সরোজ দত্ত



সরোজ দত্তের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুরেশ মৈত্র এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সরোজ দত্ত চারু মজুমদারের সংস্পর্শে আসার বহু আগেই তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর নেতা ও কর্মীদের উন্নাসিকতা দেখে বলেছিলেন- 

"তুমি কমিউনিস্ট পার্টি করবে অথচ ঘামের গন্ধ সহ্য করবে না!" 

বড়ভাই বটকৃষ্ণ তার ব্যাপারে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন ছোটবেলায় তাদের বাবা (জমিদারদের স্টেটের ম্যানেজার) এক প্রজা পান খেতে চাওয়ায় থাপ্পড় মেরেছিল। তখন সরোজ দত্ত তার বাবাকে অপমান করেছিলেন আপাত প্রজাদরদী হিসেবে ভণ্ডামি দেখানোর কারণে। 

১৯৫৩ সালে স্তালিনের মৃত্যুর পর ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেসে ক্রুশ্চেভ, বুলগানিনরা মার্ক্স, লেনিন, স্তালিনের শোষণবিহীন সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের সকল মূল্যবান নীতি নস্যাৎ করে। তারা মত দিলো শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথে বিপ্লব হবে! অর্থাৎ ভোটযুদ্ধে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে! ১৯৫৬ সালে ২০তম কংগ্রেসের আগে ১৯৫৫ সালে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ক্রুশেভ এবং বুলগানিন ভারতে আসে। এরপর থেকেই উপমহাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো নির্বাচনপন্থী বামদলগুলো তৈরী হতে থাকে ধীরে ধীরে।

নবারুণ ভট্টাচার্য তার সম্পর্কে বলেছিলেন-

"ইতিহাসে দেখা গেছে সরফরাজি চন্ড ও ভন্ডদের দাপটের সামনে অনেকেই ক্লীব, পঙ্গু ও অসাড় হয়ে পড়ে। মানুষ যত চুপ করে থাকে, যত অন্যায় মেনে নেয় তত বাড়তে থাকে রাক্ষসদের হম্বিতম্বি ও রাক্ষসদের কর্তাভজা খোক্কসদের বিকট কোরাস। এই অসময়ে যারা লালকমল নীলকমল হতে চাইবে তাদের বিবেক সবল ও তরতাজা থাকা দরকার। কোনও কোনও মানুষের কথা ভাবলে কাজটা করে ফেলা অসম্ভব নয়। সেরকমই একজন মানুষ ছিলেন সরোজ দত্ত। নিজের প্রাণ দিয়ে তিনি জায়গা করে নিয়েছিলেন জুলিয়াস ফুচিক বা গ্যাব্রিয়েল পেরির পাশে।"

সরোজ দত্তকে অধ্যাপক দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে ১৯৭১ সালের ৪ আগস্ট রাত সাড়ে ১১ টা বাজে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। পুলিশরা মদ্যপ অবস্থায় ছিল। তাকে ময়দানে নিয়ে যাওয়ার পর গাড়ি থেকে নামিয়ে হাঁটতে বলে পেছন থেকে গুলি করা হয়। তিনি মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর দুইজন মাতাল পুলিশ গিয়ে তাঁর মাথা দেহ থেকে কেটে বিচ্ছিন্ন করে বলেছিল- 

"শালা আজকে সরোজ দত্তকে মেরে কলকাতার বুদ্ধিজীবী খতম আরম্ভ করলাম।" 

অন্যদিকে 'মহানায়ক' উত্তম কুমার (যিনি কিনা বৌকে ডিভোর্স না দিয়েই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের প্রেমিকার সাথে লিভ টুগেদার করে গেছেন) সকালে হাঁটতে বের হয়ে সম্পূর্ণ ঘটনা চোখের সামনে দেখার পরও ছাত্র পরিষদের নেতাদের ধমকে কালী ব্যানার্জীর সাথে শেয়ারের পর মুম্বাই পালিয়ে যান এবং পরে লিখিত বিবৃতিতে মিথ্যা কথা বলার মহান দায়িত্বটা পালন করেন!

চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য জুলিয়াস ফুচিক বলেছিলেন- 

"নপুংসক বুদ্ধিজীবীরা পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করতেই থাকুন। আসুন আমরা শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-যুবকরা এটাকে পাল্টানোর কাজে হাত দেই।" 

অন্যদিকে মহান বিপ্লবী সরোজ দত্তের এক আত্মীয় তাকে বলেছিলেন- 

"সাবধানে থেকো। ধরা পড়লে ওরা কিন্তু তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে না।" 

তখন তিনি যশোরের আঞ্চলিক ভাষায় উত্তর দিয়েছিলেন- 

"এইডে কি কইলে! লড়াইয়ে শুধু বাহিনীই আত্মত্যাগ করবে, সিনাপতি করবে না, ইডা কেমন লড়াই!"

কথিত মার্ক্সবাদীরা ১৮৫৭ সালের উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামকে 'সামন্ততন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের পুনরভ্যুত্থান' বলে আখ্যায়িত করেছিল। তাদের মতে এই বিপ্লব ছিল 'প্রতিক্রিয়ার অভ্যুত্থান'! বিখ্যাত গবেষক সুকুমার মিত্রের সঙ্গে মিলে সরোজ দত্ত সর্বপ্রথম সিপাহী বিদ্রোহের প্রকৃত মূল্যায়ন আমাদের কাছে রেখে গেছেন। তিনি বলেছিলেন- 

"প্রতিক্রিয়াশীলরা খুন করে, কিন্তু তার যুক্তি হাজির করে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা।"

তিনি আরো বলেছিলেন- 

"আসল বিপদ কিন্তু মধ্যপন্থা।"

মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দ্বিচারিতার ব্যাপারে তিনি বলে গেছেন- 

"বিচিত্র জীব এই মধ্যবিত্ত মানুষ। গরীব, সর্বহারাদের জন্য এদের দরদও যথার্থ এবং সত্য। আবার শোষক সম্প্রদায়ের সম্পদ, বৈভব, জৌলুসের প্রতি লালসাও সত্য।"

ক্যাপিটাল শতবার্ষিকী বিশেষ সংখ্যায় [৭ অক্টোবর, ১৯৬৭] তিনি বলে গেছেন-

"....কোনো কমিউনিস্ট কতখানি মার্কসবাদী তার নিরিখ হচ্ছে শ্রেণি সংগ্রাম ও সর্বহারা শ্রমিক একনায়কত্বের প্রতি তার মনোভাব কী। মার্কসবাদকে আক্রমণ করতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা ও তাদের দালালেরা এই তত্ত্বকেই তাদের আক্রমণের আসল লক্ষ্যবস্তু বলে ধরে নেয়। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে সংশোধনবাদীরাও কৌশলে এই তত্ত্বকেই উড়িয়ে দিতে চায়। সোভিয়েত পার্টির সংশোধনবাদী নেতৃত্বেও দেখা যায় সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্বের পরিবর্তে জনগণের রাষ্ট্র নামক সংশোধনবাদী ধারণাটি কায়দা করে আমদানি করা হয়েছে। এখানে একটা কথা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। বুর্জোয়া শ্রেণির আপত্তি শ্রেণি সংগ্রামে নয়, আপত্তি শ্রেণি সংগ্রামের সঙ্গে শ্রমিক একনায়কত্বকে জুড়ে দেওয়ায়। লেনিন বলেছেন শ্রেণি সংগ্রাম বুর্জোয়ারাও গ্রহণ করে থাকে, কিন্তু সর্বহারা শ্রমিক একনায়কত্বকেই তারা মারাত্মক বিপজ্জনক বলে মনে করে। অতএব যদি কেউ শুধু শ্রেণি সংগ্রাম বলেই ক্ষান্ত থাকে এবং তার সঙ্গে শ্রমিক একনায়কত্বকে যুক্ত না করে, তবে বুর্জোয়া শ্রেণি বিচলিত বোধ করে না; কারণ বিপ্লবের মর্মবস্তুই হচ্ছে সর্বহারা শ্রমিক একনায়কত্ব, যা ইতিহাসে মার্কসের নিজস্ব বিশিষ্ট্য অবদান ও অবিস্মরণীয়। অতএব যখন দেখি এদেশের কমিউনিস্ট নেতৃত্বের পক্ষ থেকে বলা হয় বুর্জোয়া মন্ত্রিসভায় থেকে তাকে কমিউনিস্টরা ব্যবহার করবেন শুধু শ্রেণি সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে, ঐ সঙ্গে সর্বহারা শ্রমিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে নয়; তখন এই ফাঁক ও ফাঁকি যে বুর্জোয়া একনায়কত্বকেই শক্তিশালী করে তা সহজেই বুঝতে পারি। শ্রেণি সংগ্রামের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে ছিন্ন করে নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র প্রতিষ্ঠার আওয়াজ যদি যুক্ত না হয়, তবে শ্রেণি সংগ্রামের সমস্ত বাগাড়ম্বরই সংশোধনবাদী ক্লীবত্বে পরিণত হতে বাধ্য যা চোখের উপর দেখতে পাচ্ছি।"

সরোজ দত্তকে খুন করার ব্যাপারে কংগ্রেসের সংশ্লিষ্টতা, সিপিএম এর ভূমিকা, নায়ক উত্তম কুমারের সাক্ষ্য প্রভৃতি বিষয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক দিলীপ চক্রবর্তীর প্রতিবেদন ও সাক্ষাৎকার-

https://terabox.com/s/1JE5ZEXRAc33-t2r0Gn_mog?fbclid=IwZXh0bgNhZW0CMTEAAR0-c5cAlfx7nPotqQbTbch36r_vrd_bYfhPgqbrUDf0zZhnRHhcPE7kqlw_aem_CjJd_CwDMlWGKVZRJectfg




Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]