ওসমানীয়দের স্বরূপ [পর্ব-দুই]

 


ওসমানীয়দের সময়ের মহান স্থপতি মিমার সিনান অত্যন্ত উদার হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। তিনি ছাত্রদের নিয়মিত ইউরোপ নিয়ে যেতেন পশ্চিমাদের স্থাপত্য পরিদর্শনে। এই নিয়ে উগ্র মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল। তাদের মধ্যে এই জাত্যাভিমান কাজ করতো যে, মুসলিম হিসেবে তারা শ্রেষ্ঠ আর এজন্য খ্রিস্টানদেরই তাদের কাছে শিখতে আসা উচিত। কিন্তু তিনি উত্তর দিয়েছিলেন-

"দূরে কিংবা কাছে - যেখানেই যা থাকুক না কেন, আমাদের তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। একটা পাথর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো শিক্ষার্থী নয়।.... প্রত্যেক ভালো নকশাকারই তোমার শিক্ষক। যেখান থেকেই আসুক না কেন, যে ধর্মেরই হোক না কেন। চিত্রকর এবং নকশাকার, দু'জনের ধর্মই এক হওয়া উচিত।"

তিনি ইউরোপের ক্যাথেড্রালগুলোতে কিভাবে সূর্যের আলো ঢুকে তা বুঝতে প্রিজম ব্যবহার করতেন। তিনি রূপালী রঙের একটি পিন দিয়ে ছাত্রদের বলতেন পর্যবেক্ষণ করতে পিনটা উপর থেকে ছেড়ে দেয়ার পর ভবনের ভেতর শব্দ সাথে সাথে থেমে যায় নাকি প্রতিটা কোণে পৌঁছে যায়।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বসফরাসের উপর একটা সেতু তৈরি করেছিলেন। সুলতান বায়েজিদ তাঁর কাছে অন্যান্য স্থাপত্যের জন্য সাহায্য চাইলে তিনি ধর্মান্ধ পোপের ভয়ে রাজি হননি, কেবল একটা ছবি উপহার পাঠান। 

অন্যদিকে মাইকেলেঞ্জেলো লেভান্ত এ কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি গোল্ডেন হর্ন এর উপর সেতু তৈরি করতে চেয়েছিলেন; সেখানে নকশা অনুযায়ী থাকার কথা ছিল প্রদর্শনাগার ও লাইব্রেরি। কিন্তু ব্যাপারটা পোপের কানে গেলে তিনি বলেছিলেন-

"সুলতানের হাত থেকে উপহার পাওয়ার চেয়ে পোপের হাতে মরে যাওয়া ভালো।"

ধর্মান্ধ ঐ পোপ লোক লাগিয়ে সিনানের তত্ত্বাবধানে থাকা স্থাপত্যগুলো তৈরির সময় স্যাবোটাজ করা শুরু করেছিল। যেমন- দুর্ঘটনা ঘটাতে দড়ি কেটে রাখা, মার্বেল পাথর ভর্তি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া ইত্যাদি।

সুলতান সুলেমানের সময় ইস্তাম্বুলে মানুষের সংখ্যা বাড়ছিল, কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী পানির যোগান ছিল না। এই উদ্দেশ্যে পুরানো নালাগুলো সংস্কারের কাজের ভার পড়েছিল স্থপতি সিনান এর কাঁধে। সিনান এর পরিকল্পনা ছিল পাথরের সেতু, স্লুইস গেট আর ভূগর্ভস্থ টানেল দিয়ে পুরো শহরে যাতে পানি পৌঁছে দেয়া যায় তার জন্য কাজ করা। প্রায় সবাই এই কাজে তাঁকে সমর্থন দিলেও রুস্তম পাশার মতো বদমাইশ বেঁকে বসলো। এই বদমাইশ শুরু থেকেই সিনানের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিল। রুস্তম এর মতে পরিষ্কার পানি আনা হলে আরো নতুন মানুষ এখানে বসবাস করার উদ্দেশ্যে আসবে, আরো গাদাগাদি হবে, জায়গা অপ্রতুল হবে। রুস্তম পাশার সাথে যোগ দেয়া বদমাইশরা মেনে নিতে পারছিল না যে, খ্রিস্টান থেকে মুসলিম হওয়া সিনান এতো বড় কাজের দায়িত্ব নিচ্ছে। কেউ বলেছিল পাহাড় থেকে কোনো মানুষের পক্ষে পানি আনা সম্ভব না। আবার কেউ বলেছিল জমিনকে তার মতো থাকতে না দিলে ঘুমিয়ে থাকা জিনরা জেগে উঠবে। সিনান সাধারণ মানুষের কথা ভাবতেন। এজন্যই তিনি তার যোগ্য শিষ্যদের নিয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে দিনরাত কাজ করেছিলেন। বাইজেন্টাইন আমলের প্রণালিগুলো কেন কাজ করেনি তিনি তা খুঁজে বের করলেন এবং ঢালগুলোর কৌণিক দূরত্ব সম্পর্কে মাপজোক নিলেন। প্রাসাদে নকশা নিয়ে গেলেও রুস্তম সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল এই প্রকল্প রুখে দিতে, যেন আনাতোলিয়া থেকে লোকজন এদিকে আসতে না পারে। ফালতু অজুহাতে সিনানের অন্যতম প্রধান শিষ্য এবং সুলতানের হাতির মাহুত জাহানকে আটক করা হয়েছিল। পরবর্তীতে শাহজাদী মেহরিমার নির্দেশে জাহানকে ছেড়ে দেয়া হয়। মেহরিমা তার বাবা সুলতানকেও রাজি করিয়েছিলেন ঐ প্রকল্প আবার শুরু করতে আদেশ দিতে।

ওসমানীয়দের কারাগারগুলোর অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। সেখানে নিয়মিত কিশোর ও তরুণরা ধর্ষিত হতো বলশালী বন্দিদের দ্বারা। কারাগারগুলোর ভেতরের পরিবেশ ছিল অত্যন্ত নোংরা। ময়লার বালতিগুলো দিনের পর দিন পড়ে থাকতো।

সুলতানদের সময়ে যেসব হামামখানা পথে থাকতো সেগুলোতে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা সাথে করে কিশোরদের নিয়ে যেতো যৌন পরিতৃপ্তির জন্য।

শাহজাদী মেহরিমার হস্তক্ষেপে প্রকল্পটি আবার শুরু হলেও সিনানকে পুনরায় অনেকের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয় সুলতানের সম্মুখে। যেমন-

#'শায়খ আল ইসলাম' পদে থাকা উগ্র ধর্মান্ধ আবুসুদ এফেন্দী মত দিয়েছিল যে, পূর্বসূরীদের সময়ে ইস্তাম্বুল শহরে যেসব সেতু ভেঙে পড়েছিল, সেগুলো নাকি সত্যিকারের বিশ্বাস নিয়ে তৈরি করা হয়নি। এই কাঠমোল্লা সিনানকে জিজ্ঞেস করেছিল তিনি তার এই কনসেপ্টের সাথে একমত কিনা। সিনান জবাব দিয়েছিলেন-

"আল্লাহ আমাদের বুদ্ধি দিয়েছেন, বুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করতে বলেছেন। সেতুগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, কারণ শক্ত জমিনের উপর সেগুলো বসানো হয়নি। আমরা এমন জায়গা নির্বাচন করবো যেখানে জলার অবস্থান কম হবে, মাটির শক্ত হবে। সেতু বানাতে হলে বিশ্বাস থাকা অবশ্যই জরুরি, কিন্তু বুদ্ধি দিয়েও কাজ করতে হবে।"

#জেনিসারিদের প্রধান সিনানকে কটাক্ষ করে সুলতান সুলেমানকে বলেছিল-

"মহামান্য সুলতান, আমরা জানতাম আপনার স্থপতি নির্মাণ কাজ ভালো পারে। এখন দেখছি মাটির নিচে কেমন পানি আছে, সেটাও সে ভালো জানে। জাদুটোনা আবার কবে শিখলো?"

সিনান জবাব দিয়েছিলেন-

"এসব কিছু কিভাবে করে, তা আমার জানা নেই। আমি শুধু জানি উপযুক্ত যন্ত্র পেলে কতটুকু পানি মাটির গভীরে আছে, তা নির্ধারণ করা যায়।

জেনিসারিদের আগা আবার বললো-

"এই যন্ত্রপাতির কথা বললেন, এগুলো কি আল্লাহ প্রদত্ত নাকি শয়তান সাহায্য করেছে?"

জবাবে সিনান বললেন-

"অবশ্যই আল্লাহর আশীর্বাদ। তিনি চান আমাদের জ্ঞান বর্ধিত হোক।"

#শায়খ আল ইসলাম আবারও বললো-

"আল-খিদর পানি আবিষ্কার করেছিলেন। আপনি কি তার মতো পবিত্র কেউ হতে চান?"

জবাবে সিনান বললেন-

"এমন মহাপুরুষের নখের যোগ্যতাও আমার নেই। তিনি মুসা নবীর সাথে দুনিয়ার আনাচে-কানাচে ভ্রমণ করেছিলেন এবং মহাবিশ্বের অনেক রহস্য জানতে পেরেছিলেন। তার জ্ঞানের পাশে আমি নিতান্ত শিশুমাত্র। তবে একটা কথা বিশ্বাস করি, তা হচ্ছে সঠিক মাপ পেলে অদৃশ্য উৎসের খোঁজ পাওয়া যেতে পারে।"

#এরপর রুস্তম জিজ্ঞেস করলো-

"আমি জানতে চাই স্থপতি কত টাকা কাজটায় লাগাবেন ভাবছেন। রাজকোষ খালি করা যাবে না।"

জবাবে সিনান বললেন-

"দু'টো ইচ্ছা আছে। দামের বেশকম হতে পারে। এটা মহামান্য সুলতানের ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে। মহামান্য সুলতান, শহরে যাতে পরিষ্কার পানি আসে, এটাই আমাদের উদ্দেশ্য। আমাদের শত শত শ্রমিক প্রয়োজন। যদি অনুমতি দেন, তাহলে জাহাজের শ্রমিকদের ব্যবহার করতে পারি। ওদের পয়সাও দিতে হবে না।.....আমরা দক্ষ নকশাকার আর নির্মাতা নিয়োগ করবো। ওদের টাকা দেয়া হবে যোগ্যতা অনুযায়ী। বদলে শরীরের ঘাম আর প্রার্থনা দিয়ে ওরা মহামান্যের কাজ নিখুঁতভাবে শেষ করবে।"

রুস্তম পাশা ফোঁড়ন কাটলো-

"বাহ! এখন সে বলছে ঘাম আর প্রার্থনা দিয়ে সেতু তৈরি করবে।"

এতসব বাকবিতণ্ডার পর সুলতান নতুন কোনো সেতু বানাবার নির্দেশ না দিলেও বাঁধ ঠিক করার নির্দেশ দিলেন।

সুলতানের ঘোড়াশালের ঘোড়াগুলোর গলায় নীল রঙের মাদুলি পরিয়ে রাখা হতো শয়তানের নজর থেকে পশুগুলোকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য। 

ওসমানীয়দের সময়ে গাদা গাদা বাইজীবাড়ি ছিল। ঐসময়ের অধিবাসীরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করলেও ঠিকই এসব বাড়িতে যেতো।

সিনানের তত্ত্বাবধানে কাজ চলাকালীন অনেক পশু আহত হয় এবং অনেক শ্রমিক মারা যায়। তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে ইমামরা বলতো যেহেতু সুলতানের কাজ করতে গিয়ে এরা মারা গেছে, তাই শেষ বিচারের দিন খোদা বিষয়টাকে মাথায় রাখবেন এবং পুলসিরাত পার করবার সময় এই শ্রমিকদের পাশে দুইজন করে ফেরেশতা থাকবে! অথচ এই দরিদ্র শ্রমিকদের কবর ফলকের অর্থ পর্যন্ত সিনান দিয়ে দিতেন, সুলতানরা এদের কোনো খবরই রাখতো না। গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল যে, এই দুর্ঘটনার পিছে ভূতের হাত আছে! ঐ ভূত নাকি চায়নি পবিত্র জায়গা নোংরা হোক। 

গ্রীষ্মের শেষের দিকে শায়খ আল ইসলাম সিনানের দিকে নতুন অভিযোগ আনলো এই বলে যে, তিনি নাকি হাজিয়া সোফিয়া থেকে মার্বেল পাথরের একটি কলাম সরিয়েছেন, যার জন্য এই দুর্যোগ। কিন্তু সেটা ভালো করে লুকাতে না পেরে মৃতা সুলতানার কবরের পাশে সংযুক্ত করে দিয়েছেন সিনান!

আগস্টের ৫ তারিখে সুলতান এর বাহিনীর যিখেতভার পৌছালো।

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Szigetv%C3%A1r

সুলতানের কামানবাহী ষাঁড়গুলোকে সামনে এগিয়ে দেয়া হলো। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কাউন্ট নিকোলা সুবিক খ্রিনস্কি এর দুর্গ জয় করা। কাউন্ট এর বাহিনী রক্ত লাল জামা পরিধান করেছিল। এই রং বাছাই করার অর্থ ছিল ওরা প্রাণ থাকতে দুর্গ ছেড়ে বের হতো না এবং ওখানেই মরতো। এই যুদ্ধের ময়দানেই ৭২ বছর বয়সে সুলতান সুলেমানের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা বেশ কিছুদিন গোপন রাখা হয়েছিল যুদ্ধের স্বার্থে। প্রধান উজির সোকোলু মাহুত জাহানকে বাধ্য করেছিল মৃত সুলতানের শরীরকে সেনাবাহিনীর সামনে হাতির পিঠে চাপিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। সুলতানের মৃত শরীরের সামনেই সোকোলু তার স্বাক্ষর নকল করে বেশ কিছু চিঠি লিখেছিল বিভিন্ন জায়গায় পাঠানোর উদ্দেশ্যে। বৈদ্যকে ডেকে এনে মৃত সুলতানের শরীরে বিশেষ মিশ্রণ মাখিয়ে দেয়া হলো যেন বেশ কিছুদিন শরীর না পচে। এরপর বৈদ্য সুলতানের হৃদপিণ্ড বের করে আনলো সুলতানের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সেটা যুদ্ধক্ষেত্রে পুঁতে দেয়ার উদ্দেশ্যে। হাতির উপর লাশ তোলার আগে মৃতদেহের দাড়িতে চিরুনি বুলিয়ে দেয়া হলো, পাউডার মেখে চেহারা সুন্দর করা হলো, চোখে পরানো হলো সুরমা। এরপর কাফতান পরিয়ে দেয়া হলো। ঐ যুদ্ধে ওসমানীয়রা প্রতিপক্ষের বিশ হাজার সৈন্যকে হত্যা করেছিল। তাতার বার্তাবাহকের চিঠি পেয়ে শাহজাদা সেলিম ইস্তাম্বুলে বলে পৌঁছানোর পর সুলতানের লাশকে হাতির হাওড়া থেকে নামিয়ে শবের মর্যাদা দিয়ে ফিরে আসে বাকিরা। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই সেলিম নির্দেশ দিয়েছিল তার সিংহাসনে আরোহণ উপলক্ষে নগরবাসী এমনভাবে উদযাপন করুক যা আগে কখনো হয়নি, তার এই নির্দেশ অনেকের চোখেই দৃষ্টিকটু লেগেছিল। তার সময়ে ঐ শহরে ভয়াবহ আগুন লাগলেও জেনিসারি সৈন্যরা কোনো উদ্যোগই নেয়নি সেসময় আগুন নেভাতে। উল্টো তারা এই দুর্যোগকে তাদের বেতন বাড়ানোর সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করেছিল। সিনান আগুন লাগা জনিত দুর্ঘটনা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে প্রাসাদে গিয়ে প্রয়োজনীয় অনুমতি নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর নকশা অনুযায়ী-

#প্রতি পাশের রাস্তা আধা কিউবিট করে বড় করতে হতো।

#দোতলার বেশি বড় কোনো বাড়ি তৈরি করা যেতো না।

#কাঠের বদলে আরো বেশি ইট ও পাথর ব্যবহার করে বাড়ি নির্মাণ করতে হতো।

কিন্তু লোকেরা তার এসব নির্দেশ শুনেনি।

Comments

Popular posts from this blog

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-দুই]

শিবিরনামা [পর্ব-এক]