কমরেড চিয়াং চিং

 


পশ্চাৎপদ সামন্ততান্ত্রিক চীনা কৃষক নারীরা যখন শোষণ-নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে পুনর্জন্মে কুকুর হয়ে জন্মগ্রহণ করতে চাইতো সেই সমাজে সানতু প্রদেশের এক শ্রমজীবী পরিবারে ১৯১৪ সালে চিয়াং চিং জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে একটি নাট্যদলে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে রাজধানী পিকিং চলে আসেন। ১৯৩১ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা পরিচালিত নাট্যদলে যোগদান করেন এবং ১৯৩৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন।  চিয়াং চিং-এর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন না থাকলেও এসময় তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ওপর প্রচুর অধ্যয়ন করেন। লাইব্রেরিতে চাকরিরত অবস্থায় সমাজবিজ্ঞানের উপর ব্যাপক পড়াশোনা ও গবেষণা করেন। ১৯৩৩ সালের বসন্তে তাকে সাংহাইতে নিয়োগ করা হলো, যখন মাও লাইনের প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী ওয়াং মিং ও তার শহরকেন্দ্রিক লাইনের প্রভাবে পার্টি কাঠামো ধ্বংসপ্রায় এবং সুবিধাবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল। 

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Wang_Ming

চিয়াং চিং সাংহাইতে কাজ শুরু করেন মঞ্চ অভিনেত্রী হিসাবে। এখানে তিনি কয়েকটি প্রগতিশীল নাটক মঞ্চস্থ করেন। এতে দরিদ্র শ্রেণির জনগণের মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। একইসাথে তিনি নারী শ্রমিকদের মাঝেও কাজ করেন। শ্রমিকদের তিনি সচেতন করে তোলেন যে কীভাবে বৃটিশ ও জাপানি মালিকানাধীন কাপড়ের মিল ও সিগারেটের কারখানাগুলোতে শ্রমচুক্তির দুরবস্থা চলছে। এখান থেকে তিনি শত্রুর হাতে গ্রেফতার হন। আট মাস জেল খেটে তিনি জেলরক্ষীদের বোকা বানিয়ে পালিয়ে আসেন। চিয়াং চিং যখন দেখেন ২-৪টি চলচ্চিত্র বাদে সমস্ত চলচ্চিত্র পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতিক্রিয়াশীল কেন্দ্র হলিউড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তখন তিনি আওয়াজ তোলেন “জাতীয় বিপ্লবের জন্য জনগণের সাহিত্য”। শিল্পকলার ক্ষেত্রে মাও সে তুং এই আওয়াজকে অনুমোদন করেন। সাংহাই শহর জাপানিরা আক্রমণ করলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টম রুট বাহিনীতে তিনি যোগ দেন এবং ৩০০ মাইল পাহাড় পায়ে হেঁটে ইউনানে পৌঁছান।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Eighth_Route_Army

১৯৩৮ সালের শেষের দিকে চিয়াং চিং মাও এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তীতে তাদের একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। পরবর্তী বছরগুলোতে চিয়াং চিং চীনা পার্টিতে একাগ্রচিত্তে কাজ করেন এবং শত্রুর বিরুদ্ধে মাও এর পাশে থেকে লড়াই করেছেন। ১৯৪৯ সালে সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রক্ষমতা কায়েম হলে চিয়াং চিং সাংহাইতে ভূমি সংস্কার কর্মসূচিতে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। এ ক্ষেত্রেও তিনি নারীদের অসম ভূমি, খারাপ ও পতিত ভূমি দেয়ার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে ব্যাপক সংগ্রাম পরিচালনা করেন। ১৯৫০ সালে চিয়াং চিং এর গবেষণা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসাবে পশ্চাৎপদ চীনা নারীদের জন্য চীনা পার্টিতে সরকারিভাবে বিবাহ সংস্কার, স্বামী নির্বাচন, নারীদের তালাক দেয়ার অধিকারের আইন গৃহীত হয়। ১৯৬০ এর দশকের পূর্ব পর্যন্ত তিনি চীনা শিল্পকলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। প্রতিক্রিয়াশীল শিল্পকলাতে তিনি আমূল বিপ্লবী রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম হন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ সাল - এই দশ বছর মাও এর নেতৃত্বে পরিচালিত মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবে তিনি ছিলেন মাও এর পাশে অন্যতম বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যকার ঘাপটি মেরে থাকা বুর্জোয়া মতাদর্শধারীরা যদিও শর্তারোপ করেছিল চিয়াং চিং সরকারি কোন পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবে না। কিন্তু চিয়াং চিং তার যোগ্যতা ও মাও এর লাইনের প্রতি আনুগত্যতায় ঐ বুর্জোয়া পথগামীদের জবাব দেন ১৯৬৯ ও ১৯৭৩ সালে নবম ও দশম পার্টি কংগ্রেসে পলিটব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হয়ে। ১৯৭৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মাও সে তুং এর মৃত্যুর পর তার চিন্তাধারাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা ও অব্যাহতভাবে সাংস্কৃতিক বিপ্লব চালিয়ে যাওয়ার তত্ত্ব শক্ত হাতে তুলে ধরলে এক মাসের মাথায় মাও এর আদর্শ বর্জনকারী দেঙ-হুয়া চক্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চীনা পার্টি ও রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা দখল করে।  

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Hua_Guofeng

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Deng_Xiaoping

তারা চিয়াং চিংসহ সাংস্কৃতিক বিপ্লবে মাও এর প্রধান চার সহযোগী নেতৃত্বকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে বন্দী করে।

 https://en.m.wikipedia.org/wiki/Gang_of_Four

এই ভণ্ডরা ১৯৭৬ সালের তিয়েন আনমেন স্কোয়ারের দাঙ্গায় নগ্নভাবে উসকানি দিয়েছিল। তারাই আবার এই দাঙ্গার জন্য চিয়াং চিং-কে অভিযুক্ত করে। সংশোধনবাদী চক্র মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পতাকা বহনকারী নেত্রী চিয়াং চিং-কে ‘কুচক্রী’ আখ্যা দিয়ে মাও এর লাইনের প্রতি সর্বব্যাপী আক্রমণ চালায়। ১৯৮০ - ১৯৮১ সালব্যাপী প্রহসনমূলক বিচার চলে। দেঙ চক্র আদালতে তার দোষ স্বীকার করতে বললে চিয়াং চিং বলেন - 

"আদালতে আমি যদি কিছু স্বীকার করি তাহলে আমি বলবো ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ এই দশ বছর সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম করেছি এবং তা মাওএর নেতৃত্বেই। আমি যা করেছি মাও তা সমর্থন করেছেন।"

প্রসিকিউটর চিয়াং চিং এর মৃত্যুদণ্ডের আবেদন করলে চিয়াং চিং দৃঢ় কণ্ঠে বলেন -

"চেয়ারম্যান মাও একজন সেরা নারী কমরেডের মাঝে ৫টি গুণের সমাবেশ দেখতে চাইতেন-

ক. পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার ভয়ে কখনও ভীত হয়ো না;

খ. যে পদে অধিষ্ঠিত হয়েছো সেখান থেকে চ্যুত হওয়ার ভয় পেয়ো না;

গ. বিবাহ বিচ্ছেদকে ভয় পেয়ো না;

ঘ. কারারুদ্ধ হতে হলেও ভীত হয়ো না;

ঙ. ফাঁসীর দড়িতে ঝুলতে হলেও তা হাসিমুখে বরণ করে নিও।

মহান মাও এর এই পাঁচটি নির্দেশের চারটি আমি ইতিমধ্যেই পালন করেছি। পঞ্চমটি বরণ করার জন্য আমি প্রস্তুত হয়েই আছি।"

তিনি দেঙ-হুয়া চক্রের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেন - 

"তোমাদের সাহস থাকলে তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে দশ লক্ষ জনগণের সামনে আমাকে ফাঁসি দাও।"

দুই বছরেরও অধিক সময় বিচার চলার পর ১৯৮৩ সালে চিয়াং চিং-কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৯০ সালে দেঙ চক্র তাকে বন্দী অবস্থায় হত্যার পর প্রচার করে যে, চিয়াং চিং আত্মহত্যা করেছেন।

Comments

Popular posts from this blog

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-দুই]

শিবিরনামা [পর্ব-এক]