ক্লারা সেৎকিন

 

ক্লারা সেৎকিন জার্মান সমাজের শ্রেণি বৈষম্য ও পুঁজিতন্ত্র কর্তৃক শ্রমিক শোষণের ব্যবস্থা উচ্ছেদ তথা শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মার্কসবাদী দর্শন গ্রহণ করেছিলেন। মার্কসবাদী দর্শন অনুযায়ী সমাজের আমুল রূপান্তর ঘটাতে হলে পশ্চাৎপদ নারীদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলতে হবে এবং নারীজাতি তার শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্ত হতে না পারলে মানবজাতির সামগ্রিক মুক্তি সম্ভব নয়- এ শিক্ষায় তিনি নিজেকে সুদৃঢ়ভাবে গড়ে তোলেন এবং নারীদের মাঝে ব্যাপকভাবে কাজ করেন। ক্লারা সেৎকিন নারীদের সমস্যা নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি করেন। তিনি বিশ্লেষণ করে দেখান জার্মান নারীরা কিভাবে পুঁজিবাদের শ্রম শোষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার, পুঁজিবাদ কিভাবে নারীকে ভোগ্যপণ্যে পরিণত করেছে। “গৃহে স্বামী বুর্জোয়া ও স্ত্রী সর্বহারা শ্রেণি গঠন করে”- এঙ্গেলসের এই বিখ্যাত উক্তিকে তিনি জোরালোভাবে আঁকড়ে ধরে তার ব্যাখ্যা করেন এবং এটা যে শুধু জার্মান নারীদের সমস্যা নয়, শ্রেণি বিভক্ত সমস্ত দেশের নারীদের সমস্যা তার বিশদ ব্যাখ্যা করেন। ক্লারা সেৎকিন ১৮৯৬ সালে অনুষ্ঠিত পার্টি কংগ্রেসে নারীদের সমস্যার উপর দীর্ঘ বক্তৃতা দেন। কংগ্রেসে প্রদত্ত বক্তৃতায় তিনি বেকোফেন, মর্গান ও বুর্জোয়া নারীবাদীদের তীব্র সমালোচনা করেন এবং ব্যক্তিগত মালিকানা বা সম্পদ হচ্ছে নারী নিপীড়নের মূল উৎস, সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমই পারে নারী নিপীড়নের মূল শিকড় উপড়ে ফেলতে- এই ধারণা তিনি দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানান। নারীদের শ্রেণি সচেতন করে তুলতে হবে সেই ব্যাপারে তিনি কিছু দিক নির্দেশনা পেশ করেন। তাদের শ্রেণি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করাতে হবে, সমগ্র ট্রেড ইউনিয়নগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ আরো বাড়াতে হবে, বৃহৎ শিল্প ছাড়াও কুটির শিল্প ও কারখানার নারীদের জাগিয়ে তুলতে হবে।

১৯০৮ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে সর্বহারা নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন করেন। ১৯১০ সালে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সোস্যালিস্ট কংগ্রেসে ক্লারা সেৎকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক সর্বহারা ও নিপীড়িত নারীদের অধিকার আদায়ের প্রতীক দিবস করার প্রস্তাব করলে কংগ্রেস ক্লারা সেৎকিনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। এরপর থেকে বিশ্বব্যাপী ৮ মার্চ নারী দিবস পালন হয়ে আসছে। ক্লারা সেৎকিন লেনিনের সাথে বহুবার সাক্ষাত করেছেন। লেনিন ক্লারা সেৎকিনের নারী প্রশ্নে কিছু ভুল দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে পরামর্শ দিয়েছেন। ক্লারা সেৎকিন লেনিনের সমালোচনা ও পরামর্শগুলো গুরুত্ব সহকারে শুনেছেন ও গ্রহণ করেছেন। জীবনের শেষ কয়েক বছর তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে কাটিয়েছেন এবং সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণ পর্যবেক্ষণ করেছেন। সোভিয়েত যৌথ খামারের নারীদের মাঝে তিনি ছিলেন অতি প্রিয়জন। শারীরিক অসুস্থতা উপেক্ষা করে তিনি জার্মানির রাইখস্টাগে বক্তৃতা দিতে যান। ১৯৩২ সালের ৩০ আগস্ট ফ্যাসিবাদী একনায়কত্বের বিরুদ্ধে তিনি বক্তৃতা দেন সেখানে। এই বক্তৃতায় তিনি শ্রমজীবী সর্বহারা নারীদের উদ্দেশে বলেন- 

"মনে রেখো বোনেরা, ফ্যাসিবাদ চায় তোমাদের শুধু স্বামীদের দাসী ও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র বানাতে। ভুলো না সেই নারী যোদ্ধাদের যারা ফ্যাসিস্টদের হাতে প্রাণ দিয়েছে ও কারাগারের অন্তরালে আছে।"

রাইখস্টাগে ফ্যাসিবাদ বিরোধী ভাষণ দেয়ার সময় তিনি জার্মান ফ্যাসিস্ট বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন এবং তাদের অত্যাচারে ১৯৩৩ সালের ২০ জুন মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৩৩ সালের ৮ মার্চ ক্লারা সেৎকিনকে অর্ডার অব লেনিন উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

Comments

Popular posts from this blog

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-দুই]

শিবিরনামা [পর্ব-এক]