সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারী

 

“শ্রমিক শাসিত সরকার, কমিউনিস্ট পার্টি ও সংঘগুলো নরনারীর সেকেলে ধারণাগুলো দূর করার জন্য, অসাম্যবাদী মনস্তত্ত্বকে বিনাশ করার জন্য কোনও রকম কসুর করছে না। আইনের দিক থেকে অবশ্যই পুরুষ এবং নারীর মধ্যে সম্পূর্ণ সাম্য রয়েছে। এই সাম্যকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য আমরা মেয়েদের নিয়ে আসছি অর্থনীতি, আইনসভা ও সরকারের মধ্যে। যাতে তারা কাজকর্মের শক্তি আর সামাজিক শক্তি বাড়াতে পারে সেই জন্যেই সমস্ত শিক্ষায়তনে প্রবেশের পথ তাদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। আমরা প্রতিষ্ঠা করছি যৌথ রান্নাঘর, সাধারণের খাবারঘর, শিশুদের রাখার জায়গা, শিশুদের খেলাঘর, ছেলে-মেয়েদের বাড়ি, সব রকম শিক্ষালয়। এক কথায়, স্বতন্ত্র সংসারের অর্থনৈতিক ও শিক্ষামূলক কাজকে সামাজিক কাজে পরিণত করার চেষ্টায় আমরা সত্যিই উঠেপড়ে লেগেছি। তার দরুন নারীরা মুক্তি পাবে বহু দিনকার পুরনো ঘর-সংসারের একঘেঁয়ে কাজ থেকে এবং পুরুষের আধিপত্য থেকে। ফলে নারীরা নিজেদের প্রতিভা এবং রুচিকে পুরোমাত্রায় কাজে লাগাতে পারবে।শ্রমজীবী নারী আন্দোলনের প্রধান কাজ হলো নারীদের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতার জন্য সংগ্রাম করা, এবং তা শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক সমতা নয়। মূল বিষয়টা হলো নারীদের জন্য সামাজিক উৎপাদন শ্রমে অংশ নেয়া, 'গৃহস্থালী দাসত্ব' থেকে তাদের মুক্ত করা, রান্নাঘর আর শিশুপালনের আদিঅন্তহীন ক্লান্তিকর খাটুনির নিকট তাদের অসাড়কারী ও অবমাননাকর অধীনতা থেকে তাদের মুক্ত করা। এই সংগ্রাম হবে এক দীর্ঘ সংগ্রাম এবং এটা সামাজিক প্রযুক্তি ও নৈতিকতা উভয়ের মৌলিক পুনর্গঠনের দাবি করে। কিন্তু এটা কমিউনিজমের পরিপূর্ণ বিজয়ে সমাপ্ত হবে।”

- লেনিন

শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশের প্রক্রিয়ায় মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অবসান হয় এবং পুরুষ শাসিত সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। তখন থেকে নারীদের একদিকে করা হয় শ্রমদাসী, অন্যদিকে যৌনদাসী। নারীর উপর চলে পুরুষতন্ত্রের বর্ধিত শোষণ। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের যুগে সমাজ সংস্কারের অংশ হিসেবে নারীদের একটা অংশ অফিস-আদালতে, স্কুল-কলেজে এবং কলে-কারখানায় সামাজিক উৎপাদন বা অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করলেও শ্রেণি-নিপীড়ন ও পুরুষতান্ত্রিক শোষণ-নিপীড়ন থেকে নারী মুক্ত হতে পারেনি। বাহ্যিকভাবে নারী কল্যাণমূলক কিছু কিছু সংস্থার আবির্ভাব ঘটেছে। সেখানে ব্যাপক শ্রমিক-কৃষক, শ্রমজীবী নারীরা উপেক্ষিত। এছাড়া নারীদের কল্যাণে বহু আইন করা হলেও তা থেকে যায় কাগজে-কলমে। এই আইনী সেবা পেতে গেলেও বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢালতে হয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্তাদের খুশি করতে, যা শ্রমিক-কৃষক-শ্রমজীবী নারীদের পক্ষে সম্ভব নয়। ১৯১৭ সালে লেনিন-স্তালিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় মহান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণে সেখানকার নারীরা রান্নাঘর ও আঁতুরঘর থেকে এবং শ্রেণি ও পুরুষতান্ত্রিক শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেয়েছিল। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ নারীদের জন্য যা ২০০ বছরেও করতে পারেনি, সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ও চীন মাত্র ২৫-৩০ বছরে তা করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে সংবিধান তৈরী করার সময় তারা ঠিক করেছিল সমস্ত রকমের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয় এবং অন্যান্য সর্বজনীন ক্ষেত্রে সোভিয়েত রাশিয়ার মেয়েরা পুরুষের সাথে সমানাধিকার পাবে। তার বাস্তব ভিত্তি পেয়েছিল মেয়েদের পুরুষদের সাথে সমান কাজ করার অধিকার; সমান বেতন পাওয়ার, বিশ্রাম পাওয়ার ও অবসর বিনোদনের অধিকার; সামাজিক বীমা এবং শিক্ষা, মা ও শিশু স্বার্থকে রাষ্ট্রব্যবস্থা দ্বারা রক্ষা করা, বড় পরিবারের মা আর অবিবাহিত মা-কে রাষ্ট্রীয় অর্থ সাহায্য, পুরো বেতনে মাতৃত্বের ছুটির ব্যবস্থা ছিল। ব্যাপকভাবে মাতৃসদন, শিশুসদন ও খেলাঘর এর জাল বিস্তার করা। তারা এগুলো শুধু আইনেই সীমাবদ্ধ রাখেনি। বাস্তবে পরিণত করেছিল। গ্রামে বা শহরে যেখানেই হোক না কেন, কোন মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হলে (সে মেয়ের বিয়ে হোক বা না-ই হোক) রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিনা পয়সায় নিম্নোক্ত সুযোগ-সুবিধা পাবে: ১) অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় চিকিৎসামূলক যত্ন ও তদারক; ২) প্রসবের জন্য প্রসব হাসপাতালে জায়গা; ৩) পুরো বেতনে ১২ থেকে ১৬ সপ্তাহের ছুটি; ৪) সবসময়ে চিকিৎসামূলক সাহায্য ও তদারক; ৫) স্বাস্থ্যের দিক থেকে যখনই সে সম্পূর্ণভাবে কাজের উপযুক্ত তখনই তার নিজের চাকরিতে যোগ দিতে পারার অধিকার; ৬) কাজে যোগ দেয়ার পর নবজাতককে স্তন্যদানের জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর আধ ঘণ্টা করে ছুটি; ৭) নবজাতকের জামাকাপড় কিনবার জন্য নগদ টাকা; ৮) সন্তান জন্মাবার পর থেকে এক বছর ধরে তার খাদ্য বাবদ মাসে মাসে নগদ টাকা; ৯) মা যতক্ষণ কাজ করবে ততক্ষণ শিশুকে সামলাবার জন্য খেলাঘরের সুযোগ। দু’মাস বয়স থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা এই সব খেলাঘরে মানুষ হবে।

আইনত প্রত্যেক ভবিষ্যৎ মা এসব সুযোগ সুবিধা পেতো। প্রসব হাসপাতালে একটি করে আইন বিভাগ ছিল, সেই বিভাগে অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ হাজিরা দিতেন; অন্তঃসত্ত্বা কোনও নারী যাতে আইনত কোনও রকম সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা ছিল এই বিভাগের কাজ। সোভিয়েত ইউনিয়নে নারীদের এই বিভাগের পরামর্শ নগদ অর্থে কিনতে হয়নি। শহরে প্রাক প্রসব ক্লিনিকে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্বন্ধে সমস্ত মেয়েদের পরামর্শ দেয়া হতো এবং প্রত্যেক ভাবী মা-কে ১টা করে কার্ড দেয়া হতো এবং তাদের নিম্নোক্ত সুবিধা দেয়া হতো- ১) ট্রামে সবার  আগে উঠার এবং প্রথমে বসতে  পাওয়ার অধিকার, ২) দোকান-হাটে কিছু কিনতে গেলে প্রতীক্ষিয়মানদের সবাইকে পেরিয়ে সবার আগে জিনিসপত্র কিনতে পাওয়ার অধিকার, ৩) বাড়তি রেশন, ৪) যেখানে সে কাজ করে সেখানে শুধু হালকা ধরনের কাজ করতে পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি।

সোভিয়েত ইউনিয়নে নারীদের মধ্যে সামাজিক শ্রমের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার সচেতন বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা করা হয়। ঘর-সংসারের কাজ আর সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় উৎপাদনের কাজ- এ দুইয়ের মাঝে তফাতটা মুছে দিয়ে নারীদের মাঝে শ্রমের মর্যাদা ফিরিয়ে এনেছিল। পৃথিবীতে এর আগে আর কোনো দেশে (পরে মাও এর চীন সেটা করেছিল) আর কোন যুগে নারীদের মুক্তির জন্য এমন পরিকল্পনা আর কখনো দেখা যায়নি। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত গড়ার শুরু থেকেই এই প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে নারীদের সামাজিক শ্রমের মর্যাদার কাজে ফিরিয়ে আনার ফলাফল কী রকম ছিল তার হিসাব ছিল এরকম-  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় সোভিয়েত রাশিয়ায় ১,১০,০০,০০০ নারী কলকারখানা, চলাচল ব্যবস্থা আর নির্মাণ কাজে যোগ দিয়েছিল; তাদের মধ্যে ১,৭০,০০০ হলো ইঞ্জিনিয়ার আর টেকনিশিয়ান। চার হাজার নারী সোভিয়েত ইউনিয়নে ইঞ্জিন চালাবার কাজে নিযুক্ত ছিল। রুশ বিপ্লবের চল্লিশ বছর আগে সেদেশের গ্রামের মেয়েদের অবস্থা সম্পর্কে স্তালিন যে বর্ণনা দিয়েছিলেন তা হলো- বিয়ের আগে পর্যন্ত মেয়েকে সবচেয়ে অধম চাকরানি মনে করা হতো। বাপের সংসারে সে গতর খাটাত, উদয়াস্ত গতর খাটাত, তবু বাপ তাকে ধমকে বলতো ‘মনে রাখিস তুই আমার অন্ন ধ্বংস করিস!’ বিয়ের পর স্বামীর সংসারে সে গতর খাটাত, স্বামীর যেমন মর্জি তেমনিভাবেই। তবু স্বামী তাকে ধমক দিয়ে বলত, ‘মনে রাখিস তুই আমার অন্ন ধ্বংস করিস।’ বিপ্লবের আগে যেসব রুশ মেয়েরা কারখানায় কাজ করতো তাদের অবস্থাও ছিল একইরকম। জার আমলে ১০৭ ধারায় আইন ছিল؛ স্বামী পরিবারের প্রধান কর্তা, স্ত্রীর কর্তব্য হলো স্বামীর অনুগত হওয়া। তখনকার দিনে রুশ দেশে স্বামীর পক্ষে স্ত্রীকে মারধোর করাটা নেহাতই সহজ আর স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। স্ত্রীর সতীত্বে কোনও রকম সন্দেহ জাগলে স্বামীরা স্ত্রীদের সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে গরুর গাড়িতে বেঁধে চাবকাতে চাবকাতে গ্রাম ঘুরিয়ে আনতো। অথচ বিপ্লবের পর সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলার কাজে এই নারীরাই এগিয়ে এসেছে পুরুষের পাশাপাশি, সমান সমান হয়ে। এই দেশেই ১৯৩৫ সালে বিপ্লবের মাত্র ১৮ বছর পরে দেশের যত শিক্ষক আর যত ডাক্তার আছে তার মধ্যে তিনভাগের দু’ভাগই ছিল নারীরা। এমনকি সৈন্য ও নৌবাহিনীতেও যোগ দিয়েছিল মেয়েরা। বাংলাদেশের নারীরা পুলিশ, সেনাবাহিনী বা অন্যান্য পেশায় যোগ দিলেও পুরুষতান্ত্রিক নির্যাতন তাদের পিছু ছাড়ছে না। প্রতিদিন খবরের কাগজে আসছে ঊর্ধ্বতন অফিসার, সহকর্মী বা অন্যদের দ্বারা তারা ধর্ষিতা-নির্যাতিতা হচ্ছে, যা সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল কল্পনার অতীত। রুশ বিপ্লব পূর্বের রুশ সাম্রাজ্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল যেন দুটো পৃথক পৃথিবী। তাই পৃথিবীর দেশে দেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। পূর্ব ইউরোপের রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, চেকোশ্লভাকিয়া এবং এশিয়ায় চীন, ভিয়েতনামের মানুষ বেছে নিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার আদর্শ ও পথ। সেসব দেশে সমাজতান্ত্রিক বা তার লক্ষানুসারী ব্যবস্থা কায়েম হলেও বর্তমানে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ কোন দেশেই এখন আর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকে নেই। বিশ্বাসঘাতক সংশোধনবাদীরা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পরিণত করেছে। যার পরিণতিতে নারীরা হারিয়েছে তাদের স্বাধীনতা, তারা পুনরায় শ্রমিক ও নারী হিসেবে পুঁজিবাদের শ্রম ও পুরুষতান্ত্রিক শোষণ-নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।

...........................................................................

ভারতের মাওবাদী অঙ্গসংগঠন 'ক্রান্তিকারী আদিবাসী মহিলা সংগঠন' এর বর্তমান সদস্য সংখ্যা লাখের উপরে। নারীদের শরীরের উপরের অংশ অনাবৃত রাখার বর্বর প্রথা, নারীদের ফসলের বীজ বুনতে না দেয়ার প্রাচীনপন্থী রীতি, মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে জোর করে বিয়ে করা, পিরিয়ডের সময় মেয়েদের বনের মধ্যে রেখে আসা, স্বামীদের বহুগামিতা, নারীদের উপর চালানো ডমেস্টিক ভায়োলেন্স ইত্যাদি প্রায় শূন্যের কোটায় নামিয়ে এনেছেন তারা মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোতে যা যুগের পর যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকা উপমহাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা করতে পারেনি। আগে কোনো নারী গাছে চড়লে ৫০০ রুপি ও একটি মুরগি জরিমানা দিতে হতো, কোনো পুরুষের গায়ে হাত তুললে ঐ নারীকে একটি ছাগল জরিমানা দিতে হতো, নারীদের ডিম খেতে দেয়া হতো না, শিকারের পর মাংসের ভালো ভালো অংশ পুরুষদের দেয়া হতো!

.................................................................................

পি ভি রামানা [১৫ ডিসেম্বর, ২০১৫]

(ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিস এন্ড এনালাইসিস এর প্রাক্তন রিসার্স ফেলো)

সিপিআই (মাওবাদী) এ যোগদানকারী অন্ধ্র প্রদেশের প্রথম নারী কুরসেঙ্গা মোতিবাই ওরফে রাধাক্কা গত ১২ই ডিসেম্বর ২০১৫ জামিনে মুক্তি পান। তেলেঙ্গানা রাজ্যের আদিলাবাদের আদিবাসী গোন্ডি এই নারী ২৮ বছর আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলেন। খাম্মাম জেলায় গ্রেফতার হওয়ার সময় তিনি বস্তারের বিভাগীয় কমিটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। মাওবাদীরা নিজেরাই তাদের অভ্যন্তরীণ একটি দলিলে স্বীকার করেছে যে খুব বেশী নারী দলে নেতৃত্বের অবস্থানে যেতে পারেননি; সেদিক থেকে রাধাক্কা ব্যতিক্রম। আরো বড় ব্যতিক্রম ছিলেন অনুরাধা গান্ধী যিনি শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব নিয়ে গঠিত ক্ষমতাধর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। সিপিআই (মাওবাদী) এর অভ্যন্তরীণ একটি দলিল থেকে অংশ বিশেষ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

"নারী ফ্রন্টে আমাদের কার্যক্রম এখনো সন্তোষজনক নয়। অনেক রাজ্যে নিয়োগের হার ভালো নয়, নারী ক্যাডারদের বাছাই-পদমর্যাদা-পদোন্নতি এখনো নিয়মানুগ পরিকল্পনা মাফিক নয়। নারীদের আন্দোলন গড়ে তোলা, ক্যাডার নিয়োগ দেয়া ও নারীদের থেকে নেতৃত্ব পর্যায়ে পদোন্নতি প্রদানের প্রয়োজনীয়তা এবং বিশাল সম্ভাবনার তুলনায় আমাদের প্রচেষ্টা অপ্রতুল। এই ক্ষেত্রে আমাদের প্রচেষ্টায় একটি শক্তিশালী প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে পিতৃতন্ত্র।" 

সিপিআই (মাওবাদী) এর পূর্ববর্তী সিপিআই মার্কসবাদী-লেনিনবাদী (গণযুদ্ধ)/Communist Party of India - Marxist-Leninist (People’s War) এর সময়ে নারী আন্দোলন গড়ে তোলা ও নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নানাবিধ উদ্যোগ চিহ্নিত করেছিল মাওবাদীরা।

সেগুলো হলো:

কৃষি শ্রমিক ও দরিদ্র খামারি নারীদের ভূমি বন্টনের ক্ষেত্রে সমানাধিকার প্রদান।

স্বচ্ছল পরিবার থেকে উঠে আসা নারীদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ও নিজে রোজগারকৃত সম্পত্তিতে সমানাধিকার।

সমান শ্রমের জন্য সমান মজুরী প্রদান।

নারীদের উপর শারীরিক নির্যাতন দূরীকরণ ও পতিতাবৃত্তির সম্পূর্ণ বিলোপ সাধন।

নারীদের উপর অত্যাচার দূরীকরণ ও অপরাধীকে চরম শাস্তি প্রদান।

যৌতুক প্রথার বিলুপ্তি সাধন।

জাঁকজমকপূর্ণ বিবাহ অনুষ্ঠানের বিলুপ্তি ও সাদাসিধে, অসম বর্ণ বিবাহ অনুষ্ঠান আয়োজনে উৎসাহ প্রদানের দাবী।

সরকারী চাকুরীতে নারীদের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা বরাদ্দকরণ।

বালিকা ও সহশিক্ষা বিদ্যালয়গুলোতে বিনা বেতনে, বাধ্যতামূলক শিক্ষার জন্য সংগ্রাম করা।

শিক্ষা পদ্ধতিতে মেয়েদের প্রতি বৈষম্যের/বিকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করা।

লিঙ্গ নির্ণয় পরীক্ষা ও কন্যা ভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে লড়াই করা।

কিশোর ও কিশোরীদের মধ্যকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা।

নারীদের প্রতি অবমাননাকর ধর্মীয় প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করা।

‘ব্যক্তিগত আইন’ এর বিরুদ্ধে লড়াই করা।

গণমাধ্যম সহ সকল পর্যায়ে নারীদের মর্যাদাহানিকর উপস্থাপনের বিরুদ্ধে লড়াই করা।

একইভাবে, নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আগমন ঘোষণা করার পর নারী আন্দোলন যেসকল দীর্ঘমেয়াদী কার্যক্রম হাতে নেবে সেগুলোও মাওবাদীরা চিহ্নিত করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে:

সামাজিক উৎপাদনে নারীদের পূর্ণাঙ্গ অংশীদারিত্ব; যেমন- উৎপাদনে নারী ও পুরুষের মধ্যকার সম্পর্কের রূপান্তর।

গৃহস্থালী কর্মকাণ্ডে যৌথ ভূমিকা পালন।

গৃহস্থালী কাজে নারী ও পুরুষের যৌথ সম্পৃক্ততা।

রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার যৌথ অনুশীলন।

ব্যক্তিগত সম্পদের/সম্পত্তির যৌথ সম্পদে/সম্পত্তিতে রূপান্তর ও পিতৃতন্ত্রের বিলোপ সাধনের সংগ্রাম।

ব্যক্তিগত, পারিবারিক ব্যবসা/কারখানার বিলুপ্তি সাধন করে যৌথ উৎপাদন ও মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা।

ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও বিশ্ব জুড়ে নারী আন্দোলনসমূহকে সমর্থন প্রদান।

আন্ডারগ্রাউন্ডে নারীদের যোগদানের পিছনে প্রায়শ যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয় তা হলো মাওবাদীদের বিভিন্ন স্কোয়াড গ্রামে ঘুরে ঘুরে বক্তব্য রাখে ও সাংস্কৃতিক দলগুলো বিপ্লবী গান শোনায়। এই অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য ও গান সংবেদনশীল বয়সে তাদের মনে দাগ কাটে। ২০০২ সালের বসন্তকালে সারিথা নামের ছটফটে মেয়েটি এই প্রতিবেদককে বলেছিল, "আমার গ্রামে ঘুরতে আসা মাওবাদী স্কোয়াডের উদ্দীপনামূলক ও জ্বালাময়ী গান আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছিল।"

নারীদের কেউ কেউ তার পরিবারের সদস্যদের (স্বামী, ভাই, চাচা) দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েও মাওবাদী আন্দোলনে যোগদান করে। যেমন- উত্তর তেলেঙ্গানা বিশেষ জোনাল কমিটির সদস্য অনসূয়া। কোলের ছেলেকে শাশুরির কাছে রেখে এসে স্বামী কোমারাইয়াকে অনুসরণ করে তিনি মাওবাদী আন্দোলনে যোগদান করেন।

নেলাকোন্দা রাজিথার গল্পটা আবার ভিন্ন। তেলেঙ্গানার করিমনগর জেলার আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছাত্র নেত্রী রাজিথা উত্তর তেলেঙ্গানা বিশেষ জোনাল কমিটির একমাত্র নারী সদস্য ছিলেন। আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকাকালীন তিনি সান্ডে রাজামৌলির সান্নিধ্যে আসেন এবং তাকে বিয়ে করেন। পরবর্তীতে রাজামৌলি কেন্দ্রীয় কমিটি ও কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিশনের সদস্য পদ লাভ করেন। ২০০২ সালের জুলাই মাসে একটি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ রাজিথা নিহত হন এবং রাজামৌলি নিহত হন ২০০৭ সালের জুন মাসে। ৯০ এর দশক থেকে বর্তমান দশকে মাওবাদীদের ভেতরে নারী ক্যাডারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

মাওবাদীদের মাঝে প্রায় ৪০ শতাংশ নারীদের বড় অংশই এসেছে ভারতের গ্রামীণ ও আদিবাসী এলাকা থেকে এবং তারা যোদ্ধা। কেউ কেউ আছেন শহর থেকে আসা উচ্চশিক্ষিত তাত্ত্বিক নেতা। এই শ্রেণীর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে বলতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক অনুরাধা গান্ধীর নাম। সেরেব্রাল ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুবরণ করার আগে সর্ব ভারতীয় নারী আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী অনুরাধা ছিলেন সিপিআই (মাওবাদী) এর কেন্দ্রীয় কমিটির একমাত্র নারী সদস্য। তিনি ছিলেন ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লি থেকে গ্রেফতার হওয়া সিপিআই (মাওবাদী) এর পলিটব্যুরোর সদস্য ও কেন্দ্রীয় প্রচারণা ব্যুরোর (Central Propaganda Bureau) প্রধান কোবাদ গান্ধীর স্ত্রী।

মাওবাদী পদে নারীদের যোগদানের পিছনে কোনো একটি বিশেষ কারণ নেই। কেউ কেউ আন্ডারগ্রাউন্ডে যোগ দিয়েছেন হতাশা থেকে। গ্রামের উঁচু ও ক্ষমতাশালীদের কাছে নির্যাতিত হওয়াও আরেকটি কারণ। একটি পরিবারের সব বোনদের কিংবা একটি পরিবারের সকল সদস্যের বিপ্লবে যোগদানের উদাহরণও রয়েছে।

এই প্রতিবেদককে একজন নারী ক্যাডার বলেছিলেন, “পার্টিতে আমার জন্ম হয়”। তার বাবা মায়ের পরিচয় হয় আন্ডারগ্রাউন্ডে, এরপর বিয়ে। কয়েক বছর পর তার জন্ম হয়। কল্যাণ অধিদপ্তর পরিচালিত একটি স্কুলে তিনি পড়তেন আর ছুটিতে বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে যেতেন। পরবর্তীতে তিনিও পার্টিতে যোগদান করেন ও আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। দণ্ডকারণ্যতে নানাভাবে পিতৃতন্ত্রের অবসান ঘটানোর ক্ষেত্রে মাওবাদীদের সচেতন প্রচেষ্টা নারীদের আন্ডারগ্রাউন্ডে কিংবা গণ সংগঠনে যোগদান করতে সহযোগিতা করেছে।

জোরপূর্বক বিয়ে এবং আত্মীয়দের (খালাতো/মামাতো/চাচাতো/ফুপাতো ভাই বোন) মধ্যে বিয়ে বন্ধ করার ক্ষেত্রে মাওবাদীরা বেশ সফল হয়েছে। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে নারীরা মাওবাদে যোগদান করে। তারা মনে করে না যে পার্টিতে যোগদান করে তারা কোনো ভুল করেছে। মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব, তৎকালীন সামাজিক অবস্থা, ব্যক্তিগত সমস্যা, আত্মীয় পরিবারের প্রভাব ও মতাদর্শগত অনুপ্রেরণা থেকে নারীরা মাওবাদে যোগদান করে। সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা এতটা শক্তিশালী আকার ধারণ করে যে একটা পর্যায়ে গিয়ে তারা মাওবাদে যোগদান না করে পারে না।


Comments

Popular posts from this blog

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-দুই]

শিবিরনামা [পর্ব-এক]