ফিলিপাইনের অগ্নিকন্যারা

 


স্পেনীয় ও মার্কিন উপনিবেশ, জাপানি ফ্যাসিস্ট আক্রমণ এবং স্থানীয় সামন্ত শোষণের বিরুদ্ধে ফিলিপিনো নারীদের অস্ত্র হাতে নেয়ার ইতিহাস গৌরবময়। পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা যুদ্ধ করেছে, ত্যাগ স্বীকার করেছে অনেক। স্পেনীয় উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামে গ্যাবরিয়েলা জীবন দেয়। তার সেই আত্মত্যাগ আজো ফিলিপিনো নারীদের বিপ্লবী সংগ্রামে উৎসাহিত করে। 

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Gabriela_Silang

কিন্তু জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সশস্ত্র বাহিনীতে নারীরা যে ক্রমবর্ধিতহারে যোগ দিচ্ছে ফিলিপাইনের ইতিহাসে তার নজির নেই। বিপ্লবের সৈনিক হিসেবে নারীরা এখন গেরিলা ঘাঁটিতে, গ্রামে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায়, সংগঠনের দায়িত্বপূর্ণ পদে, নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।  নারী গেরিলা ও কৃষক নারীদের দেখা যায় সভায়। অফিস-আদালত ও মিলিটারি ক্যাম্পমুখী মিছিলে। নারী শ্রমিকরা যোগ দেয় সড়ক অবরোধ করতে। র‌্যালির অগ্রভাগে থাকে নারীরা। তারা সরকারি নির্মূল বাহিনীর বিরুদ্ধে বাড়ির চারপাশে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। সংখ্যালঘু নারীরা পিঠে শিশু সন্তান নিয়ে সরকারি ও বহুজাতিক উন্নয়ন প্রকল্পের স্বার্থে ভিটেমাটি উচ্ছেদের প্রতিবাদ জানায়। এই নারীদের সংগঠিত করেছে 'ম্যাকিবাকা'।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Maria_Lorena_Barros

১৯৭০ এর দশকে মার্কোস সামরিক শাসনের দমন-নির্যাতনের মধ্যে ম্যাকিবাকা গোপন বিপ্লবী নারী সংগঠন হিসেবে জন্মলাভ করে। এর প্রধান কাজ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবে নারীদের অংশগ্রহণ বাস্তবায়নে গণমুক্তি বাহিনীর (NPA) সশস্ত্র প্রচার ইউনিট, গণবাহিনী ও সশস্ত্র গেরিলা ইউনিটে নারীদের বৃহত্তম অংশ, বিশেষ করে কৃষক নারী ও শ্রমিকদের নিয়োগ করা। 

https://en.m.wikipedia.org/wiki/New_People%27s_Army

‘পুরুষরা বেশি ক্ষমতাবান’ এই গতানুগতিক ধারণাকে চুরমার করে ম্যাকিবাকা সামরিক কাজে নারীদের ক্ষমতা ও শক্তির প্রয়োগ নিশ্চিত করে। তারা কৃষক নারীদের ভিতরে নিজেরা জমির মালিক হওয়ার আকাঙ্খা সৃষ্টি করে এবং নারী শ্রমিকদের কাজে উপযুক্ত পরিবেশের কর্মসূচি দিয়ে তাদের আন্দোলন-সংগ্রামে আকৃষ্ট করে। উপনিবেশপূর্ব ফিলিপাইনে নারীদের অনেক বেশি অধিকার ও স্বাধীনতা ছিল। তাদের বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার ছিল এবং তারা দেশীয় জন্মনিয়ন্ত্রণের উপকরণ ব্যবহার করতে পারতো। স্পেনীয় উপনিবেশবাদ তাদের সে অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের আরো পিছনে ঠেলে দেয়। সামন্ত শাসন তাদের ওপর আরো ভারী বোঝা চাপায়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নারীদের পুরুষের যৌনসামগ্রী ও ভোগ্যবস্তুতে পরিণত করে পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধকে আরো মজবুত করে। তাই ম্যাকিবাকার কাছে নারী নির্যাতন মূল সামাজিক দ্বন্দ্ব থেকে পৃথক নয়। আধা ঔপনিবেশিক-আধা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই নারী নির্যাতনের কারণ নিহিত। এজন্য যতদিন না নারীরা দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দেশীয় এজেন্টদের উৎখাত করার বিপ্লবী সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করবে ততদিন তারা ধর্ষিত ও নির্যাতিত হতে থাকবে। বিপ্লবী সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণের এই প্রক্রিয়াই দেশকে নিপীড়ন নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষার প্রক্রিয়া। ফিলিপাইনে নারীরা নিজেদের মুক্তির জন্যে ঐ প্রক্রিয়ার ভিত্তি রচনা করেছে। রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তারা পুরুষ শাসন ও পুরুষ কর্তৃত্বের শৃঙ্খল ভাঙ্গতে পারবে যা তাদের সব জায়গায় আটকে রেখেছে। নারী হিসেবে তাদের কেবল দেশকে নয়, নিজেদের সবাইকে মুক্ত করার জন্য লড়তে হবে। ম্যাকিবাকা মনে করে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষরা সবকিছুর মত আন্দোলন-সংগ্রামেও কর্তৃত্ব করে। তাই নারীদের রাজনৈতিক করে তোলার জন্যে তাদের সংগ্রামের পৃথক ক্ষেত্র প্রয়োজন। প্রয়োজন ভিন্ন ফোরামের যেখানে ব্যাপক রাজনৈতিক বিষয়বস্তু মাতৃত্ব, সন্তানপালন ইত্যাদি বিষয় আলোচনা হবে। ম্যাকিবাকা মনে করে পুরুষতন্ত্র বিরোধী সংগ্রামে, সংগ্রামের ভেতরে ও বাইরে, শিক্ষা সংগ্রামের একটি প্রধান অঙ্গ। পুরুষতান্ত্রিক অহমিকাকে আঘাত করেই সচেতনতা তৈরি করতে হবে।  ম্যাকিবাকার নেতা কোনি লেডেসমা বলেন-

"একটি বাস্তব সমস্যা হলো দু:খজনকভাবে সংগঠনের নিপীড়িত নারীরা এখন পর্যন্ত লজ্জা ও নিরাপত্তার অভাবের দরুন তাৎক্ষণিকভাবে বেরিয়ে আসতে পারছে না। বেরুতে পারলেই তারা পুরুষ কর্মীদের পুরুষতান্ত্রিক সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে।"

ম্যাকিবাকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা লোরেনা ব্যারোস নতুন নারীর প্রতিনিধিত্ব করে পুরুষতন্ত্রের বন্ধন ও শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে এসে, বিপ্লবের জন্য জীবনযাপন ও জীবন বিসর্জন দেন।  ১৯৭০ সালে ফিলিপাইন বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কোস দু:শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়লে ছাত্রী হিসাবে তিনি তাতে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। ১৯৭২ সালে সামরিক শাসন জারি হলে তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। এসময় তিনি গ্রেফতার হন। তিনি যখন কারাগারে তখন তার স্বামী আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করে। লোরিনা কারাগার থেকে পালিয়ে এসে তার স্বামীর এলাকার বিপ্লবী দায়িত্ব পালন করেন। একসময় ফিলিপাইনের রাষ্ট্রীয় বাহিনী (AFP) লোরিনার শেলটার ঘেরাও করলে লোরিনা যুদ্ধ করে শত্রুর অবরোধ ভেঙ্গে সহযোদ্ধাদের পালাবার পথ যখন নিশ্চিত করেন তখনই তিনি শত্রুর হাতে শহীদ হন।  

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Armed_Forces_of_the_Philippines

তার এই অবিস্মরণীয় ত্যাগ, আপোষহীন সংগ্রামী চেতনা ও দৃঢ় অঙ্গীকার অসংখ্য নারীদের বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করে। সামরিক শাসক মার্কোস ধর্মঘট নিষিদ্ধ করলে ডিস্টিলারি কারখানার নারী শ্রমিকরা প্রথম এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে।  

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ferdinand_Marcos

তারা ‘চার্চ লেবার সেন্টারে’ জমায়েত হয়ে তাদের শোচনীয় অবস্থা সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করে এবং একদিন দুপুর বেলায় কারখানায় জোর করে ঢুকে পড়ে শ্রমিকদের সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানায়। এতে ক্ষুব্ধ সরকারের সেনাবাহিনী ঐ নারীদের ঘরবাড়ি তল্লাসী করে গণহারে তাদের গ্রফতার করে। এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে অনেক স্থানে বেপরোয়া ধর্মঘট পালিত হয়। ফলে সরকার বাধ্য হয় ঐ আইন বাতিল করতে। গড়ে উঠতে থাকে গণমুক্তি বাহিনীর বিশাল আকার। কিন্তু ১৯৮০ এর দশকে দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের বিরোধী একটি ধারা দ্রুত বিজয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে নারীদের সামরিক কাজের বাইরে রাখার লাইন নিয়ে আসে। তাদের সে লাইন গৃহীত হলে নারী আন্দোলনের মারাত্মক ক্ষতি হয়। সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় নারীদের সাহসিকতা নারী মুক্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। শহরে সশস্ত্র যুদ্ধ হলে গণতান্ত্রিক নারী সংগঠনগুলোর ভূমিকা যুদ্ধের সহায়তামূলক কাজে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বাহিনী আকস্মিক হামলা চালিয়ে সন্দেহভাজন বিদ্রোহী নারীদের বন্দী করে। এতে নারী আন্দোলনের গতি স্থবির হয়। এসময় উচ্চ আমলাতান্ত্রিক শ্রেণির সাহায্যপুষ্ট এনজিওগুলো সমাজ পরিবর্তনের ধ্বজা ধরে আসে। জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলো লিঙ্গ ভিত্তিক অর্থাৎ নারী-পুরুষের পার্থক্যকে শ্রেণিবহির্ভূত বিষয় হিসাবে গণ্য করে শ্রেণির সংজ্ঞার বিকৃতি ঘটায়। তারা আপোস ও সংস্কারের লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের নামে বুর্জোয়া নারীবাদকে চালিয়ে দিয়ে বিপ্লবী আন্দোলনের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়ায়। নারী সম্প্রদায়ের ধুয়ো তুলে শ্রেণি বিভাজনকে আড়াল করে। তার জ্বলন্ত প্রমাণ পাওয়া যায় কোরি এ্যাকুইনোকে একজন নারী ও উদার গণতান্ত্রিক হিসাবে তুলে ধরে তার শাসনের প্রথম ছয় মাস তাকে তাদের সমর্থন প্রদানের মাধ্যমে। 

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Corazon_Aquino

পরে গ্যাবরিয়েলার গণতান্ত্রিক নারী ফোরাম ব্যানারে বিপ্লবী নারী আন্দোলন নারী আন্দোলনের প্রতিবিপ্লবী ধারাকে পরাস্ত করে সশস্ত্র সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণের ধারাকে প্রবাহিত করতে সক্ষম হয়। ম্যাকিবাকা বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগতিার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ সংগঠিত করে প্যারালাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তারা নারীদের ‘মিস বেকার’ ও ‘মিস দারিদ্র’ খেতাবে ভূষিত করে দ্রুত জনগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেয়।তারা বৈশ্বীকরণের বিনাশ প্রক্রিয়া, ২০০০ সালের মধ্যে রামোস সরকারের ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি, বহুজাতিক লগিং এ্যান্ড মাইনিং কোম্পানিগুলোর স্বার্থে বনভূমি উজাড়কালে সেনাবাহিনীর বোমা নিক্ষেপের বিরোধিতায়, মুক্ত বাণিজ্যিক এলাকায় যৌনপীড়ন, কুমারীত্ব পরীক্ষা, কাজের শর্তের বিরুদ্ধে ধর্মঘট পালন এবং APEC গঠনের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ, মিছিল ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে সাহসী ভূমিকা রেখেছে।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Fidel_V._Ramos

ফিলিপাইনে যে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা পুঁজিবাদ দীর্ঘদিন জনগণকে শোষণের জোয়ালে বেঁধে রেখেছে তা উৎখাতের যে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে ম্যাকিবাকার আন্দোলন তার অখণ্ড অংশ। ম্যাকিবাকা মনে করে এই সংগ্রাম কেবল পুরুষদের নয়, বরং অনেক বেশি নারীদের। কারণ তারাই ঐ ব্যবস্থা দ্বারা বেশি শোষিত ও নির্যাতিত এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ বেয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামো ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে তারাই বেশি লাভবান হবে। এই হিসাবে অন্যান্য আন্দোলনের সাথে পার্থক্য ও সমন্বয় সৃষ্টি করে ম্যাকিবাকা তাদের নির্দিষ্ট দাবি ও কর্মসূচির ভিত্তিতে সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারা সফলতার সাথে বিপ্লবী কর্মসূচিতে নারী অবস্থান স্থাপন করতে এবং এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে বিপ্লবী সচেতনতা একটি সাধারণ মাত্রায় উন্নীত করতে পেরেছে।

Comments

Popular posts from this blog

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-দুই]

শিবিরনামা [পর্ব-এক]