সমাজতান্ত্রিক চীন?

 

নরওয়ের ‘সার্ভ দ্য পিপল’ সংগঠনের সমাজতন্ত্র বিষয়ক একটি প্রবন্ধের চীন সংক্রান্ত অংশ-

সোভিয়েত সংশোধনবাদের সঙ্গে চীনা সংশোধনবাদের বহু মিল আছে। তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিল হলো উৎপাদিকা শক্তির ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করা। একে বলে উৎপাদিকা শক্তির তত্ত্ব। সংক্ষেপে বলতে গেলে এই তত্ত্বের মূল বক্তব্য হলো, সমাজতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধি। এই তত্ত্ব দাবি করে প্রযুক্তির উন্নতি, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দক্ষতার বিকাশই হলো সমাজতন্ত্রের বুনিয়াদ। এই বিষয়টা সংক্ষেপে বোঝাতে গিয়ে দেং জিয়াও পিং বলেছিলেন, “বিড়াল যদি ইঁদুর ধরতে পারে, তাহলে সেটা সাদা না কালো তা দেখার দরকার নেই”। এই বক্তব্য সংশোধনবাদ ও পুঁজিবাদী পদ্ধতিকে ন্যায্যতা দেয়, কারণ তাতে উৎপাদন বাড়ে; অতএব জনগণের জীবনযাত্রার মান বাড়ে। লেবার পার্টির নেতা হ্যারল্ড বার্নস্টেন তার আত্মজীবনীতে গত শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের লেবার পার্টির এক সাধারণ সম্পাদকের কথা লিখেছিলেন, যিনি কিনা সিআইএ-র এজেন্ট ছিলেন। সেই সাধারণ সম্পাদক বলতেন, পতাকার রং লাল হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি শিশুদের গালে লালচে আভা। তাদের স্কুলে ঘর গরম করার যন্ত্র থাকলেই ঐ লাল আভা তৈরি হতে পারে। আর তেমন স্কুল তৈরি করতে পারে সামাজিক গণতন্ত্রীরাই। মার্কসবাদী হিসেবে আমরাও উৎপাদনে গুরুত্ব দিই। ‘উৎপাদনই মানব সভ্যতার সবচেয়ে বুনিয়াদি বিষয়’- মার্কসবাদী এই সত্যকে সামনে নিয়ে আসে। এক্ষেত্রে সংশোধনবাদীরা এই সত্যটাই আঁকড়ে ধরে। কিন্তু এটা তারা নিতান্তই যান্ত্রিকভাবে করে। আর বলতে চায় উৎপাদনটাই প্রাথমিক ব্যাপার, অর্থনীতি সবকিছুর থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেটা বাস্তবসম্মত লাইন নয়। মাওয়ের লাইন ছিল “বিপ্লবকে আঁকড়ে ধর, উৎপাদন বাড়াও”। মাওয়ের কাছে সমাজতন্ত্রের মূল বিষয় ছিল বিপ্লব, আর সেটাই উৎপাদনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে- উল্টোটা নয়। স্তালিনের বক্তব্য অনুযায়ী সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক নীতি হলো জনগণের প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, ‘তাদের ধনী বানানো নয়!’ চীনা সংশোধনবাদ সেই প্রবণতাকেই উৎসাহিত করছে। সর্বহারার একনায়কত্ব ছাড়া সমাজতন্ত্র থাকতে পারে না। শ্রেণি সংগ্রাম ছাড়া সাম্যবাদ অসম্ভব। বিপরীতে সর্বহারার একনায়কত্বের পতন হলে সমাজতন্ত্রেরও পতন হয় এবং পুঁজিবাদ পুনঃস্থাপিত হয়। সংশোধনবাদীরা ক্ষমতা দখল করার পর চীনের পরিবর্তন গোটা দুনিয়াকে দেখাচ্ছে মাওয়ের এই অন্তর্দৃষ্টি কতটা ঠিক। যদি বিড়াল নতুন বুর্জোয়াদের দরজার সামনে শুয়ে থাকে তাহলে সে যত ইঁদুরই ধরুক, তাতে জনগণের কিছু যায় আসে না।

.....................................................................

'পিংপং ডিপ্লোম্যাসি'কে মাও এর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল বললে হয়তো অত্যুক্তি হবে না। এই পদক্ষেপের কারণেই চীনের জাতিসংঘে প্রথমে সদস্যপদ  এবং পরে স্থায়ী সদস্যপদ পেতে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয়নি। কিন্তু কূটনৈতিক পদক্ষেপ আর সংস্কারের নামে সমাজতন্ত্রকেই বিকৃত করে ফেলা এক জিনিস নয়। বাজার অর্থনীতি নিয়ে আসার পুরস্কার স্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র চীনকে সর্বোচ্চ সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের বাণিজ্যিক মর্যাদা দিয়েছিলো বাণিজ্য ঘাটতির ঝুঁকি নিয়েও।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Most_favoured_nation

যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়েই পুঁজিবাদী চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দিয়েছিল। বিশ্বের ৫০০টি বড়ো বড়ো কোম্পানি যারা বিশ্ব বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের মাঝে শীর্ষে রয়েছে চীনের ৩৭টি কোম্পানি।

তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক চীনে এনজিওগুলোর নামের তালিকা-

https://en.m.wikipedia.org/wiki/List_of_non-governmental_organizations_in_China?fbclid=IwAR1nJYcbJ7D4GkTef_0Fk2D3TBBZRmQHnVcc-h8XiOEyovchdahs_S2J4nE

কুখ্যাত রবার্ট ম্যাকনামারা বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট থাকার সময় ১৯৬০ এর দশকে তার 'Assault of the Poverty of the World' বইটিতে লিখেছিলেন-

"We are helping the poor countries but what do we find poor are becoming poorer and rich are becoming richer. Gap between poor and rich is only widening. So with our own cost we are creating our own enemies. We are helping the poor countries with an aim to oppose communism, but we are paving the path of communism. Since we are world lender and facing Soviet Union we can't avoid giving help to this people. The tragedy is this help doesn't go into the deep of the society. The upper layer of the society swallows it. We have to find out a way to reach the grassroots level."

১৯৭৯ সালেও যেখানে মাত্র ১০০টি বিদেশী প্রতিষ্ঠান ছিল, বর্তমানে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক চীনে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে কয়েক লক্ষ!

...................................................................

২০০৮ সালে পদ্মা সেতুর প্রথম বাজেট ছিল প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। সেই বাজেট বাড়তে বাড়তে হয়ে যায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ সরকার বলেছিল সড়ক পথের জন্য খরচ যা হয়েছে তার জন্য অর্থ বিভাগ সেতু কর্তৃপক্ষকে লোন দিয়েছে। ১% সুদসহ ৩৫ বছরে এ অর্থ ফেরত দেবে সেতু বিভাগ। ফলে ২০৫৭ সাল পর্যন্ত বিবিএকে টানতে হবে ঋণের বোঝা (সূত্র: শেয়ারবিজ, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২)। পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নে ঋণ দিয়েছিল এডিবি। ২% সুদে ৩০ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে বিবিএকে। এ ঋণের বোঝা টানতে হবে ২০৩৭ সাল পর্যন্ত। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকার বিপরীতে সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হবে ৩৬ হাজার ৪০৩ টাকা। এই সময়ে এসডিআর (স্পেশাল ড্রইং রাইটস) এর সাথে আরেকটি ঋণের চুক্তি ছিল। এখানে সুদের হার ছিল ৬%। প্রায় ১০০ কোটি টাকার মত ঋণ দেয় তারা। আর রেলপথের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ হিসেবে দিয়েছে ২৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা (যুগান্তর, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮)। অতিরিক্ত টোলের ফলে মানুষের জীবনের ব্যয়ভার বেড়ে গিয়েছে এবং ২১টি জেলা থেকে যত ধরণের খাদ্য পণ্য ঢাকা সহ বিভিন্ন জায়গায় যায় তারও দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। লীগ সরকার ঘোষণা দিয়েছিল পদ্মার দুপারে ইকোনোমিক জোন সহ পার্ক বানানো হবে। সেই জোনে সস্তা শ্রম দিলে কি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হতো? 'বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) মোটরযান চুক্তি'র বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে এই সেতুর ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, সেতুর দুই ধারে রেল সংযোগ, ট্রান্সএশিয়ান হাইওয়ে ও রেল সংযোগ - এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে পদ্মা সেতু (প্রথম আলো, ২৫ জুন, ২০২২)। পদ্মা সেতুর ফলে বাংলাদেশের মংলা, চট্টগ্রাম বন্দরে করিডোর-ট্রানজিট করতে কম সময় লাগবে এবং তেল কম খরচ হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে। ভারতের পণ্য তাদের বন্দরগুলো থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর দিয়ে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি অঞ্চলে অনায়াসে পৌঁছাতে পারবে একমাত্র পদ্মা সেতু ও ট্রানজিটের কারণে। এই সেতুর কারণে বেনাপোল দিয়ে ভারত আগরতলায় পৌঁছাতে পারবে। বাংলাদেশ বহু আগেই ট্রানজিট ব্যবহারের জন্য অনুমতি দিয়েছে ভারতকে। পশ্চিমবঙ্গের হিলি সীমান্ত থেকে সড়কপথে মেঘালয় রাজ্যের তুরা সীমান্তে পৌঁছাতে সময় লাগে দুই দিন৷ এই সংকট সমাধান হবে ভারতের জন্য। সিঙ্গাপুর থেকে ইউরোপে ট্রেন যাবে পদ্মা সেতু হয়ে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত করবে এই সেতু। এই নেটওয়ার্ক চালু হলে ভারত, ভুটান ও নেপালে সরাসরি যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের দুয়ার খুলবে (প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম, প্রকল্প পরিচালক, পদ্মা সেতু)। এভাবেই সাম্রাজ্যবাদ এই পদ্মা সেতুর জন্য লাভবান হবে। এজন্যই চীনারা আর মার্কিনিরা সাধুবাদ জানিয়েছিল।

..........................................................................

শি জিনপিং তার গুরু দেঙ জিয়াওপিং নামক বদমাইশের কতটা যোগ্য উত্তরসূরি তা আবারো প্রমাণিত। এই মহিলার পার্টি মুসোলিনিকে সমর্থন করেছিল। বর্তমান চীনকে 'সমাজতান্ত্রিক' বলে দাবি করার ভাঙা রেকর্ড চালিয়ে যাওয়া এই লোকের ভক্তদেরই হাস্যকর প্রমাণিত করে।

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]