বর্তমান অবস্থায় আমাদের কর্তব্য (১ নং দলিল) - চারু মজুমদার



(২৮ শে জানুয়ারী, ১৯৬৫)

কংগ্রেস সরকার গত একমাসে প্রায় এক হাজার কমিউনিস্টকে গ্রেপ্তার করেছে। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নেতৃত্বের অধিকাংশই আজ জেলে। গুলজারিলাল নন্দা গেরিলাযুদ্ধের আজগুবি গল্প শুরু করেছে। শুধু তাই নয় নির্বাচনী জনতার রায়কে মানবে না বলে ঘোষণা করেছে (মানে নাই)। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ শুরু হয়েছে ধনতন্ত্রের আন্তর্জাতিক ও আভ্যন্তরীণ সংকটের জন্য। ভারত সরকার ক্রমশ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বের উপর প্রভুত্ব বিস্তারের মূল রাজনীতির অংশীদার হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রধান প্রতিক্রিয়াশীল ঘাঁটি হিসাবে ভারতকে সুপ্রতিষ্ঠিত করাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মূল উদ্দেশ্য। ভারতের ধনিক শ্রেণী তার আভ্যন্তরীণ সংকট সমাধানের কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না। স্থায়ী খাদ্য সংকট ও ক্রমবর্দ্ধমান মূল্যমান পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে এবং তারই ফলে আরও বেশী করে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি আমদানী করা ছাড়া ভারতীয় ধনিক শ্রেণীর এই সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার আর কোনো পথ নেই। সাম্রাজ্যবাদের প্রতি এই নির্ভরশীলতার জন্য ধনতন্ত্রের আভ্যন্তরীণ সংকট দিনের পর দিন বাড়তে বাধ্য। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নির্দেশে এবং নিজের আভ্যন্তরীণ সংকটের সম্মুখীন হয়ে ভারতীয় ধনিক শ্রেণী গণতন্ত্রকে হত্যা করা ছাড়া অন্য কোনো পথ খুঁজে পায় না। এই গ্রেপ্তারের পেছনে সাম্রাজ্যবাদের নির্দেশ ছিল। কেননা মার্কিন পুলিশ চীফ ম্যাকব্রাইট তখন দিল্লীতে ছিল এবং তার সঙ্গে আলোচনা করেই ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। গণতন্ত্রকে হত্যা করে এই সংকটের সমাধান করা যায় না এবং ভারতীয় ধনিক শ্রেণীও এই সংকটের সমাধান করতে পারবে না। সরকার যতই সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীল হবে তত বেশী করে তার সংকট সমাধানে অসমর্থ হবে। জনতার বিক্ষোভ দিনের পর দিন বাড়বে এবং ধনিক শ্রেণীর অর্ন্তবিরোধও বাড়বে। সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি বিনিয়োগের পূর্ব শর্ত হিসাবে যেমন কমিউনিস্টদের গ্রেপ্তার চায় তেমনি খাদ্য সমস্যার সাময়িক সমাধান চায়। এই খাদ্য সংকটের সমাধান করতে হলে খাদ্যের উপর ব্যবসা ও মুনাফার বাজার বন্ধ করা প্রতি পদক্ষেপে প্রয়োজন এবং তারই জন্য প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণের। পশ্চাদপদ অর্থনীতির দেশে এই নিয়ন্ত্রণ অনিবার্যভাবে একটা বিরাট অংশের বিরোধীতার সম্মুখীন হয়। ধনিক শ্রেণীর এই বিরোধ একচেটিয়া। পুঁজিপতির সঙ্গে জাতীয় ধনিক শ্রেণীর নয়, এই বিরোধ প্রধানত শিল্প মালিকদের সহিত ব্যবসায়ী শ্রেণীর। অনুন্নত অর্থনীতির দেশে খাদ্যশস্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ব্যবসা পুঁজি সৃষ্টি করার পক্ষে অনিবার্য এবং এই নিয়ন্ত্রণ এই পুঁজি সৃষ্টির পক্ষে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে ধনতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তার আভ্যন্তরীণ বিরোধ আভ্যন্তরীণ সংকটে রূপ নেয়। ভারতবর্ষ বিরাট দেশ। এই দেশের ৪৫ কোটি জনসাধারণকে দমন নীতির দ্বারা শাসন করা যায় না। কোনো সাম্রাজ্যবাদী দেশের পক্ষে এই বিরাট দেশের দায়িত্ব নেয়া সম্ভবপর নয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বের যে সমস্ত দেশকে সাহায্য দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা পালন করতে তার নাভিশ্বাস উঠেছে। ইতিমধ্যে আমেরিকায় শিল্পসংকট দেখা দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট জনসনের উক্তি থেকে বোঝা যায় যে দেশের বেকার সংখ্যা বেড়েছে। সরকারী সূত্রে ৪০ লক্ষ লোক পুরো বেকার, ৩ কোটি ৫০ লক্ষ লোক অর্ধ-বেকার এবং কারখানাগুলিতে অর্ধবেকারী চলছে। সুতরাং জনসাধারণের ক্রমবর্দ্ধমান বিক্ষোভকে ভারত সরকার দমন করতে পারবে না। গণতন্ত্রের উপর এই আক্রমণ জনসাধারণের বিক্ষোভকে অনিবার্যভাবে সংগ্রামে রূপান্তরীত করবে। আগামী দিনের বিক্ষোভের চেহারা কি হবে? তার কিছু আভাষ পাওয়া যায় মাদ্রাজের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে? সুতরাং আগামী যুগ শুধু বৃহৎ মাত্র সংগ্রামেরই যুগ নয়; বৃহৎ জয়েরও যুগ এবং এই যুগের জনতার বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হবে কমিউনিস্ট পার্টিকে এবং সে দায়িত্ব আমরা সার্থক ভাবে পালন করতে পারবো। তখনই যখন পার্টি সংগঠনকে বিপ্লবী সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলতে পারবো। বিপ্লবী সংগঠন গড়ার প্রধান ভিত্তি কি? কমরেড স্তালিন বলেছেন ‘বিপ্লবী কর্মী’। বিপ্লবী কর্মী কাকে বলে? বিপ্লবী কর্মী হচ্ছে সেই যে নিজের উদ্যোগে ঘটনার বিশ্লেষণ করতে পারে এবং সেই অনুযায়ী কর্মপন্থা গ্রহণ করতে পারে।

সাংগঠনিক আওয়াজ:

১। প্রত্যেক পার্টি সভ্যকে ৫ জনের সক্রিয় দল (Activist group) অন্ততপক্ষে একটি তৈয়ারী করতে হবে। এই কর্মী দলটি অন্যান্য কর্মীদের রাজনৈতিক শিক্ষা দেবে।

২। প্রত্যেকটি পার্টি সভ্যকে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে এই দলের কেউ পুলিশের চিহ্নিত লোক না হয়।

৩। প্রত্যেক দলের বৈঠকের জন্য একটি অপ্রকাশ্য জায়গা চাই। প্রয়োজন হলে ২/১ জনকে গোপনে রাখতে হবে।

৪। গোপনীয় কাগজপত্র লুকিয়ে রাখার জায়গা ঠিক রাখতে হবে।

৫। প্রত্যেক দলের যোগাযোগের জন্য একজনকে নির্দিষ্ট রাখতে হবে।

৬। সক্রিয় দলের কর্মী যখন রাজনৈতিক শিক্ষা এবং কাজে পারদর্শী হয়ে উঠবে তখন তাকে পার্টি সভ্য করতে হবে এবং পার্টি সভ্য হবার পর তার আর সক্রিয় দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা চলবে না।

এই সাংগঠনিক নীতি দৃঢ়ভাবে পালন করতে হবে। এই সংগঠনই আগামী যুগে বিপ্লবী সংগঠনের দায়িত্ব নেবে।

রাজনৈতিক শিক্ষা কি হবে? 

ভারতবর্ষের বিপ্লবের প্রধান ভিত্তি হচ্ছে কৃষি বিপ্লব। সুতরাং আমাদের রাজনৈতিক প্রচার আন্দোলনের প্রধান বক্তব্য হবে- কৃষি বিপ্লব সফল কর। কৃষি বিপ্লবের কার্যক্রম আমরা শ্রমিক ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে যত বেশী প্রচার করতে ও তাদের শিক্ষিত করে তুলতে পারবো, শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত তত বেশী রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠবে। কৃষকের মধ্যে শ্রেণীবিভাগ ও কৃষি বিপ্লবের কর্মসূচী প্রত্যেকটি সক্রিয় দলের আলোচ্য বিষয় হওয়া চাই।

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]