন এবং পুরুষ কর্তাদের প্রতি বশ্যতার চিত্র। যেহেতু কাতার তথাকথিত ‘অভিভাবকত্ব ব্যবস্থা’ মেনে চলে, সেজন্য নারীরা সব কিছুতে পুরুষদের আদেশ মেনে চলতে বাধ্য থাকে দেশটিতে। এই প্রথা অনুসারে প্রত্যেক মহিলার বিয়ে, বিদেশে পড়াশোনা, সরকারি চাকরি, অন্যান্য দেশে ভ্রমণের জন্য ‘পুরুষ অভিভাবকের’ অনুমতির প্রয়োজন হয়। নারীদের নিপীড়ন বিশেষত শ্রমজীবী ​​নারীদের দ্বিগুণ শোষণ যেকোনো রাষ্ট্রের শোষণের বৈশিষ্ট্য এবং এটা পুরো পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বস্তুগত ভিত্তির অংশ; যেখানে নারীদের সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়, যেখানে তারা পুরুষদের তুলনায় মজুরিতে বৈষম্যের শিকার হয়, যেখানে তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। বিশ্বকাপ ফুটবল মুষ্টিমেয় ক্ষমতাশালী কিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত। শুধু কাতার বিশ্বকাপ নয়, সমস্ত বিশ্বকাপের পর্দার আড়ালে ব্যাপক আর্থিক ও ক্ষমতার কেলেঙ্কারি রয়েছে। ফিফার আড়ালে চলমান বিশাল অর্থ ব্যবসার কারসাজি প্রকাশ্যে এসেছে কাতার বিশ্বকাপে। বুর্জোয়াদের জন্য, ক্ষমতালোভী সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য, ক্রীড়া ব্যবসায়ীদের জন্য খেলাধুলা বর্তমানে অর্থ উৎপাদনের কল ছাড়া আর কিছু না।

জনগণ খেলাধুলা, শিল্প, সঙ্গীত নিয়ে মেতে ওঠে, কারণ এগুলো তারা ভালবাসে এবং এগুলো জীবনেরই অংশ। সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবলকে নিয়ে মানুষ মেতে উঠবে এটাও অসঙ্গত নয়। সাম্রাজ্যবাদী ও বুর্জোয়ারা এটা জানে বলেই আর সবকিছুর মতো খেলাধুলাকেও তারা শ্রেণীর উর্ধ্বে বলে প্রচার করে তাদের নিজস্ব ধারায় জনগণকে চালিত করার চেষ্টা চালায় যাতে সেটা বুর্জোয়া ব্যবস্থার পক্ষেই কাজ করে। ক্রীড়া শৈলী, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, সুর, ছন্দ - এসবের নিজস্ব শ্রেণীচরিত্র নেই; যেমন সাহিত্য, শিল্প, রাজনীতি, অর্থনীতি- এসবের শ্রেণীচরিত্র রয়েছে। কিন্তু প্রথমোক্তগুলো কোনক্রমেই শ্রেণীর উর্ধ্বে নয় কারণ ওগুলো প্রতিটি শ্রেণীই ব্যবহার করে তার মতো করে, নিজস্ব শ্রেণী আধারে। তাই শ্রেণী উর্ধ্ব বস্তুগত সত্য বা সকল মানুষের বস্তুগত প্রয়োজনগুলোও শ্রেণীচরিত্র ধারণ করে এই শ্রেণী বিভক্ত বিশ্ব ব্যবস্থায়, আমাদের এই সমাজে। আমাদের দেশেও বিশ্বকাপ উন্মাদনার পাশাপাশি কেউ কেউ বিশ্বকাপ নিয়ে রাজনীতির নিন্দা করেছেন ও করছেন, কেউ কেউ বিশ্বকাপের বিশাল খরচেরও সমালোচনা করেছেন। কিন্তু এগুলো একতরফা ও ভাসাভাসা সমালোচনা। খেলাধুলা, আমোদ-প্রমোদের জন্য সর্বহারা শ্রেণী অর্থ ব্যয় করবে, বরং বুর্জোয়াদের চেয়ে অনেক ব্যাপক পরিসরেই তা করবে। সুতরাং জনগণের শ্রমঘণ্টার অপচয় অথবা অর্থ ব্যয়- শুধু এভাবেই বিষয়টাকে সমালোচনা করলে চলবে না। দেখতে হবে এই খরচটা হচ্ছে কীসের জন্য এবং কোন শ্রেণী ও কোন দিকগুলো এতে লাভবান ও শক্তিশালী হচ্ছে? চরম দারিদ্র পীড়িত ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এ বিশ্বে বিশ্বকাপ নিয়ে এই এলাহী কারবার, সেই সূত্রে আমাদের দেশেও লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ, জনগণের অর্থের এই অপচয়- যখন এ দেশে ৮০% কৃষক-শ্রমিক নিয়মিত দু’মুঠো ভাত পান না, তাকে আমাদের অবশ্যই কঠোর সমালোচনা করতে হবে। এদেশে বিশ্বকাপ নিয়ে উন্মাদনায় ভুগছে কারা? এদেশের ৯০% শ্রমিক বা কৃষক সাধারণভাবে এ উন্মাদনায় ভোগার মত মানসিক, শারীরিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক ও পরিবেশগত পরিস্থিতিতে নেই। একজন গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে দুইবারের বেশি তিনবার প্রস্রাব করতে গেলে কর্তৃপক্ষের ধমক খায়, একজন রিক্সা শ্রমিক বা কৃষক সারাদিন অমানুষিক শ্রম করার পর অপর্যাপ্ত খাবার খেয়ে রাতে মরার মত ঘুমায়- সেখানে বিশ্বকাপের এই প্রদর্শনী কাদের জন্য? এই অর্থ যে খরচ হচ্ছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের জন্যই এটা স্পষ্ট। কেন তবে একজন শ্রমিক বা একজন কৃষক এই আনন্দোৎসবকে সহজভাবে মেনে নেবে? শাসক শ্রেণী নিছক তাদের সুবিধা ও প্রত্যক্ষ আনন্দের জন্যই এসবের মহা আয়োজন করেছে তা নয়। তারা এই উন্মাদনা সৃষ্টি করে রাজনৈতিক উদ্দেশে, তাদের প্রভুরা অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদীরাও বিশ্বকাপের আসর বসায় তাদের শ্রেণীর প্রত্যক্ষ আনন্দ ছাড়াও সচেতন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই। এর মূল দিকটা হচ্ছে ব্যাপক শোষিত, নিপীড়িত জনগণকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চেতনা থেকে সরিয়ে অন্য কিছুতে ভুলিয়ে রাখা। জনগণ বিশ্বকাপ নিয়ে মেতে থাকুক, এজন্য যত টাকা ঢালা দরকার সরকার ঢালবে আর এই ফাঁকে তারা তাদের বাজেট ও এ জাতীয় সব অপকর্ম বিনা বাধায় পার করে নেবে - এটাই তাদের উদ্দেশ্য এবং সাম্রাজ্যবাদীদেরও উদ্দেশ্য এটাই। এই চক্রান্তটা সারা বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদীরা ও তাদের দালালরা আজ চালাচ্ছে - আজ খেলা, কাল সিনেমা, পরশু যৌন আবেদন, তারপর ক্রাইম - ইত্যাদি সব বিষয়ে জনগণকে মাতিয়ে রাখতে পারলেই তাদের লাভ। তাহলে নির্বিঘ্নে তাদের শোষণ কর্মটা চালিয়ে যাওয়া যাবে। অর্থনীতি-রাজনীতির মতো খেলাধুলা-শিল্প-জনসেবা ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেও বুর্জোয়া লাইন কাজ করে। ব্যাপক মানুষ এসব ক্ষেত্রে বুর্জোয়া মূল্যবোধই ধারণ করে থাকে এবং হালকা আবেগ ও তাড়নায় তারা ভেসে যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত বিপ্লবী রাজনীতিক সচেতনতা তাদের সঠিক পথটা না দেখায়। তাই বিশ্বজুড়ে বুর্জোয়ারা আজ এগুলোই জনগণের সামনে তুলে ধরছে। এসব ক্ষেত্রে কিছু ব্যক্তিকে স্টার বানিয়ে মানুষকে ঐসব স্টারের ভক্ত বানানো এবং মানুষের মাঝে ঐ জাতীয় স্টার হওয়ার আকাংখা গড়ে তোলাটাই বুর্জোয়াদের কাজ। বুর্জোয়ারা এটা করে একারণেই যে তাদের রাজনীতি, তাদের সামাজিক আদর্শ, তাদের নেতৃত্বরা আজ ঘৃণীত, উন্মোচিত ও পরিত্যক্ত কিংবা মানুষের আগ্রহ টানতে তারা যে অসমর্থ এটা তারা জানে। তাই এদেশেও মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের ঘরে ঘরে বুর্জোয়া কোন রাজনীতিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক কিংবা জ্ঞানী ব্যক্তির ছবি নয়; বেশি স্থান পায় বরং মাইকেল জ্যাকসন, ম্যারাডোনা জাতীয় বুর্জোয়া সমাজের শো-বয়দের ছবি। বুর্জোয়া বিশ্ব ব্যবস্থা মানুষকে এখানেই টেনে নামিয়েছে এবং বুর্জোয়ারা চায় মানুষ যেন রাজনীতি ও সমাজ প্রগতির মানদণ্ডে এগুলোকে বিচার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে স্টারমোহ, যৌনচর্চা, অর্থলোভ আর ব্যক্তি বীরত্ববাদের ফাঁদে আটকা পড়ে। বিশ্বকাপের ফলে ক্রীড়ার মান বেড়েছে, বিশ্বের অনেক মানুষ শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াশৈলী দেখার সুযোগ পেয়েছে - এই ইতিবাচক দিকগুলো সত্ত্বেও বিশ্বকাপের আসর বিশ্ব জনগণের রাজনৈতিক চেতনাকে ভোঁতা করে দেয়ার, তাদের বুর্জোয়া মূল্যবোধ ও আবেগে কলুষিত করার চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু না। পশ্চিমা বিশ্বে এর কুপ্রভাব ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে, যা আগামীতে আরো ব্যাপক ক্ষতিকর মূর্তি নিয়ে আবির্ভূত হবে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশে বুর্জোয়া শ্রেণী কর্তৃক শ্রমিক ও জনগণকে বিপ্লবী চেতনা থেকে দূরে রাখার প্রধানতম অস্ত্র হচ্ছে তাদের বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে শ্রমিক মুক্তির জন্য প্রথম কাজটিই হচ্ছে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদকে স্পষ্টভাবে বর্জন করা এবং 'শ্রমিক শ্রেণীর কোনো দেশ বা জাতি নেই' - এই আন্তর্জাতিকতাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়া। অথচ বিশ্বকাপ ঠিক এর বিপরীত মতাদর্শটাই শক্তিশালী করেছে। বুর্জোয়া প্রচারযন্ত্রের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসা কিছু খবরে বোঝা যায় কি বর্বর জাতীয়তাবাদী গুণ্ডামিতে ঐসব দেশের যুব সমাজকে মাতিয়েছে বিশ্বকাপ। বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের বিষ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর জনগণকে 'উন্নত মানব' এবং তৃতীয় বিশ্বের জনগণকে ও কালো মানুষদের 'নিকৃষ্ট জীব' হিসেবে দেখতে শিখিয়েছে এবং অব্যাহতভাবে তা শিখাচ্ছে। এক সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার শ্বেতাঙ্গ সাংবাদিক কালো আফ্রিকার ক্যামেরুনের সাফল্যে ঈর্ষা ও হিংসায় সাধারণ শালীনতাকে ভঙ্গ করে কালো খেলোয়াড়কে 'জংলী' বানানোর চেষ্টায় প্রশ্ন করার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিল - “আপনারা কি সিংহ খান?” এক ইতালিয়ান তরুণী আর্জেন্টিনার কাছে হেরে যাওয়ার পর ম্যারাডোনার উদ্দেশ্যে বলেছিল “আমাদের খেয়ে পরে আমাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা।”


.....................................................

বাম সরকার আর সমাজতান্ত্রিক সরকার যেমন এক না, ঠিক একইভাবে আংশিক অর্থনৈতিক সংস্কার আর সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক সংস্কার এক না। নির্বাচনের মাধ্যমে অর্জিত পিঙ্ক টাইড এর ফলে আসা ল্যাটিন আমেরিকার সরকারগুলো (যাদের অনেকে আবার আত্মসমর্পণকারী, বেঈমান প্রাক্তন নক্সালদের মতো) বাম সরকার হলেও সমাজতান্ত্রিক সরকার না।



Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]