বাম রঙ্গ [পর্ব-সাত]
'৮৮-র একটি ঘটনা। স্কাই ওয়াচার্স অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে 'জ্যোতিষ বনাম বিজ্ঞান' শীর্ষক আলোচনা সভায় গেছি। সেখানে আমার বক্তব্যের সূত্র ধরে এক স্বীকৃত মার্কসবাদী বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বললেন, "আমি প্রবীরবাবুর সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। বস্তুবাদে বিশ্বাসী মানুষও ঈশ্বরে বিশ্বাসী হতেই পারেন।"
বছর দুয়েক আগে জনৈক প্রগতিশীল বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও খ্যাতিমান সাহিত্যিক একটি আড্ডায় বলেছিলেন, "ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখেও যুক্তিবাদী হওয়া যায়।"
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও বিজ্ঞান আন্দোলনের নেতাকে বলতে শুনেছিলাম, "বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের বা অধ্যাত্মবাদের কোনও দ্বন্দ্ব নেই। বরং অধ্যাত্মবাদই পরম বিজ্ঞান।"............................
'৮৭-তে ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত থেকে ছাব্বিশটি বিজ্ঞান সংগঠন একসঙ্গে মাসাধিককালব্যাপী সারা ভারত জন-বিজ্ঞান জাঠার আয়োজন করেছিলেন। দেশের পাঁচটি ভিন্ন প্রান্ত থেকে পাঁচটি আঞ্চলিক জাঠা মোট প্রায় পঁচিশ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছিলেন। বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করতে, বিজ্ঞান আন্দোলন গড়ে তুলতে যে সব বিষয় জাঠা বেছে নিয়েছিল সেগুলো হলো:
স্বনির্ভরতা, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, জন-বিজ্ঞান আন্দোলন, প্রাথমিক বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের নানাক্ষেত্র, বিজ্ঞান ও ভারতবর্ষ, স্বাস্থ্য ও ঔষধ, পরিবেশ দূষণ, জল, গৃহ, শিল্পক্ষেত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও শান্তি।
না, মানুষের কুসংস্কার বিষয়ের কোনও স্থান ছিল না জাঠার বিষয়গুলোর মধ্যে। বিপুল অর্থব্যয়ের এই জন-বিজ্ঞান জাঠা তাদের কাছে এগিয়ে আসা শোষিত অন্ধ-সংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষগুলোকে বিজ্ঞানমনস্ক করার চেষ্টা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছিল। পশ্চিমবাংলার কিছু কিছু জায়গায় অবতারদের কিছু কিছু কৌশল সাধারণ মানুষদের কাছে ফাঁস করার অনুষ্ঠান হয়েছে বটে, কিন্তু সেগুলো হয়েছিল নেহাৎই হালকা চালে, সাধারণ মানুষকে ম্যাজিক দেখাবার মত করে, অবসর বিনোদনের অনুষ্ঠানের মত করে। পশ্চিমবঙ্গে এই জাঠা ছিল ধর্ম ও জ্যোতিষ বিশ্বাসের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে। ২ অক্টোবর মালদায় জাঠা উদ্বোধন করলেন এমন এক বিজ্ঞানী যাঁর নাম আমরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেখেছি ধর্মানুষ্ঠান, ভাগবতপাঠের আসর, অবতারের জন্মদিন ইত্যাদি অনুষ্ঠানের উদ্বোধক হিসেবে। ৭ অক্টোবর কলকাতার টালাপার্কে অনুষ্ঠিত বিজ্ঞান-জাঠার এক অনুষ্ঠানে একটি পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। জনৈক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী 'শক্তি' বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে শুরুতেই বললেন, "যবে থেকে ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি..."। বাক্যটা শেষ হবার আগেই সভার গুঞ্জনে সচেতন হয়ে উঠলেন। বক্তব্য পাল্টে বললেন, "অবশ্য আমরা বিবর্তনবাদে পড়েছি কেমন করে মানুষ এলো।" জাঠার উত্তর কলকাতা আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি দাপটে বিজ্ঞান সভার পরিচালনা করলেন, দু'হাতের আঙুলে গোটা চার-পাঁচেক গ্রহরত্নের আংটি ধারণ করে। এমন দ্বিচারিতার উদাহরণ এখানে শেষ নয়। এবার আপনাদের যাঁর কথা বলছি তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত বাম বুদ্ধিজীবী লেখক। বস্তুবাদ প্রসঙ্গ-টসঙ্গ নিয়ে অনেক বইও লিখেছেন। এই বুদ্ধিজীবী 'জন-বিজ্ঞান' আন্দোলনের নেতাদের আমন্ত্রণে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সোচ্চারে জানালেন, "বিজ্ঞান আন্দোলনের নামে ধর্মকে কোনও আঘাত নয়।"
মাস কয়েক পরে তিনিই আবার 'গণ-বিজ্ঞান' মঞ্চে উঠে ঘোষণা করলেন, "সাধারণের কাছে ধর্মের বিজ্ঞানমনস্কতা বিরোধিতার স্বরূপকে তুলে ধরতে হবে, চিনিয়ে দিতে হবে, আঘাত হানতে হবে।"
- 'অলৌকিক নয় লৌকিক [দ্বিতীয় খন্ড]', প্রবীর ঘোষ
.......................................................................................
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক প্রাক্তন চীফ সেক্রেটারি একবার আমাকে বলেছিলেন, "মার্কসবাদে বিশ্বাসী হলেও আমি কিন্তু অলৌকিক শক্তিকে অস্বীকার করতে পারি না। দীঘার কাছের এক মন্দিরে আমি এক অলৌকিক ক্ষমতাবান পুরোহিতের দেখা পেয়েছিলাম। আমার স্ত্রী গেঁটে-বাতে পায়ে ও কোমরে মাঝে-মাঝে খুব কষ্ট পান। একবার দীঘায় বেড়াতে গিয়ে ওই পুরোহিতের খবর পাই। শুনলাম উনি অনেকের অসুখ-টসুখ ভালো করে দিয়েছেন। এক সন্ধ্যায় আমরা স্বামী-স্ত্রীতে গেলাম মন্দিরে। পুজো দিলাম। সন্ধ্যারতির পর পুরোহিতকে প্রণাম করে নিজের পরিচয় দিয়ে আসার উদ্দেশ্য জানালাম। পুরোহিত বিড়-বিড় করে মন্ত্র পড়ে আমার স্ত্রীর কোমর ও পায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। এক সময় জিজ্ঞেস করলেন, 'কি, এখন ব্যথা কমেছে না?' অবাক হয়ে গেলাম আমার স্ত্রীর জবাব শুনে। ও নিজের শরীরটা নাড়া-চাড়া করে বলল, 'হ্যাঁ, ব্যথা অনেক কমেছে।' এইসব অতি-মানুষেরা হয়ত কোনও দিনই আপনার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ দিতে হাজির হবেন না, কিন্তু এদের অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ পাওয়ার পর তা অস্বীকার করবো কি ভাবে?"
আমি বলেছিলাম "যতদূর জানি আপনার স্ত্রীর বাতের ব্যথা এখনও আছে।"
আমার মুখের কথা প্রায় কেড়ে নিয়ে প্রাক্তন চিফ সেক্রেটারি জবাব দিয়েছিলেন, "পুরোহিত অবশ্য আরও কয়েকবার ঝেড়ে দিতে হবে বলে জানিয়েছিলেন। কাজের তাগিদে আর যাওয়া হয়নি। ত্রুটিটা আমাদেরই।"
এই সাময়িক আরোগ্যের কারণ পুরোহিতের প্রতি রোগিণীর বিশ্বাস, পুরোহিতের অলৌকিক কোনও ক্ষমতা নয়। অথবা, পুরনো রোগের নিয়ম অনুসারেই স্বাভাবিকভাবেই সেই সময় গেঁটে-বাতের প্রকোপ কিছুটা কম ছিল।
- 'আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না', প্রবীর ঘোষ
..................................................................................
নিউ জার্সির গ্লাসবোরোতে অনুষ্ঠিত সংশোধনবাদী সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জনসনের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের মিটিংয়ে ক্যাস্ট্রো উপস্থিত ছিলেন, যেখানে লাতিন আমেরিকায় সাময়িক যুদ্ধবিরতির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় দুই মোড়লের মধ্যে। পরবর্তীতে শোনা যায় সেজন্যই ক্যাস্ট্রোর পক্ষে বলিভিয়ায় অবস্থানরত চে এর প্রতি কোনোরূপ সহযোগিতা দেয়া সম্ভব ছিল না, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী সোভিয়েত ইউনিয়নের চাপে। বিখ্যাত ইতালিয়ান সাংবাদিক জান্নি মিনা তাকে এ বিষয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলে তিনি ব্যাপারটি অস্বীকার করেন।
Gianni Minà - Wikipedia https://en.m.wikipedia.org/wiki/Gianni_Min%C3%A0
.........................................................................................
পশ্চিমা দেশগুলোর কথিত 'কমিউনিস্ট পার্টি' ও 'কমিউনিস্ট'রা কোন কিসিমের 'কমিউনিস্ট' তার কিছুটা ঝলক পাওলো কোয়েলহো এর 'The Pilgrimage' বইয়ে পাওয়া যায়। লেখকের গাইড ছিলেন 'ইতালিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি'র সদস্য যিনি কিনা ৭০০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ধর্মীয় যাত্রা সম্পন্ন করেছিলেন এবং নতুনদের গাইড হিসেবে এই রুটে কাজ করতেন স্বর্গে যাওয়ার আশায়!
....................................................................................
প্রবীর ঘোষ 'হরেকৃষ্ণ বাবা' নামে যেই ভন্ডকে ধরেছিলেন সে 'মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি'র সাংসদ অজিত বাগ এর প্রশংসাপত্র সঙ্গে রাখতো!
.................................................................................
'৮৮-র ২৯ জুলাই সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের এক প্রতিবেদনে আনন্দবাজার পত্রিকায় মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে লেখা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনের চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল। চিঠিটা এখানে তুলে দিচ্ছি।
প্রীতিভাজনেষু জ্যোতিবাবু,
আনন্দবাজার পত্রিকায় পড়লাম আপনি স্পন্ডিলাইটিসে কষ্ট পাচ্ছেন। আমি স্পন্ডিলাইটিসে অনেকদিন ধরে ভুগেছি। তখন তদানীন্তন প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যক্ষ ডঃ প্রতুল মুখার্জি আমাকে একটা বালা দেন যার মধ্যে হাই ইলেকট্রিসিটি ভোল্ট পাস করানো হয়েছে। সেটা পরে কয়েকদিনের মধ্যেই আমি সুস্থ হই। আমি আপনাকে কয়েকদিনের মধ্যেই একটি তামার বালা পাঠাবো, আশা করি সেটা পরে আপনি উপকার পাবেন।
আপনার দ্রুত নিরাময় কামনা করি, আমি এখন আরামবাগে আছি।
পুনঃ সম্ভবপর হলে সাইকেলে অন্তত দৈনিক আধঘণ্টা চাপবেন। আপনি বোধহয় জানেন আমি সাইকেলে চেপে একদা ভালো ফল পেয়েছি।
স্বাঃ প্রফুল্লচন্দ্র সেন
২৮.৭.৮৮
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের এক প্রশ্নের উত্তরে প্রফুল্লচন্দ্র সেন জানান, তামার বালা পরেছিলেন ১৯৭৯ সালে। শ্রীসেনের কথায়, "স্পন্ডিলাইটিস হয়েছিল। ডঃ নীলকান্ত ঘোষাল দেখছিলেন। কিছুই হলো না। কিন্তু সেই তামার বালা ব্যবহার করলাম, প্রথম ৭ দিনে ব্যথা কমে গেল। পরের ১৫ দিনে গলা থেকে কলার খুলে ফেললাম।"
এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর নাকি তামার বালা বিক্রি খুব বেড়ে গিয়েছিল শহর কলকাতায়।
- 'আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না', প্রবীর ঘোষ
.......................................................................................
মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আমলে ভারতীয় সংবিধানে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও মরিস সেরুলো নামক টাউটকে পশ্চিমবঙ্গে এসে ভণ্ডামি দেখানোর সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি'র সদস্যরা এই টাউটের মুখোশ খুলে দেয়ার পরও মার্কিনীদের ভয়ে কথিত বাম সরকার তাকে থাইল্যান্ড এর বিমানে তুলে দেয়।
..................................................................................
পশ্চিমবঙ্গের কাক দ্বীপের কথিত দৈব পুকুরের পার্শ্ববর্তী বিশালাক্ষী মন্দিরে নব্বই দশকে মন্দির কমিটিতে যারা ছিলেন তাদের প্রায় সবাই ছিলেন সিপিএম এর নেতা। এদের অনেকে আবার ছিলেন গ্রাম পঞ্চায়েত এর সদস্য। এই পুকুর ছিল কথিত বামপন্থী সরকারের খাস জমিতে, যেখানে ধর্মান্ধরা আড্ডা জমিয়েছিল। তারা আবার এই জমি জোর করে দখল করেছিল স্থানীয় জমিদারের কাছ থেকে এই ব্যবসার উদ্দেশ্যে। ঐ মন্দিরের কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন এমএসসি পড়ুয়া মার্ক্সবাদী! ঐসময় পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটা পুজো কমিটির প্রায় সব সদস্য ছিল সিপিএম এর লোকেরা। প্রণামীর অর্থ এরা মেরে দিতো।
[সূত্র : 'যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা', প্রবীর ঘোষ]
.....................................................................................
হাবড়া পারপাটনা থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে একটা খেজুর গাছের তলার মাটির মাটির কথিত অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে ব্যবসায় যোগ দিয়েছিল সিপিএম এর কর্মীরাই। আবার মন্দির কমিটিতে এদের সাথে ছিল তৃণমূল এর কর্মীরাও। খেজুর তলার পাশে ছিল মানিক পীরের মাজার। মুসলিমদের ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় তারা রেগে গিয়েছিল। তাদের চাপে কয়েকজনকে মন্দির কমিটিতে ঢুকানো হয়েছিল মুসলমান হওয়ার পরও, একসাথে লুটপাট করতে। সভাপতি কালীপদ বিশ্বাস পেশায় সাব-ইনস্পেকটর অফ স্কুল। যুগলচন্দ্র দাস সম্পাদক, প্রভাবশালী সিপিএম রাজনীতিক। সুনীলকুমার বিশ্বাস কোষাধাক্ষ, পেশায় উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। ৩৭ জনকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল মন্দির কমিটি। কমিটিতে সিপিএম, তৃণমূল, কংগ্রেস শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতো। কমিটির সদস্য কার্তিক দাস ছিল স্থানীয় তৃণমূল নেতা। গঙ্গানগর থানার ওসি অরুণ হাজরা নিজেই মন্দির কমিটির সদস্য ছিল! ভক্তদের মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশ থেকে যেত। কিন্তু তাদের কেউই পাসপোর্ট বা ভিসা নিয়ে যেত না। যেত দালাল ধরে, দু'পারের সীমান্ত রক্ষীদের ঘুষ দিয়ে। থানার যে ক'জন পুলিশ এখানে ডিউটি করতো, তারা ওদের ভাষা শুনে ঠিকই ধরে ফেলতো। তারপর অবৈধভাবে প্রবেশের জন্য গ্রেপ্তার করে কোর্টে তোলার নাম করে যার কাছ থেকে যতটা পারতো লুটতো। গঙ্গানগর থানার ইটভাটা থেকে ডজন খানেক লরি রাতে যেত খেজুরতলায়, কমে যাওয়া মাটি ভরাট করতে।
........................................................................................
দক্ষিণ ২৪ পরগণার প্রত্যন্ত নাকালি গ্রামের কথিত দৈব পুকুর সংক্রান্ত ভণ্ডামির ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল সিপিএম নেত্রী ও পঞ্চায়েত প্রধান রাইনা বিবি। ঐ মহিলা ছিলেন 'পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ' এর সদস্য!
.....................................................................................
পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার দক্ষিণেশ্বর মন্দির সংস্কারের যে রূপরেখাটি তৈরি করেছিল, তার মুখবন্ধ থেকে কিছুটা নিম্নরূপ-
"১৮২০ বা ১৮৩০ সালে নবজাগরণের ধারক 'ইয়ং বেঙ্গল'-এর চিন্তা ভাবনা বা জীবনচর্যার যে বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখি, তাতে মূল সুরটিই ছিল নাস্তিকতা। পশ্চিমী সংস্কৃতির ঝোড়ো বাতাসে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল প্রাচ্যে ধর্মীয় ও নৈতিক ঐতিহ্য। পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণই সেই সময়কার অভিজাত সমাজের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। দক্ষিণেশ্বরই শেষ পর্যন্ত ভারতীয় ঐতিহ্যকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে। অসাধারণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, অভিজাত বাঙালি বিধবা রানি রাসমণির প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের নতুন পুরোহিত শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন আধ্যাত্মিক জগতের প্রাণপুরুষ। তিনি ও তাঁর ভুবনজয়ী শিষ্য বিবেকানন্দের আধ্যাত্মিক আদান-প্রদান উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতকে পথ দেখালো। চিন্তার জগতে যে আলোড়নের সূত্রপাত দক্ষিণেশ্বর চত্বরে, পরবর্তী পর্যায়ে স্বাধীনতা সংগ্রামও তা থেকে পুষ্টিলাভ করে।"
[সূত্র: 'যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা', প্রবীর ঘোষ]
................................................................................
২৯ নভেম্বর ১৯৯২ পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারভুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো এক ভয়াবহ স্বাধীনতা হননকারী রাজনীতির কালচার আমদানি করলো আমাদের দেশে। দলের শক্তি প্রদর্শনের খেলায় মাতোয়ারা হয়ে ফ্যাসিস্ট কায়দায় বহু খেটে খাওয়া মানুষকে হুমকি দেখিয়ে ব্রিগেডের জনসভায় যেতে বাধ্য করেছিল। ট্রেনের ফেরিওয়ালা, মুদির দোকানের মালিক, মজুর, শ্রমিক, অটোচালক, রিকশাচালক কেউই এই হুমকি থেকে অব্যাহতি পাননি। স্পষ্ট শাসানি ছিল-জনসভায় না গেলে রুজি-রোজগার বন্ধ করে দেওয়া হবে সাত কি দশ দিনের জন্য। সেদিনের শক্তি প্রদর্শনের জনসভায় সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটিয়ে সরকারি বাসগুলোকে পার্টি মিটিং-এ হাজির করা হয়েছিল। দশ হাজার বাস-মিনিবাস ও লরি মালিককে বাধ্য করেছিল বাস-মিনিবাস-লরি দিতে। এসবের ফলে কলকাতা ও তার আশেপাশে অলিখিত একটা বন্ধ চেপে বসেছিল। স্বাধীনতার উপর এই বীভৎস আক্রমণ চালানো নিয়ে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের বিবেককে সরব হতে দেখিনি, সরব হতে দেখিনি স্ত্রী-স্বাধীনতার পক্ষে বলিষ্ঠ দাবি তোলা লেখিকা ও লেখকদের। মানুষের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সেদিনের আক্রমণে বেছে বেছে নারীদের তো ছাড় দেওয়া হয়নি! তবু কেন নারী স্বাধীনতাকামীদের কলম ও মুখ আশ্চর্য রকম নীরবতা পালন করেছিল? তবে কি ধরে নেব, স্বাধীনতা হরণকারীদের রাজনৈতিক ও পেশী ক্ষমতাই নারী স্বাধীনতাকামীদের কলম ও মুখকে ভোঁতা করে দিয়েছিল? এসব কি এ কথাই প্রমাণ করে না-এ সমাজ ক্ষমতাতান্ত্রিক সমাজও? ২৩ আগস্ট '৯৩ আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার চার কলম জুড়ে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল। খবরের একটা অংশ তুলে দিলাম:
পিভি-র দ্বারস্থ: মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এবং সি পি এমের রাজ্য সম্পাদক শৈলেন দাশগুপ্তের কাছে এক প্রোমোটারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর পর ফল না পেয়ে, দমদমের কিছু বাসিন্দা ও দোকানদার রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তক্ষেপের আর্জি জানিয়েছেন। একইসঙ্গে তাঁরা সি পি এমের সাধারণ সম্পাদক হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎকেও চিঠি দিয়েছেন। বাসিন্দা ও দোকানিদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট প্রোমোটার 'জোর করে, বে-আইনিভাবে ঘর ভেঙে দিয়েছেন' এবং সমাজবিরোধীদের সাহায্যে 'ভুয়া চুক্তিপত্রে সই করার জন্য হুমকি দিচ্ছেন।' পুলিশ ও প্রশাসনের বিভিন্ন পদস্থ অফিসারদের কাছে অভিযোগ জানিয়েও তাঁরা ফল পাননি। এমনকি, স্থানীয় থানা আদালতের নির্দেশও কার্যকর করছেন না বলে তাঁদের অভিযোগ। দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয় বাসিন্দারা দমদম রোডে মতিঝিলের কাছে ফাঁকা পড়ে থাকা ওই জমিতে অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। জমিটি তখনকার ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর বিধানসভা এলাকার অন্তর্ভুক্ত। ১৯৮৮ সালে স্থানীয় বাসিন্দা এবং দক্ষিণ দমদম পুরসভার বামপন্থী কমিশনাররা 'বিতর্কিত' জমিটির 'বে-আইনী হস্তান্তর' বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ জানান। ওই আবেদনপত্রে সুভাষবাবুরও স্বাক্ষর ছিল। আবেদনকারীদের বক্তব্য ছিল: "দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কিত জমিটি কার্যত 'নো-ম্যানস ল্যান্ড' এবং অবাধেই সেখানে অসামাজিক কার্যকলাপ চলে।" ওই জমিতে হাসপাতাল অথবা শিশু উদ্যান তৈরির জন্য তাঁরা সরকারি হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেন। ওই আবেদনপত্রে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে ছিলেন সি পি এমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অজিত চৌধুরী, সি পি আইয়ের অধ্যাপক নেতা জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায়, সি পি এমের বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী ফ্রন্টের নেতা সুনীল দাশগুপ্ত এবং সি পি এমের আঞ্চলিক কমিটিগুলির সম্পাদকেরা। ১৯৯১ সালে মহকুমা শাসক জমিতে নোটিশ বোর্ড টাঙানোর জন্য পুরসভাকে নির্দেশ দেন। পুরসভার পক্ষ থেকেও একটি আলাদা বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়, যার মূল কথা ছিল: "দক্ষিণ দমদম পুরসভার অধীন ওই জমিটি জল সরবরাহ, শিশু উদ্যান, মেডিক্যাল ইউনিট প্রভৃতির জন্য অধিগ্রহণ করা হলো। ওই জমি কোনওভাবে বেচাকেনা, হস্তান্তর বা ভরাট করা যাবে না। জমিতে লাইসেন্স, বাড়ির নকশা অনুমোদিত হবে না।"
হঠাৎ স্থানীয় বাসিন্দারা দেখতে পান, 'বিতর্কিত' জমিটিতে প্রোমোটাররা বহুতল বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করে দিয়েছে। অথচ, জমির 'বেআইনি হস্তান্তর'-এর বিরুদ্ধে একসময় দমদম সি পি এমের সব গোষ্ঠীর নেতারাই যে একযোগে আন্দোলনে নেমেছিলেন, মহকুমা শাসকের কাছে পাঠানো স্মারকলিপির স্বাক্ষর থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বহুতল বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার পর স্থানীয় বাসিন্দারা সি পি এমের জেলা স্তরের নেতাদের কাছে অভিযোগ জানাতে যান। এরপর বাসিন্দা ও দোকানিদের একাংশ যান সি পি এমের রাজ্য দফতরে, রাজ্য সম্পাদক শৈলেন দাশগুপ্তের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁদের বক্তব্য: লিখিতভাবে অভিযোগ দায়ের করার পরেও তাঁরা কোনও 'ফল' পাননি। এরপর তাঁরা অভিযোগ জানান মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, কলকাতার পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদার এবং উত্তর ২৪ পরগণার পুলিশ সুপার রচপাল সিংহের কাছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং সুরজিতের কাছে পাঠানো আবেদনপত্রে অভিযোগকারীরা জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, পুলিশের কর্তা এবং রাজ্যের বহু মন্ত্রী ও বিশিষ্ট নেতাদের সমগ্র ঘটনার কথা জানানো হয়েছে। তাঁরা লিখেছেন, 'যাঁরা ভুয়া চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করছেন, তাঁদের ঘর জোর করে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এই অবস্থায় আমরা আমাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানাচ্ছি। অথবা আমাদের সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে ভারতীয় সেনাদের গুলি করার নির্দেশ দিন।'
[সূত্র: 'যুক্তিবাদের চোখে নারীমুক্তি', প্রবীর ঘোষ]
...................................................................................
....সমরবাবু মানুষের মনস্তত্ত্ব বোঝেন। জানেন-অন্যায়বোধের দ্বারা সংগ্রামী মানুষেরও মন স্তিমিত হয়। 'সিস্টেম' বা 'সমাজ কাঠামো'র নিয়ন্ত্রকরা ব্যক্তির সততাকে ভয় পায় না, ভয় পায় সৎ ও সঠিক আন্দোলনকে। কারণ এই 'সমাজ কাঠামো' ব্যক্তি-সততায় উৎখাত করার নয়। ব্যক্তি-সততা থেকেই সামগ্রিক-সততা, এটা মেনে নিয়ে ব্যক্তি-সততার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা জানিয়েও বলছি-সমাজ কাঠামো পালটাতে চাই আন্দোলন, সঠিক আন্দোলন, যেখানে ব্যক্তি-সততা অবশ্যই আবশ্যিক শর্ত। ব্যক্তি-সততার শক্তির সীমাবদ্ধতা বোঝাতে একটা উদাহরণ টানছি। হাতের সামনে চটজলদি উদাহরণ হিসেবে ৮ নভেম্বর '৯৩-এর আনন্দবাজার পত্রিকার একটি খবরকেই বেছে নিলাম। জাল বাটখারা রোজ হিসেবে ভাড়া পাওয়া যায় শিয়ালদায়। প্রয়োজন মতো জাল বাটখারায় কখনও ওজন বেশি থাকে, কখনও কম। জাল বাটখারা দামে সস্তা। ক্যাশমেমো লাগে না। কাঠের দাঁড়িপাল্লা, জাল বাটখারার আড়তদার বড়বাজারে নিজের গদিতে বসে গোঁফে তা দিতে থাকেন। জানেন তাঁর গায়ে হাত দেওয়ার সাধ্য নেই কারও। ওজন ও পরিমাপন দফতরও ব্যাপারটা ভালোই জানে। তবু ওই দফতরের দুর্বুদ্ধিগ্রস্ত কোনও সৎ অফিসার যদি জাল বাটখারার উৎস সন্ধানে এগোতে চান তবে তাঁর জন্যে মাথাভাঙা, মেখলিগঞ্জ বা পুরুলিয়ায় বদলি নির্দিষ্ট করাই থাকে। একদা ডবলিউ বি সি এস কুণাল বন্দ্যোপাধ্যয় ওজন ও পরিমাপন দফতরের ইন্সপেক্টর হয়ে হাওড়ার জাল বাটখারার কারখানা খুঁজতে গিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন মাথাভাঙায়। দুর্নীতির আখড়ার হদিস দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে চিঠি লেখার পরিণাম ওই বদলি। সেই চিঠি এখনও মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের ঠান্ডা ঘরে পড়ে আছে। বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওই চাকরি ছেড়ে দিয়ে কুণালবাবু এখন অধ্যাপনায়। কিন্তু এখনও বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা অটুট। এখনও তাঁর প্রাপ্য বকেয়া মাইনে, প্রভিডেন্ড ফান্ড, লিভ এনক্যাশমেন্ট, গ্র্যাচুইটি-সবই আটকে আছে। সাড়ে তিন বছর পরেও এক পয়সাও মেটায়নি কোচবিহার অফিস কিংবা সদর দফতর। এও কি কায়েমি স্বার্থের প্রতিশোধের ভিন্ন চেহারা নয়? কিসের ভরসায় চোরদের বিরুদ্ধে লড়বে কোনও সৎ অফিসার?....
- 'যুক্তিবাদের চোখে নারীমুক্তি', প্রবীর ঘোষ
................................................................................
....অতি সাম্প্রতিক একটি ঘটনা। রাতদুপুরে একটি ফোন এলো। ফোন করলেন এই বঙ্গের গব্বর সিং। তিনি বামফ্রন্টের মহাক্ষমতাবান এক মন্ত্রীর শক্তির উৎস। নো ধানাই-পানাই। সরাসরি জানিয়ে দিলেন, ওমুক জ্যোতিষী মন্ত্রী মহোদয়ের খুব কাছের লোক। আমি যেন দেখি। ওইটুকু বলেই লাইন কেটে দিলেন। বুঝলাম জ্যোতিষীর সঙ্গে মন্ত্রীর লাইন ভালোই আছে। যেভাবে মাঝে-মধ্যে জ্যোতিষী, তান্ত্রিকদের পুলিশ ধড়পাকড় করছে, মিডিয়া টিভিতে দেখাচ্ছে, তাতে মন্ত্রী আশ্রিত জ্যোতিষী ভয় পেয়েছেন, বুঝলাম। কিন্তু তাঁকে বাঁচাতে নির্লজ্জ দালালিতে নামবেন মার্কসবাদী মন্ত্রী ও তাঁর মস্তান? এই মার্কস বাদ দেওয়া মার্কসবাদীদের সত্যিই বুঝি না।....
....মার্কসবাদী মন্ত্রীরা আগে প্রকাশ্যেই জ্যোতিষ সম্মেলনে যেতেন। প্রশংসা করতেন এই প্রাচীন ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসকে। কোনও কারণে যেতে না পারলে সরকারি প্যাডে গদগদ ভাষায় চিঠি কম্পোজ করে পাঠাতেন। অমূল্য ও'সব দলিল জ্যোতিষ সম্মেলনের উদ্যোক্তারা সম্মেলনের স্মারক গ্রন্থে ছাপতেন। যুক্তিবাদীদের চেল্লামিল্লিতে মার্কসবাদী মন্ত্রীরা এখন প্রকাশ্য ছেড়ে নেপথ্যে গেছেন। কিন্তু জ্যোতিষীদের সঙ্গে রাজনীতিকদের ফেবিকলের জোড় অটুট রয়েছে।....
- 'যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা', প্রবীর ঘোষ
.........................................................................................
বামফ্রন্টের সময়েই জ্যোতিষী আচার্য সত্যানন্দ (আগের নাম প্রদীপকুমার বিশ্বাস) মানুষকে ঠকিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেছিল। তার আলাদা বিমান ছিল যাতায়াত এর জন্য, এমনকি ছিল ব্যক্তিগত এয়ারপোর্ট। উত্তর ২৪ পরগনার বারাসাতে তার ছিল বিশাল প্রাসাদ, যেটির প্রতিটি কক্ষ ছিল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। টাকি রোডে তার এয়ারক্রাফট ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দায়িত্ব ছিল স্বাস্থ্য অধিকর্তা প্রভাকর চট্টোপাধ্যায়ের ভাইঝি ক্যাপ্টেন শতাব্দী চট্টোপাধ্যায়ের উপর। সবসময় ৮-১০ জন গুন্ডা সাথে রাখতো এই টাউট। তার ভণ্ডামির বিজ্ঞাপনের জন্য সেসময়েই বছরে কয়েক কোটি টাকা খরচ করতো। জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর ম্যাগাজিন প্রকাশের ১৫ বছর আগে অশ্লীল ম্যাগাজিন প্রকাশ করতো সে। পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তারা ছাড়াও বামফ্রন্টের অনেক নেতার সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল। এই লোক ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক চ্যানেল এর তৎকালীন ডিরেক্টর ফ্রেঞ্চ রবার্টকে মারধর করেছিল এবং একটি চ্যানেলে প্রবীর ঘোষ ও তার সহযোগীদের হত্যার হুমকি দিয়েছিল। এই ভন্ডের আগের ঘরে দুই সন্তান ছিল, পরে সে দ্বিতীয় বিয়ে করে। কলকাতার হিন্দুস্তান পার্কে তার বিমান চালনার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। এই লোক ১৫ টাকার আংটি ভক্তদের কাছে বিক্রি করতো সাড়ে ৫ হাজার টাকায়! তার দ্বিতীয় স্ত্রী অলকানন্দা হচ্ছে গায়ক নচিকেতার বড়ো বোন। জ্যোতিষ গণনা করে সত্যানন্দ জন প্রতি পারিশ্রমিক নিতো ৩০০ টাকা। দিনে প্রায় ৫০ জনের মতো লোক আসতো ভাগ্য গণনা করতে। এছাড়া সত্যানন্দের আয় পাথর বিক্রি কিংবা বিভিন্ন রকম উপদেশের পথ ধরেও হতো। এই লোক নিয়মিত বৃত্তিকর দিতো। ব্যবসা করতে বারাসাতের বামপন্থী পুরবোর্ড থেকে জ্যোতিষ গণনার জন্য ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছিল সে।
...............................................................................
সিপিএম এর সমর্থক বর্ধমান জেলার কাঁকসা থানার তেলিপাড়ার 'মোবাইল বাবা'কে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি'র অনেক চেষ্টার পর পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। লোকটির আসল নাম ছিল জগদ্বন্ধু বা জগবন্ধু লোহার। অভিযোগ ছিল অনিমেষ ধীবর নামের এক কিশোরকে রেল লাইনের তলায় হাত দিতে প্ররোচিত করেছিল এই ভন্ড। অনিমেষের ডান হাতের রেখায় নাকি মৃত্যুযোগ ছিল। তাই ডান হাত কব্জি থেকে কেটে ফেলার উপদেশ দিয়েছিল মোবাইল বাবা। এক টুকরো হাড় নিয়ে মোবাইল বাবার কেরামতি ছিল। হাড়ের টুকরোকে মোবাইল ফোনের মতো ব্যবহার করতো সে। এই ফোনে শুধুই মা কালীর সঙ্গে কথা বলা যেত! দেবীর সঙ্গে কথা বলতে পারতো শুধু জগবন্ধু লোহার! ঐ জন্যই ওর নাম হয়েছিল 'মোবাইল বাবা'। সিপিএম এর বড় বড় নেতাদের সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা ছিল, কয়লা ও লোহার ছাঁট মাফিয়াদের সঙ্গেও। বাইরের ভক্তদের পকেট কেটে স্থানীয় মানুষদের দান করে 'রবিন হুড' ইমেজ তৈরি করেছিল সে। মোবাইল বাবা দাবি করতো যে কোনও রোগ-বালাই দূর করতে পারে, নিঃসন্তানকে সন্তান দিতে পারে সে।
দুর্গাপুর কোর্ট থেকে অন্তবর্তী জামিনে ছাড়া পেয়ে যায় মোবাইল বাবা। সরকারি আইনজীবী অসিত মুখোপাধ্যায় জানান পুলিশ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ৪২০ ও ৩২৬ ধারার অভিযোগ আনলেও তারা আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নেয়ার কোনও আবেদন করেনি। তাই আসামির জামিনের বিরোধিতা করার কোনও সুযোগ ছিল না তার।
অনিমেষ মাছের ব্যবসা করতো। মাসিক আয় এক থেকে দেড় লাখ টাকা ছিল সেই ২০০৫ সালেই। ঘটনার বছর তিনেক আগে থেকে অনিমেষ মোবাইল বাবার আশ্রমে যাচ্ছিল। চ্যবনপ্রাশের মতো একটা করে শিশি প্রায়ই আনতো আশ্রম থেকে। সব সময় নেশায় নিস্তেজ হয়ে থাকতো।
পুলিশের দাবি অনুযায়ী রাজবাঁধ ও পানাগড় স্টেশনের মাঝে চার নম্বর রেল গেটের কাছে লাইনে হাত রেখেছিল অনিমেষ। পুলিশ স্পটে গিয়ে রক্তের দাগ দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি'র সদস্যরা কোনও রক্তের চিহ্ন দেখতে পায়নি।
দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালের ডা. রাজা সাহার মতে-
"এটা ট্রেনে কাটার কেস নয়। যে পরিমাণ রক্তপাত হচ্ছিল, ট্রেনে কাটা পড়লে তা হওয়ার কথা নয়। ট্রেনের প্রচণ্ড চাপে রক্ত বের হবার পথগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।"
বর্ধমান মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের ডেপুটি সুপার মঞ্জুর মুর্শেদ জানান অনিমেষ তাকে বলেছে, মোবাইল বাবা কয়েকবারই জানিয়েছিল, ডান হাতে ফাঁড়ার রেখা আছে। সামনে নিশ্চিত মৃত্যু। ফাঁড়া কাটাতে হলে ডান হাতের কব্জি থেকে কেটে বাদ দিতে হবে। গত শনিবার ও মোবাইল বাবার আশ্রমে যায়। মোবাইল বাবা মুড়ি খেতে দেয়। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সে। তখন মোবাইল বাবা একটা ভোজালি দিয়ে হাত কেটে নেয়।
ইনজুরি দেখে ডা. মুর্শেদ জানান কব্জি ধারালো কোনও অস্ত্র দিয়ে কাটা। ট্রেনের চাকায় কাটা পড়লে কব্জির কাছের মাংসের তন্তুগুলোর চেহারা অন্যরকম হতো। ট্রেনে কাটা পড়লে ওর মাথায়ও মারাত্মক চোটের চিহ্ন থাকতো।
এর বছর দেড়-দুই আগে এক মহিলাকে ধর্ষণের অভিযোগে মোবাইল বাবাকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। তারপর পুলিশকে ম্যানেজ করে জামিন পেয়ে যায় সে। সেই সময় থেকেই পুলিশের সঙ্গে ওর দোস্তি বেড়েছিল। মোবাইল বাবা সিপিএম এর খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল। সিপিএম এর শেল্টারেই মোবাইল বাবার এতো মস্তানি ছিল। বছরখানেক আগে সিপিএম এর জাঠায় অংশ নেয়া ক্যাডার ও লিডারদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল এই মোবাইল বাবা।
সিপিএম এর কাঁকসা জোনাল কমিটির সম্পাদক বীরেশ্বর মণ্ডল জানায়-
"পার্টি মোবাইল বাবার কোনও অপকর্মকে সমর্থন করে না। মানুষ যদি শান্তি পেতে মোবাইল বাবার কাছে যায়, তাতে আমরা তো বাধা দিতে পারি না। মানুষের ধর্মীয় আবেগকে তো আমরা আঘাত দিতে পারি না।"
মোবাইল বাবার পেটোয়া মাফিয়ারা সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের হুঁশিয়ারি দিয়েছিল-
"বাবাজির ব্যাপারে নাক গলালে ফল ভালো হবে না।"
ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি এবং হিউম্যানিস্টস্ অ্যাসোসিয়েশন এর সদস্যরা বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি অনিমেষের সঙ্গে দেখা করলে সে তাদের জানায়, মোবাইল বাবার আশ্রমে বেশ কয়েক বছর ধরে তার যাওয়া-আসা ছিল। মোবাইল বাবা নানা অছিলায় তার কাছ থেকে ৯০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকার মতো নিয়েছিল। ভাগ্য-পাল্টানোর নাম করে তার ডান হাত কাটতে বলে মোবাইল বাবা। অনিমেষ হাত কাটতে রাজি না হলে তাকে মাদক জাতীয় কিছু খাইয়ে মাথার পিছনে আঘাত করা হয়। এর ফলে অজ্ঞান হয়ে যায় অনিমেষ। জ্ঞান ফিরে দেখে তার ডান হাত কাটা।
ছেলে নারায়ণ সমিতির সদস্যরা দেখা করতে গেলে চিৎকার করে বলেছিল-
"আমরা সিপিএম করি। আমাদের একগাছা বালও ছিঁড়তে পারবে না। মানে মানে কেটে পড়।"
এরপর এক লোক ছুরি বের করে সাংবাদিক ও তাদের সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলেছিল-
"বাবা বললে, যে কোনও লোকের জান নিয়ে নিতে পারি।" নিজের নাম জানালো আত্মারাম সরকার। অকপটে জানালো অবৈধ পেট্রল ও ডিজেলের ব্যবসা আছে তার।
মোবাইল বাবার দুর্নীতি-ধর্ষণ নিয়ে সিপিএম আওয়াজ তুলতে নারাজ ছিল। তাদের 'পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ' ছিল। কিন্তু বিজ্ঞান মঞ্চ অনিমেষের ব্যাপারে, মন্ত্রে সন্তান উৎপাদনের নামে ধর্ষণের ব্যাপারে আশ্চর্য রকম নীরব ছিল। প্রতারণা করে, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে মিলনে বাধ্য করা আইনের চোখে ধর্ষণ। পার্টির এই নীরবতার পক্ষে যুক্তি ছিল "আমরা ধর্মীয় ভাবাবেগকে তো আঘাত করতে পারি না"। তাই পশ্চিমবঙ্গে ডাইনি হত্যা নিয়ে পার্টি আইনের পক্ষ নেয়নি। আইন যেহেতু আদিবাসীদের ধর্মীয় ভাবাবেগকে আঘাত করতে পারে তাই ওদের বেআইনি কাজকে কখনও নীরব সমর্থন জানিয়ে, কখনও বা বেআইনি কাজে অংশ নিয়ে ভোট কুড়োবার রাজনীতি করেছিল এই নির্বাচনপন্থীরা।
অনিমেষকে পরপর দু'দিন পরীক্ষা করেছিল হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের চিকিৎসকরা। সোমবার বর্ধমান মেডিক্যালের মানসিক রোগ বিভাগের প্রধান ওমপ্রকাশ সিংহ বলেন-
"অনিমেষ মোটেই মানসিক রুগি নয়। সাধুটি ওর হাতে অকালমৃত্যুর রেখা থাকার কথা বলায় সে ভয় পেয়েছিল।... ঘটনার দিন অনিমেষকে 'ফেনসাইক্লিডিন' জাতীয় কোনও মাদক খাওয়ানো হয়েছিল। ওই মাদকের প্রভাবে কারও শরীরে আঘাতের অনুভূতি লুপ্ত হয়ে যায়।”
ট্রেনের ইঞ্জিনের তলার দিকে একটা শক্ত গ্রিল থাকে। একে বলে 'কাউক্যাচার'। গরু চরতে চরতে চলন্ত ট্রেনের সামনে এসে পড়লে ধাক্কা খাবে ওই গ্রিলে। ফলে ছিটকে যাবে গরু। রেললাইন ও ইঞ্জিন থাকবে সুরক্ষিত। অনিমেষ এর মাথা কাউক্যাচারের ধাক্কায় ছিটকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু যায়নি, কারণ ও রেল লাইনে ডান হাতটি রাখেনি। চার নম্বর গেটের গেটম্যান সমিতির সদস্যদের এই যুক্তি সমর্থন করেছিল। ডাক্তাররা পরে বলেছেন পুলিশ মেডিকেল রিপোর্ট নিতে আসেনি।
অনিমেষ আরও জানায় সন্তান হচ্ছে না, এমন অনেক লোকই সঙ্গে বউ নিয়ে মোবাইল বাবার কৃপা পেতে আসতো। তাদেরই কোনও কোনও বউকে পুত্রেষ্টি যজ্ঞের নাম করে রেখে দিতো। রাতে বউটিকে কোনও ওষুধ খাইয়ে অনিমেষের কাছে দিয়ে বলতো-
"তুই শিব, ও শক্তি। মনের আনন্দে দু'জনে মিলিত হ।"
সরকারি অফিসার, পুলিশ অফিসার, মাফিয়ারাও তন্ত্র শিখতে আসতো। তারাও ভৈরবী হিসেবে অন্যের বউকে পেতো। পুলিশ বেডে এসে অনিমেষকে হুমকি দিয়ে গিয়েছিল সে যেন বলে নিজেই ট্রেনের তলায় হাত দিয়েছিল। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ভক্তরা আসতো দূর-দূরান্ত থেকে এই ভন্ডের কাছে। তাদের পয়সায় হয়েছিল পাকা দোতলা বাড়ি, স্কুটার, ১০-১২ বিঘা জমি, বহু নগদ টাকার মালিক, পাকা মন্দির। অথচ আগে ছিল খেতমজুর। সম্মিলিত চাপে পুলিশ গ্রেফতার করতে বাধ্য হওয়ার আগে সে টানা ১৪ বছর মানুষকে লুটেছিল। মহিলাদের সঙ্গ পেতে ঐ ভন্ডকে লক্ষাধিক টাকা দিয়েছিল বলে অনিমেষ স্বীকার করেছিল। পুলিশ ভন্ড বাবাকে বাঁচাতে মিথ্যা ফরেনসিক রিপোর্ট তৈরি করেছিল। ২০০৫ সালের ২৬ নভেম্বর পুলিশ এমনকি অনিমেষকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল চাপ দিয়ে কেস তুলে নিতে বাধ্য করতে।
Comments