বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দ

 

ভাষা নিয়ে চুলকানি থাকা চাড্ডি ও মোল্লাদের কিছু বিদেশি শব্দের ব্যাপারে ধারণা দেয়া যাক যেগুলো এখন বাংলা ভাষাভাষীরা ব্যবহার করে।

তুর্কি: উজবুক, উর্দি, উর্দু, কঞ্চি, কাবু, কুর্নিশ, কুলি, কোর্মা, খাঁ, খান, চকমক, চিক, চোগা, চারু, ঝকমক, ঠাকুর, তকমা, তোপ, দারোগা, তুর্ক, বাবা, বেগম, বাবুর্চি, মোগল, লাশ, সওগাত, চাকু ইত্যাদি।

পর্তুগিজ: আনারস, আলপিন, পাউরুটি, চাবি, কফি, কাকাতুয়া, কেরানি, গির্জা, গোলাপ, আলকাতরা, আলমারি, বোমা, বোতাম, বালতি, বন্দর, বাসন, নিলাম, লোনা, পেঁপে, বাতাবি, সাবান, টুপি, ফিতা, আতা, গামলা, পাদরি, পিরিচ, পেরেক, হোলা, ইংরেজ, বর্গা, বারান্দা, টুপি, পুলিশ, পেয়ারা ইত্যাদি।

ফরাসি: এলিট, কার্টুজ, কুপন, খোরাকি, ডিপো, রেস্তোরাঁ, ক্যাফে, বুর্জোয়া, মাদাম, ব্যালে, গ্যারেজ, মেনু, বুফে, পিজা, সেমিজ, বিস্কুট, আঁতাত, জাহাজ, আঁশ, ম্যাটিনি, রেনেসাঁ, দিনেমার, প্রোগ্রাম ইত্যাদি।

ওলন্দাজ: ইস্কাপন, টেক্কা, তুরুপ, রুইতন, হরতন।

হিন্দি: বার্তা, পুরি, পানি, টহল, বাচ্চা, চানাচুর, মিঠাই, কাহিনী, খানাপিনা, সাচ্চা, চাচা, চাচী, দাদা, নানা, লুচি, ঠান্ডা, ফুফা ইত্যাদি।

গুজরাটি: খদ্দর, খাদি, হরতাল, জয়ন্তী, গরবা, চরকা।

সিংহলি: সিডর, বেরিবেরি।

পাঞ্জাবি: চাহিদা, শিখ, খলসা, গুরুদুয়ার।

ইতালিয়ান: সনেট, মাফিয়া, ম্যাজেন্টা, ম্যালেরিয়া।

মেক্সিকান: চকোলেট।

রুশ: কমরেড।

দক্ষিণ আফ্রিকান: জেব্রা, জিরাফ।

পেরু: কুইনাইন।

জার্মান: নাৎসি, কিন্ডারগার্টেন।

তামিল: চুরুট।

চিনা: চা, চিনি, লিচু, এলাচি, তুফান, সাম্পান, লবি ইত্যাদি।

বর্মি: কিয়াং, লুঙ্গি, ফুঙ্গি, লাম, ঠোঙা, প্যাগোডা ইত্যাদি।

জাপানি: রিকশা, হারিকিরি, জুডো, হাসনাহেনা, সুনামি ইত্যাদি।

গ্রিক: দাম, কেন্দ্র, সুড়ঙ্গ ইত্যাদি।

আরবি: আদালত, আলেম, ইনসান, ঈদ, উকিল, ওজর, এজলাস, এলেম, কানুন, কলম, কিতাব, কেচ্ছা, খারিজ, গায়েব, দোয়াত, নগদ, বাকি, মহকুমা, মুন্সেফ, মোক্তার, রায়, আল্লাহ, ইসলাম, ঈমান, ওজু, কোরবানি, কুরআন, কিয়ামত, গোসল, জান্নাত, জাহান্নাম, তওবা, তসবি, যাকাত, হজ্জ, হাদিস, হারাম, খবর, শরিফ, তারিখ, বকলম, দাওয়াত, মশকরা, মশগুল, শালগম, দালাল, তবলা ইত্যাদি।

ফারসি: খোদা, গুনাহ, দোজখ, নামাজ, পয়গম্বর, ফেরেশতা, বেহেশত, রোজা, আইন, কারখানা, চশমা, জবানবন্দি, তারিখ, তোশক, দফতর, দরবার, দোকান, দস্তখত, দৌলত, নালিশ, বাদশাহ, বান্দা, মেথর, রসদ, আদমি, আমদানি, জানোয়ার, জিন্দা, নমুনা, বদমাশ, রপ্তানি, হাঙ্গামা, বরফ, সোয়া, সবুজ, একতারা ইত্যাদি।

..................................................................................

....শিক্ষা ও সংস্কৃতির সুপার চ্যানেল বা অধিপ্রণালী হলো ভাষা, কাজেই মৌলবাদ যে ভাষার বিষয়ে নানা নিয়ন্ত্রণ জারি করবার চেষ্টা করবে তা বলা বাহুল্য মাত্র। মৌলবাদ প্রথম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে ভাষার অভিধান। তারা শব্দগুলিকে 'হিন্দু' বা 'মুসলমান' ইত্যাদি চিহ্ন দেয় এবং প্রাণপণ চেষ্টা করে একে অন্যের অভিধান থেকে এই শব্দগুলিকে নির্বাসন দিতে। তাদের মধ্যে ভাষাগত 'বিশুদ্ধি' সম্বন্ধে একটা নির্বোধ ও অবৈজ্ঞানিক ধারণা আছে। তারা জানে না (বা মানে না) যে, সব ভাষাই সমৃদ্ধ হয় অন্য ভাষা থেকে ঋণ নিয়ে। বরং ভাষার ঋণ কখনও ফেরত দেবার দরকার পড়ে না। এই কারণেই গত শতাব্দীতে উত্তর ভারতে উর্দু ও হিন্দির বিরোধ তীব্র হয়ে উঠেছিল এবং কাশীর পণ্ডিতেরা সংস্কৃত প্রধান এক কৃত্রিম সাহিত্যিক হিন্দি ভাষার সৃষ্টি করেছিলেন যা সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত হিন্দি থেকে বহু দূরবর্তী। ফলে উর্দুও আরও কঠোরভাবে আরবি-ফারসির সংক্রমণ গ্রহণ করতে থাকে এবং হিন্দি-উর্দু ভাষাগত সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটে। তৈরি হয় ভাষা বিচ্ছেদ। উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি হিন্দু পণ্ডিতেরা বাংলা ভাষাকে হিন্দুত্বের দিক থেকে সংস্কৃত নির্বোধ খেলায় মেতে উঠেছিলেন, বাংলা ভাষা থেকে রোজকার ব্যবহৃত ফারসি ও আরবি শব্দগুলিকে বিদায় করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, এই নিয়ে যুক্তিবাদী মনস্বী হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁদের প্রচুর ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেছেন। তাঁদের পদ্ধতি ছিল বিকল্পন (Substitution); অর্থাৎ তাঁরা 'কলম', 'দোয়াত', 'পাট্টা', 'আদালত' ইত্যাদির বদলে 'লেখনী', 'মস্যাধার', 'ভোগবিধায়ক পত্র', 'বিচারালয়' ইত্যাদি ব্যবহার করতে চান। হরপ্রসাদ নিজেকে যার 'চ্যালা' বলেছেন সেই প্রবল নাস্তিক ও প্রাজ্ঞ ভাষাবিদ অধ্যাপক শ্যামাচরণ গাঙ্গুলি ১৮৭৮-এই এই অসুস্থ চেষ্টার বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্রের 'বাঙলা ভাষা'য় (১৯৭৮) শ্যামাচরণের প্রবন্ধের প্রতিক্রিয়ায় লেখা এই ভাষা বিরোধে একটা সমন্বয়ের চেষ্টা দেখা দায়, যাতে তিনি সিদ্ধান্ত করেন - 'বলিবার কথাগুলি পরিস্ফুট করিয়া বলিতে হইবে, যতটুকু বলিবার আছে সবটুকু বলিবে - তজ্জন্য ইংরেজি, ফার্সি, আরবি, সংস্কৃত, গ্রাম্য, বন্য, যে ভাষার শব্দ প্রয়োজন তাহা গ্রহণ করিবে, অশ্লীল ভিন্ন কাহাকেও ছাড়িবে না।'

ভাষা বিচ্ছিন্নতার এই প্রয়াস যে এখনও ক্ষান্ত হয়েছে তা বলা যায় না, খুব কাছেই তার দৃষ্টান্ত আছে। একটি সংবাদপত্রের চিঠিপত্রের কলামে কিছুদিন ধরে বাঙালি মুসলমানদের 'বাংলা' নামকরণের ব্যাপারে বেশ কিছু চিঠিপত্র বেরোল। চিঠিগুলি লিখছেন অধিকাংশ হিন্দুরা। তাদের মতে 'আকবর', 'রহমান', 'কুদরত-ই-খুদা', 'সাজ্জাদ' এসব নাম বাংলা নয়। বিস্ময়ের কথা হলো, তারা যে নাম প্রস্তাব করেন, বেশিরভাগই সংস্কৃত শব্দ বাহিত নাম। অর্থাৎ এর মধ্যেও এক ধরনের হিন্দুত্ববোধ প্রচ্ছন্ন আছে, যেন সংস্কৃত বা তৎসম শব্দের নামই 'বাঙালি নাম'; 'করিম', 'রহিম', 'রহমত' ইত্যাদি নয়। আমি এই যুক্তির অর্থ বুঝি না। 'করুণাময়' নাম বাঙালি হলে 'রহিম' কেন বাঙালির নাম হবে না তার যুক্তি আমার কাছে স্পষ্ট নয়। অধিকাংশ হিন্দু বাঙালি এ নামগুলির অর্থ জানেন না সেটা একটা সমস্যা। আধুনিক হিন্দু মুসলমান বাঙালি যারা যুক্তিবাদে বিশ্বাসী তারা অবশ্যই নামকরণে ধর্মীয় অনুষঙ্গ বাদ দেবার কথা ভাবতে পারেন। সেক্ষেত্রে এমনধারা হিন্দু বাঙালিদের কাছে 'ভবেশ', 'নারায়ণ', 'ভবানীচরণ', 'রমাপতি' ইত্যাদি নামও এখন গ্রহণযোগ্য মনে হওয়া উচিত নয়। ফলে নাম ধর্মনিরপেক্ষ হোক - তা প্রকৃতি, কবিতা, সাহিত্য, ইতিহাস, প্রতিষ্ঠান ও স্থাপত্য-ভাস্কর্য সব জায়গা থেকেই আসতে পারে - এইটে হলো আসল দাবি। এরকম নাম বাংলাদেশে প্রচুর হচ্ছে - বর্ষা ইসলাম, সুরঞ্জনা ফারুকি, বিদিশা রায়হান ইত্যাদি নাম যথেষ্টই পাই, এখানেও সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের মতো লেখকেরা তাঁর পুত্র সন্তানদের এরকম নাম দিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে নামকরণে আরবি-ফারসি শব্দ থাকলেই তা 'বাঙালি' নয় - এটা একটা কুসংস্কার এবং এর পিছনে একটা প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতা আছে, যে সম্বন্ধে হয়তো সব পত্র লেখক সচেতন নন। আমার মতে ওই আরবি-ফারসি শব্দগুলিও যথেষ্টই বাংলা। আমরা একশ্রেণীর বাঙালি সেগুলির অর্থ জানি না, তার কারণ আমাদের অধিকাংশগত হিন্দু অভিধানকার এসবের অর্থ দেবার কথা বিবেচনাই করেনি, তারাও হিন্দু চেতনাবদ্ধ এক ভাববিশ্বের অধিবাসী ছিলেন, যাতে ওই নামগুলির অর্থ বোঝার গুরুত্ব তাঁদের কাছে তত বেশি ছিল না। যেজন্য তাঁরা 'জল' কথাটির প্রতিশব্দ হিসেবে 'অপ', 'সলিল', 'জীবন' ইত্যাদি লিখেছেন; কিন্তু 'পানি' কথাটা লেখেননি - যে কথাটি লিখলে অধিকাংশ বাঙালির বোধগম্য হতো। তাঁরা এ কথাও খেয়াল করেননি যে, 'পানি', 'আণ্ডা' ইত্যাদি মোটেই আরবি-ফারসি শব্দ নয়; একেবারে খাঁটি তদ্ভব ও অর্ধ-তৎসম শব্দ - দুটিই সংস্কৃত থেকে এসেছে, এদের মূল হলো 'পানীয়' ও 'অন্ড'। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের দ্বারা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হওয়ার ফলে অচেতন ও প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবে আমরা এগুলিকে 'মুসলমানি' শব্দ বলে চিহ্নিত করেছি। এ কথাও ভুলে থেকেছি যে সিলেট, চট্টগ্রাম অঞ্চলে বহু হিন্দুও 'পানি' কথাটা ব্যবহার করেন এবং সর্বভারতীয় কোটি কোটি হিন্দুও তা ব্যবহার করেন।

সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের প্রশ্নে যে কোনো দেশের সচেতন সংখ্যাগুরুর একটা বিশেষ দায়িত্ব থাকে, যে দায়িত্ব সংখ্যালঘুর থাকে না। সংখ্যাগুরুকে একটু বেশি সতর্ক হয়ে ভাবতে হয় যে, তার কথায় বা আচরণে শুধু প্রকাশ্য স্পষ্ট সাম্প্রদায়িকতা নয়, কোনো অচেতন অপ্রকাশ্য সাম্প্রদায়িকতা আছে কিনা। শরৎচন্দ্র যে 'শ্রীকান্ত' প্রথম পর্বে 'বাঙালি' ও মুসলমান ছাত্রদের ফুটবল খেলার প্রসঙ্গে বাঙালি বলতে হিন্দু বুঝিয়েছিলেন, তাতে আছে ওই অসচেতন সাম্প্রদায়িকতার ইঙ্গিত। সচেতনভাবে শরৎচন্দ্র মৌলবাদী নন, সাম্প্রদায়িকও নন। কিন্তু আমাদের চেতনার নানা ভিতরকার ভাঁজে আমাদের জাতীয় ও সামাজিক ইতিহাস কোথায় কী সংস্কার লুকিয়ে রেখে দিয়েছে সে সম্বন্ধে অনেক সময় আমরা নিজেরাই অবহিত নই। তা কখনও কোনো শব্দ ব্যবহারে হঠাৎ বেরিয়ে আসে।

শরৎচন্দ্র যদি বাঙালি-হিন্দু এই সমীকরণ করে ভুল করে থাকেন সে ভুল তাঁর আগে থেকেই মুসলমানরাও করে আসছেন। আমার ধারণা এই ভুলের জন্ম মুসলমান সমাজের উচ্চ অংশে যাঁরা নিজেদের বাঙালি পরিচয় গোপন করতেন, যাঁরা 'শরিফ' বা 'আশরাফ' বর্গের; যাঁরা নিজেদের তুর্কি, ইরানি, আফগান শাসকদের বংশধর বলে কল্পনা করতেন। তাঁরাই হিন্দুদের 'বাঙালি' হিসেবে দেখবেন - এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। এবং ইসমাইল হোসেন শিরাজির মতো লেখকেই আমরা পাই ওই হিন্দু অর্থে 'বাঙালি' কথাটার প্রয়োগ। বঙ্কিমচন্দ্রের 'দুর্গেশনন্দিনী'-র জবাবে লেখা তাঁর 'রায়নন্দিনী' উপন্যাসের ভূমিকাতেই 'বাঙ্গালি লেখকেরা' বলতে তিনি হিন্দু লেখকদেরই নির্দেশ করেছেন, তা শরৎচন্দ্রের বহু আগে। কাজেই শরৎচন্দ্রকে অহেতুক দায়ী করার কোনো অর্থ হয় না।

এসব দৃষ্টান্তই বুঝিয়ে দেয়, ভাষার শব্দ ব্যবহার সম্বন্ধে আমাদের প্রতি মুহূর্তে সতর্ক ও সচেতন থাকা দরকার। কারণ প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িকতা যদি মৌলবাদের দ্বারা ব্যবহৃত হতে পারে, প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতাও মৌলবাদকেই শেষ পর্যন্ত সহায়তা করে। সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু দু দলেরই এ বিষয়টা বুঝে নেওয়া দরকার, বিশেষত সংখ্যাগুরুর দরকার আরও বেশি।....

- 'শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মৌলবাদ', পবিত্র সরকার

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]