ইয়াজিদি সম্প্রদায় [পর্ব - এক]

 

আইসিস খুনিদের বহু আগে থেকেই আব্রাহামিক ধর্মগুলোর অনুসারীরা, বিশেষ করে মুসলিমরা ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে। যেমন- 'ইয়াজিদি' শব্দটা এসেছে 'ইজদ' থেকে, যার অর্থ 'দেবদূত'। অথচ এরা প্রচার করেছে 'ইয়াজিদি' শব্দটি এসেছে উমাইয়া বংশের দ্বিতীয় খলিফা ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া'র নাম থেকে যিনি মুসলিমদের কাছে ঘৃণিত হলেও তাদের রটনা অনুযায়ী ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের কাছে দেবতুল্য ছিলেন! তাছাড়া এই ধর্ম বহু প্রাচীন, যা এমনকি জরাথ্রুস্ট ধর্মের আগেই পৃথিবীতে বজায় ছিল। তাদের উপাস্য মেলেক তাউস এর 'তাউস' শব্দটি গ্রিক, যার অর্থ 'সৃষ্টিকর্তা'। অথচ মুসলিম ও খ্রিস্টানদের কাছে মেলেক তাউস হচ্ছে আজাজিল নামক শয়তান! এই সম্প্রদায় প্রতি ২৪ ঘন্টায় দুইবার প্রার্থনা করে এবং তাদের ধর্মগ্রন্থ দুইটি- 

#কিতাব আল জিলওয়াহ 

#মিশেফা রেস 

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Yazidi_Book_of_Revelation

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Yazidi_Black_Book 

তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, সমস্ত সৃষ্টির পূর্বে কিতাব আল জিলওয়াহ মেলেক তাউসের কাছে সংরক্ষিত ছিল। পরে তিনি সেটি আবেদ তাউসের কাছে প্রেরণ করেন এবং দায়িত্ব দেন সৃষ্টিকর্তার বাণী পৃথিবীর কিছু সংরক্ষিত মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে।

আব্রাহামিক ধর্মগুলোর মতোই ইয়াজিদি ধর্মের কিতাবগুলোর মধ্যে প্রথমটিতে অন্য সম্প্রদায়ের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং অন্যান্য ধর্মগুলোর কিতাবগুলো বাতিল করে দেয়া হয়েছে। তবে এই প্রথম কিতাবে পুনর্জন্মের কথা আছে আর বিভিন্ন প্রজন্মের পথপ্রদর্শকের নীতিগুলোর পরিবর্তনশীলতার কথা আছে। তাদের এই কিতাবে সরাসরি আব্রাহামিক তিন ধর্মের অনুসারীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছে নাম উল্লেখ করেই। এই তিন ধর্মের অনুসারীদের সামনে ঈশ্বরের বাণী প্রদর্শনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে এই কিতাবে, তাদের দ্বারা ঈশ্বরের বাণী পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার আশংকা প্রকাশ করে। প্রথম কিতাবটিতে আব্রাহামিক ধর্মগুলোর মতোই পদে পদে গজবের ভয় দেখানো হয়েছে।

এবার আসা যাক দ্বিতীয় কিতাবের কথায়। সেখানে বলা আছে ঈশ্বর তার গুপ্ত ভান্ডার থেকে একটি সাদা মুক্তা ও 'আঙ্গার' নামক একটি পাখি সৃষ্টি করেন। তিনি সাদা মুক্তাটি পাখিটির পিছে রেখে দিয়েছিলেন যা এই অবস্থায় প্রায় ৪০ বছর ছিল। প্রথমদিন (রবিবার) তিনি মেলেক তাউস'কে (সবকিছুর প্রধান, মুসলিমরা ইবলিশ যে ফেরেস্তাদের সর্দার ছিল সেই কনসেপ্ট এখান থেকে মেরেছে) সৃষ্টি করেন, সোমবার তিনি সৃষ্টি করেন মেলেক দারদিল'কে (শেখ হাসান বলা হয়), মঙ্গলবার সৃষ্টি করেন মেলেক ইসরাফিল'কে (শেখ শামস বলা হয়), বুধবার সৃষ্টি করেন মেলেক মিকাঈল'কে (শেখ আবু বকর বলা হয়), বৃহস্পতিবার সৃষ্টি করেন মেলেক আজরাইল'কে (সাজাদ আদ দ্বীন বলা হয়), শনিবার সৃষ্টি করেন মেলেক নুরেল'কে (ইয়াদিন বলা হয়)।

এরপর তিনি সাত আসমান, পৃথিবী, সূর্য ও চাঁদ সৃষ্টি করেন। অন্যদিকে সাজাদ আদ দ্বীন সৃষ্টি করেন বিভিন্ন প্রাণী। সৃষ্টিকর্তা এসব তার জামার পকেটে রেখেছিলেন। কোনো একসময় সাদা মুক্তাটি বেরিয়ে আসে ফেরেস্তাদের মাধ্যমে। ঈশ্বর মুক্তাটির প্রতি চিৎকার শুরু করলে সেটি চার টুকরা হয়ে মাঝে পানি ঢুকে যায়, যা পরবর্তীতে মহাসাগর হয়ে যায়। বিশ্ব গোল ছিল, কিন্তু বিভক্ত ছিল না। এরপর তিনি গ্যাব্রিয়েলকে সৃষ্টি করে পৃথিবীর চারটি কোণ ঠিক করতে পাঠিয়ে দেন। ঈশ্বর একটি পাত্র তৈরী করে এটির মধ্যে ত্রিশ হাজার বছর ধরে অবতরণ করেন। এরপর তিনি লালিশ পাহাড়ে আসেন।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Lalish

পরে তিনি কঠিন ভূমি সৃষ্টি করলেও এটি কাঁপতে লাগলো। সেসময় তিনি মুক্তাটির দু'টি অংশ নিয়ে আসতে আদেশ দেন। এক টুকরো পৃথিবীর নিচে স্থাপন করে তার মধ্যে সূর্য ও চাঁদ স্থাপন করেন, মুক্তার বিক্ষিপ্ত অংশগুলো দিয়ে নক্ষত্র সৃষ্টি করেন। এই নক্ষত্রগুলো স্বর্গে ঝুলিয়ে দেন অলংকার হিসেবে। অন্যদিকে ফলের গাছ, নানা রকম বৃক্ষরাজি ও পাহাড় সৃষ্টি করেন পৃথিবীর অলংকার হিসেবে। এরপর তিনি কার্পেটের উপর নিজের সিংহাসন স্থাপন করেন।

তারপর ঈশ্বর দেবদূতদের আদম এবং হাওয়া সৃষ্টি করার কথা জানায় যারা পৃথিবীতে পৃথক পৃথক সম্প্রদায় হিসাবে হাজির হবে। অন্যদিকে আজাজিল বা মেলেক তাউসের সম্প্রদায় ইয়াজিদি নামে পরিচিত হবে। তারপর তিনি শেখ আদি বিন মুসাফিরকে সিরিয়া থেকে ডেকে পাঠালেন এবং যিনি মাউন্ট লালিসে বসতি স্থাপন করেন। এরপর ঈশ্বর কালো পাহাড়ে নেমে আসেন। তিনি চিৎকার করে ত্রিশ হাজার ফেরেশতা সৃষ্টি করলেন এবং তাদের তিনভাগে বিভক্ত করলেনতারা সবাই চল্লিশ হাজার বছর ঈশ্বরের প্রার্থনা করলো। এরপর তাদের মেলেক তাউসের কাছে প্রেরণ করা হলো। তারা মেলেক তাউসের সাথে স্বর্গে অবস্থান করতে লাগলো। ঠিক সেসময় ঈশ্বর পবিত্রভূমি আল কুদস এ নেমে আসেন। তিনি গ্যাব্রিয়েলকে নির্দেশ দিলেন পৃথিবী থেকে মাটি, বাতাস, আগুন এবং পানি নিয়ে আসার জন্য। এগুলো মিশ্রিত করে তিনি আদমকে সৃষ্টি করলেন এবং তার মধ্যে আত্মা ফুৎকার করলেন। এরপর তিনি গ্যাব্রিয়েলকে নির্দেশ দিলেন আদমকে স্বর্গে নিয়ে যেতেঈশ্বর আদমকে একটি নিষিদ্ধ গাছ দেখালেন এবং তাকে গাছটি থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে বললেন। স্বর্গে আদম প্রায় ১০০ বছর অবস্থান করেছিল। এরপর মেলেক তাউস যখন ঈশ্বরকে আদমের বংশবৃদ্ধির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন, তখন ঈশ্বর জবাব দিয়েছিলেন তিনি নিষিদ্ধ ফল সংক্রান্ত ব্যাপারটি মেলেক তাউসের উপর ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর মেলেক তাউস আদমকে বোঝালেন যে নিষিদ্ধ ফলটি খেলে তার উপকার হবে আদম ফলটি খাওয়ার সাথে সাথে তার পেট ফুলে উঠলো। মেলেক তাকে বাগান থেকে বের করে স্বর্গের অভ্যন্তরে নিয়ে গেলেন। ঈশ্বর একটি পাখি তার কাছে প্রেরণ করেন এবং পাখিটি তার মলদ্বার তৈরি করে দিলে আদম স্বস্তি পেয়েছিলেন। এই ঘটনার পর গ্যাব্রিয়েল আদমের কাছ থেকে প্রায় ১০০ বছর দূরে থাকেন। আদম এজন্য কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। এরপর ঈশ্বর গ্যাব্রিয়েলকে নির্দেশ দিলেন আদমের বাম পাজরের বাঁকা হাড় থেকে হাওয়াকে সৃষ্টি করতে। কিছুদিন পর হাওয়া আদমকে চাপ দিতে থাকে ঈশ্বরকে এটা জিজ্ঞেস করতে যে, কিভাবে তারা বংশবৃদ্ধি করবে এবং তাদের প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি করবে। এরপর আদম ও হাওয়া সিদ্ধান্ত নিলো তারা তাদের বীজ দু'টি আলাদা আলাদা জারের মধ্যে আটকে রাখবে। এরপর তারা নয় মাস অপেক্ষা করার পর আদমের জারের মুখ খুলে দেখলো সেখানে একটি মেয়ে ও একটি ছেলে শিশু ছিল। কিন্তু হাওয়ার জারে ছিল পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত কীট। এরপর ঈশ্বর আদমের জারের শিশুদের দুধ পান করানোর জন্য আদমের স্তনের বিকাশ ঘটান। এজন্যই পুরুষদের স্তনবৃন্ত থাকে। তবে এই স্তনের কার্যকারিতা সীমিত সময়ের জন্য ছিল। হাওয়া তার জারের অবস্থা দেখে ঈশ্বরের কাছে কাঁদতে কাঁদতে আবেদন জানায় যেন সে বাচ্চা জন্ম দিতে পারে। এরপর ঈশ্বর তাকে আদম এর কাছে যেতে বলেন এবং উভয়ের বীজ একটি জারে একত্রে রাখতে নির্দেশ দেন। এরপর সেই জারটি থেকে জন্ম নিলো একটি ছেলে ও একটি মেয়ে

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]