বাম রঙ্গ [পর্ব-ছয়]

 

ইউরো কমিউনিজম এর স্বরূপ বুঝতে অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা বামপন্থী দলগুলোর ক্ষমতার দৌঁড় বুঝতে নেরুদার স্মৃতিকথার শরণাপন্ন হওয়া যাক। ইতালির মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনে বামপন্থীরা জেতার পরও নেরুদাকে কেন্দ্র কর্তৃক পুলিশ দিয়ে হেনস্থার সময় এরা কিছুই করতে পারেনি মিনমিনে আনুগত্য দেখানো ছাড়া। পরে জনতার প্রবল চাপের মুখে ইতালির সরকার বাধ্য হয় নেরুদাকে ইতালি অবস্থান করার অনুমতি দিতে। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন দে গাস্পেরি। 

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Alcide_De_Gasperi


ফিনল্যান্ডের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক (যেই সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের নির্বাচনে জেতার পর উপমহাদেশের নির্বাচনপন্থী বামেরা গর্ব করে পোস্ট দেয়) পার্টির চেয়ারম্যান এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন বন্ধুদের নিয়ে ড্রাগসসহ উদ্দাম পার্টিতে ব্যস্ত!

এই পাড়ের নির্বাচনপন্থী হাজিদের অনুরূপ ঐ পাড়ের দীপ্সিতা ধর এবং তাদের মতো নির্বাচনপন্থীদের ধর্ম তোষণ নীতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে কমিউনিজম আর বামগিরির মধ্যে পার্থক্য দেখিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

পশ্চিমাদের দালাল সরকারের ভুঁইফোড় উপদেষ্টাদের এই বৈঠকে ছিল ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ইউনিয়ন আর সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট এর বামেরা  


উপমহাদেশের দেশগুলোর অনেকেই যৌবনে বাম ধারার রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও প্রৌঢ় অবস্থায় পৌঁছালে ধর্ম চর্চা শুরু করেন। বিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক দস্তয়েভস্কির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। সাইবেরিয়া থেকে শাস্তি ভোগ করে আসার পর তিনি ধীরে ধীরে কট্টর খ্রিস্টানে পরিণত হন। তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৃতি হিসেবে গণ্য এই বইটিতে তিনি চরিত্রগুলোর মুখ দিয়ে সমাজতন্ত্রের বিষোদ্গার করেছেন বহুবার এবং দেখাতে চেয়েছেন সমাজতন্ত্রীরা নাস্তিক দেখেই তাদের মধ্যে নাকি কোনো ধরনের নীতিবোধ কাজ করে না! তিনি এটাও দেখাতে চেয়েছেন যে, কোনো সমাজে ধর্ম কিংবা সৃষ্টিকর্তার ধারনার অস্তিত্ব বিলীন হলে সেখানে নাকি অমানুষ পয়দা হয়ে অরাজকতা ঘটায়! অন্যদিকে লম্পট, মদ্যপ, সুদখোর, ভূমিদাস প্রথার সমর্থক ধার্মিকদের মধ্যে মানবতাবোধের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছেন! ঠিক যেমনটা মুসলমানদের দাবী অনুযায়ী, একজন মুসলমান হাজারটা অপরাধ করলেও সে জান্নাতে যাবে কিংবা হিন্দুদের ব্রাহ্মণরা! আবার ধার্মিকদের চারিত্রিক স্খলনের দিকটিকে হালকা করে প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তিনি সেই চিরাচরিত রীতি অনুসরণ করে এর জন্য নারীদের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দিয়েছেন। এজন্যই এই লেখকের বই পড়া সোভিয়েত আমলে নিরুৎসাহিত করা হলেও এই অঞ্চলের নির্বাচনপন্থীদের কাছে প্রিয়পাত্র তিনি। কারণ তারা ধর্মগুলোর ক্ষতিকর দিক ও শোষণের মাধ্যম হিসেবে সেগুলোর প্রায়োগিক ক্ষেত্রগুলো তুলে ধরার পরিবর্তে নিজেরা একদিকে যেমন ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মীয় রীতির চর্চা করে, আবার অনেকে নিধার্মিক হয়েও বুর্জোয়া পার্লামেন্টের কয়েকটা সিটের জন্য লালায়িত হয়ে ধার্মিক তোষণ লাইনের চর্চা করে।


ইরানের বিক্ষোভকে শ্রেণিগতভাবে বিশ্লেষণ করতে পারেনি বামেরা। ইরানের ছোট-বড় শহর জুড়ে প্রায় ৫০টি জায়গায় সাম্যের আহবান এবং ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে 'নারী-জীবন-স্বাধীনতা' - এই তিনটি দাবিকে সামনে রেখে ইরানের ইসলামিক শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে মূলত উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত জনগণ। আবার এর সাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী পোস্টার হাতে নিয়ে দোষীদের শাস্তির দাবিতে মিছিল দেখা গেছে ইরানের রাস্তাতে (যদিও তার প্রচার হচ্ছে কম)। পশ্চিমী ধারার সংবাদমাধ্যমগুলো ইরানি বিক্ষোভকে তুলনা করেছে ২০০৯ সালে ইরানে ঘটে যাওয়া তথাকথিত 'গ্রীন মুভমেন্ট' এর সঙ্গে, যা ছিল ইরানের পূর্বের শাসক বাদশাহ শাহ রেজা পাহলভীর নেতৃত্বে মূলত নির্বাচনী জালিয়াতির বিরুদ্ধে। 

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Iranian_Green_Movement

খুবই চালাকি করে ও সচেতনভাবে পশ্চিমী মিডিয়া ইরানের ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল অব্দি গ্রাম ও ছোট ছোট শহরগুলোর দরিদ্র অঞ্চলে ঘটে যাওয়া শ্রমিকশ্রেণী, ক্ষুদ্র কৃষক এবং খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত জনগণের ইসলামিক সরকার বিরোধী বিক্ষোভকে ইরানের ইতিহাস থেকে কাঁচি দিয়ে কাটতে চেয়েছে তাদের সংবাদ প্রচারের মধ্যে দিয়ে। সেসময় ইরানের ইসলামিক প্রজাতান্ত্রিক সরকারের হাতে শত শত মানুষ বন্দী এবং ১৫০ জনের বেশি নিহত হয়েছিল। সেই সময়ের দাবি ছিল ইরানের মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। ইরান বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ তেল অধিকারী দেশ। বিংশ শতকের শুরু থেকে ইরানের তেলের খনিগুলো ব্রিটিশ কোম্পানির এংলো-ইরানিদের হাতে ছিল। ১৯২৫ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় অভ্যুত্থান মধ্য দিয়ে রেজা শাহ পাহলভী ইরানে বাদশাহ হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করে। ১৯৫১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের মহান নেতা স্তালিনের প্রত্যক্ষ সমর্থনে ও সহযোগিতায় গণতান্ত্রিক ইরান প্রতিষ্ঠিত হয়। সেসময় ইরানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন মোসাদ্দেক। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি প্রথমেই তেলক্ষেত্রগুলোর জাতীয়করণের ঘোষণা দেন। সেই মোতাবেক কাজও শুরু হয়। কিন্তু ১৯৫৩ সালের শেষে স্তালিনের মৃত্যুর পর ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এবং সিআইএ এর সহায়তায় সংগঠিত সামরিক অভ্যুর্থানের ফলে ক্ষমতা হারান মোসাদ্দেক। গণতান্ত্রিক ইরানকে দু'বছরের মধ্যেই খতম করে ফের বাদশাহ হিসেবে ক্ষমতা নেয় রেজা শাহ পাহলভী। ইরানের রাস্তা জনগণের বিরুদ্ধে উত্তাল হয়ে ওঠে ইঙ্গ-মার্কিন মদতপুষ্ট বাদশাহ'র বিরুদ্ধে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ১৯৫৭ সালে ইরানের বাদশাহ'র সাথে পারমানবিক প্রযুক্তি বিষয়ক চুক্তি সাক্ষর করে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ইরানের খেটে খাওয়া জনগণের ক্ষোভকে খোমেনির ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেছিল এবং বাদশাহ তাকে দেশ ছাড়া করে তুরস্কে নির্বাসনে পাঠায়। ধীরে ধীরে খোমেনির পরিচিতি ইরানের খেটে খাওয়া জনগণের মধ্যে বাড়তে থাকে। খোমেনিকে জানতে গিয়ে মানুষের মধ্যে ইসলামিক ধর্মীয় চেতনা বৃদ্ধি পায়। ইঙ্গ-মার্কিন মদতপুষ্ট বাদশাহ পাহলভীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে মানুষ ধর্মের দিকে পুরোপুরি ঝুঁকে পড়ে এবং নির্বাসন অবস্থাতেই খোমেনি জনগণের তথাকথিত মুক্তির নেতা হয়ে উঠে। ১৯৬৮ সালে বাদশাহ পাহলভী মার্কিনীদের ৯৩% পরিশোধিত ৫ কেজির বেশি ইউরেনিয়াম দিয়ে পারমানবিক শক্তি বিস্তার নিয়ন্ত্রণে চুক্তি স্বাক্ষর করলে ইরানি জনগণ খোমেনির নেতৃত্বে প্রতিক্রিয়াশীল ইসলামিক বিপ্লবের ডাক দেয় ইরানে। 

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Treaty_on_the_Non-Proliferation_of_Nuclear_Weapons

১৯৭৯ সালে বাদশাহ পাহলোভীর শাসনের অনাচার, দুঃশাসন ও দেশের অভ্যন্তরীন অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে ইরান জুড়ে প্রবল বিক্ষোভের সূচনা হয়। বিক্ষোভ দমনের সময় কয়েক হাজার নিরীহ জনগণ নিহত হয় ইঙ্গ-মার্কিন মদতপুষ্ট বাদশাহ'র সৈন্যবাহিনীর হাতে। ইরানে ফলস্বরূপ ক্ষমতা দখল করে প্রতিক্রিয়াশীল ইসলামিক সরকার। এর প্রায় ১৫ বছর বাদে খোমেনি দেশে ফেরে তথাকথিত বিপ্লবী নেতা রূপে। এরপর বাদশাহ পাহলভী আমেরিকা পালিয়ে গেলে এতদিনের অনাচারে বিচারের দাবিতে বিক্ষুদ্ধ জনগণ ইরানের মার্কিন দূতাবাসে হামলা করে। ইরানের ভেতর পশ্চিমী স্থাপত্য, শিল্পকলা, গ্রন্থাগার সব ভেঙে ফেলে। ইসলামিক সরকার জনগণের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে মৌলবাদী প্রাসাদ বাড়াতে থাকে ইরানে। সেসময় নারীদের চলাফেরা, বেশভুষায় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। হিজাব ও চাদর পড়া নারীদের জন্য বাধ্যতামুলক করা হয় রাস্তাঘাটে। পরবর্তীকালে নানা প্রতিবাদে পিছু হটে সরকার, এজন্য কট্টর ধার্মিক নারী সংগঠনগুলো খেপে যায় ইসলামিক সরকারের বিরুদ্ধে। তখন সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদ বিরোধী লড়াইয়ে উঠে আসা পড়শী দেশের নেতা সাদ্দাম ইরানকে ইসলামিক মৌলবাদীদের হাত থেকে মুক্ত করার ডাক দেয়। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল অব্দি চলমান ইরাক-ইরান যুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ উপরে উপরে সাদ্দামকে সমর্থন জানালেও গোপনে ইরানকে অস্ত্র বিক্রি করে নিজেদের অর্থ ভান্ডার পূর্ণ করতে থাকে যা ইরাক দখলের পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান এবং বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমে স্বীকার করে। 'এক অর্থনৈতিক ঘাতকের স্বীকারোক্তি' গ্রন্থের লেখক জন পার্কিংস তার লেখা 'আমেরিকান সাম্রাজ্যের গোপন ইতিহাস' বইয়ে ইরাক-ইরান যুদ্ধকে "অর্থনৈতিক ঘাতকদের আরেকটি বিজয়" বলে বর্ণনা করেছেন। 

https://drive.google.com/file/d/1-03jRG0tLpTygqHdgnuw7j3BileHKPE2/view?usp=drivesdk

তিনি আরো বলেছেন-

"ইরাক ইরানের জনগণের সাথে সব থেকে ভয়ঙ্কর বিশ্বাসঘাতকতা করেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা। আট বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে প্রতিটা নিরীহ মানুষের (১৫ লক্ষ) মৃত্যুতে দায়ী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। ইরাকি নেতা সাদ্দামকে তারা না কিনতে পেরেই এই যুদ্ধ আট বছর ধরে দীর্ঘায়িত করেছে৷"

https://drive.google.com/file/d/1-1D8APKMl9bLcdTPEEK4u6VymuMSQdpT/view?usp=drivesdk

১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধের শেষের দিকে 'ভিনসেন্স' নামের মার্কিন জাহাজ ইরানের একটি যাত্রীবাহী বিমানে মারণাস্ত্র হামলা চালিয়ে অনৈতিকভাবে ইরান উপকূলের সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে। 

https://en.m.wikipedia.org/wiki/USS_Vincennes_(CG-49)
 
সেই হামালায় ২৯৮ জন নিরীহ যাত্রী নিহত হয়। এই গোটা ৮ বছরে ১৫ লক্ষের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে ইরাক ও ইরান দুই দেশ মিলিয়ে। ১৯৯৭ সালে ইরানে বিপ্লবী গার্ডের (আইআরজিসি) কমান্ডার কাশেম সুলেমানি কুদস ফোর্সের প্রধান নির্বাচিত হয়। 

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Quds_Force

মূলত মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণের কাজের ভার তার কাঁধে পড়ে। সুলেনির নেতৃত্বে সিরিয়া, ইয়ামেন ও লেবানন যুদ্ধে অংশ নেয় কুদস ফোর্স এবং হামাস, ইসলামিক জিহাদ সহ মার্কিন লবি (ইজরায়েল, সৌদি) বিরোধী প্রতিটা বিদ্রোহী সশস্ত্র দলকে সামরিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র প্রদান করে বিভিন্ন ধরণের সহায়তা করা শুরু করে। 

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Islamic_Jihad_Organization

ইরান ২০০২ সালে সেপ্টেম্বর মাসে রাশিয়ার সাহায্য চায় সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার স্বার্থে। ইরানের বুশেহার শহরে নির্মিত হয় রাশিয়ান প্রযুক্তির সহায়তায় পারমানবিক চুল্লি। ২০০১ সালের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের প্রসঙ্গ এনে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরানকে 'শয়তানের অক্ষশক্তি' বলে অভিহিত করে। ২০০৩ সালে গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অজুহাত দেখিয়ে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় ইরানের উপর। ২০১৫ সালে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার মার্কিন প্রস্তাবে ইরান রাজি হলে সাময়িকভাবে ইরানের উপর থেকে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও তা পরবর্তীকালে ২০১৭ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ফের জারি করে। ২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরান সহ সাতটি মুসলিম দেশের সাধারণ নাগরিকদের ভিসা বাতিল এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের কুদস ফোর্সকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে ঘোষণা করলে ইরানের ইসলামিক সরকার তার বিরোধিতায় বাণিজ্যে ডলার (মার্কিন মুদ্রা) ব্যবহারে অস্বীকার করে এবং পুনরায় ২০১৮ সালে ফের আর্থিক নিষেধাজ্ঞা দেয় মার্কিন সরকার। এরপর ২০১৯ এবং ২০২০ সালে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা হয় ইরানের উপর কাশেম সুলেমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এতে ইরানের অর্থনীতি একদমই ধ্বংসের পথে চলে যায় এবং ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ইরানের আর্থিক সংকটে ভূগতে থাকা জনগণ, বিশেষত শ্রমিকশ্রেণী ও দরিদ্র কৃষক এবং বেকার যুবকরা ইসলামিক প্রজাতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখাতে থাকে জনগণের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে সামনে রেখে। মাশা আমিনীর হত্যাকে ঘিরে যে বিক্ষোভ দেখা দেয়, তার ভেতরে সেখানকার জনগণের দীর্ঘকালীন পর্যায়ে অর্থনৈতিক সংকটে ভুগতে থাকা ক্ষোভ পুর্জিভূত আছে, যা ইরানের প্রতিক্রিয়াশীল ইসলামিক সরকার এবং পরোক্ষভাবে দীর্ঘদিনের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে। তাই ইরানের ছোট ছোট শহরের রাস্তায় বহু মানুষ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী পোস্টার হাতে নিয়ে হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে পথে নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছে আলাদাভাবে। ইরানের জনগণের এই পরিস্থিতি হওয়ার পেছনে প্রধানত দীর্ঘকালীন ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শোষণের মূল অবদান রয়েছে, যারা ইরানের খনিজ সম্পদ নিয়ন্ত্রণে ও মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের একাধিপত্য অধিকার বিস্তারে আজও ইরানের উচ্চ মধ্যবিত্ত-মধ্যবিত্ত নারীদের ভেতরের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে তাদের ভেতর পশ্চিমা ভার্সনের নারী স্বাধীনতার মোহ জাগিয়ে তুলে, সাম্প্রচারিক কৌশলে বেঁধে শ্রেণীগত অবস্থান থেকে দূরে সরিয়ে গোটা ইরান নিয়ে ছেলেখেলা করছে কেবল ইসলামিক শাসনের সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার কাঁধে বন্দুক রেখে।

...........................................................................

শি জিন পিং, দেঙ জিয়াওপিং প্রভৃতি কাল্ট ফিগারের ব্যাপারে অবসেশনে আক্রান্ত বামেদের এটা পড়া উচিত। সাম্রাজ্যবাদী চীনকে দুনিয়ার নির্যাতিত মানুষের শত্রু হিসেবে উল্লেখ করে এই দলিল প্রকাশ করে সিপিআই (মাওবাদী)। দলিলে চীনকে 'একটি নয়া সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি' আখ্যা দেয় সিপিআই (মাওবাদী)। এই দলিলের শিরোনামে লেখা হয়েছে চিন ‘বিশ্বের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থারই অংশ’। উপমহাদেশের বুর্জোয়া ও এর দ্বারা প্রভাবিত রাজনৈতিক শিবিরের একটি বড় অংশ মনে করে বিশ্ব বাণিজ্যে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে চীন মাও এর পথ ছেড়ে ঠিকই করেছে! এর ফলেই নাকি মার্কিনিদের চোখে চোখ রেখে কথা বলার মতো অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করতে পেরেছে তারা! ভারতের মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটির বিশ্লেষণের ফসল এই দলিল তৈরি হয় ২০১৭ সালে। এতদিন তেলুগু ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় তা প্রকাশ করা হয়নি। নিজেদের এই বিশ্লেষণ সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ইংরেজিতে অনুবাদ করে সিপিআই (মাওবাদী)। দলিলের মুখবন্ধে মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটি জানিয়েছে, সাম্রাজ্যবাদী চিন দুনিয়ার নির্যাতিত মানুষের শত্রু। বলা হয়েছে বিশ্বজুড়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে যারা লড়ছে, সেই মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী এবং মাওবাদী দলগুলোর যুদ্ধের নিশানা হবে বর্তমান চীন। মাওবাদীদের মতে, সাম্রাজ্যবাদী চীন পিছিয়ে পড়া দেশে যুদ্ধাস্ত্র ও পুঁজি রফতানি এবং অসম বাণিজ্য চাপিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে দেশগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদকে গ্রাস করছে। সেসব দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও নাক গলাচ্ছে তারা। এমনকি সেসব দেশে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত সুযোগেরও অপেক্ষা করছে। বস্তুত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে চীন। ভারতের সিপিএম ছাড়াও বাংলাদেশের কিছু নির্বাচনপন্থী বাম সংগঠনের মতে এখনও চীন সমাজতান্ত্রিক! চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তাদের দেশকে ‘চৈনিক বৈশিষ্ট্য সমেত সমাজতান্ত্রিক’ আখ্যা দিয়েছে! কিন্তু মাওবাদী তাত্ত্বিকরা এই অভিধা নিয়ে তীব্র কটাক্ষ করেছেন তাদের দলিলে।

https://terabox.com/s/1Q4H65IIpreA_ud0k2XajSg?fbclid=IwZXh0bgNhZW0CMTEAAR0FRpycywtmKVRdcN3I6gInRVcNufnUVI5t7CLTGqVYKzO82ApqkCFrdMk_aem_OCikosyMPck1-W5eExwdJQ

নির্বাচনপন্থীদের মহা প্রিয়পাত্র শি জিনপিং'কে ট্রাম্প 'গ্রেট লিডার' বলে উল্লেখ করেছিলেন যখন তিনি ২০১৭ সালের ১৯তম পার্টি কংগ্রেসে আবারো সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন! এমনকি ট্রাম্প তাকে রাজার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন! [সূত্র: গার্ডিয়ান, ২৫ অক্টোবর, ২০১৭] 

তথাকথিত এই কমিউনিস্ট নেতা আজ পর্যন্ত কতবার উত্তর কোরিয়াকে আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বন্ধের আহবান জানিয়েছে সেই খবর কি নির্বাচনপন্থী বামেরা রাখে? শুধু তাই নয়, এই নেতা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটা সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সব ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

.......................................................................


নির্বাচনপন্থী বামেদের চরিত্র দেশে দেশে একই। বাংলাদেশের বামেরা পশ্চিমা বিরোধী আসাদ সরকারের পক্ষে গলাবাজি করলেও নিজের দেশের আমেরিকা বিরোধী সরকারকে সরাতে যেমন জঙ্গিদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলো, সিরিয়ার বামেরাও আসাদকে সরাতে 'ন্যাশনাল কোঅর্ডিনেশন কমিটি' নামের আড়ালে জঙ্গিদের সাথে সমান তালে কাজ করে যাচ্ছে একেবারে প্রথম থেকেই। এসব বামেরা যে নিয়মিত ইজরায়েল আর পশ্চিমাদের সাহায্য পাচ্ছে তা অনেকগুলো গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।


এবার বাসদের কোরবানি উৎযাপন দেখা যাক-



Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]