গোলাম আযম ও ভাষা আন্দোলন

 

গোলাম আযম ১৯২২ সালের ৭ই নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার বীরগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহন করে। মাদ্রাসায় প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা শেষ করার পর ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স ডিগ্রী সমাপ্ত করে ১৯৫০-১৯৫৫ সাল পর্যন্ত রংপুর কারমাইকেল কলেজে শিক্ষকতা করে সে। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন 'পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী'তে যোগ দেয় এবং ১৯৫৭-১৯৬০ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী'র সেক্রেটারী পদে বহাল থাকে। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত গোলাম আযম জামায়াতে ইসলামী'র আমীর হিসাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে।

১৯৪৮ সালের ২৭ নভেম্বর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবেশে ভাষণ দেয়। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা একটি মানপত্র পাঠ করে। ঐ মানপত্রের একটি অংশে বাংলা ভাষা নিয়ে দাবি জানানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান চৌধুরী মানপত্রটি লিখেছিলেন। মানপত্রটি ডাকসু কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট অরবিন্দ বোসের পাঠ করার কথা ছিল। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি চরম সাম্প্রদায়িক ছিল ও তাদের জাতিগত বিদ্বেষ-অবিশ্বাসের কারণে মানপত্রটি মুসলমান ছাত্র হিসেবে ডাকসু কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের অনির্বাচিত জেনারেল সেক্রেটারী গোলাম আযমকে পড়তে দেয়া হয়।

['জীবনে যা দেখলাম', গোলাম আযম]

https://www.islamicboisomahar.in/jibone-ja-dekhlam-pdf/

বর্তমান ডাকসু (DUCSU - Dhaka University Central Student’s Union) নামে পরিচিত ছাত্র প্রতিষ্ঠানটিকে সেকালে Dhaka University Student’s Union বলা হতো। পরিস্থিতির কারণে গোলাম আযম সেই মানপত্র পাঠ করেছিল। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে গোলাম আযমের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সেদিন মানপত্রটি বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে পড়তে হয়েছিল। মানপত্রে বাংলা ভাষার দাবিটি সে নিজেই সমর্থন করতো না। ভাষা আন্দোলনের কোথাও তার উপস্থিতি ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। ভাষা সংগ্রামের কোনো স্তরের আন্দোলনে তার উপস্থিতি নেই। ভাষা আন্দোলনের জন্য গঠিত কোনো কমিটিতে সে ছিল না। ভাষা সংগ্রামের কোনো সভা বা মিছিলে তার উপস্থিতি নেই। সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচীতে প্রথম সারির সব ভাষা আন্দোলনকারীদের উপস্থিতি থাকলেও সেখানে তার উপস্থিতি নেই। যেখানে ভাষা আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারী গ্রেফতার হওয়া ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা ছিল, সেখানে সে একবারও গ্রেফতার বা বহিষ্কার হয়নি। ২১ ফেব্রুয়ারি ও ১৪৪ ধারা ভঙ্গের আন্দোলনের কোনো অংশে সে উপস্থিত ছিল না।

তাছাড়া মানপত্রে বাংলা ভাষা নিয়ে যে দাবি জানানো হয়েছিল, তা গোলাম আযম সমর্থন করতো না। ১৯৭০ সালের ২০ জুন দৈনিক আজাদ পত্রিকার পঞ্চম পাতায় একটি প্রতিবেদন দেখা যায় যেখানে গোলাম আযম নিজেই বলছে যে, বাংলা ভাষা আন্দোলন একটি ভুল ছিল-

"মুছলমানদের অধিকাংশ তম্মুদিন ও ধর্মীয় জ্ঞানের ভাণ্ডার উর্দু ভাষায় সংরক্ষিত রহিয়াছে। জাতীয় ভাষার প্রশ্ন উঠার পর পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলনকারীদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম, কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ থেকে তাহা মোটেও সঠিক কাজ হয়নি। কারণ উর্দু ভাষা ব্যাপকভাবে প্রচলিত এবং পাক-ভারতের সকল প্রদেশের মুছলমানরা উহা বুঝিতে পারে। উর্দু হচ্ছে এমন একটা ভাষা যার মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষার উপযুক্ত প্রচার ও প্রসার সম্ভব। উর্দু পাক-ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের সাধারণ ভাষা এবং এতে তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সম্পদ সংরক্ষিত রয়েছে।"


মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক বাহিনী শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়। এই কাজকে সমর্থন করে দেয়া গোলাম আযমের একটি বিবৃতি ১৯৭১ সালের ১৬ জুলাই জামায়াতের মুখপত্র 'দৈনিক সংগ্রাম' পত্রিকায় বের হয়।


['মুক্তিযুদ্ধে দৈনিক সংগ্রামের ভূমিকা', আলী আকবর টাবী]

https://gold.mukto-mona.com/Articles/Ali_Akbar_Tabu/sangram1.pdf

গোলাম আযম তার আত্মজীবনী গ্রন্থ 'জীবনে যা দেখলাম' এ নিজ জবানীতেই উর্দুর পক্ষে সাফাই গাইছে-

"উপমহাদেশে যারা ইসলামের কর্মসূচী নিয়ে চর্চা করেন, তাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমই হলো উর্দু। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, আফগানিস্তান ও মায়ানমারসহ গোটা উপমহাদেশের মুসলমানদের কমন ভাষা একমাত্র উর্দুই। উচ্চশিক্ষিতদের জন্য ইংরেজি কমন ভাষা হলেও সকলের জন্য উর্দুর কোনো বিকল্প নেই। মুসলমানদের জন্য বিভিন্ন কারণে এ ভাষায়ই সবচেয়ে সহজে ভাবের আদান-প্রদান সম্ভব। বিশেষ করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মুসলমানদের বিরাট জনশক্তি ঐসব দেশে রয়েছে। তাদের মধ্যে যারা ইসলামী কর্মকান্ডে জড়িত, তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। উপমহাদেশের কোন দেশ থেকে কোন ইসলামী ব্যক্তিত্ব আসলে তারা যৌথ সমাবেশের আয়োজন করে থাকেন। তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ ও মতবিনিময়ের মাধ্যম প্রধানত উর্দু ভাষা। তাই বাংলাদেশীরাও উর্দু মোটামুটি বুঝে এবং কিছু কিছু বলতেও পারে।"


Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]