গোলাম আযম ও মুক্তিযুদ্ধ

 

২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিরীহ নিরস্ত্র তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের উপর ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক গণহত্যা চালানোর পর গোলাম আযম ৬ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে গভর্নর টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের অভিযানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে ও তার দলের পক্ষ থেকে সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। এর আগে ৪ এপ্রিল গোলাম আযম গভর্নর টিক্কা খানের সাথে বৈঠক করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে গণহত্যাসাধারণ মানুষের উপর অমানবিক নির্যাতনে সর্বতোভাবে সহায়তা প্রদানের জন্য একটি বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা করে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ৯ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে খাজা খয়েরউদ্দিন'কে আহ্বায়ক করে ১৪০ সদস্যের ‘শান্তি কমিটি’ গঠন করা হয়। গোলাম আযম ‘আমীর’ হিসাবে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র সংঘের সাংগঠনিক কাঠামো এবং কার্যক্রম নির্ধারণনিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনী গঠনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও রেডিও বার্তায় গোলাম আযম মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দেশদ্রোহী’, ‘ভারতীয় চর’, ‘দুষ্কৃতিকারী’ আখ্যা দিয়ে পাকিস্তানের দোসর রাজাকার, আল-বদর বাহিনীকে নির্দেশ দেয় তাদের ‘ধ্বংস’ করার জন্য।

৮ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামের আমীর গোলাম আযম ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক যুক্ত বিবৃতিতে বলে-

"ভারত পূর্ব-পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। ভারতীয় বা পাকিস্তান-বিরোধী এজেন্টদের বা অনুপ্রবেশকারীদের যেখানেই দেখা পাওয়া যাবে দেশপ্রেমিক পূর্ব-পাকিস্তানীরা তাদের নির্মূল করবে।"

.............................................................

২১ জুন, ১৯৭১ সালে লাহোরে জামায়াতে ইসলামের কর্মীদের জন্য দেয়া এক বক্তব্যে গোলাম আযম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানায়। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর এ ছাড়া কোন উপায় ছিল না বলেও সে ঘোষণা দেয়।

.............................................................

রংপুর জামাতের ভারপ্রাপ্ত আমীর মিয়া তোফায়েল মোহাম্মদ ১৩ জুলাই মুক্তিযোদ্ধাদের 'দুষ্কৃতিকারী' ও 'পাকিস্তানের শত্রু' আখ্যা দিয়ে তাদের হত্যা করার আহ্বান জানায়। ১৫ জুলাই গোলাম আযম ও  মিয়া তোফায়েল গভর্নর হাউসে টিক্কা খানের সাথে দেখা করে।

..............................................................

১৪ আগস্ট, ১৯৭১ সালে 'পাকিস্তান দিবস' উপলক্ষে পাকিস্তানে যায় গোলাম আযম, সেখানে সে পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের মধ্যে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব জোরদার করার আহ্বান জানায়-

"জাতি যে চরম সঙ্কটের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এবারের স্বাধীনতা দিবস পালন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের আদর্শের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতাই জাতীয় সঙ্কটের মূল কারণ।"

...........................................................

১৮ আগস্ট, ১৯৭১ সালে লাহোরে গোলাম আযম মুক্তিযোদ্ধাদের 'দুষ্কৃতিকারী' সম্বোধন করে পাকিস্তানের ভারত আক্রমণ করার পূর্বাভাস দিয়ে বলে-

"ভারত দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) সাহায্য করছে।
তাই, পাকিস্তানের উচিত কাল বিলম্ব না করে ভারত আক্রমণ করা এবং আসাম দখল করা।"

..............................................................

২৩ আগস্ট, ১৯৭১ সালে লাহোরে গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধকে 'ভারতীয় ষড়যন্ত্র' ও মুক্তিযোদ্ধাদের 'ভারতীয় চর' উল্লেখ করে বলে-

"পূর্ব-পাকিস্তানে যা ঘটছে তা ভারত ও তার চরদের ষড়যন্ত্রেরই ফল। একমাত্র ইসলামের শক্তিই দেশের অখন্ডতা রাখতে পারে।"

এই বক্তব্যে গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে জামাত ও ছাত্র সংঘের (বর্তমানে ইসলামী ছাত্র শিবির) সক্রিয় অংশগ্রহণের কথা স্বীকার আরো বলে-

"যারা জামাতে ইসলামীকে দেশপ্রেমিক সংস্থা নয় বলে আখ্যায়িত করছে, তারা হয় জানে না বা স্বীকার করার সাহস পায় না যে, ইসলামের আদর্শ তুলে ধরা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবর্তীণ হওয়ায় পূর্ব-পাকিস্তানে জামাতের-ছাত্র সংঘের বিপুল সংখ্যক কর্মী দুষ্কৃতিকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) হাতে প্রাণ হারিয়েছে।"

..............................................................

২৮ আগস্ট, ১৯৭১ সালে পেশোয়ারে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক বাঙালি গণহত্যা-ধর্ষণের প্রশংসা করে গোলাম আযম বলে-

"শুধুমাত্র ইসলামী আদর্শই দেশের (পাকিস্তানের) দুই অংশের ঐক্য বজায় রাখতে পারে। পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষায় পরিস্থিতি বিবেচনায় পূর্ব-পাকিস্তানে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা প্রশংসনীয়।"
.............................................................

৩১ আগস্ট, ১৯৭১ সালে গোলাম আযম বলেছিল-

“কোনো ভালো মুসলমান তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক হতে পারে না।”

গোলাম আযম তার পাকিস্তান সফরের সময় হায়দারাবাদে এক সাংবাদিক সম্মেলন সহ বিভিন্ন সময় বলে-

"বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচিত ও সরকার কর্তৃক বহাল ঘোষিত ৮৮ জন সদস্যের অধিকাংশই পাকিস্তানে নেই। তাই, পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে সদস্যপদে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হোক এবং পূর্ব পাকিস্তানে সকল বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং তাদের নেতৃবৃন্দকে শাস্তি দেয়া হোক। কোন ভালো মুসলমানই তথাকথিত ‘বাংলাদেশ আন্দোলনের’ সমর্থক হতে পারে না। বর্তমান মুহূর্তের আশু প্রয়োজন হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে দেশপ্রেমিক ও ইসলাম-প্রিয় লোকজনের হাত শক্তিশালী করা। পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নির্মূল করার জন্যে একমনা ও দেশপ্রেমিক লোকরা একত্রে কাজ করে যাচ্ছে। রাজাকাররা খুবই ভালো কাজ করছে।এসব লোক (রাজাকার) পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকভাবে সাহায্যে করছে এবং দুষ্কৃতিকারীদের রাষ্ট্র বিরোধী কার্যকলাপ ও বিদ্রোহীদের দমনে সেনাবাহিনী প্রশাসনকে পূর্ণ সহযোগিতা দান করছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানে ইসলাম রক্ষায় ও পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষায় সফলভাবে কাজ করছে। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে।"

...............................................................

১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সালে গোলাম আযম এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের বিরোধিতা করার জন্য গঠিত পাকিস্তানী প্রতিনিধি দলে খান এ সবুর ও ফজলুল কাদের চৌধুরীকে অর্ন্তভুক্ত করার দাবি জানায়।

.............................................................

২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সালে জামাত মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের এক সংবর্ধনায় গোলাম আযম বলে-

"জামাতের কর্মীরা মুসলিম জাতীয়তাবাদের আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদকে মেনে নিতে রাজী নয়।"

........................................................

৩ অক্টোবর, ১৯৭১ সালে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর মজলিশে সুরার বৈঠক হয়। এতে গোলাম আযম জনগণের প্রতি ইসলামের পবিত্র আদর্শের আবাসভূমি পাকিস্তান রক্ষার জন্যে সব রকমের ত্যাগ স্বীকারের আহবান জানায়।

......................................................

১৬ অক্টোবর, ১৯৭১ সালে বায়তুল মোকাররমে এক সভায় গোলাম আযম বলে-

"মুসলিমদের অস্তিত্ব অক্ষুন্ন রাখতে হলে পাকিস্তানের সংহতি অবশ্যই টিকিয়ে রাখতে হবে।...পূর্ব-পাকিস্তানে এখন জানমাল-ইজ্জতের কোনো নিরাপত্তা নেই। এ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যে প্রথমতঃ মওলানা ভাসানী, যাদু মিয়া, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এবং তাদের পার্টি ও ছাত্র সংগঠন, আতাউর রহমান খান ও শাহ আজিজুর রহমান, দ্বিতীয়তঃ জনাব ভূট্টো এবং তৃতীয়তঃ শেখ মুজিবের আর্দশ ও অদূরদর্শিতা দায়ী।বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ‘তথাকথিত বাংলাদেশের’ ভুয়া শ্লোগানে কান না দিয়ে পাকিস্তানকে ইসলামী আদর্শে নতুনভাবে গড়ে তুলতে হবে।"

একাত্তরের নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদের লোক দেখানো উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যার মাধ্যমে জামাত ও পাকিস্তানপন্থী দলগুলোর মাঝে আসন বন্ট করা হয়; এতে নির্বাচিত ৭৬ জন সদস্যের মধ্যে জামাতের সদস্য সংখ্যা ছিল ১৯ জন। টাঙ্গাইল থেকে পরিষদ সদস্য হয়েছিল গোলাম আযম; এটা নিয়ে দৈনিক পাকিস্তানে ৬ নভেম্বর খবর প্রকাশিত হয়।

..............................................................

৬ নভেম্বর, ১৯৭১ সালে গোলাম আযম এক বিবৃতিতে ৭ নভেম্বরকে যথাযোগ্য মর্যাদায় ‘আলবদর দিবস’ পালনের জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানায়।

.............................................................

৮ নভেম্বর, ১৯৭১ সালে ঢাকা জেলার ইউনিয়ন ও থানা শাখার জামাতের সভাপতিদের নিয়ে সিদ্দিক বাজারে অনুষ্ঠিত এক সভায় গোলাম আযম বলে-

"দেশের অভ্যন্তরে দুষ্কৃতিকারীদের হামলা, সীমান্তে আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ পরিচালনার জন্যে ব্রাহ্মণ্য-সাম্রাজ্যবাদী ভারতকে হুঁশিয়ার করা হচ্ছে। পূর্ব-পাকিস্তানে দৃষ্কৃতকারী পাঠিয়ে হিংসাত্মক ও মানবতাবর্জিত কার্যকলাপ থেকে ভারত বিরত না হলে, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা অমিততেজী পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে ভারতীয় যুদ্ধবাজদের চরম শিক্ষাদান এবং তাদের অস্ত্রবলকে স্তব্ধ করে দেবে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের আরো সচেতন ও কর্তব্যপরায়ণ এবং সতর্ক হওয়া প্রয়োজন; বিচ্ছিন্নতাকামী দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।"

পাকিস্তানের পরাজয়ের লক্ষণ স্পষ্ট হতে থাকায় মওদুদীর পরামর্শে গোলাম আযম ও জামাতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর (সহ সভাপতি) মওলানা আবদুর রহীম ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর বিমানে করে লাহোর চলে যায়।

.............................................................

২৩ নভেম্বর, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান রক্ষার সংগ্রামে তাদের ভূমিকার জন্য সংবর্ধনা দেয়া হয়।

..........................................................

২৩ নভেম্বর, ১৯৭১ সালে লাহোরে গোলাম আযম পূর্ব-পাকিস্তানে পাকিস্তানের প্রায় নিশ্চিত পরাজয় থেকে উদ্ধার পেতে ইসলাম ও পাকিস্তানের ঐক্যের স্বার্থে রাজনৈতিক দলাদলি ভুলে গিয়ে কার্যকরভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানায়।

..............................................................

২৭ নভেম্বর, ১৯৭১ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে গোলাম আযম বলে-

"পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক ভারতের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবে এবং তাদের পবিত্র মাতৃভূমির এক ইঞ্চি জমিও ভারতকে দখল করে নিতে দেবে না।"

.............................................................

১ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে লাহোরে ফিরে এসে গোলাম আযম বলে-

"পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কখনো তাদের দাবির প্রতি মিসেস গান্ধীর সমর্থন চায়নি। পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্যে অবিলম্বে ভারতের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা হোক।"

...............................................................

১৯৭২ সালে গোলাম আজমের নেতৃত্বে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার সপ্তাহ’ পালিত হয়। একই বছর গোলাম আযম হজ্জ্ব করার জন্য সৌদি আরব গমন করলেও উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান-বাংলাদেশ কনফেডারেশন গঠনে আরব রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের সহায়তা ও সমর্থন আদায়। এই উদ্দেশ্যে সে জেদ্দা, কুয়েত, আবুধাবী, দুবাই, বৈরুত সফর করে। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারী পাশ হয় দালাল আইন এবং এর গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে চিহ্নিত দালালদের ১১ নম্বরে ছিল গোলাম আযম। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিলে একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকার দায়ে ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আদেশের ৩ ধারা অনুসারে গোলাম আজমের নাগরিকত্ব বাতিল করে। ১৯৭৩ সালে গোলাম আযম পাকিস্তানপন্থী বাঙালীদের সংগঠিত করার জন্য লন্ডন যায়। এসময় তার নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান জামাতের মুখপত্র 'দৈনিক সংগ্রাম' সাপ্তাহিক হিসেবে লন্ডনে প্রকাশিত হয়। লন্ডনের কাজ শেষ করে গোলাম আযম পাকিস্তান ফিরে যায়। সেসময় পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টো বাংলাদেশের স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়ে পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত আহ্বান করলে পাকিস্তান জামাত-ই-ইসলামী'র মজলিশে শুরার বৈঠকে গোলাম আযম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিরোধিতা করে-

"বাংলাদেশের আদর্শ কি, সে ধারণা আমার নেই। শুধু জানি, বাংলাদেশ একটা জমি, একটা মাটি; মাটির কোনো আদর্শ থাকে না। এই ভূখন্ডের অধিবাসীরাই ঠিক করবে, কোন আদর্শের ভিত্তিতে দেশ চলবে।"

১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে লিবিয়ার বেনগাজিতে এক ইসলামী পররাষ্ট্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আমন্ত্রিত না হয়েও গোলাম আযম সম্মেলনে উপস্থিত হয় এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য আহ্বান জানায়। এছাড়া গোলাম আযম বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ‘গোলামির জিঞ্জির’ বলে অভিহিত করে এবং পাকিস্তান পুনঃরুদ্ধারে ইসলামী উম্মাহর সাহায্য কামনা করে। ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে সে সৌদি আরব ভ্রমন করে এবং তৎকালীন সৌদি বাদশাহ ফয়সালের সাথে সাক্ষাৎ করে। সাক্ষাতে সে বলে বাংলাদেশে ভারতীয় হিন্দুরা মসজিদ দখল করে মন্দির তৈরী করেছে, কোরআন পুড়িয়েছে এবং মুসলিমদের হত্যা করেছে। এই ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য বাদশাহ ফয়সালকে অনুরোধ করে সে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাকিস্তান একত্রিত করার কথা বলে ফান্ড গঠন করেছিল সে।

১৯৭৬ সালের ১৮ জানুয়ারি তৎকালীন ‘জিয়াউর রহমান অধীনস্ত বাংলাদেশ সরকার’ এক প্রেসনোট জারি করে, যাতে ‘নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে’ এমন ব্যক্তিরা তাদের নাগরিকত্ব ফিরে পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে পারবে। গোলাম আযম নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার জন্যে আবেদন করে। ১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার গোলাম আযমকে তিন মাসের জন্য বাংলাদেশের ভিসা দেয়; কারণ হিসেবে দেখানো হয় তার মা অসুস্থ। ১৯৭৮ সালের ১১ আগস্ট গোলাম আযম পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।


১৯৮১ সালের ১ জানুয়ারী বায়তুল মোকাররাম মসজিদে হাজির হয় গোলাম আযম। অন্যতম প্রধান স্বাধীনতা বিরোধী, পাক-বাহিনীর দোসর সবার সাথে এক কাতারে নামাজ পড়বে এটা সেদিন মুসল্লিরা মেনে নিতে পারেনি। এই মুসল্লিদের একজন সেদিন পায়ের স্যান্ডেল খুলে গোলাম আজমের মুখে আঘাত করে। সেদিন তাকে কিল-ঘুষিও দিয়েছিল মসজিদে নামাজ পরতে আসা জনগন। পরদিন ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকায় সেই খবর ছবিসহ ছাপা হয়।


১১৯৪ সালের ২৬ জুলাই চট্টগ্রামে গোলাম আযমের সমাবেশ বিরোধী জনতার মিছিলে জামায়াতের সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির (পাকিস্তান আমলে ‘ইসলামী ছাত্রসংঘ’ নামে পরিচিত ছিল ও একাত্তরে এর একটি অংশ ‘আল বদর’ নামে বুদ্ধিজীবি ও বাঙালি গণহত্যায় অংশগ্রহণ করে) ও তৎকালীন প্রতিক্রিয়াশীল বিএনপি সরকারের অনুগত পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা গুলি চালায়; এতে কিশোর এহসানুল হক মনি, টিটু সহ চারজন নিহত হয় ও আহত হয় শতাধিক।

১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাঁচ দিনব্যাপী ‘মজলিশে শুরা’র বৈঠকে গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামের আমীর ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের নাগরিক হিসাবে কোনো বৈধ ভিসা বা আদালতের অনুমতি ছাড়াই সে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থান করে। 

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]