শিবিরনামা [পর্ব-তিন]

 

"আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা শিবিরকে প্রতিহত করার যে ঘোষণা দিয়েছে, আমরা তাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছি। পৃথিবীর সকল অস্ত্র জড়ো করে আমাদের পরাস্ত করা যাবে না।"

- রেজাউল করিম, সভাপতি, ছাত্রশিবির
(দৈনিক সংগ্রাম, ১৯.০১.২০১০)

ইসলামি ছাত্রশিবিরের ৩৩তম কেন্দ্রীয় সম্মেলনে ১৯ জানুয়ারি, ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এই কথা বলেছিল শিবিরের কেন্দ্রিয় সভাপতি।

"ছাত্রজীবনে যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে ইসলামি আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম, এখন আল্লাহতায়ালা ছাত্রশিবিরের মাধ্যমে সে স্বপ্ন পূরণের ব্যবস্থা করেছেন।"

- মতিউর রহমান নিজামী
(দৈনিক সংগ্রাম, ১৯.০১.২০১০)

একই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এই কথা বলেছিল জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী।

উপরে উল্লেখিত দু'জনের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শিবির সভাপতি তার বক্তব্যে শিবিরের শক্তি আর সামর্থের দাপট দেখিয়েছে। চোখে আঙ্গুল দিয়ে রাষ্ট্রকে দেখাতে চেয়েছে-

দেখো, আমরা তোমাদের প্রকাশ্যে হুমকি দেই;
আমরা প্রকাশ্যে বলতে পারি, তোমাদের যত অস্ত্র
আছে তার চেয়ে বেশি অস্ত্র আমাদের কাছে আছে।

অন্যদিকে নিজামীর বক্তব্য শুনেই বোঝা যায় একাত্তরে এত এত রক্ত দেখে, এত এত খুন করেও নিজামীর মন ভরেনিতার আরো রক্তের প্রয়োজনআরো লাশের প্রয়োজন

স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম হচ্ছে জামাত শিবিরের নতুন স্বপ্নএকাত্তরে যে হত্যাগুলো করতে পারেনি নিজামীর আলবদর রাজাকার বাহিনী, স্বাধীন বাংলাদেশে নিজামীদের অসমাপ্ত কাজ এখন শিবির করছেতৃণমূলের শিবির নেতারাও এমন আগ্রাসী ও আক্রমণাত্বক বক্তব্য দিয়ে থাকেসেটা কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় হোক, ভোলার কোনো চর হোক, অথবা হবিগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো গ্রামই হোক; সব জায়গাতেই শিবিরের বক্তব্যের ধরণ এক, আক্রমণের ভাষা এক।

প্রতিষ্ঠার পর রাজধানীতে বাধা পেয়ে শিবির মফস্বল, গ্রাম কেন্দ্রিক আর শিক্ষাঙ্গন টার্গেট করে যে রাজনীতির পরিকল্পনা করেছিল; চট্টগ্রামের পর তারা এই হিংম্র ও খুনের রাজনীতির সফল প্রয়োগ করেছিল রাজশাহীতে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি শিক্ষাঙ্গন দখলের যে রাজনীতি শুরু করে শিবির, তার ধারাবাহিকতায় তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৭৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা চত্বরে এক জনসভার মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু করে। শুরুতেই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠন ছাত্রমৈত্রী, জাসদ আর ছাত্রলীগের বাধার মুখে পড়ে। কিন্তু হত্যা আর রগ কাটার রাজনীতি শুরু করে শিবির সেই বাধাকেও তুচ্ছ করে ফেলে। একপর্যায়ে শিবির বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। রাজশাহী বিশ্বাবদ্যালয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে শিবির চট্টগ্রামের মতো একই কায়দায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্রে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে তাদের শক্তিমত্তা বাড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোকে তারা নিজেদের মিনি ক্যান্টনমেন্ট বানায়পার্শ্ববর্তী গ্রাম মেহেরচন্ডী, বিনোদপুর, বুধপাড়ায় শিবিরের অনেক কর্মী ও ক্যাডার স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করে এসব গ্রামে নিজেদের শক্তি বাড়িয়েছেএছাড়া আত্মীয়তার সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার কারণে শিবিরের এসব কর্মী ও ক্যাডারদের কথায় স্থানীয় অনেকেই জামায়াত শিবিরের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে একে একে শিবির বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পুরোটাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। গোটা রাজশাহী মহানগর জুড়ে প্রগতিশীল ও বাম সংগঠনগুলোর ব্যর্থতা, অদক্ষতা, কর্মক্ষমহীনতা, অসততা যত বেড়েছে; শিবির বিপুল উদ্যোগে সেই ফাঁকা জায়গায় তাদের বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। মহানগরী জুড়ে কোচিং সেন্টার, মেস, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ নানা ক্ষুদ্র ব্যবসায় তারা লগ্নি করেছে। এই অর্থ লগ্নির একটা বড় অংশ শিবিরের সংগঠনের পেছনে খরচ করা হয়েছে। এই আর্থিক প্রণোদনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা গ্রামের সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেক সমস্যা লাঘব করে। টিউশনি, লজিং ইত্যাদি জুগিয়ে ছাত্রজীবনে আর্থিক সহায়তার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরির নিশ্চয়তার ধারাবাহিক পথ তৈরি করে জামায়াত তাদের ছাত্র সংগঠনকে মজবুত করার কাজে লাগায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে যে আর্থিক কর্মকান্ড তার প্রায় পুরোটাই জামায়াত-শিবিরের নিয়ন্ত্রণে। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডার সহ সকল রকমের স্টেশনারি, পরিবহন বাণিজ্যের মূল অংশের নিয়ন্ত্রক জামায়াত-শিবির। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন দোকান, বাজার, পার্শ্ববর্তী গ্রামে দীর্ঘদিনের শ্রমে শিবির সমর্থকদের জুটিয়ে জামায়াত তাদের শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো যখন ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বোঝেনি, তখন জামায়াত-শিবির রাজশাহী মহানগরী এবং বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে সংগঠনের স্বার্থকে পরিপুষ্ট করেছে। জামায়াত বিশ্বাস করেছে, এই এলাকায় জামায়াতের অবস্থান শক্ত হলে এখানকার প্রশাসন এবং সকল আর্থিক ব্যবস্থাপনা তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে। এই বিশ্বাসকে তারা কর্মে পরিণত করে। এই পরিকল্পনা রাজশাহী জেলা এবং পার্শ্ববর্তী জেলা বগুড়া, নাটোরের একাংশ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতে তারা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিএনপির দুই মন্ত্রী রাজশাহীর ব্যারিস্টার আমিনুল হক, নাটোরের রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু  জামায়াতের সাংগঠনিক-আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে মুক্তহস্তে সমর্থন জুগিয়ে গেছেন।

১. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে শিবির চট্টগ্রামের মতোই নৃশংসতার পথ বেছে নেয়। সর্বপ্রথম ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ শিবির ক্যাডাররা চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বাসভর্তি বহিরাগত সন্ত্রাসী নিয়ে এসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের উপর হামলা চালায়। এই সহিংস ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

২. রাজশাহী মেডিকেল কলেজের প্রধান হোস্টেলের সামনে ১৯৮৮ সালের ৩ মে প্রকাশ্য দিবালোকে শিক্ষার্থীদের সামনে ছাত্রমৈত্রী নেতা ডাক্তার জামিল আক্তার রতনকে কুপিয়ে ও হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যা করে শিবিরের ক্যাডাররা

৩. চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে ১৯৮৮ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জাসদ নেতা জালালকে তার নিজ বাড়ির সামনে কুপিয়ে হত্যা করে শিবির ক্যাডাররা।

৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা যখন ঘুমিয়ে ঠিক সেই সময় ১৯৮৮ সালের ১৭ জুলাই ভোর রাতে বহিরাগত শিবির ক্যাডাররা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়ে জাসদ ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সভাপতি ও সিনেট সদস্য আইয়ূব আলী খান, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সিনেট সদস্য আহসানুল কবির বাদল এবং হল সংসদের ভিপি নওশাদের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়।

৫. একই বছরের আগস্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মো: ইউনুসের বাসভবনে শিবির বোমা হামলা করে।

৬. ১৯৯২ সালের ১৭ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির সন্ত্রাসীদের হাতে জাসদ ছাত্রলীগ নেতা ইয়াসির আরাফাত খুন হন। এদিন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ছাত্র হল আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।

৭. শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে হরতাল কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে জাসদের মিছিলে ১৯৯২ সালের ১৯ জুন শিবিরের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। শিবিরের হামলায় ঐদিন সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে জাসদ নেতা মুকিম মারাত্মক আহত হন এবং ২৪ জুন তিনি মারা যান।

৮. ১৯৯২ সালের আগস্ট মাসে শিবির নিয়ন্ত্রিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী নতুন বুধপাড়া গ্রামে শিবির ক্যাডার মোজাম্মেলের বাড়িতে বোমা বানানোর সময় তাদেরই ক্যাডার আজিবর সহ অজ্ঞাতনামা আরো তিন জন নিহত হয়।

৯. শিবিরের খুনীরা ১৯৯৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। ছাত্রদল ও সাবেক ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মিলে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ওপর শিবিরের হামলায় ছাত্রদল নেতা বিশ্বজিৎ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নতুন এবং ছাত্র ইউনিয়নের তপন সহ ৫ জন ছাত্র নিহত হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ঐদিন শিবির সবচেয়ে বড় তান্ডব চালায়।

১০. বহিরাগত সশস্ত্র শিবির কর্মীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হলে হামলা চালিয়ে ছাত্রমৈত্রী নেতা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট দলের সদস্য জুবায়েদ চৌধুরী রিমুকে ১৯৯৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর হাত-পায়ের রগ কেটে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে।

১১. শিবির কমীরা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন চৌদ্দপাই নামক স্থানে রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী একটি বাসে হামলা চালিয়ে ছাত্রমৈত্রী নেতা দেবাশীষ ভট্টাচার্য রূপমকে ১৯৯৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাসের যাত্রীদের সামনে কুপিয়ে হত্যা করে।

১২. ১৯৯৬ সালে জাসদ এর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক আমান উল্লাহ আমানকে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করে শিবির ক্যাডাররা।

১৩. রাবি অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহাকে ২০০১ সালে শিবির কর্মীরা হাত-পা বেধে জবাই করে হত্যা করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের হস্তক্ষেপে ঐদিন তিনি প্রাণে বেঁচে যান।

১৪. ২০০৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মো: ইউনুসকে ফজরের নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় কুপিয়ে হত্যা করে শিবির ক্যাডাররা। এর আগে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালে দুই দফায় ছাত্র শিবির অধ্যাপক ইউনুসকে হত্যার চেষ্টা করেছিল।

১৫. ২০০৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জামায়াতপন্থী শিক্ষক মহিউদ্দিন এবং ছাত্র শিবির সভাপতি মাহবুব আলম সালেহী সহ আরো দুইজন শিবির ক্যাডার মিলে একযোগে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে রাবি'র ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবু তাহেরকে হত্যা করে। সালেহী এই মামলা থেকে খালাস পেয়ে শিবিরের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

১৬. ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাতের আঁধারে বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়ে ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করে তার লাশ ম্যানহোলে ফেলে রাখে শিবিরের খুনী পিশাচরা।


Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]