ইয়াজিদি সম্প্রদায় [পর্ব - দুই]

 

ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের অনুসারীদের কাছে প্রথম নবিরা হচ্ছে শিস, নূহ এবং ইউনুস; যারা কেবল আদম থেকে আগত। তাদের মিথ অনুযায়ী এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল যেখানে একজন মহিলা তার স্বামীকে 'স্বামী' হিসেবে অস্বীকার করেছিল। সমস্যাটির সমাধানে একজন ধার্মিক এই বিধান দিয়েছিল যে, প্রতিটি বিয়ের সময় ড্রাম এবং পাইপ বাজাতে হবে সাক্ষী হিসেবে। এটিই বিয়ের আইনগত বৈধতা দিবে। তারপর মেলেক তাউস ইয়াজিদিদের জন্য পৃথিবীতে নেমে আসেন এবং তাদের জন্য আলাদা রাজ্য সৃষ্টি করেন। প্রাচীন রাজাদের পাশাপাশি আসিরিয়া, নিসরক [নাসির আদ দ্বীন], কামুস, যানি মেলেক [ ফাহার আদ দ্বীন] এবং আর্টিমেস [মেলেক শামস আদ দ্বীন] তাদের শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিল। এদের পরেও আরো দুইজন রাজা ইয়াজিদিদের শাসন করেছিল- সাবুর এবং দ্বিতীয় সাবুর

যিশুখ্রিস্টের আবির্ভাব এর পূর্বে রাজা আহাব তাদের শাসন করতো। আহাব বিলজাবিব নামক এক দেবতার আরাধনা করতো। বর্তমানে আহাবকে ইয়াজিদিরা 'পীর বাবা' বলে সম্পাদন করে

ব্যাবিলনে তাদের বাহতনাসার নামে একজন রাজা ছিল। পার্সিয়ানদের মধ্যে তাদের আউরাস নামে একজন রাজা ছিল কনস্টান্টিনোপলে তাদের এগ্রিলাস নামে একজন রাজা ছিল

তাদের ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে-

"স্বর্গ এবং পৃথিবী সৃষ্টির পূর্বে ঈশ্বর একটি সমুদ্রের উপর ছিলেন; আমি তোমাদের আগেই জানিয়েছি ঈশ্বর একটি পাত্র বানিয়েছিলেন এবং সেখানে প্রায় ৪০ বছর পরিভ্রমণ করেন। এই পরিভ্রমণকে বলা হয় কুনসিয়াত যার অর্থ সমুদ্রের মধ্যে নিজেকে উপভোগ করা। এরপর তিনি সাদা পার্ল সৃষ্টি করেন এবং এটার উপর ৪০ বছর শাসন করেন। অতঃপর এই পার্লের উপর তিনি তার ক্রোধ প্রকাশ করেন এবং এটাকে লাথি মারেন; পাহাড়গুলো তার কান্না এবং ক্রোধের প্রকাশ দেখে অবাক হয়ে গেলো। স্বর্গ থেকে ধোঁয়া নির্গত হতে থাকলো। অতঃপর ঈশ্বর স্বর্গে আহরণ করলেন কোন প্রকার স্তম্ভ ছাড়াই তারপর তিনি মাটিতে পড়লেন। এরপর তিনি কলম দিয়ে লিখতে শুরু করলেন সমস্ত সৃষ্টির বিবরণ।"

শুরুতে তিনি নিজের থেকে এবং তার আলো থেকে ছয়টি দেবতা সৃষ্টি করেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে বলেন-

"এখন আমি আকাশ সৃষ্টি করেছি। আপনারা ঊর্ধ্ব জগতে উঠে আসেন এবং কিছু একটা সৃষ্টি করেন।"

এরপর দ্বিতীয় দেবতা আরোহণ করে সূর্য সৃষ্টি করলেন, তৃতীয় দেবতা চাঁদ, চতুর্থ দেবতা স্বর্গের প্রবেশদ্বার, পঞ্চম দেবতা স্বর্গ এবং সপ্তম দেবতা নরক সৃষ্টি করেন

ইয়াজিদিদের বিশ্বাস অনুযায়ী, নূহ এর বন্যা ছাড়াও আরো একটি বন্যা হয়েছিল পৃথিবীতেতাদের সম্প্রদায় নওয়ামির উত্তরসূরি। ইয়াজিদিরা তাকে মেলেক মিরান বলে থাকে। তিনি ছিলেন শান্তির রাজা। অন্যান্য সম্প্রদায় হ্যামের বংশধর, যিনি তার পিতাকে তুচ্ছ করেছিলেন। জাহাজটি আইন সিফনি এসে থেমে যায়, যা মাসুল শহর থেকে পাঁচ পাড়াসাং দূরে। প্রথম বন্যার কারণ ছিল তারা বিদ্রুপ করেছিল। আর এই বিদ্রুপকারী সম্প্রদায় হচ্ছে ইহুদি এবং আদম-হাওয়ার মিলন থেকে অবতীর্ণ সম্মিলিত সম্প্রদায়। আর ইয়াজিদিরা ছিল শুধুমাত্র আদমের উত্তরসূরীদ্বিতীয় বন্যাটির কারণ ইয়াজিদিরা। সমুদ্রের পানি বাড়তে শুরু করেছিল এবং জাহাজ ভাসতে শুরু করলো। সমুদ্রের উচ্চতা এত ছিল যে, পানি সিনজার মাউন্টের উপর দিয়ে বয়ে গেলো। জাহাজটি ভাসতে ভাসতে মাউন্ট জুডি পর্বতে গিয়ে থেমে গেলো। ততদিনে জাহাজের মধ্যে অবস্থানরত সর্প জাতীয় জীব বড় হয়ে গিয়েছিল। সেগুলো মানুষদের আক্রমণ করা শুরু করলো। পরে সেগুলোকে জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং তাদের ছাই থেকে মাছি সৃষ্টি হয়। বন্যার সময় থেকে এখন অবধি পৃথিবী প্রায় ৭০০০ বছর অতিক্রম করেছে। প্রতি এক হাজার বছর অন্তর সাত জন ঈশ্বর তাদের আইন, নীতি-বিধান প্রণয়ন করেন এবং আবার ফিরে যান। ইয়াজিদিদের বিশ্বাস অনুযায়ী তারা পৃথিবীতে মানুষের সাথে বসবাস করেন। তাদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পবিত্র স্থান রয়েছে। সর্বশেষ ঈশ্বর ইয়াজিদিদের জন্য একজন শেখ নির্বাচিত করেছিলেন। তিনি তখন কুর্দিশ ভাষায় কথা বলেছিলেন তিনি নবী মুহাম্মদকে আলোকিত করেছিলেন। নবী মুহাম্মদের মুয়াবিয়া নামে এক সচিব ছিল। মুহাম্মদের হঠাৎ মাথাব্যথা দেখা দেয়। এরপর তিনি মুয়াবিয়াকে তার মাথা ন্যাড়া করে দিতে বলেন। মুয়াবিয়া জানতো না কিভাবে মাথা ন্যাড়া করতে হয়। সেজন্য সে মুহাম্মদের মাথা কেটে ফেলেছিল। মুয়াবিয়া দ্রুত রক্ত চেটে খেয়ে ফেলে যেন মাটিতে না পড়ে। মুহাম্মদ মুয়াবিয়াকে এই কান্ডের জন্য অভিশাপ দিয়ে বলেছিলেন যে, মুয়াবিয়া এমন এক সম্প্রদায়ের জন্ম দিবে যারা মুহাম্মদের অনুসারীদের বিরোধিতা করবে। মুয়াবিয়া ভয় পেয়ে জবাব দিয়েছিল সে আর বিয়ে করবে না। ঈশ্বর মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে বিচ্ছু প্রেরণ করলেনবিচ্ছুর কামড়ে তার সারা শরীরে বিষ ছড়িয়ে পড়ে এবং মুখে ফেটে যাচ্ছিল। চিকিৎসক তাকে পরামর্শ দেয় যে, এই বিষ থেকে বাঁচতে হলে তাকে বিয়ে করতে হবে। মুয়াবিয়া অনেক চিন্তা করে একজন ৮০ বছরের বৃদ্ধাকে বিয়ের সম্মতি জানায়। সে ভেবেছিল এই বৃদ্ধার বাচ্চা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। কিন্তু বিয়ের পর অলৌকিকভাবে সেই বৃদ্ধা ২৫ বছরের যুবতীদের রূপান্তরিত হয়। মহিলাটি গর্ভবতী হয়। এরপর ইয়াজিদিদের প্রভু ইয়াজিদের জন্ম হয়ইয়াজিদিদের বিশ্বাস অনুযায়ী ইয়াজিদ স্বর্গ থেকে এসেছিল। অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা ইয়াজিদকে উপযুক্ত সম্মান দেখায়নি। ইয়াজিদ হচ্ছে ৭ দেবতার অন্যতম। ইয়াজিদিদের তার নাম এবং তার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কোনো কিছু [স্যাটান, ক্যাইতান, সার, সাট] উচ্চারণ করার অধিকার নেই

ইয়াজিদিরা Hass অর্থাৎ লেটুস খায় না। কারণ এটার উচ্চারণ কিছুটা তাদের নবী Hassiah এর মতো। তারা মাছ খায় না এই বিশ্বাসের কারণে যে, মাছ তাদের নবী ইউনুসকে আশ্রয় দিয়েছিল। তাদের জন্য ময়ূর নিষিদ্ধ এজন্য যে, প্রাণীটি মেলেক তাউসের প্রতীক। লাউ জাতীয় সবজিও ইয়াজিদিরা খায় না। তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে  শরীরে পানি ঢালে না, বসা অবস্থায় কাপড় পরিধান করে না, তাদের গোসলখানায় প্রবেশের নিয়ম আব্রাহামিক তিন ধর্মের অনুসারীদের থেকে আলাদা। ইয়াজিদিদের বিশ্বাস অনুযায়ী মেলেক তাউস তাদের কাছে জ্ঞানের গুপ্ত ভান্ডার হস্তান্তর করে স্বর্গে ফিরে যান

সাত জন ঈশ্বর সম্মিলিতভাবে একটি সানজাক তৈরি করে সোলাইমানকে প্রদান করেছিলেন। সোলাইমানের মৃত্যুর পর ঐ সানজাক ইয়াজিদিদের রাজার কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেসময় প্রভু ইয়াজিদ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পরে তিনি সেই সানজাক গ্রহণ করেন। তিনি ইয়াজিদিদের সানজাকটি দান করে কুর্দিশ ভাষায় দু'টি গান রচনা করেন। 'Hallelujah to the jealous god' গাইতে গাইতে তারা টিমব্রেল এবং পাইপগুলো নিয়ে সানজাকগুলোর সামনে মার্চ করেনসানজাকগুলো ইয়াজিদের সিংহাসনে আরোহিত আমিরের সাথে থাকেসানজাকগুলো প্রেরণ করার আগে কাওয়ালরা আমির এবং শেখ [ যিনি আসিরিয়দের দেবতা শেখ নাসির আদ দ্বীনের প্রতিনিধিত্ব করেন] এর সাথে একত্রিত হয়। তারা সানজাকগুলো দর্শন করেন। এরপর তারা এগুলোকে কাওয়ালদের নেতৃত্বে নির্দিষ্ট স্থানে প্রেরণ করেন। এদের মধ্যে একটিকে Halantaneye, একটিকে আলেপ্পো, একটিকে রাশিয়া এবং একটিকে দিনজারে পাঠানো হয়সানজাকগুলোকে চারজন কাওয়াল এর কাছে চুক্তিবদ্ধভাবে হস্তান্তর করা হয়। এগুলোকে নির্দিষ্ট স্থানে পাঠানোর পূর্বে শেখ আদির সমাধির কাছে নিয়ে আসা হয়। এখানে গান ও নাচের মাধ্যমে সানজাকগুলোকে ব্যাপটাইজ্ড করানো হয়। এরপর প্রত্যেক কাওয়াল শেখ আদির সমাধি থেকে ধুলো বা মাটি নিয়ে ছোট ছোট বাদামের আকারের গোলক তৈরি করেন এবং সেগুলোকে আশীর্বাদস্বরূপ সানজাকগুলোর সাথে রাখেন। কাওয়াল কোনো নির্দিষ্ট শহরে পৌঁছালে তিনি একজন বার্তাবাহক প্রেরণ করেন। বার্তাবাহক শহরটির জনগণকে প্রস্তুত করে শ্রদ্ধার সাথে কাওয়াল ও সানজাকটিকে গ্রহণ করার জন্য। প্রত্যেকে অভিজাত পোশাক পরিধান করে এবং ধূপ হাতে সানজাকটিকে স্বাগত জানাতে বেরিয়ে আসে, মহিলারা গান গাইতে থাকে, সকলে কাওয়ালকে সাধ্যমত রূপা উপহার দেয়

এই চারটি সানজাকের পাশাপাশি আরও তিনটি সানজাক রয়েছে। এই তিনটি সানজাককে নিরাময়ের উদ্দেশ্য নিয়ে পবিত্র স্থানে স্থাপন করা হয়। এদের মধ্যে প্রথম দুইটি শেখ আদির সমাধিক্ষেত্রে এবং তৃতীয়টি মশুল থেকে চার ঘন্টার দূরত্বে অবস্থিত বাহাজাইন গ্রামে রয়েছে। প্রতি চার মাস পরপর কাওয়ালরা ভ্রমণ করেন। এদের মধ্যে একজনকে অবশ্যই আমিরের প্রদেশে ভ্রমণ করতে হয়। ভ্রমণকারী যতবার বাইরে চান ততবার তাদের অবশ্যই সুমাক যুক্ত পানি এবং তেল দ্বারা নিজেদের অভিষিক্ত করতে হয়। এছাড়া প্রতিটি মূর্তিতে বাতি জ্বালাতে হয় তাদের

নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে বলা হয় Sersaili, এর অর্থ 'বছরের শুরু'। এটি ইয়াজিদিরা এপ্রিল মাসের প্রথম বুধবার পালন করে। দিনটিতে প্রত্যেক বাড়িতে মাংস রান্না করতে হয়। সম্ভ্রান্তদের জন্য গরু বা মেষ এবং গরিবদের জন্য একটি মুরগি বা অন্য কিছু জবাই করা আবশ্যক। এগুলোকে নববর্ষের আগের রাতে রান্না করা হয়। নববর্ষের দিনের শুরুতে এই খাদ্য গ্রহণ করাকে আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য করা হয়। নতুন বছরের প্রথম দিন মৃতদের সমাধিতে দান করা উচিত মনে করা হয়। এই দিনে সকল বয়সের ইয়াজিদি নারীরা মাঠে একত্রিত হয়ে লালচে রংয়ের ফুল সংগ্রহ করে। তারা ফুলগুলো তিনদিন নিজের কাছে রেখে এগুলোকে বেঁধে দরজার সামনে ঝুলিয়ে দেয়। এগুলোকে ঘরে থাকা প্রতিটি ব্যক্তির ব্যাপ্টিজম এর প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। নতুন বছরের শুরুতে প্রতিটি বাড়ির প্রবেশদ্বার লিলি ফুল দিয়ে সাজানো হয়। এই দিনে ইয়াজিদি নারীরা তাদের গৃহের সামনে দিয়ে যাওয়া অভাবী ও ক্ষুধার্ত মানুষদের ভোজন করায়। এই দিন কাওয়ালরা কুর্দিশ ভাষায় গান গাইতে গাইতে ট্রিমবেল হাতের সমাধিক্ষেত্র প্রদক্ষিণ করেন এবং কাজটির জন্য তাদের অর্থ প্রদান করা হয়। নববর্ষের দিনে কোনো আনন্দের বাজনা বাজানো নিষিদ্ধ, কারণ তাদের ধারণা অনুযায়ী এই দিনে ঈশ্বর তার সিংহাসনে আরোহন করে পরবর্তী বছরের জন্য পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করেন, সবাইকে নিজের দিকে আহবান করেন এবং তিনি তাদের সংবাদ দেন যে তিনি গান এবং প্রশংসার সাথে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হবেন। এই দিনে ইয়াজিদিরা উঠে দাঁড়িয়ে তাদের খাবারের কিছু অংশ স্রষ্টার উদ্দেশ্যে নিবেদন করে। এরপর ঈশ্বর তার নিজ সিল দ্বারা মোহরায়িত করেন। এই দিন ঈশ্বর সিদ্ধান্ত নেন কোন ঈশ্বর পরবর্তীতে অবতীর্ণ হবেন এবং তাকে নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী যেকোনো কিছু করার ক্ষমতা প্রদান করেনইয়াজিদিদের বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের ঈশ্বর ভালো কর্ম এবং দানকে রোজা ও প্রার্থনার চাইতে বেশি পছন্দ করেন। তাদের মধ্যে যেকোনো মূর্তি পূজা রোজার চাইতে উত্তম। কেউ কেউ গ্রীষ্ম বা শীতকালে তাদের চল্লিশ দিনের রোজার পর একজন কোচাককে ভোজন করায়। সে যদি বলে এই বিনোদনটি সানজাককে দেয়া তার ভিক্ষা, তবে তাকে রোজা থেকে মুক্তি দেয়া হয় না

যদি তিথি সংগ্রাহকরা জানতে পারে কেউ নিজের তিথি পুরোপুরি প্রদান করেনি, তাহলে অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা তাকে চাবুক মারতে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত চাবুক চলতে থাকে। প্রদানকৃত অর্থগুলো শত্রুদের সাথে লড়াই করা এবং ইয়াজিদিদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কাজে ব্যবহার করা হয়

প্রতি শুক্রবার মূর্তির উদ্দেশ্যে প্রচুর উপহার নিবেদন করা হয়। এসময় একজন চাকর একজন কোচাকের বাড়ির ছাদে অবস্থান করে এবং চারপাশের সবাইকে এই বলে আহবান করে যে, "ভোজনের জন্য এটি একজন নবীর পক্ষ থেকে আহ্বান"। প্রত্যেকে ঘোষণাটি গুরুত্ব সহকারে শুনে মাটিতে চুম্বন করে

ইয়াজিদিদের আইন অনুযায়ী কোনো কাওয়াল মুখে ক্ষুর চালাতে পারবেন নাইয়াজিদিদের বিয়ের সময় কোচাকের ঘর থেকে এক টুকরো রুটি সংগ্রহ করে সেটি বর ও কনের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দেয়া হয়। তারা আশীর্বাদস্বরূপ রুটির পরিবর্তে শেখ আদির সমাধির মাটিও খেতে পারে। বছরের প্রথম মাস বিধায় এপ্রিল মাসে বিয়ে নিষিদ্ধ, যা কাওয়ালদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কোনো সাধারণ ইয়াজিদি কাওয়াল এর কন্যাকে বিয়ে করতে পারে না। প্রত্যেকে কেবল তাদের নিজ শ্রেণী থেকে স্ত্রী নির্বাচনের অধিকার রাখে। একজন ইয়াজিদি পুরুষ একের অধিক স্ত্রী গ্রহণ করতে পারলেও এক বছরের অন্তর রাখা বাধ্যতামূলক। সাধারণ ইয়াজিদিদের ১০ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে বিয়ে করতে হবে। বরের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথে কনেকে প্রতিটি মূর্তির মাজার দর্শন করতে হবে। এমনকি সেটা খ্রিস্টানদের গির্জা হলেও কনেকে একই কাজ করতে হবে। বরের বাড়িতে পৌঁছানোর পর বর কনের উদ্দেশ্যে একটি ছোট পাথর নিক্ষেপ করে। কাজটি দ্বারা বোঝানো হয় কনে এখন তার কর্তৃত্বে। কনের মাথার উপর এক টুকরো রুটি ভাঙ্গা হয়, যা দ্বারা বোঝানো হয় কনে গরিব ও অভাবীদের প্রতি সর্বদা সদয় থাকবে। ইয়াজিদিরা তাদের স্ত্রীদের সাথে প্রতি মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার প্রথম রাত্রি যাপন করে না। কেউ এই আইন লঙ্ঘন করলে সে কাফের হিসেবে গণ্য হয়। যদি কোনো পুরুষ তার প্রতিবেশীর স্ত্রী, মা, বোন বা তার নিজের স্ত্রীকে চুরি করতে সক্ষম হয় তবে সে তাদের যৌতুক প্রদান করতে বাধ্য নয়। কারণ তারা তখন তার জন্য লুটের সম্পত্তিতে পরিণত হয়। এই সম্প্রদায়ের কন্যারা তাদের পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে না। একজন যুবতী নারীকে জমির মতোই বিক্রি করা যায়। কোনো মেয়ে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে ঐ বিয়ে থেকে মুক্তি পেতে নিজের পিতাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হয়। এই অর্থ তাকে অবশ্যই নিজের শ্রমে অর্জন করতে হয়

মুসলিমদের বর্বর আইন অনুযায়ী, কোনো অমুসলিম সম্প্রদায়কে তাদের সাথে চুক্তি করতে হবে এবং কর প্রদান করতে হবে। নইলে হয় তাদের মুসলিম হয়ে যেতে হবে, নয়তো মুসলিমরা তাদের হত্যা করার অধিকার রাখে। ইয়াজিদিদের সাথে মুসলিমদের কোনো চুক্তি নেই দেখে ইয়াজিদিদের উপর চালানো গণহত্যাকে জায়েজ বলে ফতোয়া দেয়া হয়েছে। কোরআনের আইন অনুযায়ী মুসলিম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্মের অনুসারীরা ইসলামী রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে পারবে না। কিন্তু তুর্কি সরকার নিজেদের স্বার্থে সৈনিক পর্যায়ে ইয়াজিদিদের যোগদানের সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু ইয়াজিদিরা অভিযোগ করেছিল যে, তুর্কি মুসলিম সৈন্যরা যে শপথ গ্রহণ করে তা তাদের ধর্মীয় আইনের বিরোধী। এছাড়া তুর্কি সৈন্যদের ইউনিফর্মের নীল রঙের অংশটি এবং ইয়াজিদিদের যে ধরনের খাবার দেয়া হয় সেগুলো তাদের ধর্মীয় আইনের বিরোধী

১৮৩২ সালে রাওয়ামান্দুজ বেগ 'শেখাহান' জেলার আশেপাশের পাহাড়ের বেশিরভাগ কুর্দি উপজাতিগুলোকে তার হুকুমের আওতায় একত্রিত করেছিল। সে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল এই সম্প্রদায়কে দুনিয়া থেকে মুছে দিতে। সম্প্রদায়টির তৎকালীন আমির আলী বেগের বাহিনী রাওয়ামান্দুজ বেগের বাহিনীর চেয়ে সংখ্যায় কম ছিল। আলী বেগকে হত্যা করা হয় পরবর্তীতেশেখাহান জেলার কুর্দিরা মশুল পালিয়ে গিয়েছিল। সময়টি ছিল বসন্তকাল এবং নদীর পানি প্লাবিত হয়ে ব্রিজটি দূরে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের কিছু অংশ নদী অতিক্রম করতে সক্ষম হলেও অধিকাংশ ইয়াজিদি নদীর বিপরীত দিকে তাল আর্মাসে সমবেত হয়রাওয়ামান্দুজ বেগ তাদের অনুসরণ করে প্রচন্ড নিষ্ঠুরতার সাথে গণহত্যা চালিয়েছিল। এই গণহত্যার সময় বর্বর মুসলিমরা উল্লাস প্রকাশ করছিল

গণহত্যার কিছুদিন পর বাগদাদের সুলাইমান পাশা, লুতফি আফেন্দির নেতৃত্বে সিঞ্জারে বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। তিনি জাবালে সিঞ্জারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বাসিন্দাদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করেন। এরপর দিয়ারবেকের হাফিজ পাশা সিঞ্জারের ইয়াজিদিদের পরাধীন করার চেষ্টা করেন এবং কিছুটা প্রতিরোধের মুখোমুখি হওয়ার পর ১৮৩৭ সালে ইয়াজিদিদের পরাজিত করে একজন মুসলিমকে তাদের তদারকি করার জন্য নিয়োগ করেন। অন্য আরেকটি সময়ে মোহাম্মদ রাশেদ পাশা সিঞ্জার আক্রমণ করেছিলেন। উভয় আক্রমণেই ইয়াজিদিদের উপর গণহত্যা চালানো হয়। এই সময়কালে ইয়াজিদিরা গুহাগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল, সেখানে তারা ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে এবং কামানের গোলার আঘাতে নিহত হয়েছিল। এগুলো ছাড়াও ইয়াজিদিদের উপর অনেক গণহত্যা চালানো হয়েছিল মুসলিম শাসকদের সরাসরি নির্দেশে

১৮৯২ সালে তুর্কি সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওমর ফারুক পাশা শেখাহান এবং সিন্জারে ইয়াজিদিদের উপর আক্রমণ করেছিল। ফারুককে ১৮৯২ সালের গ্রীষ্মে তৎকালীন ওসমানীয় সুলতান বিশেষ কমিশনার হিসেবে বাগদাদ ও মশুলে কিছু নির্দিষ্ট কাজের জন্য প্রেরণ করেছিলেন- ২০ বছরের অবৈতনিক কর আদায় করা, বেদুইনদের যাযাবর জীবনের পরিবর্তে গ্রাম্য জীবনে প্ররোচিত করা, শেখাহান এবং জাবালে সিন্জারের ইয়াজিদিদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিতকরণ। ফারুক প্রথমে ইয়াজিদিদের কয়েকজন প্রধানকে মশুলে আমন্ত্রণ করে। ওলামা এবং কয়েকজন খ্রিস্টানদের নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রীয় কাউন্সিল 'মাজলিস আল এদারাহ' এর অধিবেশন চলাকালীন তারা ফারুক এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিল। ফারুক প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিল এই প্রধানরা ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হলে তাদের উচ্চ পদমর্যাদা দিয়ে পুরস্কৃত করা হবে। প্রধানরা তার প্রস্তাবে রাজি না হলে তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়, কেউ মারা যায় এবং কেউ পালিয়ে যায়। এদের মধ্যে কয়েকজন নির্যাতন ও বেদনাদায়ক মৃত্যুর ভয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। অতঃপর ফারুক তাদের গ্রামে সেনাবাহিনী প্রেরণ করে ইসলাম ও তরবারির মধ্যে যেকোনো একটি বেছে নিতে বলেছিল সবাইকে। ফারুকের ছেলে সেনাপতি ওমর বেগ সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিল পুরুষদের হত্যা করতে ও নারীদের বন্দি করে তাদের জোর করে বিয়ে করতে। ওমর বেগ প্রায় ৫০০ ইয়াজিদিকে হত্যা করেছিল। সৈন্যদের সিভিল চিফ মেরাজ বেগের ভয়ে অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। অতঃপর মেরাজ বেগ তাদের মাঝে মোল্লাদের নিয়োগ করলো ইয়াজিদি বাচ্চাদের কট্টর মুসলিম বানানোর উদ্দেশ্যেমেরাজ তাদের মন্দিরগুলো, বিশেষত বাহযানিয়ে এবং বাশিকা ভেঙে ফেলেছিল। দীর্ঘকাল কারাবাস ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও ইয়াজিদিদের প্রধান ধর্মীয় নেতা আমির আলী বেগ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস পরিত্যাগ করেনি। ইয়াজিদিদের মনোবল ভেঙে দিতে তাকে কনস্টান্টিনোপল এর নিকট কাটামুনিতে কিছু সৈন্যসহ নির্বাসিত করা হয়েছিল

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]