ভারতের স্বত:স্ফূর্ত বৈপ্লবিক উচ্ছ্বাসের উৎস কি? (৩ নং দলিল)
কমরেডস,
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগে পৃথিবীতে দুটো ঘটনা ঘটলো। একদিকে যেমন আতঙ্কিত ফ্যাসিষ্ট শক্তির পরাজয়ের নগ্ন রূপ মানুষের সামনে ফুটে উঠলো অন্যদিকে তেমনি কমরেড ষ্টালিনের নেতৃত্বে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষের মনে ভরসা জাগালো, ফলে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী এক স্বতঃস্ফূর্ত বৈপ্লবিক উচ্ছ্বাস দেখা দিলো। সর্বোপরি, যুদ্ধ ছাড়াই ১৯৪৯ সালে চীন বিপ্লবের সাফল্য এই স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসের মধ্যে এক নতুন বৈপ্লবিক জোয়ার নিয়ে আসলো যার সঠিক মূল্যায়ন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি কোনোদিন করতে পারেনি। তারই ফলে এই মহান বিপ্লব সমগ্র এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনলো তা কোনোদিন আমাদের চোখে পড়েনি। তারই ফলে ৬৫ কোটি মানুষের উদাত্ত আহ্বান “দেখো আমরা নিজেরাই নিজেদের সমাজতন্ত্রের পথে নিয়ে গিয়েছি, না-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদও আমাদের এই দুর্বার বিপ্লবী স্রোতের দারুণ গতিকে রুদ্ধ করতে পারেনি" এই বলিষ্ঠ বৈপ্লবিক আওয়াজের তাৎপর্য আমরা বুঝতে পারিনি। কিন্তু সংগ্রামী জনতা ভুল করেনি। সেই বিপ্লবী অগ্নিস্ফুলিঙ্গ গিয়ে পড়েছে ভিয়েতনামে, কিউবায়, সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকার প্রত্যেকটি দেশে। ভারতবর্ষের মানুষও সাড়া দিয়েছে সেই ডাকে, তারই রূপ দেখি ১৯৪৯ সালের স্বতঃস্ফূর্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে যাকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সংকীর্ণ পরিসরে ধরতে গিয়ে আমরা স্তিমিত করে দিলাম। শুধু তাই নয়, ঐ স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের উৎসস্থল মহান চীন বিপ্লব ও তার মহান নেতা কমরেড মাও সে তুঙের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সমালোচনা করে সমগ্র চীন বিপ্লবের তাৎপর্যকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করা হলো। সর্বোপরি, পরবর্তীকালে এই চীন বিপ্লবকে অস্বীকার করার ফলেই পার্টির ভেতরে আওয়াজ উঠলো "চীনের পথ নয়, সাচ্চা ভারতীয় পথেই বিপ্লব সাধিত হবে"। আর এখান থেকে জন্ম নিলো আজকের শোধনবাদ। সেদিনকার সেই বামপন্থী সংকীর্ণতাবাদের জন্যই সেই আন্দোলনকে আমরা ঠিক পথে পরিচালিত করতে পারিনি। কিন্তু না কমরেড, ১৯৪৯ সালের সেই বিপ্লবী আন্দোলনের জোয়ারকে নিঃশেষ করা যায়নি। কারণ চীনের বিপ্লবকে, পিকিং শহরের আশার লাল পতাকাকে কোন সাম্রাজ্যবাদই নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। সেই স্তিমিত আন্দোলনের আবার বিপুল জোয়ার দেখি ১৯৫১ সালে কোরিয়ার যুদ্ধে; তারই পূর্ণ বিকাশ দেখি স্বতঃস্ফূর্ত মিটিংয়ে, মিছিলে, ঐক্যবদ্ধ চীন ও কোরিয়ার পাল্টা আক্রমণকে অভিনন্দিত করার মধ্য দিয়ে। এরই বস্তুগত রূপ দেখি ১৯৫২ সালের নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির বিরাট জয়ের মধ্য দিয়ে। আর তারই সংগ্রামীরূপ দেখি ১৯৫৩-৫৪ সালে সংগ্রামী জনতার স্বতঃস্ফূর্ত ব্যারিকেড গড়ার মধ্য দিয়ে। আমরা বুঝতে পারিনি কিন্তু ধনিকশ্রেণী বুঝলো, চিনলো সংগ্রামী জনতার রূপকে, জানলো তার উৎসস্থলকে। সে বুঝলো আর এই মহান বিপ্লবকে উপেক্ষা করা যায় না। তাই সে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য মুখ ঘোরালো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দিকে, মুখ ঘোরালো মহান চীন বিপ্লবের দিকে। তাই সে অংশ নিলো পঞ্চশীলে, বান্দুং মহাসম্মেলনে। ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যবাদও বুঝলো পুরানো কায়দায় আর চলা সম্ভব নয়। তাই সে নতুন রূপ নিলো, ডলার উপঢৌকন দিলো, চালু করলো শোষণের নতুন কায়দা, শুরু হলো নয়া উপনিবেশবাদ। সাম্রাজ্যবাদ ও পৃথিবীর সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলেরা যখন নিজেদের বাঁচাবার জন্য পথ হাতড়াচ্ছে তখন ১৯৫৬ সালে বিশ্বাসঘাতক ক্রুশ্চেভের শোধনবাদী নীতি তাদের সামনে নতুন আশার আলো নিয়ে আসলো। পথ পেলো ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল সরকার ক্রুশ্চেভের Independent Capitalist [স্ব-নির্ভর ধনতান্ত্রিক] পথ সম্পর্কে মানুষের মনে মোহ সৃষ্টি করতে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল সরকার জানতো এ অবান্তর, অলীক; তাই ভারতের ধনিক শ্রেণীর প্রতিক্রিয়াশীল সরকার ১৯৫৮ সালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে গোপন চুক্তিতে লিপ্ত হলো। তাই ১৯৫৯ সালে কেরালায় শাসনতন্ত্র কেড়ে নিয়ে একদিকে সে যেমন গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ করলো, অন্যদিকে তেমনি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের উৎসস্থল মহান চীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করলো। স্থান দিলো তিব্বতের সাম্রাজ্যবাদী চর দালাই লামাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষ যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংগ্রামের পথে পা বাড়ালো তখন ধনিক শ্রেণী কালবিলম্ব না করে ৮০ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করলো। শেষ হলো শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের শেষ সম্ভাবনা। কিন্তু না, কমরেড তবু সরকারের শক্তির সামনে এসে মানুষ থমকে দাঁড়ালো না। ছড়িয়ে পড়লো ’৬০ সালের স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট সারা ভারতে ব্যাপক আকারে। কারণ এই শক্তির চাইতেও শত সহস্র গুণ শক্তির আধার চীন বিপ্লবের আলোকবর্তিকা তাদের পথ দেখিয়েছে। তাই কমরেড, কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ পা বাড়িয়েছে সংগ্রামের পথে। এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের সংগ্রামী অস্ত্রের কাছে মার খেয়ে যখন আরো কঠিন সংগ্রামের কথা ভাবছে তখন (’৬২ সালের) বিকল্প সরকারের আওয়াজ তাদের মনে বৈপ্লবিক উৎসাহ সৃষ্টি করতে পারেনি। কারণ তারা জবাব চেয়েছিল কেরালার ঘটনা বাংলায় ঘটলে কি হবে? আমরা এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারিনি। কেরালার ঘটনা বাংলায় ঘটলে সশস্ত্র সংগ্রামই হবে এই সরকার উচ্ছেদের একমাত্র পথ- এই সঠিক বলিষ্ঠ আওয়াজ আমরা সেদিন রাখতে পারিনি। কিন্তু ধনিক শ্রেণী সংগ্রামী জনতার চেহারা দেখতে ভুল করেনি, তাই ’৬২ সালে আতঙ্কগ্রস্ত ভারত সরকার সংগ্রামী জনতার সংগ্রামের উৎসস্থলকে আক্রমণ করলো। আক্রমণ করলো মহান চীনা গণতন্ত্রকে। কিন্তু দুটো ঘটনা ঘটে যাওয়ার ফলে ধনিক শ্রেণী নিজেই তার কবর খুঁড়লো।
প্রথমত: ধনিক শ্রেণীর সৈন্য বাহিনীর পরাজয়ের ফলে এই সরকারের দুর্বলতার নগ্নরূপ সংগ্রামী জনতার সামনে দিবালোকের মতো ফুটে উঠলো, সংগ্রামী জনতা পেলো সংগ্রামের নতুন আলো।
দ্বিতীয়ত: চীনের সৈন্যদের এককভাবে ভারতীয় এলাকা থেকে সরে যাওয়ার ফলে ধিকৃত জাতীয়তাবাদের দূষিত স্পর্শ কৃষককে স্পর্শ করতে পারলো না। ধনিক শ্রেণী আতঙ্কগ্রস্ত হলো, সে বন্দী করলো কমিউনিস্টদের।
কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামকে সে ঠেকাতে পারলো না বন্ধ হলো বোম্বাই, শুরু হলো দমদম দাওয়াই। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির থেকে উদ্ধার পাবার জন্য ধনিক শ্রেণী কমিউনিস্টদের ছেড়ে দিয়ে তাদের অন্তর্বিরোধকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী ডাঙ্গের কুখ্যাত চিঠি সে আশায় বাদ সাধলো। গড়ে উঠলো নতুন বিপ্লবী পার্টি। পতন হলো ক্রুশ্চেভের, মার খেলো বিশ্ব শোধনবাদ প্রচন্ডভাবে। যে খুঁটিকে আশ্রয় করে ধনিক শ্রেণী চীনের বিরুদ্ধে হামলা শুরু করেছিল সেই খুঁটি নড়তে শুরু করলো ভিয়েতনামে। ধনিক শ্রেণী প্রমাদ গুনলো, সে দেখলো তার পিঠ দেওয়ালে ঠেকেছে- আর পেছোবার উপায় নাই। তাই সে আক্রমণ শুরু করলো, বন্দী করলো এক হাজার কমিউনিস্টকে। কিন্তু সংগ্রামী জনতা রায় দিলো কেরালায়! স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের উচ্ছ্বাস দেখলো সরকার, ছিঁড়ে ফেললো গণতন্ত্রের শেষ মুখোশ। কিন্তু না, শত সহস্র কমিউনিস্টকে বন্দী করে হাজারো দমন নীতি দিয়েও ঐ স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে ঠেকানো যায় না। কারণ চীনের বিপ্লবকে শেষ করা যায় না, কোন ঝড়ো হাওয়াই ঐ বিপ্লবের আলোকবর্তিকাকে নিভিয়ে দিতে পারে না। বিকারগ্রস্ত ধনিক শ্রেণী তা জানে, তাই সে নিজের দুর্বল জায়গাগুলো সম্বন্ধে প্রলাপ বকতে শুরু করেছে। মিলিটারীর মধ্যে সংগঠন গড়ে উঠার কল্পনায় শিউরে উঠেছে। তেলেঙ্গানার ভূত দেখতে শুরু করেছে। হ্যাঁ কমরেড, আজ বলদৃপ্তভাবে মানুষের সামনে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে হবে এলাকা ভিত্তিক ক্ষমতা দখলই আমাদের পথ। কাঁপিয়ে দিতে হবে ধনিক শ্রেণীকে তার দুর্বলতম জায়গায় প্রচন্ডতম আঘাত করে। বলিষ্ঠ কণ্ঠে মানুষের সামনে বলতে হবে ঐ দেখুন দরিদ্র অনগ্রসর চীন ১৬ বছরের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর সাহায্যে নিজের অর্থনীতিকে বলিষ্ঠ ও দৃঢ় করে তুলেছে। অন্যদিকে দেখিয়ে দিতে হবে এই দেশদ্রোহী সরকারকে যে ১৭ বছরের মধ্যে ভারতবর্ষকে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের লীলাক্ষেত্রে পরিণত করেছে, যে সমগ্র ভারতবাসীকে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের লীলাক্ষেত্রে পরিণত করেছে, যে সমগ্র ভারতবাসীকে বিদেশীর কাছে ভিক্ষুকের জাতে পরিণত করেছে। আসুন কমরেডস, শ্রমিকের নেতৃত্বে কৃষি বিপ্লবের কর্মসূচী নিয়ে সমস্ত মেহনতী মানুষ মিলে এই সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হই। অন্যদিকে কৃষক বিদ্রোহের মাধ্যমে মুক্ত কৃষক এলাকা গঠন করে নতুন জনগণতান্ত্রিক ভারতের গোড়াপত্তন করি। আসুন, একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গর্জে উঠি।
ভারতের আসন্ন সশস্ত্র সংগ্রাম জিন্দাবাদ!
শ্রমিক কৃষক মেহনতী জনতার ঐক্য জিন্দাবাদ!
(৯ই এপ্রিল, ১৯৬৫)
Comments