ব্রিটিশ আমলে চা শ্রমিকদের জীবন
বাংলাদেশ ও ভারতের চা বাগানগুলোতে ব্রিটিশ আমলের কিছু উন্নাসিক নিয়ম এখনো প্রচলিত আছে। যেমন- উঁচু শ্রেণীর কর্মকর্তারা তাদের সন্তানদের ঐ বিদ্যালয়গুলোতে পড়াতে পারবে না যেখানে নিচু শ্রেণীর স্টাফ ও শ্রমিকরা তাদের সন্তানদের পড়াচ্ছেন, সমমর্যাদার বাইরের কোনো আত্মীয়ের সাথে পর্যন্ত সম্পর্ক রাখা যাবে না, শ্রমিক ও নিচু শ্রেণীর স্টাফদের সাথে মেলামেশা করা যাবে না ইত্যাদি। ব্রিটিশদের ধারণা ছিল শ্রেণীবৈষম্য নাকি উৎপাদন বৃদ্ধির সহায়ক!
ব্রিটিশরা কর্মকর্তা হিসেবে চা বাগানগুলোতে মূলত সেসব শ্বেতাঙ্গদেরই পাঠাতো যাদের ব্রিটেনে অপরাধের রেকর্ড আছে। ব্রিটেনের মূল ভূখণ্ডের এই অপরাধীরা উচ্চ শিক্ষিত ছিল না। আর এদের মধ্যে অপরাধ করার প্রবণতা থাকতো বলে উপমহাদেশে আসার পর এরা মনের সুখে নিজেদের বিকৃতি মিটিয়ে নিতো। প্রশ্ন তোলার কেউ ছিল না। কোম্পানিও কোনো ব্যবস্থা নিতো না, কারণ এদের দ্বারা কোম্পানিকে খুশি রাখতে পারলেই হতো। ব্রিটিশ কর্মকর্তারা কোম্পানিকে ভুল তথ্য দিয়ে বলতো যে, তারা প্রতি সপ্তাহে শ্রমিকদের বেতন দিতো (পুরুষদের বেশি)। আদতে তারা শ্রমিকদের পরিশ্রমের অর্থ আত্মসাৎ করে মাসের শেষে বেতন দিতো। আবার চাল, ডাল, তেল, লবণের দাম বেতন থেকে কেটে রাখতো। তাছাড়া কোম্পানি নির্ধারিত বেতন শ্রমিকরা পেতো না, এজেন্টরা যেই পরিমাণের কথা বলে তাদের নিয়ে আসতো তারা সেই পরিমাণে বেতন পেলেও ব্রিটিশ কর্মকর্তারা কোম্পানিকে ভুল রিপোর্ট পাঠিয়ে বাকি অর্থ মেরে দিতো। এই দরিদ্র আর অশিক্ষিত শ্রমিকদের আঙুলের ছাপ নিয়ে নেয়া হতো কোম্পানির কাছে এটা প্রমাণ করতে যে, তারা কোম্পানি নির্ধারিত বেতন নিতো। উদ্বৃত্ত অর্থের ৪০% সহকারী ম্যানেজার আর ৬০% ম্যানেজার মেরে দিতো। কাজ ঠিকমতো না করলে বা তাদের চোখে শ্রমিকদের কোনো আচরণ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হলে ব্রিটিশ কর্মকর্তারা শ্রমিকদের খাঁচায় রেখে খাবার আর পানি ছাড়া কিছুদিনের জন্য রেখে দিতো। বাঘের আক্রমণ ছাড়াও ম্যালেরিয়ায় অসংখ্য শ্রমিক মারা যেতো অসহায়ের মতো। বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচতে যেসব দিন শ্রমিকদের তাদের কলোনির আশেপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করতে বলা হতো, সেসব দিনও শ্রমিকদের বেতন কেটে রাখা হতো। নিজের বাগানের নারী শ্রমিকদের দিয়ে মন ভরতো না দেখে পার্শ্ববর্তী বাগানগুলো থেকে নারী শ্রমিকদের নিয়ে আসতো এসব লম্পট ব্রিটিশরা। কোম্পানি কঠোরভাবে নিশ্চিত করতো শ্রমিকরা যেন স্থানীয়দের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। অনেক বাগানে শর্ত থাকতো কোনো শ্রমিক বিয়ে করলে তার বৌকে আগে এসব ব্রিটিশদের কাছে এক সপ্তাহ কাজ করতে হবে অর্থাৎ পুরো সপ্তাহ নারীটিকে ভোগ করার পর স্বামীর কাছে পাঠানো হতো। বাঘের আক্রমণ আর ম্যালেরিয়া ছাড়াও শ্রমিকদের জোঁকের উপদ্রব, সাপের কামড় আর আমাশয় এর সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হতো। নদী পার হয়ে পালাতে গিয়ে অনেক শ্রমিক মারা যেতো। আর পলাতক শ্রমিকদের কুকুর নিয়ে তাড়া করে ধরে এনে খাঁচায় আটকে প্রচন্ড মারধর করা হতো। এদের কান কেটে দিয়ে অন্যদের ভয় দেখানো হতো। ব্রিটিশদের ভোগের ফসল নারী শ্রমিকদের বাচ্চাদের 'মুল্যাটো' বলে ডাকা হতো।
বিভিন্ন অবাঙালি জাতির অসহায় দরিদ্রদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পর ব্রিটিশরা প্রথমদিকে আম, কাঁঠাল এদের খেতে দিয়ে চাল, গম এর পয়সা বাঁচাতো। এসব ব্রিটিশ অফিসারদের প্রায় সবাই পছন্দের নারী শ্রমিকদের রাতে জোর করে বাংলোতে উঠিয়ে নিয়ে যেতো তাদের বৌরা উপমহাদেশের পরিবেশে মানিয়ে নিতে অক্ষম হয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যেতো দেখে। আবার যাদের বৌ কলকাতায় থাকতো এবং ছুটিতে এসব বাংলোতে আসতো, তাদেরকে এসব ব্রিটিশরা পরস্পরের সাথে রাতে বিনিময় করতো (Wife swapping)। এরাই আবার নিজেদের 'সভ্য জাতি' হিসেবে দাবি করে। ক্লাবগুলোতে এদের মদ খাওয়া ছাড়াও অন্যান্য খাবারের সম্পূর্ণ খরচ কোম্পানি বহন করতো। রবিবারে ব্রিটিশরা অনেকেই গির্জায় যেতো না, কিন্তু শ্রমিকদের সবাইকে বাধ্যতামূলক গির্জায় যেতে হতো। খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করা কালীন সময় বাঁচাতে পাদ্রিরা কেবল পুরুষদের ধর্মান্তরিত করতো। তারা এই বিধান দিয়েছিল যে, পরিবারের পুরুষরা খ্রিস্টান হলে বৌ আর সন্তানরা এমনিতেই খ্রিস্টানে পরিণত হবে।
Comments