এরিখ মারিয়া রেমার্ক

 

তার বইগুলো থেকে আমরা জানতে পারি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশেষ করে আমেরিকানরা জার্মানির এমন অবস্থা করেছিল যে, তাদের এক ডলারের বিনিময়ে জার্মান মুদ্রার মান ১২ লক্ষ মার্ক এ নেমে গিয়েছিল। অসহায় সাধারণ জার্মানরা এজন্য প্রাচীনকালের মতো দ্রব্য বিনিময় প্রথা শুরু করেছিল জীবন বাঁচাতে। জার্মান সামরিক কর্তৃপক্ষ তাদের সৈন্যদের জন্য বেশ্যালয় তৈরি করেছিল আলাদাভাবে। যৌন কর্মের আগে ও পরে এসব সৈন্যদের ইনজেকশন দেয়া হতো। অসহায় জার্মান মেয়েরা জীবন বাঁচাতে এই পেশায় জড়িত হয়েছিল।

পশ্চিমারা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়ালেও নিজেদের ব্যাপারে নিশ্চুপ। রেমার্ক তার 'A Time to Love and a Time to Die' বইটিতে মিত্র বাহিনীর পশ্চিমা দেশগুলোর বর্বরতা তুলে এনেছেন বিস্তারিতভাবে। এরা বোমা ফেলে জার্মানির বেসামরিক বসতিগুলোকে রীতিমতো গণকবরে পরিণত করেছিল। পোল্যান্ড ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নারীদের জোর করে ধরে এনে নাৎসিদের দ্বারা ক্ষেতে খামারে কাজ করিয়ে নেয়ার ব্যাপারটাও উঠে এসেছে এতে। নাৎসি বর্বরদের দ্বারা সোভিয়েত ইউনিয়নের নারী গেরিলাদের হত্যার আগে ধর্ষণের কথাও বলেছেন রেমার্ক। আমরা এই বইটি থেকে জানতে পারি নাৎসিরা সোভিয়েত শিশুদের গলায় ভদকা ঢেলে আগুন ধরিয়ে খুন করতো। মূল জার্মান ভূখণ্ডে অনেকগুলো শেল্টার কেবল উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল, যা সাধারণ মানুষদের অধিক সংখ্যায় মৃত্যুবরণের অন্যতম কারণ ছিল। এছাড়া দরিদ্র ঘরের আহত সৈনিকদের নামমাত্র চিকিৎসার ব্যবস্থা করে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেয়া হতো। সামরিক বাহিনীর কসাই ডাক্তাররা এনেস্থেশিয়া ছাড়াই মারাত্মক আহত সৈনিকদের চিকিৎসা দিতো, খরচ বাঁচাতে সামান্য ক্ষত দেখলেও পা কেটে ফেলতো। ছুটিতে এসে পালিয়ে থাকা কিশোর সৈনিকদের ধরতে পারলে গুলি করে মারা হতো। পলাতক সৈনিকদের পরিবারের সদস্যদেরও খুন করা হতো। নাৎসিদের বিরুদ্ধে গেলেই সাধারণ জার্মানদের কুড়াল দিয়ে কেটে কল্লা আলাদা করে ফেলা হতো। পশ্চিমারা কাতিন গণহত্যার দায় সোভিয়েতদের উপর চাপিয়ে দিলেও এই বইয়েই অসংখ্য পোলিশকে নাৎসিদের দ্বারা খুনের কথা ও সেজন্য পুরস্কৃত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

'Heaven Has No Favorites' বইটিতে একজন জিজ্ঞেস করছে সোভিয়েতদের রাস্তার অবস্থা, আরেকজন ঠাট্টা করে উত্তর দিচ্ছে তারা বরফ যুগের অবশিষ্ট ব্যবহার করছে। মূলত অক্ষ শক্তির সোভিয়েত ভূমিতে চালানো বর্বরতার একটা দিক এভাবে তুলে এনেছেন রেমার্ক বইটিতে। তাছাড়া পালিয়ে যাওয়া হোয়াইট আর্মি ও তাদের পারিবারিক সদস্যদের ইউরোপের বিলাসী জীবনযাপনের কথা উঠে এসেছে বইটিতে। 

অনেকের থাকার অনুমতি থাকলেও কাজ করার অনুমতি ছিল না। এরা ছোটখাটো জিনিস বিক্রি করে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করতো। মিত্র বাহিনীর দেশগুলোর অসৎ পুলিশরা এদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জিনিস কেড়ে নিতো নিজেদের ব্যবহারের জন্য।

মৃতদের আত্মীয়দের থেকে অর্থের বিনিময়ে জীবিত রিফিউজিরা পাসপোর্ট ক্রয় করতো। 

তার বিভিন্ন বই থেকে আমরা আরও জানতে পারি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এক লক্ষ জার্মান ইহুদি কাইজারের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল। এদের মধ্যে ১২ হাজার মারা যায় জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে করে। অথচ যুদ্ধের পর স্মৃতিস্তম্ভতে এদের নাম লিখতে দেয়া হতো না, স্মরণ অনুষ্ঠানে মৃত ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের জন্য আলাদা দুইজন পাদরী থাকতো। কিন্তু মৃত ইহুদিদের জন্য কোনো রাব্বি ডাকার অনুমতি ছিল না। উল্লেখ্য, আব্রাহামিক ধর্মগুলোর নিয়ম অনুযায়ী কেউ আত্মহত্যা করলে তাকে এদের ধর্মীয় উপাসনাস্থল সংলগ্ন কবরস্থানগুলোতে কবর দেয়া নিষিদ্ধ। জার্মানিতে দুই বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেকেই নানা কারণে আত্মহত্যা করেছিল। পরবর্তীতে তাদের লাশের ব্যাপারে ধর্মীয় পান্ডারা খবরদারি করেছিল এই নিয়মের মাধ্যমে।

'Shadows in Paradise' বইটিতে রেমার্ক দেখিয়েছেন কিভাবে কিছু ইহুদি একাত্তরের বাঙালি রাজাকারদের মতোই অন্যান্য ইহুদিদের ঠিকানা বলে দিতো নাৎসি বর্বরদের। শেষে বিপুল পরিমাণ অর্থ পুরস্কার দিয়ে নাৎসিরাই আমেরিকা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দিতো এদের। তাছাড়া যুদ্ধ পরবর্তী জার্মানিকে পুনর্গঠনের নামে মার্কিন জোঁকেরা কিভাবে অর্থের পাহাড় বানিয়েছিল সেই ব্যাপারটাও তুলে এনেছেন তিনি বইটিতে।

তিনি আমাদের তার কালজয়ী সাহিত্যগুলোর মাধ্যমে জানালেন আব্রাহামিক তিন ধর্মের পুরুষদের জন্যই যে খৎনা করা বাধ্যতামূলক তা নাৎসিরা জানতো। পাকিস্তানি বর্বররা যেমন অমুসলিম পূর্ব পাকিস্তানিদের ধরতে এই পদ্ধতি কাজে লাগাতো, ঠিক তেমনি নাৎসি বর্বররাও ইহুদিদের ধরতে একই পন্থা অনুসরণ করতো। অর্থাৎ উলঙ্গ করে খৎনা করা আছে কিনা দেখা।

রেমার্ক তার 'The Night in Lisbon' বইটিতে দেখিয়েছেন লাল ফৌজের বীর কমিউনিস্টদের হাতে পরাজিত হয়ে জার এর দালাল শ্বেত ফৌজের জোঁকেরা জার্মান ভাষাভাষী দেশগুলোতে পালিয়ে গিয়েছিল। সেখানে তারা সঙ্গে নিয়ে যাওয়া রুশ উপপত্নীদের ছাড়াও প্রথম মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউরোপের দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করাতো। এরা ছাড়াও জার আমলের অভিজাত শ্রেণীর অসংখ্য জোঁক বিপ্লব চলাকালীন বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি নিয়ে এসব দেশে পালিয়ে যায়। তাছাড়া জার্মান ভাষাভাষী দেশগুলো থেকে পালিয়ে আসা অসহায় সাধারণ মানুষদের দিয়ে কাজ করানোর সময় যে মিত্র দেশগুলো তীব্র মজুরি শোষণ চালাতো সেটাও উঠে এসেছে বইটিতে।

বিশ্বসাহিত্যের নানা লেখায় নাৎসিদের ইহুদিদের উপর বর্বরতার কথা উঠে আসলেও তারা জার্মান কমিউনিস্টদের সাথে কি কি করেছে সেই ব্যাপারে খুব কমই আলোচনা করা হয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত জার্মান লেখক এরিক মারিয়া রেমার্ক তার 'Spark of Life' বইতে কিভাবে অত্যাচারের সময় কমিউনিস্টদের চোখে আর অন্ধকোষে সিগারেটের ছেঁকা দেয়া হতো, ধর্ষণ করা হতো, দিনের পর দিন না খাইয়ে রাখা হতো, তাদের অন্য বন্দিদের থেকে আলাদা করে চিনতে পোশাকে লাল রঙের কাপড়ের টুকরা সেলাই করে দেয়া হতো, কিভাবে তাদের রোদে আর ঠান্ডায় ক্রুশে ঝুলিয়ে রাখা হতো, প্রবল অত্যাচারে মৃত্যুর পর লাশগুলো জ্বালিয়ে ফেলা হতো ইত্যাদি অনেক কিছুই তুলে এনেছেন। নাৎসিরা নিজেদের সামরিক কুকুরদের প্রশিক্ষণ দিতে তাদের উপর লেলিয়ে দিতো। দহন চুল্লিগুলোর লাশের ছাই এরা কৃত্রিম সার হিসেবে বিক্রি করতো কিংবা নিজেদের বিশাল বিশাল ব্যক্তিগত খামারে ব্যবহার করতো। আবার এসব ছাই বরফে পিছলে না যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হতো। যতবার মিত্রশক্তি তাদের কোনো শিবিরের উপর বোমাবর্ষণ করতো, তারা শাস্তিস্বরূপ বেছে বেছে কমিউনিস্ট বন্দিদের হত্যা করতো ঐ শিবিরে। কমিউনিস্টদের নিকট আত্মীয় আর পরিবারের সদস্যদেরও তুলে এনে তারা অত্যাচার করতো। কোনো বন্দির স্বর্ণের দাঁত থাকলে তারা সেটা তালিকাভুক্ত করতো এবং ঐ বন্দিকে পোড়ানোর পর স্বর্ণের টুকরোটা নিজেরা নিয়ে ফেলতো। পোড়ানোর আগে অন্য কোনো বন্দি লুকিয়ে ফেললে পুরো শিবিরের সব বন্দিকে না খাইয়ে রাখা হতো এবং কেউ ধরা পড়লে তাকে ফাঁসি দেয়া হতো। কাতিন গণহত্যার দায় এরা প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে সোভিয়েতদের উপর চাপানোর কাজটা ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছিল। অথচ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যোদ্ধা এই বিখ্যাত লেখক এই বইয়ে তুলে ধরেছেন কিভাবে বন্দি শিবিরগুলো পোলিশ আর রুশ বন্দিদের দ্বারা ভর্তি থাকতো। নাৎসি বাহিনীর কর্মকর্তারা সোভিয়েত কমিউনিস্টদের দিয়ে বাড়ির ব্যক্তিগত কাজগুলো করিয়ে নিতো। নাৎসি বাহিনীর সদস্যরা অবস্থাপন্ন পরিবার থেকে আসেনি। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এরা লাখপতিতে পরিণত হয়েছিল বিশেষ করে ইহুদিদের সম্পত্তি জোর করে দখলে নিয়ে। এই বই থেকে আমরা আরো জানতে পারি গোয়েবলস কিভাবে লালফৌজের দ্বারা জার্মান শহরগুলোকে ধ্বংসের বানোয়াট কাহিনী বানিয়ে নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতো উগ্র জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে। কাউকে শাস্তি দেয়ার সময় তারা অন্য বন্দিদের গান গাইতে বাধ্য করতো। কারখানাগুলোতে কাজ করার জন্য যেসব শ্রমিককে আলাদা করে রাখা হতো সেসব বন্দিদের মাঝে বছরের পর বছর নির্যাতন সহ্য করার কারণে যে প্রচন্ড হতাশা দেখা দিতো সেটা দেখে তারা পরস্পরকে 'মুসলমান' বলে উপহাস করতো। কারণ সারা বিশ্বের কাছেই এই সম্প্রদায় পরিচিত তাদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কারণে, আর সেটা হচ্ছে চেষ্টা না করেই ভাগ্য তথা তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেদের সঁপে দেয়া। শিবিরগুলোতে নাৎসিদের মনোরঞ্জনের জন্য অভাবের কারণে বাধ্য হয়ে পতিতাবৃত্তিতে নাম লেখানো জার্মান নারীদের আনা হতো। নাৎসি ডাক্তাররা যেসব জীবন্ত বন্দিদের উপর পরীক্ষা চালাতো তাদের মধ্যে অসংখ্য কমিউনিস্ট ছিলেন। অথচ গণহারে সবাইকে পশ্চিমা বিশ্ব সাধারণ ইহুদি হিসেবে প্রদর্শন করে এসেছে বছরের পর বছর ধরে। বিজ্ঞানের স্বার্থে শ্রমদান করছে, এই বিবৃতি সহ সই জোর করে তাদের কাছ থেকে আদায় করা হতো শিবিরগুলো থেকে এসব কসাই ডাক্তারদের কাছে পাঠানোর আগে। ক্যাম্পে প্রত্যেক নাৎসি কর্মকর্তার রক্ষিতা থাকতো এরা বিবাহিত হওয়ার পরও। ব্যক্তিগত বাগানে ধরে আনা সোভিয়েতদের শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগানোর পর তাদের গরুর মতো পেটানো হতো, যখন-তখন গুলি করে মারা হতো। ক্যাম্পের দাহন চুল্লির কর্মীদের প্রতি ৪-৫ মাস অন্তর নিধন শিবিরে নিয়ে গিয়ে গ্যাস প্রয়োগে হত্যা করা হতো নাৎসিদের অপকর্মের সাক্ষীদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে। এসব ক্যাম্পে অসংখ্য মুসলমান আটক ছিল, তথ্যটা না জেনেই অনেক মুসলিম এখনো হিটলারকে পছন্দ করে কেবল ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষ এর কারণে। এসব ক্যাম্পগুলোর বন্দিদের অর্ধেকের বেশি ছিল কমিউনিস্ট আর বামপন্থীরা যাদের যুদ্ধের শেষের দিকে খরচ বাঁচাতে নাৎসিরা খুন করেছিল, অথচ পশ্চিমারা এসব তথ্য প্রকাশ করে না। বাকি বন্দিদের কিছু ছিল সমকামী, এই তথ্যটাও পশ্চিমারা এড়িয়ে গিয়ে স্ট্যালিনের পিছে লাগে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। বন্দিদের মধ্যে আরও ছিলেন অসংখ্য সাংবাদিক আর 'জিহোভা'স উইথনেসেস' সম্প্রদায়ের অনুসারীরা। নাৎসি কর্মকর্তারা মিত্র বাহিনীর বোমার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ জার্মানদের বাড়িগুলো পানির দরে কিনে নিতো। যেগুলোতে বোমা পড়েনি, সেগুলোও তারা কিনে নিতো নিরীহ জার্মানদের আতঙ্কের সুযোগ নিয়ে। বোমার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন খনি আর যুদ্ধাস্ত্রের কারখানাগুলো মেরামতের কাজ বন্দি শ্রমিকরা হাত দিয়েই করতো শাবল আর বেলচার অভাবে। তাদের হাত ক্ষতবিক্ষত আর রক্তাক্ত হয়ে যেতো, টানা ১২ ঘন্টা কাজ করানোর ফাঁকে একবার মাত্র পাতলা ঝোল খেতে দেয়া হতো তাদের। এদের ঘুরপথে ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো যেন শহরের সাধারণ জার্মানরা এদের দুর্দশা দেখতে না পায়। প্রচন্ড মারধরের পর বন্দিরা অজ্ঞান হয়ে গেলে নাকের নিচে জ্বলন্ত দিয়াশলাই এর কাঠি ধরে জ্ঞান ফেরানো হতো। প্রায়ই অশক্ত শ্রমিকদের গুলি করে মেরে ফেলতো নাৎসিরা। নিধন শিবিরগুলোতে স্নানের নাম করে মানুষগুলোকে উলঙ্গ করিয়ে গ্যাস কুঠুরিতে ঢুকিয়ে দেয়া হতো। তারপর ধারাযন্ত্র থেকে পানির বদলে ছড়িয়ে পড়তো মারাত্মক গ্যাস। বন্দিদের অকর্মণ্য বিবেচনা করলে ইনজেকশন দিয়েও মেরে ফেলা হতো। অজ্ঞান হয়ে গেলে জীবন্ত জ্বালিয়ে ফেলা হতো তাদের। তাদের দৌঁড়াতে বলা হতো যাচাই করতে। প্রাণ বাঁচাতে বন্দিরা তা-ই করতে গিয়েই অনেকে মারা যেতো। এসএসদের মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেকে বিজলিবাহী কাঁটাতারের বেষ্টনীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করতো। নাৎসিরা জ্যান্ত অবস্থায় অনেকের চোখ পুড়িয়ে দিতো। শিবিরের কয়েদিদের মাথা মুড়িয়ে চুলগুলো ব্যবসার জন্য সংগ্রহ করে রাখা হতো। আংটা থেকে তাদের ঝুলিয়ে দেয়া হতো যন্ত্রনা দিয়ে ধীরে ধীরে মারতে। মিত্রবাহিনীর বোমাবর্ষণে ধ্বংস হওয়া জঞ্জাল সরানোর সময় আবার বিমান হামলার সংকেত বাজলে নাৎসিরা লুকিয়ে থাকলেও এদের খোলা আকাশের নিচে অসহায়ের মতো মরতে হতো। জঞ্জাল সরানোর কাজেও অনেকে মারা যেতো দেয়াল চাপা পড়ে। যুদ্ধের শেষের দিনগুলোতে ইচ্ছা করে কয়েকদিন পর পর ছাউনিগুলোতে রাতে রুটি না দিয়ে মৃতের সংখ্যা বাড়িয়ে 'বোঝা' কমানো হতো।

'দি স্পার্ক অব লাইফ' বইটিতেও পোল্যান্ডে নাৎসিদের গণহত্যার কথা উল্লেখ আছে। অথচ বুর্জোয়া পুতিন পশ্চিমাদের দ্বারা কাতিন গণহত্যার দায় স্তালিনের উপর চাপিয়ে দেয়া মেনে নেয়। 

তবে বইটিতে তিনি সাম্যবাদ ও সাম্যবাদীদের সমালোচনা করেছেন এবং নাৎসিদের সাথে তাদের 'সমগোত্রের' হিসেবে বিবেচনা করেছেন রেমার্ক তার চরিত্রের বক্তব্যের মাধ্যমে।

নাৎসিরা নিজেদের সিফিলিস রোগ গোপন করতে যেই চিকিৎসকদের দ্বারা চিকিৎসা করাতো তাদের মেরে ফেলতো কিংবা শিবিরে বন্দি করে রাখতো। বন্দিরা মৃতদের শরীর থেকে লিভার সংগ্রহ করে খেতো খাবার না পেয়ে। যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে নাৎসিরা শিবিরগুলোর চারপাশে ফুলের গাছ লাগিয়েছিল, বন্দিদের জন্য নতুন পোশাকের ব্যবস্থা করেছিল আর প্রচুর খাবার মজুদ করেছিল এই উদ্দেশ্যে যে, মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার পর তারা যেন নিজেদের 'মানবিক' হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে। পরাজয় নিশ্চিত জেনে শিবির ত্যাগের আগে বর্বররা গ্যাসোলিন দিয়ে বন্দিদের পুড়িয়ে মারতো। এই অবস্থায় কোনো বন্দি বের হয়ে আসলেই গুলি করে মারা হতো।

নাৎসিরা কয়েদিদের মাথা থেকে টুপি খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার পর সেটা কুড়িয়ে আনতে বলতো। কয়েদিরা তা করতে গেলে এদের পেছন থেকে গুলি করা হতো। এটা ছিল এই বর্বরদের প্ৰিয় খেলা। পুরস্কার হিসেবে এসএস সদস্যরা কয়েকদিনের ছুটি পেতো।

অনেক বন্দিকে শেকলে বাঁধা থাকতে হতো পূর্ণ মাত্রায় তাপ সঞ্চালিত উত্তপ্ত নলের সঙ্গে। তাদের উচ্চ মাত্রায় লবণ মিশ্রিত পানি দেয়া হতো খাওয়ার জন্য। অনেককে আবার পা বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হতো।

বইটির শেষে লেখক মার্কিনীদের এতো এতো প্রশংসা করলেন যা দৃষ্টিকটু। অথচ মিত্র বাহিনীর পশ্চিমা দেশগুলোর সৈনিকদের যুদ্ধপরাধের তালিকা বিশাল।

তিনি তার কিছু বইয়ে নারীদের সম্পর্কে আপত্তিকর কিছু লাইন লিখেছেন। যেমন-

"মেয়েরা একা থাকতে পারে না কেন?

কারণ আমরা লতাগাছের মতো - কোনও অবলম্বন ছাড়া থাকতে পারি না। অবলম্বন সরিয়ে নিলে ধপাস করে মাটিতে পড়বো আমরা। পচে মরবো সেখানেই।"

- শ্যাডোয ইন প্যারাডাইস 

'Arch of Triumph' বইয়ের নায়ক ডাক্তারকে দিয়ে বলিয়েছেন-

"এমন ঘটনা কোনও মহিলার সাথে ঘটে না।"

অথচ নায়কের কাছে পুরুষদের দ্বারা সংঘটিত প্রেম সংক্রান্ত প্রতারণা স্বাভাবিক!

একই বইয়ে আছে-

"ডাক্তারদের সবসময় ভালো কারণ থাকে", সে ধীরে ধীরে বললো এবং তার দিকে তাকালো। 

"নারীদের মতো, জোয়ান। আমরা মৃত্যু তত্ত্বাবধান করি আর তুমি ভালোবাসা তত্ত্বাবধান করো। এর মধ্যেই পৃথিবীর সমস্ত কারণ এবং সমস্ত অধিকার নিহিত।"

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]