শিবিরনামা [পর্ব-চার]

 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি শিবির ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাস সংলগ্ন এলাকায় ব্যাপক চাঁদাবাজি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে টেন্ডারসহ সকল রকমের স্টেশনারি, পরিবহন বাণিজ্যের মূল অংশের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দোকান ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শিবির নিয়মিত চাদা সংগ্রহ করেছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়টির অনেক সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও বাইতুল মাল এর নামে বহুবার চাঁদাবাজি করেছে। এই বর্বরদের চাঁদাবাজি থেকে রেহাই পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বল্প বেতনের মালী-ঝাড়ুদার থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের ক্ষুদ্র দোকানিরাও। ফারুক হত্যাকান্ডের পর এদের বেশ কিছু গোপন নথি উদ্ধার করেছিল পুলিশ। উদ্ধার করা শিবিরের গোপন নথিপত্রে মিলেছিল এসব চাঁদাবাজির ফিরিস্তি। বিশ্ববিদ্যালয়টির শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ছাত্রশিবির নিয়ন্ত্রিত কক্ষগুলোতে দফায় দফায় তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ উদ্ধার করেছিল তাদের চাঁদাবাজি তালিকা। সোহরাওয়ার্দী হল থেকে উদ্ধার করা শিবিরের চাঁদাবাজি তালিকায় দেখা যায় তারা হলের ২৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছ থেকে নিয়মিত ধার্য করা চাঁদা তুলতো। এদের মধ্যে হলের তৎকালীন মালী চান মিয়া ও লোকমানের কাছ থেকে ১শ টাকা করে, মালী জাবেরের কাছ থেকে ১শ টাকা, ঝাড়ুদার সাইদুরের কাছ থেকে ১শ টাকা; প্রহরী আলাউদ্দিন, চান মিয়া, মোহাম্মদ আলী ও রাজ্জাকের কাছ থেকে ৫০ টাকা করে; করে প্রহরী আমজাদের কাছ থেকে ৩০ টাকা, ক্যান্টিন ম্যানেজার আবুল হাশেমের কাছ থেকে ১শ টাকা, লাইব্রেরি কর্মচারী আজহারের কাছ থেকে ১শ টাকা, ডাইনিং কর্মচারী ইসমাইলের কাছ থেকে ৫০ টাকা, গেম রুমের কর্মচারী আলী ও আশরাফের কাছ থেকে ১শ টাকা করে, ক্রীড়া শিক্ষক মন্টু সিংহের কাছ থেকে ৩শ টাকা এবং ডাইনিং কর্মচারী হকের কাছ থেকে ১শ টাকা করে চাঁদা আদায় করতো শিবির।সোহরাওয়ার্দী হল থেকে উদ্ধার করা শিবিরের চাঁদা আদায়ের একটি রসিদে দেখা গেছে তারা নানা প্রক্রিয়ায় হলের সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত নিয়মিত চাঁদা আদায় করতো। সোহরাওয়ার্দী হলের কাছেই বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন বাজার এলাকা। তাছাড়া হলের আশপাশে রয়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দোকান। স্বল্প পুঁজির এসব ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নিতো শিবির। হল থেকে উদ্ধার করা শিবিরের চাঁদাবাজির তালিকায় দেখা যায় সেলুন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১শ টাকা, চা দোকানি আজিজের কাছ থেকে ১শ টাকা, ফল ব্যবসায়ী চান মিয়ার কাছ থেকে ১শ টাকা, হাবিব ভ্যারাইটির কাছ থেকে ৩শ টাকা, বটতলা হোটেল থেকে ২শ টাকা, ফটোকপি ব্যবসায়ী লিখনের কাছ থেকে ১শ টাকা, ক্ষুদ্র দোকানি মিন্টুর কাছ থেকে ৫০ টাকা, মোবাইল ব্যবসায়ী মুনিরের কাছ থেকে ৫০ টাকা, বিসমিল্লাহ হোটেল থেকে ৫০ টাকা, মোবাইল ব্যবসায়ী নাজিরের কাছ থেকে ২শ টাকা, ক্ষুদ্র দোকানি গাফফার ও মাজদারের কাছ থেকে ১শ টাকা, মনোহারী দোকানি মামুনের কাছ থেকে ৬শ টাকা এবং মোবাইল ব্যবসায়ী আনিসুরের থেকে ৫০ টাকা চাঁদা আদায় করেছিল শিবির ক্যাডাররা। একজন ক্ষুদ্র মোবাইল ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেসময় সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন-

"ভাই, ভয়ে নিয়মিত টাকা দিছি। না দিলে খালি ঝাড়ি মারতো।"

বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী প্রক্টর মুসতাক আহমেদ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন-

"দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের কাছ থেকে যারা এমন নির্দয়ভাবে চাঁদাবাজি করেছে এদের চেয়ে বর্বর কেউ থাকতে পারে না। এদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।"

বিশ্ববিদ্যালয়টির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রশিবিরের ২০১০ সালের বার্ষিক পরিকল্পনার একেবারে শেষ অংশে 'নোমানীর খুনের বদলা' শীর্ষক বিষয়ে ঐ হলের ছাত্রলীগ কর্মী আসাদ, কাওসার ও সোহেলের নাম ছিল। কাওসার ও আসাদের নামের পাশে তিনটি তারকা চিহ্ন ও সোহেলের নামের পাশে দু'টি তারকা চিহ্ন দেয়া ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি আওয়াল কবির জয় বলেছিলেন-

"এ বছরের ২৮ জানুয়ারি করা ঐ বার্ষিক পরিকল্পনার ১১ দিনের মাথায় আসাদ ও কাওসারকে খুন করতেই গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে হলের গেটে তাদের ওপর হামলা করে শিবির ক্যাডাররা। কিন্তু তাদের খুন করতে ব্যর্থ হয়েই শিবির ক্যাডাররা রাতে অন্যান্য হলে হামলা চালিয়ে খুন করে মেধাবী ছাত্রনেতা ফারুক হোসেনকে ও আহত করে ছাত্রলীগের অর্ধশত নেতাকর্মীকে।"

ছাত্রশিবিরের নেতারা এখনো গর্ব করে বলে রাজনীতি করলেও নাকি তারা পরীক্ষায় ভালো ফল করে, প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়। তাদের সেই 'ভালো ফলে'র রহস্য উন্মোচন করা যাক এবার। চূড়ান্ত পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ বিভাগে দেয়ার কথা থাকলেও তারা এতদিন দিয়ে এসেছে নিজের হলে নিজের রুমে বসে। এর প্রমাণ মিলেছিল বিশ্ববিদ্যালয়টির শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে। তল্লাশি চালাতে গিয়ে ঐ হলের শিবির নিয়ন্ত্রিত একটি রুম থেকে ফলিত রসায়ন ও রাসায়নিক প্রযুক্তি বিভাগের চূড়ান্ত পরীক্ষার তিনটি খাতা উদ্ধার করেছিল হল প্রশাসন। সোহরাওয়ার্দী হলের তৎকালীন প্রভোস্ট অধ্যাপক আখতার ফারুক জানিয়েছিলেন, ঐ বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি হলে শিবির নিয়ন্ত্রিত বেশ কয়েকটি কক্ষে তল্লাশি চালানো হয়েছিল। সেসময় আতাউর রহমান নামে এক শিবির ক্যাডারের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত পরীক্ষার তিনটি খাতা উদ্ধার করা হয়েছিল। খাতাগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও রাসায়নিক প্রযুক্তি বিভাগের সিলমোহর ছিল। আতাউর ঐ বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ছিল। খাতাগুলোর উপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বসানো সিরিয়াল নম্বরগুলো ছিল ০২৮২০৫, ০২৫৯১৪ ও ৪০৮৭১১। এই সাদা খাতাগুলো আতাউর বিভাগ থেকে এনে রুমে বসে সেগুলোতে লিখেছিল পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার উদ্দেশ্যেই। ফলিত রসায়ন বিভাগের তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক সি. এ. মোস্তফা জানিয়েছিলেন-

পরীক্ষার হলে অনেক সময় শিক্ষার্থীদের সংখ্যার চেয়ে বেশি খাতা নিয়ে যাওয়া হয়। পরীক্ষা শেষে যেসব খাতা অব্যবহৃত থাকে সেগুলো জমা রাখা হয় বিভাগীয় কর্মকর্তাদের কাছে। সেখান থেকে কোনও শিক্ষার্থীর খাতা নেয়ার সুযোগ নেই। ভালো ফল করার জন্য জালিয়াতির অংশ হিসাবে এসব খাতায় ঘরে বসে প্রশ্নের উত্তর লিখে পরীক্ষার হলে এসে কৌশলে তা জমা দিয়ে দিতে পারে। ছাত্ররা খাতা নিতে না পারলেও বিভাগীয় শিক্ষকরা অব্যবহৃত এসব খাতা অফিসের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে নিতে পারেন।

তৎকালীন বিভাগীয় সভাপতি অব্যবহৃত খাতাগুলো পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দফতরে ফেরত পাঠানো হয় বলে দাবি করলেও তারা জানায় যে, ঐ বিভাগ থেকে অব্যবহৃত কোনও খাতা তারা ফেরত পায়নি। তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক চৌধুরী জাকারিয়া মত প্রকাশ করেছিলেন সেসময় - জালিয়াতি করে এভাবেই এতদিন ভালো ফল করে এসেছে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। তিনি বলেছিলেন-

"হল থেকে পরীক্ষার সাদা খাতা উদ্ধারই তাদের অসদুপায় অবলম্বনের প্রমাণ দিয়েছে।"

চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন খাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের কোটি টাকা আয়ের খতিয়ান পেয়েছিল পুলিশ তাদের গোপন নথিতে। এগুলোর মধ্যে তারা 'কনটেস্ট' ও 'কনক্রিট' কোচিং সেন্টার থেকে সব খরচ বাদ দিয়ে বছরে কমপক্ষে ৮৬ লাখ টাকা আয় করেছিল। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে হলে অনেক অনাবাসিক ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা করেছিল শিবির। হলে বিনামূল্যে থাকার লোভে আর্থিকভাবে অসচ্ছল অনেক অনাবাসিক শিক্ষার্থী এভাবেই জড়িয়ে গিয়েছিল এই বর্বরদের সাথে। তবে হলে ওঠার পর এদের অনেকের কাছ থেকে মেস ভাড়ার মতো সিট ভাড়া আদায় করেছিল শিবির। পুলিশের উদ্ধার করা শাহ্‌ মখদুম হল শিবিরের 'সিট রেন্ট আদায়যোগ্য মোট জনশক্তি' শীর্ষক নথি থেকে জানা গিয়েছিল, ঐ হলে তাদের ২০ নেতাকর্মীর কাছ থেকে নিয়মিত ভাড়া আদায় করা হতো। যারা হলের আবাসিকতা পায়নি তাদের কাছ থেকে কত হারে ভাড়া আদায় করা হতো সেই ব্যাপারে কোনও তথ্য নথিতে ছিল না।সোহরাওয়ার্দী হল থেকে উদ্ধার করা নথিপত্রে দেখা গেছে, শিবির প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়টির ১০টি ছাত্র হল থেকে প্রায় ২৪ লাখ টাকা এই খাতে আয় করেছিল। জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের কাছ থেকে সারা বাংলাদেশেই প্রতি মাসে এখনো টাকা পায় শিবির। পুলিশের হাতে থাকা শিবিরের একটি নথিতে দেখা গিয়েছিল তারা বিশ্ববিদ্যালয়টির ২৫০ জন শিক্ষকদের কাছ থেকে মাসে ১ হাজার টাকা করে আদায় করতো। সেই হিসাবে এক মাসে এই খাতে তাদের আয় ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার এবং বছর শেষে তা দাঁড়াতো ৩০ লাখ টাকায়। ছাত্রাবাস ভাড়া দিয়ে প্রচুর টাকা আয় করতো শিবির। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর অঞ্চলে স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার ভবন নামের ছাত্রাবাস থেকে তারা মাসে ২৪ হাজার টাকা আয় করতো। সেই হিসাবে বছরে ঐ ছাত্রাবাস থেকে তাদের আয় আসতো ২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। এটির পাশেই 'মহানন্দা' নামের ৪ তলা ছাত্রাবাস আছে, যেখানে সিট ভাড়া দিয়ে বছর শেষে তারা আয় করতো ৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকা।

ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে জড়িত হয়ে যারা কিছুদিন পর নানা কারণে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় তাদের কপালে জোটে ‘পলাতক’ আখ্যা। শাহ্ মখদুম হলে শিবিরের সভাপতির কক্ষ থেকে উদ্ধার করা রেজিস্টার খাতায় এর প্রমাণ মিলেছিল। সাবেক সভাপতি আনিছের মেয়াদকালে সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিস্তারিত তথ্য সংযোজন করে ঐ খাতাটি তৈরি করা হয়েছিল। এতে বেশকিছু কর্মীর নামের পাশে লাল কালিতে লেখা ছিল 'পলাতক'। এদের মধ্যে অনাবাসিক হয়েও হলের ৩৫৬ নম্বর কক্ষে থাকতো শিবির কর্মী সাইফুল ইসলাম। শিবির করবে না বলে সে পরে কাজলা এলাকার ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি ছাত্রাবাসে ওঠে। তাই শিবিরের ঐ রেজিস্টার খাতায় সাইফুলের নামের পাশে লেখা ছিল ‘মেসে পলাতক’। শফিউল বাশার নামে এক 'সাথী'র নামের পাশে লাল কালিতে লেখা ছিল 'কোন খোঁজ নাই'।






















Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]