সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সাচ্চা বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার সংগ্রামই এখানকার প্রধান কাজ (৬ নং দলিল)



পার্টির নেতারা দীর্ঘদিন জেল খাটার পর পার্টি কংগ্রেসের পর প্রথম পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক করলেন। শোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যে পার্টি গঠিত হলো, সেই পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ভাবাদর্শগত প্রস্তাব গ্রহণ করে সোজাসুজি ঘোষণা করলেন, মহান চীনা পার্টি ভারত সরকার সম্বন্ধে যেসব সমালোচনা করেছে সবগুলিই ভুল। সাথে সাথেই তারা প্রস্তাবে বলেছেন, সোভিয়েত শোধনবাদী নেতৃত্বের এখন সমালোচনা চলবে না, যাতে সমাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যায়। অর্থাৎ সোভিয়েত শোধনবাদী নেতৃত্ব মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহযোগীতায় বিশ্বে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তার মুখোশ খুলে ধরা চলবে না। মহান চীন বিপ্লবের নেতা, কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার নেতা কমরেড মাও সে তুঙ আজ বিশ্বের শ্রমিক এবং বিপ্লবী সংগ্রামের নেতৃত্ব করছেন। লেনিনের পর কমরেড মাও সে তুঙ আজ লেনিনের স্থান অধিকার করেছেন। সুতরাং চীনা পার্টি এবং কমরেড মাও সে তুঙ এর বিরোধিতা করে শোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা যায় না। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা যায় না। চীনের পার্টির বিরোধিতা করে ভারতে পার্টি নেতৃত্ব মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিপ্লবী পথ পরিত্যাগ করেছেন, শোধনবাদকে নতুন বোতলে ঢেলে চালাবার চেষ্টা করছেন। সুতরাং পার্টি সদস্যদের আজ একথা স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে শোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এই পার্টি নেতৃত্ব আমাদের সহকর্মী তো ননই, আমাদের সহযোগীও নন। সোভিয়েত শোধনবাদী নেতৃত্ব আজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহযোগীতায় বিশ্ব প্রভুত্বের চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা আজ প্রত্যেকটি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতি শত্রুতা করছে। বিপ্লবী পার্টিগুলিকে ভেঙ্গে শোধনবাদী নেতৃত্ব কায়েম করার চেষ্টা করছে এবং নির্লজ্জভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালালী করছে। তারা আজ প্রত্যেকটি দেশের গণমুক্তি সংগ্রামের শত্রু, বিপ্লবী সংগ্রামের শত্রু, বিপ্লবী চীনের শত্রু, এমনকি সোভিয়েত জনগণেরও শত্রু। সুতরাং এই সোভিয়েত শোধনবাদী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সংগ্রাম না চালিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা যায় না। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে সোভিয়েত সংশোধনবাদী নেতৃত্ব অংশীদার নয়, একথা না বুঝলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম পরিচালনা করা অসম্ভব। পার্টি নেতৃত্ব তো এ পথে যাচ্ছেনই না বরং বিভিন্ন লেখার মারফতে জনসাধারণকে বোঝাবার চেষ্টা করছেন, কিছু কিছু ভুল করলেও মূলত সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ ভারত সরকারের নীতির বিরোধীতা করছেন এবং সমাজতন্ত্রের পথেই আছেন অর্থাৎ সোভিয়েত নেতৃত্ব যে ধীরে ধীরে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে একটি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করছে এবং তারই জন্য যে সোভিয়েত-মার্কিন সহযোগীতা এই কথা সুচতুরভাবে গোপন করার চেষ্টা করছেন। তাই গত দুই বৎসরের ভারতের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হস্তক্ষেপের কথা বলা হয়নি। যদিও জনসন থেকে শুরু করে হামফ্রে পর্যন্ত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী সরকারের প্রতিনিধিরা বার বার ঘোষণা করেছে, চীনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষকে তারা ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করবে। এত বড় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন কেন্দ্রীয় কমিটির নজরেই পড়লো না। তাই রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রস্তাবে সাম্রাজ্যবাদীর প্রতি আক্রমণের বিরুদ্ধে পার্টি সদস্যদের প্রতি কোনো হুঁশিয়ারী নেই, বরং সমস্ত প্রস্তাবটা পড়লে মনে হয় যে অবস্থার বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়নি, কোনো কোনো অংশে কড়াকড়ি বেড়েছে; সাধারণ আন্দোলন মারফতই তার মোকাবিলা করা যায়। পার্টি নেতৃত্ব গত দুই বছরের সংগ্রামে যে নতুন বৈশিষ্ট অর্থাৎ প্রতিবিপ্লবী হিংসার বিরুদ্ধে বিপ্লবী হিংসার প্রকাশ, গণআন্দোলনের এই বিকাশোম্মুখ দিক সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নীরব। গণ আন্দোলনের প্রশ্নগুলিকে এমনভাবে তারা পেশ করলেন যা থেকে সহজ সিদ্ধান্ত বেরিয়ে এলো যে আগামী নির্বাচনে আমাদের অ-কংগ্রেসী গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠাই মূল লক্ষ্য হবে। তাদের প্রস্তাবে এক জায়গাতেও এ কথা বলা হলো না যে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ এবং পরোক্ষ শাসনকে গোপন করার জন্যই এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই নির্বাচনের মারফতে ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল সরকার নিয়মতান্ত্রিকতার মোহ বিস্তার করতে চায় আর তারই আড়ালে সাম্রাজ্যবাদের নির্দেশে আমাদের দেশকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রতিবিপ্লবী ঘাঁটি হিসাবে গড়ে তুলতে চায় এবং জনসাধারণের বিপ্লবী অংশের উপর হিংস্র আক্রমণ করে জনগণের প্রতিরোধকে স্তব্ধ করে দিতে চায়। ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে যে এই মরণোম্মুখ সাম্রাজ্যবাদ আজ কত হিংস্র হতে পারে। পার্টি নেতৃত্বের দায়িত্ব ছিল এই অবস্থার মোকাবিলার জন্যই পার্টি সদস্যদের প্রস্তুত করা এবং বিপ্লবী হিংসাই (Revolutionary violence) যে একমাত্র পথ তা স্পষ্ট তুলে ধরা এবং সমগ্র পার্টিকে সেই ভিত্তিতে সংগঠিত করা। ভারতের পার্টি নেতৃত্ব এ কাজ শুধু করেননি তাই নয়, বিপ্লবী প্রতিরোধের কথা বলাও পার্টির মধ্যে বেআইনী করে দিয়েছেন। পার্টি নেতৃত্ব বিপ্লবী প্রতিরোধ বা সশস্ত্র সংগ্রামের কথা শুনলেই হঠকারিতা বলে চিৎকার করে উঠেছেন কিন্তু সাথে সাথেই তারা মজুত, উদ্ধার, ঘেরাও লাগাতার, ধর্মঘট প্রভৃতি কথাকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করছেন। কিন্তু এইসব সংগ্রাম কৌশল যে অনিবার্যভাবে দমননীতি ডেকে আনবে সেই দমননীতি প্রতিরোধ করার কোনো কথা বললেই তাকে হঠকারিতা বলে অভিহিত করছেন। প্রদেশব্যাপী লাগাতার ধর্মঘট, মধ্যবিত্ত সুলভ উগ্রবামপন্থী আওয়াজ ছাড়া অন্য কিছু নয়। একদিকে এই উগ্রবামপন্থী আওয়াজ অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রশ্নে নির্বাচনের ক্ষেত্রে ঐক্য করার আকুল আকাংখা, যার অর্থ হচ্ছে বুর্জোয়াশ্রেণীর লেজুড় হয়ে চলা। সুতরাং এই পার্টির নেতৃত্ব ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করছেন এবং তারই ফলে তারা আধুনিক শোধনবাদের সুচতুর কৌশল অর্থাৎ মুখে বিপ্লব এবং কাজে বুর্জোয়ার লেজুড়বৃত্তির পথ নিচ্ছেন। তাই বর্তমান পার্টি ব্যবস্থা ও তার গঠনতান্ত্রিক কাঠামোর ধ্বংস সাধনের মধ্য দিয়েই একমাত্র বিপ্লবী পার্টি গড়ে উঠতে পারে। কাজেই এই পার্টির তথাকথিত ফর্ম বা গঠনতান্ত্রিক কাঠামো মেনে চলার অর্থ মার্কসবাদী-লেনিনবাদীদের নিষ্ক্রিয় করে ফেলা এবং শোধনবাদী নেতৃত্বের সাথে সহযোগিতা করা। সুতরাং পার্টি নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সাধারণ সদস্য পর্যন্ত যারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদে বিশ্বাসী তাদের আজ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিপ্লবী বক্তব্য নিয়ে পার্টি সদস্যদের সামনে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই বিপ্লবী পার্টি গড়ার কাজে আমরা হাত দিতে পারবো। ভারতব্যাপী গণ বিস্ফোরণের সামনে ভারত সরকার পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছেন। তার ফলে নির্বাচন পূর্ব যুগে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সুযোগ বেড়েছে। এই যুগে সরকার প্রতিবিপ্লবী শক্তিকে সংগঠিত করছে, বিপ্লবী শক্তিকেও এই আপাত গণতান্ত্রিক আবহাওয়ার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। সাম্প্রতিক গণ আন্দোলনে জনতা যে রণকৌশল গ্রহণ করেছিল, তা প্রাথমিক স্তরের পার্টিজান সংগ্রাম ছাড়া আর কিছু নয়। কাজেই বিপ্লবী শক্তিকে সংগঠিতভাবে সেই পার্টিজান সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে এবং ব্যাপক প্রতিবিপ্লবী আক্রমণের আগেই এই সংগ্রাম কৌশলে পার্টি সদস্যদের তত্ত্ব ও বাস্তব প্রয়োগের মারফতে সুশিক্ষিত করে তুলতে হবে। বর্তমানে পার্টির অ্যাকটিভ গ্রুপের অর্থ হচ্ছে কমব্যাট ইউনিট [সংগ্রামকারী গ্রুপ], তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে রাজনৈতিক প্রচার আন্দোলন এবং প্রতিবিপ্লবী শক্তির বিরুদ্ধে আঘাত হানা। আঘাত হানার জন্যই আঘাত হানা নয়, খতম করার জন্যই আঘাত হানা- মাও সে তুঙের এই শিক্ষা সব সময়ে মনে রাখতে হবে। আঘাত যাদের হানতে হবে তারা প্রধানত হবে-

১। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিভূ অর্থাৎ পুলিশ বা মিলিটারী অফিসার,

২। ঘৃণিত আমলাতন্ত্র,

৩। শ্রেণী শত্রু। অস্ত্র সংগ্রহও এই আক্রমণের লক্ষ্য হবে। বর্তমান যুগে এই আক্রমণ শহর এবং গ্রামাঞ্চল সর্বক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা যায়। আমাদের বিশেষ লক্ষ্য থাকা উচিৎ কৃষক অঞ্চলে। নির্বাচন পরবর্তী যুগে যখন প্রতিবিপ্লবী আক্রমণ ব্যাপক আকার ধারণ করবে, তখন কৃষক অঞ্চলের উপরেই আমাদের প্রধান ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কাজেই এই যুগে আমাদের সংগঠনের সামনে এই কথা স্পষ্ট করে তুলে ধরতে হবে। শ্রমিক এবং বিপ্লবী মধ্যবিত্ত ক্যাডারকে গ্রামাঞ্চলে যেতেই হবে। সুতরাং শ্রমিক এবং মধ্যবিত্ত ক্যাডারের দায়িত্ববোধ জাগার সাথে সাথে তাকে গ্রামাঞ্চলে পাঠাতে হবে। গ্রাম থেকে শহরকে ঘিরে ফেলার মহান চীনের সংগ্রামী কৌশল, প্রতিবিপ্লবী আক্রমণের যুগে আমাদেরও প্রধান কৌশল হবে। প্রতিবিপ্লবী আক্রমণকে আমরা কত তাড়াতাড়ি নিস্তব্ধ করতে পারবো তা নির্ভর করবে কত দ্রুত আমরা জনগণের সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে পারবো। প্রথমদিকে আমরা কিছু কিছু জয়লাভ করতে পারবো সত্য, কিন্তু ব্যাপক প্রতিবিপ্লবী আক্রমণের সামনে নিছক আত্মরক্ষার তাগিদেই আমাদের প্রতি আক্রমণ করতে হবে। এই দীর্ঘস্থায়ী, কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জনতার বিপ্লবী সৈন্যবাহিনী গড়ে উঠবে-যে সৈন্যবাহিনী রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ, রাজনৈতিক প্রচার আন্দোলন এবং সংঘর্ষের মারফতে দৃঢ়। এই রকম সৈন্যবাহিনী ছাড়া বিপ্লব সফল হওয়া সম্ভবপর নয়, জনসাধারণের স্বার্থরক্ষা সম্ভব নয়।

কমরেডস, স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের পিছনে না ছুটে আজ সংগঠিতভাবে পার্টিজান সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। সময় ছয় মাসও নেই, এর ভিতরেই আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে না পারলে সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের মুখে আমাদের সংগঠিত হওয়ার দুরূহ কাজের সম্মুখীন হতে হবে।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির
'মাওপন্থী কেন্দ্র' (৩০শে আগস্ট ’৬৬)

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]