সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সশস্ত্র পার্টিজান সংগ্রাম গড়ে তুলুন (৭ নং দলিল)



গত দুই বৎসর ধরে মধ্যবিত্তশ্রেণী যুব ছাত্রদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। শুরুতে যদিও খাদ্যের দাবীই প্রধান ছিল কিন্তু ক্রমশই কংগ্রেস সরকারের উচ্ছেদের দাবীই প্রধান হয়ে উঠেছে। চেয়ারম্যান মাও বলেছেন “মধ্যবিত্ত ছাত্র এবং যুবকেরা জনতারই অংশ এবং তাদের সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতিতে শ্রমিক এবং কৃষকের সংগ্রাম উত্তাল হয়ে উঠবে।” তাই ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়ের সংগ্রাম শেষ হতে না হতেই বিহারে কৃষকের সংগ্রাম শুরু হয়েছে। শয়ে শয়ে কৃষক ক্ষেতের ফসল কেটে নিয়ে যাচ্ছে, জমির মালিকদের সঞ্চিত ফসল দখল করে নিচ্ছে। এই সংগ্রাম দিনের পর দিন বাড়ছে বই কমছে না। এই সংগ্রাম আগামী দিনে পশ্চিম বাংলার এবং অন্যান্য প্রদেশে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য। সরকার বিক্ষুদ্ধ কৃষককে দমন করার জন্য হিংস্র দমননীতির আশ্রয় নিচ্ছেন। চেয়ারম্যান মাও বলেছেন "অত্যাচার হলে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হতে বাধ্য"। তাই আমরা স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ দেখেছি ছাত্র এবং যুব আন্দোলনের মধ্যে। প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে বিহারের কৃষকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সরকারী মুখপাত্ররা বার বার ঘোষণা করছে যে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষায় তারা আরও দমননীতির আশ্রয় গ্রহণ করবে। সুতরাং বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণী ও পার্টির সামনে আজ সচেতনভাবে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার দায়িত্ব এসেছে। এই যুগ সক্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলনের যুগ। সক্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলন বিপ্লবী জনতার বিপ্লবী প্রতিভার মুখ খুলে দেবে। সারা ভারতে বিপ্লবের জোয়ার ছড়িয়ে দেবে। কাজেই এই যুগে বিপ্লবী কর্মীদের আইনানুগ ট্রেড ইউনিয়ন বা কৃষক সভার আন্দোলন আজকের বিপ্লবী জোয়ারের যুগের প্রধান সহায়ক শক্তি হতে পারে না। এর থেকে এ রকম সিদ্ধান্ত টানা ঠিক হবে না যে ট্রেড ইউনিয়ন বা কৃষক সভা জনসাধারণের সাথে ঐক্য গড়ে তোলার সংগঠন। এই ঐক্য সুদৃঢ় হবে তখনই যখন মার্কসবাদী লেনিনবাদী কর্মীরা বিপ্লবী প্রতিরোধ আন্দোলনের কৌশল দিয়ে শ্রমিক এবং কৃষক জনসাধারণের মধ্যে বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার কাজে এগিয়ে যাবে।  ভারতবর্ষের প্রতিক্রিয়াশীল সরকার জনসাধারণকে হত্যা করার কৌশল গ্রহণ করেছে। তারা হত্যা করছে অনাহার দিয়ে, বন্দুকের গুলি দিয়ে। চেয়ারম্যান মাও বলেছেন "এটাই তাদের শ্রেণীচরিত্র, পরাজিত হওয়ার ঝুকি নিয়েও জনতার উপর আক্রমণ চালাবে"। এই নির্বিচারে হত্যার সামনে কিছু নেতা আছেন যারা ভয় পান, আড়াল খোঁজেন। তাদের সম্পর্কে চেয়ারমান মাও বলেছেন "তারা ভীরু এবং বিপ্লবী নেতৃত্বের অযোগ্য আর একদল আছেন যারা নির্ভয়ে মৃত্যুর মোকাবিলা করেন, প্রত্যেকটি হত্যার বদলা নেওয়ার চেষ্টা করেন। এরাই বিপ্লবী, এরাই জনতাকে পথ দেখাতে সক্ষম।" আপাতদৃষ্টিতে সরকারকে শক্তিশালী বলে মনে হয়, কারণ তার হাতে খাদ্য এবং তার হাতে অস্ত্র। জনতার হাতে খাদ্য নাই তারা নিরস্ত্র, কিন্তু এই নিরস্ত্র জনতার ঐক্য ও দৃঢ় মনোবলই প্রতিক্রিয়ার সমস্ত দম্ভকে চূর্ণ করে বিপ্লব জয়যুক্ত করে। তাই চেয়ারম্যান মাও বলেছেন "প্রতিক্রিয়াশীল চক্র আসলে কাগুজে বাঘ।" আজকের যুগে আমাদের কাজ প্রধান তিনটি আওয়াজের ভিত্তিতে হবে।

প্রথমত: শ্রমিক কৃষকের ঐক্য। এই ঐক্যের অর্থ এই নয় যে, শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত জনসাধারণ কৃষক আন্দোলনকে কেবল নৈতিক সমর্থন জানাবেন। এই আওয়াজের অর্থ ভারতবর্ষের মত আধা উপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষক সমাজই বিপ্লবের প্রধান শক্তি, এই উপলব্ধিতে শ্রমিক-কৃষকের ঐক্য গড়ে উঠতে পারে একমাত্র শ্রেণী সংগ্রামের ভিত্তিতে। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রশ্নে তাই চেয়ারম্যান মাও বলেছেন গ্রামাঞ্চলের মুক্ত অঞ্চলই হচ্ছে এই শ্রমিক কৃষক ঐক্যের বাস্তব প্রয়োগ। তাই শ্রমিক এবং বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দায়িত্ব হচ্ছে এই মুক্ত অঞ্চল গড়ে তোলার কাজে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলা। তাই মধ্যবিত্ত ছাত্র এবং যুব আন্দোলন সম্পর্কে চেয়ারম্যান মাও বলেছেন তারা কতখানি এই আন্দোলনে সামিল হলো তার দ্বারা তারা বিপ্লবী কিনা সেটা নির্ধারিত হবে। যারা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে না তারা বিপ্লবী নয়। যারা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে না তাদের প্রতিবিপ্লবী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

দ্বিতীয়ত: বিপ্লবী প্রতিরোধ আন্দোলন। সশস্ত্র সংগ্রাম। ভারতবর্ষের প্রতিক্রিয়াশীল সরকার জনসাধারণের প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক দাবীর সংগ্রামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে। ভারতবর্ষ সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের শোষণের লীলাক্ষেত্র বসিয়েছে এবং বৈদেশিক নীতিতে সাম্রাজ্যবাদ ও আধুনিক শোধনবাদীদের সহযোগিতায় ভারতবর্ষ প্রতিক্রিয়াশীল ঘাঁটি করেছে। এই অসহনীয় অবস্থার বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের মানুষ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে ও শোধনবাদী পার্টির নিস্ক্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী মার্কসবাদীদের সশস্ত্র পার্টিজান সংগ্রাম আজ পার্টির প্রধান অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং প্রত্যেকটি পার্টি সভ্য এবং বিপ্লবী কর্মীকে এই রণকৌশল আয়ত্ব করতেই হবে, প্রয়োগ করতে শিখতেই হবে এবং জনসাধারণের মধ্যে প্রচার মারফৎ জনসাধারণের সংগ্রামী মনোবল দৃঢ় করে তুলতে হবে। সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনীতিকে জনসাধারণের মধ্যে প্রচারের মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনীতিকে জনসাধারণের মধ্যে প্রচারের মাধ্যমে কতখানি জনপ্রিয় করে তুলতে পারা যায় তারই উপর সংগ্রামের সাফল্য নির্ভর করছে।

তৃতীয়ত: বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলা। বর্তমান ভারতবর্ষের এই বিপ্লবী অবস্থায় নেতৃত্ব দেওয়ার পক্ষে আমাদের পার্টি সংগঠন উপযুক্ত নয়। তত্ত্বগতভাবে দৃঢ়, রাজনীতিতে স্পষ্ট এবং সংগঠনের ক্ষেত্রে গণভিত্তি ছাড়া আজকের এই বৈপ্লবিক যুগে নেতৃত্ব দেওয়া অসম্ভব।

১। তত্ত্বগত প্রশ্ন: মনে রাখতে হবে যে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের পার্টি নেতৃত্ব এক শোধনবাদী নেতৃত্বের হাতে এসে পড়েছে। ফলে আজ পৃথিবীর বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টিতে শোধনবাদী প্রভাব এসে পড়েছে। আমাদের দেশেও এই শোধনবাদী প্রভাব অনুভূত হওয়ার ফলেই আলাদা পার্টি গড়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়ে পড়েছিল এবং তারই ফলে সপ্তম কংগ্রেসে আলাদা পার্টি গড়ে ওঠে। আলাদা পার্টি গড়ে ওঠার অর্থ এই নয় যে শোধনবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শেষ হয়ে গেছে। শোধনবাদ-সাম্রাজ্যবাদ, সামন্ততন্ত্র এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা মুখে বলে কিন্তু কাজে এই শক্তিগুলির সহযোগিতার পথকেই প্রশস্ত করে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ দৃঢ়ভাবে এই শক্তিগুলোকে বিরোধিতা করে। এদের প্রত্যেকটি আক্রমণের বদলা নেয় এবং দীর্ঘস্থায়ী কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জনসাধারণকে জমায়েত করে এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলিকে ধ্বংস করে। পুরাতন ধ্যান ধারণাগুলি স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়:

(ক) আন্তর্জাতিক শোধনবাদীদের বিরুদ্ধে মহান চীনা পার্টির নেতৃত্বকে স্বীকার না করা। 

(খ) নতুন বিকাশমান শক্তিকে স্বীকার না করা। 

(গ) শ্রমিকশ্রেণীকে এই নতুন উপলব্ধিতে সচেতন না করা। 

(ঘ) শ্রমিক শ্রেণীর যে প্রধান মিত্র কৃষক তার সংগ্রামে সাহায্য না করা।

২। রাজনীতি: জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবকে এই মুহুর্তের কাজ হিসাবে দেখতে হবে। চেয়ারম্যান মাও বলেছেন “কোন মুমূর্ষ শ্রেণী সহজে ক্ষমতা ছেড়ে দেয় না এবং বন্দুকের নলের ভেতর থেকেই স্বাধীনতা আসে।” তাই আমাদের রাজনীতিতে প্রধান অংশ হবে ক্ষমতা দখলের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম। এই সশস্ত্র সংগ্রাম সাধারণ মানুষ স্বত:স্ফূর্তভাবে শুরু করেছে। আমাদের রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য হবে এই সংগ্রামকে সচেতনভাবে গণভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা। 

মূল তিনটি কথা হলো- 

(ক) শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষকের ঐক্য। 

(খ) সশস্ত্র সংগ্রামকে সচেতনভাবে গণভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা এবং 

(গ) কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। 

এই কাজের কোন একটিকে বাদ দিয়ে দেওয়া চলবে না। এই রাজনীতি জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে।

৩। সাংগঠনিক: সাংগঠনিকভাবে পার্টির গণভিত্তি বাড়াতে হবে। গত কয়েক বৎসর ধরে আমরা দেখেছি বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামের সময় হাজার হাজার জঙ্গী কর্মী সংগঠনের কাজে নেমে এসে সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আন্দোলন থেমে যাওয়ার সাথে সাথে তারা আবার নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। আজকে অভ্যূত্থানের যুগে বহু পিছিয়ে পড়া এলাকার মানুষ সংগ্রামের পথে এগিয়ে আসছে এবং সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বহু যুবক [জঙ্গী] কর্মী সংগঠনের কাজে নামছে। আমাদের বিপ্লবী তত্ত্ব ও রাজনীতি দিয়ে এই কর্মীদের শিক্ষিত করে তুললেই পার্টি তার গণভিত্তি পাবে। বলিষ্ঠভাবে আমাদের এইসব কর্মী সংগ্রহ এবং তাদের গোপন সংগঠন [গ্রুপ] গঠন করার কাজে নামতে হবে। এই কর্মী গ্রুপ রাজনৈতিক প্রচারের ব্যাপারে এবং সশস্ত্র সংগ্রামের ইউনিট হিসাবে কাজ করবে। এই গ্রুপ তৈরীর কাজ কত বেশী সংখ্যায় শ্রমিক এবং কৃষকের মধ্যে করতে পারছি তারই উপরে পার্টির আঘাত হানবার ক্ষমতা নির্ভর করছে। কাকে কাকে নিয়ে গ্রুপ করছি এই সাংগঠনিক খুঁটিনাটি অর্থাৎ শেল্টার, ডাম্প ইত্যাদি গোপন রাখতে হবে। কিন্তু আমাদের তত্ত্ব, রাজনীতি এবং পার্টি গঠনের আওয়াজ কোনক্রমেই গোপন রাখা চলবে না। সশস্ত্র সংগ্রামের যুগে প্রত্যেকটি পার্টি ইউনিটকেই সশস্ত্র সংগ্রামের অংশীদার এবং আত্মনির্ভরশীল নেতা হতে হবে।

সাধারণ নির্বাচন আসছে। নির্বাচনের সময় বিক্ষুব্ধ মানুষ রাজনীতি শুনতে চায় এবং শুনবে। নির্বাচনের আগে প্রত্যেকটি দল তার রাজনীতি জনসাধারণের মধ্যে প্রচারের চেষ্টা করবে। আমাদের এই নির্বাচনের সুযোগ নিয়ে রাজনীতি প্রচার করতে হবে। অ-কংগ্রেসী গণতান্ত্রিক সরকারের ভুয়া আওয়াজে যেন আমরা বিভ্রান্ত না হই। আমাদের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের রাজনীতি অর্থাৎ শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক ঐক্য, সশস্ত্র সংগ্রাম এবং পার্টি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার রাজনীতি জনসাধারণের মধ্যে বলিষ্ঠভাবে নিয়ে যেতে হবে। আমরা যদি এ সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করি তবে কোনো বামপন্থী নেতার পক্ষে আমাদের বিরোধিতা করা সম্ভব হবে না। এই সুযোগ আমাদের পুরোপুরি গ্রহণ করতে হবে।

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]