ইহুদিদের কথিত আদিবাসী হওয়ার সত্যতা [পর্ব-এক]

 


"....বর্তমানে জেরুসালেম নগরী হিসেবে পরিচিত এলাকাটির পাহাড় ও উপত্যকাগুলোতে প্রথম কারা বসতি স্থাপন করেছিল, সে সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। পুরনো নগরীর বর্তমান প্রাচীরগুলোর দক্ষিণে অবস্থিত ওফেল পাহাড়ের করবগুলোতে পাওয়া মৃৎপাত্রগুলো খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ সালের। এই সময়ে আধুনিক ইসরাইলের কেনানের অন্যান্য অংশে, মেগিডো, জেরিকো, আই, ল্যাচিশ ও বেথ শানে নগর আবির্ভূত হতে শুরু করেছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মন্দির, ঘর-বাড়ি, কারখানা, রাস্তা ও পয়োঃপ্রণালি আবিষ্কার করেছেন। তবে ওই সময়ে জেরুসালেমে নগরজীবন শুরু হয়ে গিয়েছিল, এমন কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং পরিহাসের বিষয় হলো যে পরবর্তীকালে কোটি কোটি ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্র হিসেবে যে স্থানটিকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে, সেটি ছিল প্রাচীন কেনানের পরিচিত অংশের বাইরে। পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত এ স্থানটিতে বসবাস করা ছিল কঠিন, এটি ছিল দেশের মূলকেন্দ্রের বাইরে। প্রাথমিক ব্রোঞ্জ যুগের বিকাশ প্রধানত উপকূলীয় সমতল এলাকা, উর্বরা জেজরিল উপত্যকা ও নেগেভেই মূলত সীমিত ছিল। এখানেই মিসরীয়রা তাদের বাণিজ্য গুদামগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিল। কেনান ছিল সম্ভাবনাময় সমৃদ্ধ দেশ : এর অধিবাসীরা মদ, তেল, মধু, বিটুমিন ও শস্য রফতানি করত। এর কৌশলগত গুরুত্বও ছিল। এশিয়া ও আফ্রিকার সংযোগস্থলে অবস্থিত স্থানটি মিসর, সিরিয়া, ফোনেশিয়া ও মেসোপোটিমিয়ার সভ্যতার মধ্যে সেতুবন্ধ প্রতিষ্ঠা করেছিল। তবে ওফেল পাহাড়ের চারপাশে বসন্তকাল সবসময়ই শিকারী, কৃষক ও সাময়িক বসতি স্থাপনকারীদের -প্যালেওলিথিক যুগের চকমকি পাথর, কাচ পাওয়া গেছে - আকৃষ্ট করলেও আমরা যতটুকু জেনেছি, জেরুসালেম এই প্রাথমিক বিকাশকালে কোনো ভূমিকা পালন করেনি। প্রাচীন বিশ্বে সভ্যতা সবসময়ই ছিল অনিশ্চিত অর্জন। খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ সালে কেনানে কার্যত আর কোনো নগরীই ছিল না। জলবায়ু পরিবর্তন, বিদেশী আগ্রাসন কিংবা মারাত্মক গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি যে কারণেই হোক না কেন, নগরজীবন অদৃশ্য হয়ে যেত। তখন ছিল নিকট প্রাচ্যজুড়ে টালমাটাল ও অস্থিতিশীলতার সময়। মিসরে ওল্ড কিংডম (আনুমানিক ২৬১৩-২১৬০ খ্রিস্টপূর্ব) হিসেবে পরিচিত রাজবংশ ধ্বংস হয়ে যায়। মেসোপটেমিয়ার আকাডিয়ান রাজবংশকে উৎখাত করে অ্যামোরাইটসরা, ওয়েস্টার্ন সেমিটিক এই জাতিগোষ্ঠী ব্যাবিলনকে রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এশিয়া মাইনরজুড়ে শহুরে স্থানগুলো পরিত্যক্ত হয়ে যায়, ফিনিসিয়ান উপকূলের উগারিট ও বাইবলোরাও ধ্বংস হয়ে যায়। আমাদের কাছে এখনো অজ্ঞাত এমন কোনো কারণে সিরিয়া অক্ষত থেকে যায়, মেগিডো ও বেথ শানের মতো নগরীগুলো তাদের দক্ষিণ প্রতিবেশীদের চেয়েও বেশি সময় টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু তারপরও লোকজন যাতে অনেক নিরাপদ ও পূর্ণাঙ্গ জীবন চালিয়ে যাওয়ার জন্য এসব অঞ্চল একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে, সে প্রয়াস অব্যাহত রাখে। নতুন নতুন নগরী ও নতুন নতুন রাজবংশ আত্মপ্রকাশ করতে থাকে, পুরনো বসতিগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুতে কেনানের পুরনো নগরীগুলোতে আবারো মানব বসতি দেখা যেতে থাকে। এই সময়কালে কেনানের জীবন সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত। দেশটিতে কোনো কেন্দ্রীয় সরকার গড়ে ওঠেনি। প্রতিটি শহর ছিল স্বায়াত্তশাসিত, তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব শাসক ছিল, আশপাশের গ্রাম এলাকায় প্রাধান্য বিস্তার করে থাকত। অথচ তখন মেসোপোটেমিয়ায় সভ্যতার সূচনা ঘটেছে। কেনান তখনো প্রবলভাবে পশ্চাৎপদ দেশ হিসেবে রয়ে যায়। এখানে বড় ধরনের বাণিজ্য বা শিল্প ছিল না। তাছাড়া অঞ্চলে অঞ্চলে ভৌগোলিক ও আবহাওয়াগত ব্যাপক পার্থক্য থাকায় বিভিন্ন জেলার মধ্যে একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা থাকার প্রবণতা ছিল। পার্বত্য এলাকা, জুদার প্রান্তর বা জর্দান উপত্যকায় অল্প কিছু লোক বাস করত। এখানকার নদীগুলো নৌচালনার উপযোগী ছিল না, চলাচল করা যেত না। যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল কঠিন। লোকজন দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে খুব বেশি দূর যেতে পারত না। মিসর ও দামাস্কাসকে সংযুক্তকারী প্রধান সড়কটি উপকূল বেয়ে গাজা থেকে জাফা পর্যন্ত গিয়েছিল, তারপর মাউন্ট কারমেলের চারপাশের জলাভূমি এড়িয়ে মেগিডো, জেফরিল উপত্যকা ও গ্যালিলি সাগর পর্যন্ত যায়। প্রাকৃতিকভাবে এসব অঞ্চল সবচেয়ে ঘন বসতিপূর্ণ ছিল। এই এলাকাটির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে টুয়েলফথ ডাইনেস্টির ফারাওরা। খ্রিস্টপূর্ব বিশ ও উনিশ শতকে তারা উত্তর দিকে তাদের প্রভাব বাড়ানোর কাজ শুরু করে। মিসরীয়দের কাছে 'রেতিনু' নামে পরিচিত কেনান আসলে মিসরের প্রদেশে পরিণত না হলেও ফারাওরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তৃতীয় সেসোসত্রিস অত্যন্ত শক্তিশালী ও স্বাধীন হওয়া স্থানীয় শাসকদের বশ মানতে উপকূলীয় পথে সৈন্য পাঠাতে দ্বিধা করেননি। মেগিযো, হাজর ও অ্যাক্কোর মতো নগরীগুলোকে নগর-রাষ্ট্র হিসেবে সুরক্ষিত করলেও ফারাওরা এমনকি কেনানের অন্যান্য অংশের প্রতিও তুলনামূলক কম আগ্রহ দেখায়। উনিশ শতকের শেষ দিকে বসতি স্থাপনকারীরাও পার্বত্য দেশটিতে অনুপ্রবেশ করে সেখানে নগরী বানাতে থাকে। শেচেম হয়ে পড়ে এসব সুরক্ষিত পার্বত্য শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। কোনো কোনো এলাকায় শহর ৩৭ একর জায়গাজুড়ে বিদ্যমান ছিল, পল্লীর বিশাল এলাকাও ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। দক্ষিণের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে হেবরন ও জেরুসালেমের মতো নগরী গড়ে ওঠে।....

১৯৬১ সালে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্যাথলিন কেনিয়ন প্রায় সাড়ে ছয় ফুট চওড়া একটি প্রাচীর আবিষ্কার করেন। এটি ওফেল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। প্রাচীরটিতে গিহন স্প্রিঙের কাছে একটি বড় দরজা ছিল। তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে এ নগর প্রাচীরটি পাহাড়টির দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত চলে গিয়ে পশ্চিম ঢালু পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, উত্তরে পরবর্তীকালের একটি নগর প্রাচীরের নিচে হারিয়ে যায়। প্রাচীর আর পাথুরে খাড়াইয়ের মধ্যবর্তী স্থানে মৃৎপাত্রও আবিষ্কার করেছেন কেনিয়ন। পাত্রটি খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ সালের। নগরীটি উত্তর দিকে প্রায় অরক্ষিতই ছিল, পরে সেখানে জায়ন দুর্গ নির্মাণ করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টাদশ শতকে সেখানে কোনো দুর্গ থাকার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ওফেলের পূর্ব ঢালুতে বেশ নিচু করে তৈরী প্রাচীরগুলোর মধ্যে সম্ভবত গিহন স্প্রিং পর্যন্ত একটি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গও ছিল। ব্রিটিশ প্রকৌশলী চার্লস ওয়ারেন ১৮৬৭ সালে সুড়ঙ্গটি আবিষ্কার করেন। নগরীর অভ্যন্তরীণ পাহাড় থেকে শুরু হয়ে এটি তির্যকভাবে নেমে গিয়ে তারপর উলম্বভাবে পানিতে মিশেছে। এই পানি সম্ভবত গিহন থেকে অপর একটি অনুভূমিক সুড়ঙ্গের মাধ্যমে আসত। অবরোধের সময় সম্ভবত জগ ও কলস খাদে ডুবিয়ে রাখতে হতো। একই ধরনের সরঞ্জাম পাওয়া গেছে মেগিডো, গেজার ও গিবেয়নে। কেনিয়ন বিশ্বাস করতেন, ব্রোঞ্জ যুগে খাদটি ব্যবহৃত হতো। কিন্তু তার তত্ত্বটি বিতর্কিত : অনেকে সন্দেহ করেন, এই পর্যায়ে এ ধরনের ব্যবস্থা নির্মাণের প্রযুক্তিগত দক্ষতা অধিবাসীদের ছিল না। তবে সাম্প্রতিক ভূতত্ত্বগত আবিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে, 'ওয়ারেন্স শাফট' নামে পরিচিত খাদটির পুরোটা মানবনির্মিত নয়। এটি চুনাপাথরের সন্ধিক্ষণে একটি প্রাকৃতিক গর্ত। প্রাচীন জেরুসালেমবাসী সম্ভবত এটিকে সংস্কার করে বড় করেছিল। সম্ভবত গিহনের কাছাকাছি থাকার কারণেই ওফেলের প্রতি আকৃষ্ট হতো বসতি স্থাপনকারীরা। স্থানটির কৌশলগত সুবিধাও ছিল। পার্বত্যভূমির ঢালুতে ছিল এর অবতরণস্থল। এর ফলে এখান দিয়ে জুদা মরুভূমিতে যাওয়া যেত। তবে বিপুল জনসংখ্যাকে সঙ্কুলান করার মতো ব্যবস্থা ছিল না ওফেলের। নগরীটির আয়তন ছিল মাত্র ৯ একরের কিছু বেশি। তবে তিন খাড়া উপত্যকা বসতি স্থাপনকারীদের বিপুল সুরক্ষা দিত: পূর্ব দিকে কিদরন উপত্যকা, দক্ষিণে হিন্নম (বা গেহেন্না) উপত্যকা, পশ্চিমে সেন্ট্রাল উপত্যকা। এটি এখন পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। ইহুদি ইতিহাসবিদ ফ্লাভিয়াস যোসেফাস একে টাইরোপোয়ন উপত্যকা হিসেবে অভিহিত করেছেন। এমনকি তখনো শহরটি কেনানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগরীগুলোর মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তবে এর অস্তিত্ব সম্ভবত মিসরীয়দের জানা ছিল। ১৯২৫ সালে লুক্সরে সিরামিক সামগ্রী পাওয়া গেছে। এগুলো জোড়া লাগিয়ে ৮০টি থালা ও পাত্র পর্যন্ত তৈরি করা সম্ভব ছিল। এতে প্রাচীন মিসরীয় পুরোহিতদের বক্তব্য খোদাই করা ছিল। পাঠ উদ্ধারের পর লিখিত লিপিতে দেশ, নগরী ও শাসকদের নাম উদ্ধার করা হয়। এগুলো মিসরের শত্রুদের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে হয়েছে। পাত্রগুলো সম্ভবত বৈরী সামন্তদের পতনের জন্য কোনো মন্ত্রযপ অনুষ্ঠানে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাত্রগুলোতে ফারাও তৃতীয় সেসোসট্রিস (১৮৭৮-১৮৪২ খ্রিস্টপূর্ব) আমলের তারিখ দেওয়া ছিল। এগুলোতে ১৯টি কেনানি নগরীর নাম রয়েছে। এগুলোর একটি হলো 'রুশালিমাম'। কোনো ঐতিহাসিক নথিতে এই প্রথম নগরীটির নাম দেখা গেল। পাঠে দুই রাজপুরুষের নামও পাওয়া যায়। তারা হলেন ইয়রম ও শাশান। এসব তথাকথিত 'এক্সেক্রেশন টেক্সটের' আরেকটিতে সম্ভবত এক শ' বছর পর খোদাই করা হয়েছিল। এখানে আবারো 'রুশাললিমামকে' অভিশাপ দেওয়া হয়েছে। তবে এ সময় নগরীতে সম্ভবত একজন শাসকই ছিলেন। এই অপ্রতুল বিচ্ছিন্ন প্রমাণ থেকে অনেক বিশেষজ্ঞ অভিমত প্রকাশ করেছেন যে অষ্টাদশ শতকে কেনানের বাকি অংশের মতো জেরুসালেমও অনেক গোত্রপতির শাসিত গোত্রীয় সমাজ থেকে একজন একক রাজার শাসিত নগর বসতিতে বিবর্তিত হয়েছে। এখানে আমাদের উচিত হবে একটু বিরতি নিয়ে নগরীর নামটি বিবেচনা করা। মনে হচ্ছে অস্তায়মান সূর্য কিংবা সন্ধ্যা তারার নামের সাথে সম্পৃক্ত সিরিয়ার ঈশ্বর সালেম থেকে তা এসেছে। কেনানে মিসর রাজনৈতিকভাবে আধিপত্য বিস্তার করলেও সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিষয়াদিতে সিরিয়ার প্রভাব ছিল। হাজর, মেগিডো ও শেচেমে এই আমলের আবিষ্কৃত মন্দিরগুলো সিরিয়ান মডেলেই তৈরি হয়েছে বলে স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। রাজার প্রাসাদের মূল পরিকল্পনা অনুযায়ীই এসব মন্দির নির্মিত হয়েছে। এর মাধ্যমে এ ধারণাও দেওয়া হয় যে ঈশ্বরদের কাছ থেকেই আসে সব নিয়ম-কানুন। সাধারণ লোকজনের জন্য কাল্ট হল বা হেখালে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ ছিল, ঠিক যেভাবে রাজার উপস্থিতিতে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিল। হলরুমের কুলুঙ্গিতে রাখা রাজার প্রতিকৃতি তারা আঙিনা থেকে হেখালের খোলা দরজা দিয়ে একনজর দেখতে পেত। জেরুসালেমে ব্রোঞ্জ যুগের কোনো মন্দির এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, তবে নগরীর নামে বোঝা যাচ্ছে, অধিবাসীরা সিরিয়ান ধর্মের কাছে উন্মুক্ত ছিল। 'এক্সারক্রেশন টেক্সটে' জেরুসালেমের রাজপুরুষদের নাম পাওয়া যাওয়ায় ইঙ্গিত দিচ্ছে সিরিয়ার জনসাধারণের মতো জেরুসালেমবাসীও ছিল ওয়েস্টার্ন সেমিটিক বংশোদ্ভূত, তারা একই ধরনের বিশ্ববীক্ষা পোষণ করত। 'রুশালিমাম' নামটির অনুবাদ করলে এর অর্থ দাঁড়াতে পারে 'সালেম (শান্তি) পাওয়া গেছে'। নিকট প্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার প্রাচীন দুনিয়ার বসতি স্থাপন ও নগর-পরিকল্পনা করাকে বিবেচনা করা হতো ঐশী উদ্যোগ। ওফেল পাহাড়ের প্রতি উপনিবেশকারীদের প্রথম আকৃষ্ট হওয়ার কারণ ছিল এর পানি....

সপ্তদশ শতকে ফারাওরা ঘরোয়া বিষয়াদি নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল যে 'রেতিনু' নিয়ে ভাবার ফুরসতই পায়নি। ফলে দেশটি সমৃদ্ধ হয়েছিল। মিসরীয়দের আগ্রাসী কোনো অভিযান না থাকায় স্থানীয় সংস্কৃতি এর ফলে বিকশিত হতে পেরেছিল।....

কেনানের কোনো কোনো শহর পুরোপুরি নগর-রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এগুলোর স্থাপত্য, আসবাবপত্র, গৃহস্থালি সামগ্রী, অলঙ্কার ইত্যাদি মেগেডো, হাজর ও শেচেমে আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু জেরুসালেমে সপ্তদশ থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত কোনো মৃৎপাত্র পাওয়া যায়নি। আমরা যতটুক জানি তা এই যে এ সময়কালে নগরীটি সম্ভবত তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছিল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের পরেই আমরা নিশ্চিতভাবে জানতে পারি, নগরীটি আবার জনবসতিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। ওই সময় নাগাদ মিসর আবার কেনানে তাদের উপস্থিতি আবারো জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ফারাওরা এখন আনাতোলিয়ায় নতুন হিতিতি সাম্রাজ্য ও উত্তর মেসোপোটেমিয়ার তিত্তানির হুরিয়ান রাজ্যের সাথে সঙ্ঘাতে জড়িত। তাদের এখন নিশ্চিত করা প্রয়োজন যে গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট দেশ কেনান প্রবলভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ১৪৪৬ সালে ফারাও তৃতীয় থুতমোস মেগিডোতে কেনানি ও সিরীয়দের একটি বিদ্রোহ দমন করেন। তিনি 'রেটিনোর' মর্যাদা হ্রাস করে মিসরের স্রেফ একটি এলাকায় পরিণত করেন। দেশটিকে চারটি প্রশাসনিক জেলায় ভাগ করা হয়, কেনানের নগর-রাষ্ট্রগুলোর শাসকেরা ফারাওদের সামন্তে পরিণত হয়। তারা তার কাছে ব্যক্তিগতভাবে শপথ গ্রহণ করতেন, তাদের ওপর বিপুল কর চাপানো হলো। বিনিময়ে তারা আরো বেশি সহায়তা ও সমর্থন পাবেন বলে আশা করেছিল। তবে ততটা দিতে আসলে ফারাও প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু তারপরও রাজপুরুষেরা বেশ ভালো রকমের স্বাধীনতাই ভোগ করতেন। দেশটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করার মতো উপায় মিসরের ছিল না। রাজপুরুষেরা সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারতেন, নিজেদের ভূখণ্ড সম্প্রসারণ করতে পারতেন। অবশ্য তত দিনে অন্য বড় শক্তিগুলোও কেনানের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করতে শুরু করে দিয়েছে। মিতানি রাজ্যের হুরিয়ানরা পঞ্চদশ শতকের প্রথম দিক থেকেই দেশটিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা শুরু করে দেয়। বাইবেল অনুযায়ী, এসব লোক নিজেদের বলত 'হিভিতি' বা 'হোরিত'। স্থানীয় লোকজনের বিপরীতে তারা ছিল আর্য বংশোদ্ভূত। তবে তারা বিজয়ী হিসেবে না এলেও এত প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিল যে মিসরীয়রা কেনানকে 'হরু' বা 'হুরিয়ান ভূমি' বলতে শুরু করেছিল। হুরিয়ানরা প্রায়ই নগর-রাষ্ট্রগুলোতে ক্ষমতার অবস্থান লাভ করত। তারা স্থানীয় লোকজনের সাথে মিলেমিশে বসবাস করে তাদেরকে আক্কাইডিয়ান ভাষা শেখাতে থাকে। এটিই কূটনৈতিক ভাষা ও কোনিফর্ম লিপিতে পরিণত হয়। জেরুসালেমে হুরিয়ান প্রভাব ছিল প্রবল। চতুর্দশ শতকে কেনানের অন্যতম নগর-রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল জেরুসালেম। অবশ্য তার মর্যাদা হ্যাগর বা মেগিডোর চেয়ে কম ছিল। এর আয়তন তখন শেচেম ও গেজার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এর শাসক আবদি-হেপার নামটি হুরিয়ান। এই পর্যায়ে জেরুসালেম সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ১৮৮৭ সালে মিসরের তেল আল আমারনায় প্রাপ্ত কোনিফর্ম ট্যাবলেট থেকে পাওয়া। এগুলো সম্ভবত ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপ (খ্রিস্টপর্ব ১৩৮৬-৪৯) ও তার ছেলে আখেনাতেনের (খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫০-৩৪) রাজকীয় আর্কাইভের অংশ ছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল ফারাও প্রভুর কাছে লেখা কেনানের রাজপুরুষদের প্রায় ৩৫০টি চিঠি। এগুলোতে দেখা যায়, দেশটি তখন গোলযোগের মধ্যে ছিল। নগর-রাষ্ট্রগুলো একে অপরের সাথে যুদ্ধে মত্ত ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শেচেমের প্রিন্স ল্যাবায়ু নির্মমভাবে সম্প্রসারণবাদী নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তার ভূখণ্ড উত্তরে গ্যালিলি সাগর পর্যন্ত সম্প্রসারণ করেছিলেন, পশ্চিম দিকে তা গাজা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। রাজপুরুষেরা অভ্যন্তরীণ শত্রুদের সম্পর্কেও অভিযোগ করেছিলেন। তারা ফারাওয়ের কাছে সহায়তা কামনা করেন। এতে আরো মনে হয়, হিত্তিতিদের সাথে তখন যুদ্ধে নিয়োজিত মিসর তাদের সহায়তা দিয়েছিল সামান্যই। কেনানের অস্থিরতা সম্ভবত ফারাওকে নাখোশ করেনি। কারণ এর ফলে নগর-রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে মিসরীয় প্রাধান্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করা অসম্ভব করে তুলেছিল।

আমারনা চিঠিগুচ্ছের মধ্যে ছয়টি ছিল জেরুসালেমের আবদি-হেপার। কেনানের যেসব শাসক অপেক্ষাকৃত সফল হয়েছিলেন, তিনি সম্ভবত তাদের মধ্যে ছিলেন না। তিনি অসংযত ভাষায় ফারাওয়ের প্রতি তার আনুগত্যের কথা দৃঢ়ভাবে জ্ঞাপন করেন, তার শত্রুদের বিরুদ্ধে সহায়তা করার জন্য জোরালো আবেদন করেন। তবে ওই সাহায্য কখনোই আসেনি। শেচেমের বিরুদ্ধে আবদি-হেপা এগিয়ে যেতে পারেননি, শেষ পর্যন্ত তিনি তার সব মিত্রকে হারান। জেরুসালেম নগরীতে পর্যন্ত অভ্যুত্থান ঘটেছিল। কিন্তু তবুও আবদি-হেপা চাননি, জেরুসালেমে মিসরীয় সৈন্য পাঠানো হোক। তিনি ইতোমধ্যেই অতি সামান্য প্রশিক্ষিত ও অপর্যাপ্ত মিসরীয় সৈন্যদের হাতে হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, তারা তার প্রাসাদ ভেঙ্গেছে, তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। তিনি এর বদলে বরং গেজার, ল্যাচিশ বা আশকেলনে শক্তি বাড়ানোর জন্য ফারাওয়ের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। মিসর থেকে সহায়তা না এলে জেরুসালেম ভূমির নিশ্চিতভাবেই তার শত্রুদের হাতে পতন ঘটবে। প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আবদি-হেপা কখনো তার সৈন্য পাননি। বস্তুত, এই পর্যায়ে, পার্বত্য দেশটি দ্রুত অসামরিককৃত এলাকায় পরিণত হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সুরক্ষিত শহর শিলোহ পরিত্যক্ত হয়, ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে অপেক্ষাকৃত ছোট পার্বত্যাঞ্চলের ৮০ ভাগ স্থানের বসতি অদৃশ্য হয়ে যায়। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, অস্থিরতার এই সময়ই বাইবেলে বর্ণিত জেবুসিতরা নিজেদেরকে জেরুসালেমে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

সাহিত্যিক প্রমাণের ভিত্তিতে অন্যদের দাবি, হিত্তিদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত জেবুসিতরা প্রায় ১২০০ খ্রিস্টপূর্ব সালের দিকে বর্তমান উত্তর তুরস্কের উত্তরে অবস্থিত হিত্তিতি সাম্রাজ্যের পতনের আগে ওই দেশে পৌঁছেনি। কোনটা সত্য তা নির্ধারণ করা অসম্ভব। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে এখন পর্যন্ত কিছু পাওয়া না গেলেও ব্রোঞ্জ যুগের (খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০-১২০০) শেষ সময়ের দিকে জেরুসালেমের জনসংখ্যার পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আরো দেখা যায়, জেবুসিতরা ছিল স্রেফ অভিজাত পরিবার। তারা শহরের লোকজনের থেকে আলাদা হয়ে দুর্গে বাস করত। ফলে এমনটা হতে পারে যে জেবুসিতরা ওফেলের পুরনো দুর্গগুলো মেরামত করেছিল এবং পাহাড় চূড়া ও প্রাচীরের মাঝখানের পূর্ব দিকের ঢালুতে নতুন এলাকা নির্মাণ করেছিল। ক্যাথলিন কেনিয়ন পাথরে পূর্ণ অনেক চত্বর আবিষ্কার করেছেন। এর ফলে, তিনি বিশ্বাস করতেন, ঢালু এলাকাটি বসবাস উপযোগী হয়, পুরনো নড়বড়ে বাড়িঘর ও খাড়া রাস্তাগুলোর স্থলাভিষিক্ত হয় এগুলোই। নতুন কাজে দীর্ঘ সময় লাগে। কেনিয়ন দাবি করেছেন, প্রকল্পটি চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝিতে শুরু হলেও তৃতীয় শতকের প্রথম দিকের আগে শেষ হয়নি। কোনো কোনো প্রাচীর ছিল ৩৩ ফুট উঁচু। আর ভূমিকম্প ও ভূমিক্ষয়সহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে নির্মাণকাজে প্রায়ই বিঘ্ন ঘটত। আবাসনের সুযোগ সৃষ্টি ছাড়াও নতুন কাঠামোটি সম্ভবত নগরীর প্রতিরক্ষার কাজেও ব্যবহৃত হতো। কেনিয়ন মনে করেছিলেন, বাইবেলিক লেখকদের উল্লেখিত 'মিলো' হতে পারে এটি। কারণ জুদার পরবর্তী রাজাদের কেউ কেউ মিলো মেরামতের কথা বলেছেন। মিলো সম্ভবত সামরিক কাজেও ব্যবহৃত হতো। ওফেলের শীর্ষে থাকা নগরদুর্গের অংশও হতে পারে এটি। ধারণা করা যেতে পারে 'জায়ন' নামটি দিয়ে পুরো জেরুসালেম নগরীর কথা বোঝাত না, বরং শুরুতে এটি দিয়ে দুর্গ বোঝানো হতো। এই দুর্গ নগরীর উত্তর ও আরো নাজুক এলাকা নিরাপদ রাখার মাধ্যমে নগরীকে সুরক্ষিত রাখত। আমারনার আমলে জেরুসালেম সম্ভবত এর প্রতিষ্ঠাতা-দেবতা সালেমের প্রতি অনুগত্য বহাল রেখেছিল। ফারাওয়ের কাছে লেখা চিঠিতে আবদি-হেপা 'জেরুসালেম ভূখণ্ডের রাজধানী হিসেবে বেইত-সুলমানির (সালেমের ঘর)' কথা বলেছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, হুরিয়ানরা নগরীতে নতুন দেবতা নিয়ে এসেছিল। এই দেবতা ছিলেন ঝড়ের দেবতা বাল। সিরীয় উপকূলের উগারিত এর লোকজন তার উপাসনা করত। ১৯২৮ সালে বাস শামরায় (প্রাচীন উগারিত এলাকার আধুনিক নগরী) আবিষ্কৃত কোনিফর্ম ট্যাবলেট থেকে আমরা বাল ধর্মমত সম্পর্কে জানতে পারি।...."

- 'Jerusalem: One City, Three Faiths', Karen Armstrong

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]