বুর্জোয়া গণতন্ত্রে উপমহাদেশ যেমন আছে [পর্ব - এক]
"সংবিধান আমাদের দিয়েছে সমতার অধিকার। ভারত ভূখণ্ডে প্রত্যেকেই আইনের চোখে সমান। এদেশে সর্বোচ্চ পদাধিকারী রাষ্ট্রপতির আর ওড়িশার কালাহান্ডির মানুষগুলো একই অধিকার ভোগ করে। চুলচেরা সমান অধিকার। আমাদের মনে রাখতে হবে, নাগরিকরা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারলেই তা গণতন্ত্রের প্রমাণ নয়। সাম্য না থাকলে গণতন্ত্রই অর্থহীন। এদেশে স্বাধীনভাবে ভোট দেবার অধিকারও সবার জোটে না। ভোট লুঠ করে রাজনৈতিক দলগুলো। এদেশে আদিবাসীদের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে সরকার। তারপর...
বাস্তবে এ যে কী বিশাল মিথ্যা, কী প্রচণ্ড রকম বর্বর রসিকতা তা বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না, যখন দেখি কালাহান্ডির মানুষগুলো দিনের পর দিন ক্ষুধার আগুনে জ্বলতে জ্বলতে জীবন্ত নরকংকাল থেকে মৃত মানুষ হয়ে যায়। এর পরও কি বেঁচে থাকে একটি গণতান্ত্রিক দেশের মানুষদের বেঁচে থাকার অধিকার? আর ঠিক তখন রাষ্ট্রপতির গণতান্ত্রিক অধিকার সম্মতভাবে দেওয়া ছত্রিশ কোর্সের ভোজসভায় কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে করতে রাজনীতিকরা ভারতকে 'সুমহান গণতন্ত্রের দেশ', 'সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ' ইত্যাদি বলে এইসব রাজনীতিকরা বাঁধা পড়ে আছে হর্ষদ, বিড়লা, আম্বানি, হিন্দুজা, বাজাজ, ওয়াদিয়া, কির্লোস্কার, গুলাবচাঁদ ইত্যাদি ধনকুবেরদের কাছে। স্বাধীনতা নিয়ে, সমান অধিকার নিয়ে এর চেয়ে বর্বর রসিকতা, এর চেয়ে অশ্লীল রসিকতা আর কিছু হয় কি? অর্থের অভাব হেতু যে দেশের মানুষের দু'বেলা পেট ভরে খাওয়ার স্বাধীনতা বা অধিকার নেই, রোগজীর্ণ শরীরকে সুস্থ করতে চিকিৎসার সুযোগ গ্রহণের অধিকার নেই, শিক্ষালাভের অধিকার নেই; সেখানে বিড়লা, আম্বানি, হিন্দুজা, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী আর গরিব মানুষগুলোর সমান গণতান্ত্রিক অধিকার ও সমান স্বাধীনতার কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা আর যাই হোন, সৎ নন-এটুকু দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায়। এ-দেশে প্রতিটি গণতান্ত্রিক অধিকারই বিড়লা, আম্বানিদের সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হয়েছে পথের ভিখারিটিকে পর্যন্ত। পার্থক্য শুধু রাষ্ট্রশক্তির অকরুণ সহযোগিতায় বিড়লা আম্বানিদের অধিকারের হাত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। ওদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে গিয়ে হতদরিদ্র, দলিত ও ভিখারিদের অধিকার রক্ষা করতেই ভুলে গেছে রাষ্ট্রশক্তি-এই যা। শোষণ ও যৌনপীড়ন দলিত হরিজনদের উপর বারবার নেমে এসেছে। হিন্দু ধর্মের বিধানে হরিজনরা অস্পৃশ্য জন্মগতভাবেই। যুগ-যুগ ধরেই ওরা ভূমিদাস। ওরা মানুষ নয়। ওদের নারী-পুরুষ-শিশু জমি মালিকের সম্পত্তি। বেগার দাস আজও ভারতে আছে। পরিষ্কার পানীয় জলটুকু পাওয়ারও অধিকার নেই ওদের। গ্রামের কুয়ো থেকে জল নেওয়া তো দূরের কথা, ছুঁলে হিন্দু রক্তে আগুন ধরে যায়। সে আগুন নেভে শুধু হরিজনদের রক্তে, হরিজন-বস্তির আকাশ স্পর্শ করা আগুনে। আজও ভারতের বহু গ্রামে হরিজন রমণীদের ব্লাউজ পরা, হাঁটুর নিচে নামিয়ে কাপড় পরা, চুলে সিঁথি কাটা, চুলে ফুল গোঁজা নিষিদ্ধ। হরিজন পুরুষরা খেতে ফসল ফলায় রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে। ফসলে ওদের অধিকার নেই, অধিকার নেই জমির উপর, অধিকার নেই ভালোবাসার সম্পর্কের। ওদের নারীর-পুরুষ-শিশু সকলেই জমি মালিকের সম্পত্তি। ওরা অস্পৃশ্য। তবু বর্ণহিন্দু জমি মালিক, জোতদার, মহাজন, পুলিশ ইত্যাদি শ্রেণির ক্ষমতাবান পুরুষদের দ্বারা অস্পৃশ্য নারীকুল বারবার যৌনপীড়নের শিকার হয়। দলিত শ্রেণির ওপর আক্রমণ ও তাদের রমণীদের ওপর যৌনপীড়নের সরকারি পরিসংখ্যান হলো - 'এশিয়ার মুক্তিসূর্য'র শাসনকালে ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬-এ এই ধরনের আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে চল্লিশ হাজার বার। জনতা সরকারের উনিশ মাসে আক্রমণ হয়েছে সতেরো হাজার বার। যতই দিন যাচ্ছে, ততই শোষণ ও যৌনপীড়নের ঘটনা বেড়েই চলেছে। বহু ভূমিহীন দলিত শ্রেণির পরিবার থেকেই নারীরা বেশ্যার জীবন গ্রহণ করে। তারা যখন গ্রামে ফেরে গ্রামের মানুষ তাদের অন্য দৃষ্টিতে দেখে না, ঘৃণা বা অবজ্ঞা করে না। বেশ্যাবৃত্তিতে যাওয়া তাদের কাছে 'পেশা মে জানা'। এই সমাজে বর বউ বেচে দেয়, পিতা-কন্যাকে, মাত্র দু-পাঁচ-সাত হাজারের বিনিময়ে। কেনে মহাজনেরা। এ খবর জানে পুলিশ, প্রশাসন, বিধায়ক, সাংসদ-সক্কলে। এদের জন্য আমাদের দেশের গণতন্ত্রের কিছুই করার নেই। পৃথিবীর বৃহত্তম এই গণতান্ত্রিক মহান দেশের কোনও এক মহান রাষ্ট্রনায়ক মারা গেলে রাষ্ট্রীয় শোক চলে কয়েকদিন ধরে। বেতার-দূরদর্শনে বেহালার সুর আর চোখের জলের ছড়াছড়ি চলে। মহারাষ্ট্রের ভূমিকম্পে চল্লিশ হাজারের মৃত্যুতে একটি দিনের জন্যেও রাষ্ট্রীয় শোকের বেহালা বাজে না বেতারে বা দূরদর্শনের পর্দায়। ভূপাল গ্যাস দুর্ঘটনায় মারা গেল পঁচিশ হাজার। রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হয় না। আমাদের সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারা প্রতিটি নাগরিককে দিয়েছে ভারত ভূখণ্ডের যে কোনও স্থানে ঘর বসাবার স্বাধীনতা। যে দেশে কয়েক কোটি মানুষের বাস মুক্ত আকাশের নীচে, সে দেশের মানুষদের কাছে পছন্দসই জায়গায় ঘর বসানোর স্বাধীনতা স্রেফ একটা রসিকতা, একটা ধাপ্পা। আমাদের দেশের সংবিধান নাগরিকদের দিয়েছে যে কোনও আইনি পেশা, ব্যবসা বা বাণিজ্য করার স্বাধীন অধিকার। পরনে যার ত্যানাটুকু জোটাতে হিমশিম খেতে হয়, পেটে এক-বেলার বেশি দু-বেলা ভাত কি রুটি পড়াটাই বিশাল বিলাসিতা, তাকে ব্যবসা-বাণিজ করার ঢালাও স্বাধীন অধিকার দেওয়াটা কি এক বিশাল ঠাট্টা নয়? যার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই তার কাছে এইসব স্বাধীনতা ও অধিকারই একান্তভাবে অর্থহীন, তা সে নারী হোক, কী পুরুষ।"
- 'যুক্তিবাদের চোখে নারীমুক্তি', প্রবীর ঘোষ
.....................................................................................
আপনার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকলেই যে বাস্তবিকই আপনি স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে পারবেন আপন খুশিতে-এমন অতি সরলীকৃত চিন্তার দ্বার পরিচালিত হলে তা হতেই পারে আকাশকুসুম। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ
নাকি এই ভারত, যে দেশের সৎ ও সচ্ছল নাগরিক হলেও সরকার গঠনে আপনার ভোটদানের স্বাধীনতা প্রকাশ্যে লুঠ হতে পারে-যেমনটি ফি নির্বাচনে আকছার ঘটেই থাকে। আর এই স্বাধীনতার লুটেরার ভূমিকায় শাসকদল, পুলিশ, প্রশাসন, বিরোধী দল সব্বাইকেই দেখতে পাওয়া যায়-এ অভিজ্ঞতা আমার-আপনার-সকলের।
১৯৯৩-এর ঘটনা। কলকাতার বিশিষ্ট মনোরোগ চিকিৎসক পার্থ দত্ত ফোনে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন, "ইন্ডেন গ্যাসের জন্য বাবা অ্যাপ্লাই করেছিলেন, ওঁরা জানালেন বর্তমানে কোনও এমপি'র রেকমেন্ডেশন ছাড়া কনজিউমার করা হচ্ছে না।" কী অবস্থা বুঝুন! অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের কাছে মাথা নোয়াও, তবে পাবে তোমার নাগরিক অধিকার।
এটা নতুন কোনও চিত্র নয়। চুঁচড়োর অমিত নন্দীর মফস্বল স্কুলে একটি শিক্ষকতার চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা তামাদি হয়ে গিয়েছিল সিলেকশন কমিটির দাবি মতো ষাট হাজার টাকা ঘুষ না দিতে চাওয়ার এককাট্টা জেদের জন্য। সেই সঙ্গেই কি তামাদি হয়ে যায়নি ভারতীয় সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারা অনুসারে অমিতের যেকোনও পেশা গ্রহণের স্বাধীনতার অধিকার?
ধানবাদ থেকে কলকাতা ফিরছিলাম অমর সিং-এর কয়লা বোঝাই লরিতে। ওইটুকু পথে গাড়ি চালাবার, ব্যবসা চালাবার স্বাধীনতা বারবার হোঁচট খাচ্ছিল স্বাধীনতার রক্ষক পুলিশদের হাতে। পুলিশদের বা তাদের দালালদের হাতে গুঁজে দেওয়া টাকার পরিমাণ হাজার পার হওয়ার পর গোনায় ক্ষান্ত দিয়েছিলাম। পথ তারপরও ছিল অনেকটাই বাকি।
দুর্গানগর থেকে প্রত্যেক দিন সক্কাল না হতেই দমদম স্টেশনে এসে নামেন সোনা, তসবির, লক্ষ্মী। ঠাকুরনগর থেকে আসেন মাধাইয়ের মা, সুজাতা। ভোর না হতেই এঁদের নেমে পড়তে হয় বেঁচে থাকার লড়াইয়ে। এইসব হতদরিদ্র হাড়জিরজিরে যৌবনেই বিগতযৌবনারা ফুটপাতে আনাজ সাজিয়ে বসতেই শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে 'তোলা' আদায় করে রাজনৈতিক মস্তান ও পুলিশ। এদের হাত থেকে উদ্ধার পায় না ফুটপাতের গরিব দোকানি নিধা, বাদল, বাপী, গোবিন্দরাও। এসব লুটেরাদের কাছে নারী-পুরুষ বৈষম্য নেই। এ-ব্যাপারে ওরা দারুণ প্রগতিশীল। প্রগতিশীল স্বাধীনতা-লুটেরা।
১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৯১ আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটা খবরের দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। খবরটাকে ছোট্ট করে নিলে দাঁড়ায় এই - পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশের এক বড়কর্তার বাগান আছে ঝাড়গ্রামের জিতুশোল মৌজায়। সেই বাগান থেকে তিনটি আমগাছের চারা চুরি যাওয়ায় রাজ্য পুলিশবাহিনী তাণ্ডব চালিয়েছে ওই অঞ্চলে। পুলিশের নৃশংস অত্যাচারে জিতুশোল মৌজার তিনশো গ্রামবাসী জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছেন। একটিও বয়স্ক পুরুষ নেই গ্রামে। তবু গ্রামবাসীদের ওপর চলেছে পুলিশের ভীতিপ্রদর্শন। অনেককেই থানা-লকআপে আটক রেখে দিনের পর দিন পেটানো হচ্ছে। আর পুলিশের বড়কর্তার বাগান পাহারা দিতে রাজ্যের জনগণের টাকায় পালিত পুলিশ একটি স্থায়ী চৌকি বসিয়েছে।
একবার উত্তেজিত মাথাকে ঠান্ডা করে ভাবুন তো-একটি গরিব লোকের বাগান থেকে তিনটে আমগাছের চারা চুরি যাওয়ার পর থানায় রিপোর্ট লেখাতে গেলে পুলিশ তার সঙ্গে কী ব্যবহার করবে? আমচারা-চোর ধরে দেবার বেয়াদপি আবদার শুনে থানার মেজবাবু হয় বেজায় রসিকতা ভেবে অট্টহাসিতে ফেটে পড়বেন নতুবা বেয়াদপটাকে এক দাবড়ানিতে থানা-ছুট করতে বাধ্য করবেন। কিন্তু রাজ্য-পুলিশের বড়কর্তার বাগান থেকে মাত্র তিনটি আমচারা চুরি যেতেই গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় অতন্দ্র-প্রহরী পুলিশবাহিনী পাগলা-কুকুরের মতোই ঝাঁপিয়ে পড়ল জিতুশোলের মানুষগুলোর ওপর। পুলিশি অত্যাচারে তিনশো মানুষ জঙ্গলের রাজত্ব থেকে বাঁচতে জঙ্গলে আশ্রয় নিল। ধরে নিলাম, ওই গ্রামবাসীদের মধ্যেই রয়েছে এক, দুই বা তিনজন আমচারা চোর। ধরে নিলাম, পুলিশ তাদের ধরেও ফেলল। ফেলুন, খুব ভালো কথা। তারপর পুলিশের কর্তব্য চোরটিকে বা চোরদের বিচার বিভাগের হাতে তুলে দেওয়া। অপরাধ প্রমাণে শাস্তি যা দেবার তা দেবে বিচার বিভাগ। ওই বিচারাধীন চোর বা চোরদের পেটাই করার কোনও অধিকার আমাদের দেশের গণতন্ত্রে পুলিশদের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। জিতুশোল মৌজার এক দুই বা তিনজন সম্ভাব্য অপরাধীর ওপর পুলিশি অত্যাচার নেমে আসেনি, পুলিশবাহিনী বর্বর গুন্ডামি চালিয়েছে তামাম গ্রামবাসীদের ওপর। গ্রামবাসীদের একটিই অপরাধ বড়কর্তার বাগান এলাকায় তাদের বাস। আইন ভাঙা অপরাধ। আইনের রক্ষকদের আইন ভাঙা আরও বড় অপরাধ। পুলিশের ইউনিফর্ম পরা ওইসব বর্বর গুন্ডার বিরুদ্ধে আইন আদৌ কঠিন হতে পারবে? তা যদি না পারে তবে অত্যাচারিত মানুষগুলো, যুক্তিবাদী মানুষগুলো অনপুংসক মানুষগুলো কী করে বিশ্বাস করবে-আমাদের দেশের গণতন্ত্রে রাজ্যপুলিশের বড়কর্তারও একজন দরিদ্র গ্রামবাসীর সমান গণতান্ত্রিক অধিকার, সমান স্বাধীনতা?
পুলিশের সামান্য বড়কর্তার সঙ্গে সাধারণ অধিকারের পার্থক্য যদি এম আসমান-জমিন হয়, তবে মন্ত্রী-টন্ত্রীদের সঙ্গে এবং মন্ত্রী বানাবার মালিক অর্থকুবেরদের সঙ্গে গরিব মানুষগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকারের পার্থক্য যে সীমাহীন হবে, এই তো প্রকৃত সত্য।
- 'যুক্তিবাদের চোখে নারীমুক্তি', প্রবীর ঘোষ
.........................................................................................
এ দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশ টিকিয়ে রেখেছে অসাম্যের সমাজ-ব্যবস্থা। এ সমাজে খাটতে চাইলেও পাওয়া যায় না কাজের গ্যারান্টি। চিকিৎসার সুযোগ, লেখা-পড়ার সুযোগ সংবিধানের পাতাতে শুধু ছাপাই থাকে। ভাত-কাপড়-পানীয় জল ও মাথা গোঁজার ঠাঁই প্রতিটি নাগরিককে দেবার যে সংকল্প সংবিধানে রয়েছে, তার খবরই জানে না দেশের নিরন্ন মানুষগুলো। ওরা আগাছার মতই বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকে সমাজের সমস্ত বঞ্চনা ও অবহেলার মধ্যে। যে বয়সে আপনার আমার বাড়ির শিশু লজেন্স চোষে, সেই বয়সে ওদের বাড়ির শিশু চলন্ত ট্রেনে লজেন্স ফেরি করে। যে বয়সে গাড়ি চেপে আপনার আমার বাড়ির শিশু ফিটফাট পোশাকে স্কুলে যায়, সে বয়সে ওদের বাড়ির শিশু কালি-ঝুলি মেখে মোটর-গ্যারেজে গাড়ি সারাবার 'ফালতু'। লোডশেডিং নিয়ে যখন আপনি আমি এবং আমাদের পত্রিকাগুলো গলা ফোলাচ্ছে, তখন ওরা অদ্ভুত নির্বিকার। মুক্ত আকাশের নীচে ফুটপাতে বা পাঁচ ফুট বাই পাঁচ ফুট বস্তির ঘরে দশটা মানুষের স্তূপ। আলো বলতে ফুটপাতে স্ট্রিটলাইট, পাঁচ ফুট বাই পাঁচ ফুট ঘরে কুপি। কুপি জ্বলে, তবে অনেক হিসেব কষে। আলোই যে দেখেনি, তার আবার আলো হারাবার ভয় কী? হাওয়াই যে পায়নি, তার হাওয়া হারাবার ভয় কী? ওরা অন্ধকার জগতের অনেক কেষ্ট-বিষ্টুদের দাবার খুঁটি। ওরা ফালতু-পালতু। কেষ্ট-বিষ্টুদের ইশারায় প্রাণ দেওয়া নেওয়ার খেলায় মাতে। ওরা একদিনে তৈরি হয়নি। আর্থ-সামাজিক অবস্থা ওদের একটু একটু করে তৈরি করেছে। যে দেশে সর্বোচ্চ পদ থেকে বইতে শুরু করে দুর্নীতির স্রোত; যে দেশে হত্যাকারী, ধর্ষক, গুন্ডা, ছিনতাইবাজ, ডাকাত, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকার দরুন শুধু পারই পায় না, বরং বুক চিতিয়ে ঘুরে বেরাবার ছাড়পত্র পায়, নেতা হবার সুযোগ পায়, সে দেশের মানুষ দু-বেলা ঠাকুর প্রণাম সেরে, নামাজ পড়েও দুর্নীতি চালিয়ে যাবেই; এবং যাচ্ছেও তা। এই তো ধর্মপ্রাণ, ঈশ্বর-বিশ্বাসী ভারতের সামাজিক অবস্থা। এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের এমন কিছু শেখাবার চেষ্টা করে চলেছে, যা অন্ধবিশ্বাস নির্ভর, যা অর্ধসত্য, যা একপেশে, যা অধ্যাত্মবাদী ও ভোগবাদী মতবাদের পরিপোষক, যা ক্যারিয়ারিজমের আঁতুড়ঘর, যা অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে সহায়ক। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় যে-প্রজন্ম ধারাবাহিকভাবে তৈরি হয়ে চলেছে, তারা প্রকৃত শিক্ষিত না হয়ে অসাম্যের এই সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার সহায়ক শক্তি হয়ে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ তাদের শিক্ষা, তাদের সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশ ভুল শিখিয়ে এসেছে 'দেশপ্রেম' সম্পর্কে, 'বিচ্ছিন্নতাবাদ' সম্পর্কে, 'জাতীয়তাবাদ' সম্পর্কে, 'জাতীয় সংহতি' সম্পর্কে, 'মৌলবাদ' সম্পর্কে, 'ধর্মনিরপেক্ষতা' সম্পর্কে, 'গণতন্ত্র' সম্পর্কে, 'মানুষের উপর পরিবেশের প্রভাব' সম্পর্কে। টেলিভিশন, রেডিও, সিনেমা, থিয়েটার, গান, নাচ, বৃহৎ পত্র-পত্রিকাগোষ্ঠী ও প্রকাশকরা বিশাল ভাবে আমাদের চিন্তা ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরা টেলিভিশনে কতটা মারদাঙ্গা দেখব, কতটা যৌনতা, কতটা ভক্তিরসে আপ্লুত হবো, ধর্মগুরুদের বাণীর দ্বারা কতটা আচ্ছন্ন হবো, কতটা ভাগ্য-নির্ভর হবো, কতটা ঈশ্বর বিশ্বাসী হবো, কতটা ভূতে, "আদর্শ-নারীর গুণ-পতিসেবা, পতির পরিবারের সেবা, লজ্জা"-এই ধরনের নীতিবোধ কতটা আমাদের মাথায় ঠাসবো-এ সবই ঠিক করে দিচ্ছে বিভিন্ন ধনকুবের গোষ্ঠি ও রাষ্ট্রশক্তি। আমরা কী ধরনের গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস কবিতা পড়ব-তা ব্যাপকভাবে নির্ধারণ করে দিচ্ছে বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠী ও প্রকাশকরা। প্রচারমাধ্যমগুলোর সংবাদ সরবরাহের 'নিরপেক্ষ' মোড়কের আড়ালে থাকে একটি একপেশে মূল্যবোধ ও মতাদর্শগত কর্তৃত্বকে সাধারণ মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেবার দৃঢ় প্রচেষ্টা। এই একপেশে মূল্যবোধ কাদের স্বার্থ-রক্ষায় সহায়ক হবে? অর্থাৎ, কোন শ্রেণীর স্বার্থরক্ষায় সহায়ক হবে? অবশ্যই প্রচারমাধ্যমের মালিক যে শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই শ্রেণীর। কারণ প্রচারমাধ্যমগুলোর নীতি মালিকের শ্রেণী চরিত্রের উপর নির্ভর করে। প্রচারমাধ্যমগুলোর সাহায্যে ধনকুবেরগোষ্ঠী আমাদের মনে জাগিয়ে তোলে নতুন নতুন উৎপাদিত ভোগ্যবস্তুর প্রতি ক্ষুধা। আমরা কোন ধরনের সিনেমা দেখব, 'অপরাধ' কতটা বীরত্বের সূচক হিসেবে আমাদের চেতনায় ধরা পড়বে, ধর্ষণে কতটা খুঁজে পাবো উত্তেজনার মজা, অশ্লীল নাচে কতটা খুঁজে পাবো আধুনিকতার মুক্ত হাওয়া, দেশপ্রেম সম্পর্কে কতটা ভুল ধারণা গেলানো হবে-সে সবই ঠিক করে কোটিপতি চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সেন্সর ক্ষমতার অধিকারী সরকার। এমনই সমাজ সাংস্কৃতিক প্রভাবের ফলশ্রুতি হিসেবেই দলে দলে উঠে আসছে কিশোর অপরাধী, ঠান্ডা মাথার কিশোর খুনি, ঠান্ডা মাথার কিশোর ধর্ষক। শুভবাবু, এতক্ষণের দেওয়া যুক্তিগুলোর মধ্য দিয়ে নিশ্চয়ই আপনার পূর্ব-মতকে পাল্টাতে সমর্থ হয়েছি। আপনি যদি সুপরিকল্পিতভাবে ঈশ্বর বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট ব্যক্তি না হন, যুক্তির প্রতি যদি ভালোবাসা থাকে, সুন্দর সমাজ গড়ে ওঠার প্রতি যদি আন্তরিক সহানুভূতি থাকে, তবে নিশ্চয়ই আপনি পাল্টাবেন। অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে বিরত করতে 'ঈশ্বর' নামের জুজুর ভয়ের কোনও প্রয়োজন হয় না। যে মানুষ নিজেকে সঠিক আদর্শবোধ ও সঠিক মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত করে, সে কখনই খারাপ কাজ করে না। তাকে দিয়ে কোনও অন্যায় কাজ করানো যায় না। 'সঠিক আদর্শবোধ', 'সঠিক মূল্যবোধ' শব্দ দুটি ব্যবহারের কারণ, এই অসামোর সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে 'বেঠিক আদর্শবোধ' ও 'বেঠিক মূল্যবোধ' প্রবল ভাবেই প্রতিষ্ঠিত। আমাদের এই সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক নীতির নিয়ন্তা ধনকুবের গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণকে কায়েম রাখতে হাতে রাখে সরকার, প্রশাসন-পুলিশ-সেনাবাহিনী, প্রচারমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের। ধনকুবের গোষ্ঠীর শোষণের সহায়ক এই শক্তিগুলো শোষকশ্রেণীর স্বার্থ-রক্ষার প্রয়োজনে বহু নীতিবোধ বা মূল্যবোধ সমাজের উপর চাপিয়ে দেয়। এই নীতিবোধ ও মূল্যবোধ ব্যাপক প্রচারের ফলে, ব্যাপক মগজ ধোলাইয়ের ফলে বহুর কাছেই গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করলেও আসলে এগুলো 'বেঠিক নীতিবোধ' বা 'বেঠিক আদর্শবোধ' এবং 'বেঠিক মূল্যবোধ'।
- 'কেন আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না', প্রবীর ঘোষ
..........................................................................................
"দুর্গতিনাশিনী দুর্গা হিন্দু প্রধান এই ভারতে প্রতি বছরই প্রবল থেকে প্রবলতর জাঁকজমক নিয়ে ফিরে আসেন পুজো পেতে। বিশেষভাবে লক্ষাণীয়, দুর্গাপুজোর রমরমা ও বঞ্চিত সাধারণ মানুষ্যের দুর্গতি প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে। দেশে আইন আছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। আইন আজ পুলিশ-প্রশাসন-রাজনীতিক ও ধনীদের বুটের তলায় ফুটবল। পুলিশ বা রাজনীতিকের হাতে আপনি যদি আগামী দিনে খুন হন, আপনার প্রিয়জনেরা খুনিদের বিরুদ্ধে কোনও আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন না। উল্টে আপনার কপালেই দেগে দেওয়া হবে 'সমাজবিরোধী' শিরোপা। আপনি যদি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশ্রিত দুর্বৃত্তদের দ্বারা ধর্ষিতা হন, 'খারাপ মেয়েছেলে' শব্দটি আপনার ওপর বর্ষিত হতে থাকবে। যেন আমাদের দেশের সংবিধান বিচার ব্যবস্থাকে শিকেয় তুলে রেখে সমাজবিরোধীদের খুন করার অধিকার ও খারাপ মেয়েছেলেদের ধর্ষণ করার অধিকার কিছু কিছু বিশেষ ক্ষমতাভোগীদের হাতে তুলে দিয়ে বসে আছে। রাজনৈতিক নেতা, রাজনৈতিক দল বা রাষ্ট্রশক্তির প্রচার ভুলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপনি যদি কোমর সোজা করে রুখে দাঁড়াতে যান, আপনার কোমর ভাঙতে করুণাহীন দৃঢ়তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে পুলিশ-প্রশাসন-রাজনীতিকরা। আরও একটু এগিয়ে গিয়ে আপনি যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করতে সচেষ্ট হন, রাষ্ট্রশক্তি আপনার পিছনে গোয়েন্দা-ফেউ লাগিয়ে দেবেই, একশো পারসেন্ট গ্যারান্টি দিচ্ছি। অসাম্যের সমাজ কাঠামো ভেঙে সাম্যের সমাজ গড়ার দার্শনিক আত্মোপলব্ধি নিয়ে, বঞ্চনা ও অবিচার সম্পর্কে দার্শনিক আত্মোপলব্ধি নিয়ে আপনি যদি অসুরের বিরুদ্ধে সুসংবদ্ধ সংগ্রামে নামেন, 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' বা 'উগ্রপন্থী' তকমা আপনার দলের গায়ে সেঁটে দেওয়া হবে। প্রচারের অপার মহিমায় 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' ও 'ক্রিমিনাল' শব্দ দুটি সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, একটু ভাবুন তো, একটা পচন ধরা সমাজে সৎ, আদর্শবাদী, সাম্যকামী মানুষরা বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য কি না? 'বিচ্ছিন্নতা' কী? সাধারণের থেকে স্বতন্ত্র, সাধারণের থেকে আলাদা, সকলের সঙ্গে মানিয়ে না নিতে পারা। গ্যালিলিও থেকে বিদ্যাসাগর, প্রত্যেকেই সেই সময়কার সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানবগোষ্ঠীর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। যে সমাজে দুর্নীতি সমুদ্রগভীর, যে সমাজে শাসকের গদিতে বসতে ধনকুবেরদের কাছে ভিক্ষাপাত্র ধরতে হয়, যে সমাজের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি কোন পথে চলবে তা ঠিক করে দেয় টাকার কুমিররা, যে সমাজে বৈষম্য ও শোষণ লাগাম-ছাড়া, সেই সমাজ থেকে কোনও জনগোষ্ঠী যদি বেরিয়ে যেতে চায়, তবে তাদের সেই উচ্চশির স্পর্ধিত সংগ্রামকে কুর্নিশ জানানোই প্রতিটি বঞ্চিত মানুষের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি হওয়া উচিত। কিন্তু সেই 'উচিত'টাই ঘটছে না শাসক ও শোষক শ্রেণীর সুনিপুণ মগজ ধোলাইয়ের কল্যাণে। সাহিত্যে-নাটকে-পর্দায় এমন অনেক চরিত্র হাজির হয় যারা নৈরাশ্যতাড়িত, বিকারগ্রস্ত, একাকিত্বের শিকার এক মানসিক রোগী। মগজ ধোলাইয়ের কৃপায় শুধু এইসব নেতিবাচক চরিত্রগুলোকে সমাজ-বিচ্ছিন্ন বলে আমরা ধরে নিই। ফলে এই মগজ ধোলাইয়ের ফলস্বরূপ আমরা ভুলে থেকেছি ব্যাধিগ্রস্ত সমাজের বিরুদ্ধে আদর্শবাদী মানুষদের স্বাভাবিক প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং সংগ্রামও 'বিচ্ছিন্নতা'। যে বিচ্ছিন্নতার অর্থ শোষণের অবসানমুখী সংগ্রাম, শোষণযুক্ত সমাজ থেকে বিযুক্ত হওয়ার তীব্র আকুতি, সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশমুখী চেতনা, সুস্থ আত্মবিকাশের চেতনা, সেই বিচ্ছিন্নতা অবশ্যই মানুষের কাম্য, মানবসভ্যতার কাম্য। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, এমন ক্ষেত্রে আপনি-আমি-আমরা কি মানব সভ্যতার অগ্রগতির স্বার্থে পচনধরা সমাজের বিরুদ্ধে কোনও জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতার অধিকারকে, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে দুঢ়ভাবে সমর্থন করবো না? জনগোষ্ঠীর সংগ্রামগুলোর প্রতি সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেওয়াকে সমর্থন করবো না? অবশ্যই করবো।
এই ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন কখনই বহু রক্ত ঝরানো সংগ্রাম ছাড়া সাফল্য অর্জন করতে পারে না। কারণ শোষক-শাসকগোষ্ঠী নিশ্চিতভাবেই কোনও জনগোষ্ঠীকে তাদের শোষণ-আওতার বাইরে যেতে দেবে না। শোষক-শাসকগোষ্ঠীর কাছে এটা শুধুমাত্র একটি জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে কায়েম করার লড়াই নয়। তারা জানে, একটি বিচ্ছিন্নতাকামী জনগোষ্ঠীর জয় আরও বহু সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্নের জন্ম দেবে, আরও বহু বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের জন্ম দেবে। আর তাই শাসক-শোষকগোষ্ঠী বিচ্ছিন্নতাকামী জনগোষ্ঠীর উপর তীব্র থেকে তীব্রতর সন্ত্রাস চালাতে থাকে। এই সন্ত্রাস থেকে বাঁচতে ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে কায়েম করতে বিচ্ছিন্নতাকামী জনগোষ্ঠীকে পাল্টা সন্ত্রাসের পথ বেছে নিতেই হয়। অমনি শোষক-শাসকগোষ্ঠী তাদের সহযোগী প্রচার মাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের সহযোগিতায় বিচ্ছিন্নতাকামী জনগোষ্ঠীর গায়ে 'সন্ত্রাসবাদী' বা 'টেররিস্ট' শব্দটি দেগে দেয়। প্রচারের মহান ক্ষমতায় 'টেররিস্ট' ও 'ক্রিমিনাল' শব্দ দুটি আমাদের কাছে সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। শোষক-শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেওয়া 'টেররিস্ট' বা 'সন্ত্রাসবাদী' এমন একজন মানুষ যে বঞ্চনা ও অবিচারের সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে তার উপর গড়ে তুলতে চায় এক বঞ্চনাহীন মানব-সমাজ। একজন টেররিস্ট-এর মধ্যে অবশ্যই রয়েছে জগতের বঞ্চনা ও অবিচার সম্পর্কে দার্শনিক আত্মোপলব্ধি। এই ধরনের দর্শনবোধ দ্বারা পরিচালিত না হয়ে যারা সমাজের উপর ধ্বংসের লীলা চালায় আপন ভোগবাদী মানসিকতাকে চরিতার্থ করতে, তারা 'ক্রিমিনাল'। শাসক-শোষকগোষ্ঠীর পক্ষে আইনকে পরোয়া না করে লুঠ-ধর্ষণ-অত্যাচার-হত্যার সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী ভাড়াটে সেনা-পুলিশরা তাই শেষ পর্যন্ত আর 'সন্ত্রাসবাদী' হয়ে ওঠে না, হয়ে ওঠে সবচেয়ে সংগঠিত ক্রিমিনাল। রাষ্ট্রশক্তি কিন্তু কোনও জনগোষ্ঠীর গায়ে 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' বা 'সন্ত্রাসবাদী' শিলমোহর দেগে দিয়ে 'কাজ শেষ' ভেবে চুপচাপ বসে থাকে না। ইতিহাস অন্তত এ কথাই বলে। পৃথিবীর যে কোনও অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে বজায় রাখা রাষ্ট্রশক্তি এক্ষেত্রে যা করে তা হলো, নিজেদের ভাড়াটে সেনাদের সাহায্যে হাটে-বাজারে-বাসে-ট্রেনে নিরীহ মানুষদের হত্যা করে বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের নামে ঘটনাস্থলে কিছু স্লোগান দিয়ে ও প্রচারপত্র ছড়িয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ঢালাও জনসমর্থন আদায় করে। এই ধরনের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্র এদেশেও চলছে চলবে। দুর্গতিনাশিনী দুর্গা বঞ্চিত, অত্যাচারিত মানুষদের পক্ষে আজ পর্যন্ত কুটোটি নেড়ে দেখেছেন কি? কার দুর্গতি তবে তিনি নাশ করেন? ধনকুবেরগোষ্ঠী ও তাদের সহায়কদের? লক্ষ্মীপুজো করলে ধন-দৌলত যদি উপচেই পড়বে, তবে হিন্দুদের ঘরে ঘরে লক্ষ্মীপুজোর পরেও এত ভয়ংকর দারিদ্র্য কেন? 'শবেবরাত'-এর রাতে খোদাতালার গুণগান গাওয়ার পরও আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এত করাল দারিদ্র্য কেন? আমেরিকা ও জাপানের ধনকুবেররা লক্ষ্মীপুজো না করেও, শবেবরাতের নমাজ না পড়েও যদি প্রাচুর্যের পাহাড় বানাতে পারেন, তবে তো লক্ষ্মীপুজো ও শবেবরাতের নমাজ পড়াই প্রাচুর্য কেনার পক্ষে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। গণেশ পুজো না করেও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর বিশ্ববাণিজ্যের অধীশ্বর হয়ে বসা গণেশের ভূমিকাকে বাতিল করার পক্ষে যথেষ্ট নয় কি? শেক্সপিয়ার থেকে বিদ্যাসাগর, মেঘনাদ থেকে হকিং সরস্বতী পুজো না করেও বৌদ্ধিক জ্ঞানে হিমালয় হয়ে উঠে প্রমাণ করে দিয়েছেন, জ্ঞানার্জনে সরস্বতীর ভূমিকা শূন্য।"
- 'আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না', প্রবীর ঘোষ
......................................................................................
"প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ধারক-বাহকরা, ধর্মীয়বেত্তারা, বুদ্ধিজীবী ধর্মগুরুরা অধুনা প্রচার শুরু করেছেন-প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে শেখায়। ধনী-দরিদ্রের বিভেদ ভুলিয়ে সকলকে একই গণউপাসনায়, গণপ্রার্থনায় মেলাতে পারে এবং মিলিয়ে থাকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বা ধর্মীয় সংম্প্রদায়। কিন্তু, এ তো কোনও কাম্য মিলন হতে পারে না! এ তো ধনী-দরিদ্রের বাস্তব বিভেদ মেটানোর কোনও পথ নয়! শোক ও শোষিতের সম্পর্ক ভেঙে সাম্য প্রতিষ্ঠার কোনও দিশা নয়? এ তো অলীক বিশ্বাসের, ভ্রান্ত চেতনার ঐক্য! অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে, শোষিতদের ক্ষোভকে বের করে দিতেই এই ঐক্য। শোষিতদের ক্ষোভকে বিস্ফোরিত হতে না দেওয়ার স্বার্থে ঐক্য। এই ঐক্য, এই আবেগময় ধর্মীয় গণজমায়েত প্রায়শই গণহিস্টিরিয়া তৈরি করে। এবং এ জাতীয় গণহিস্টিরিয়া ব্যক্তিমানুষের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা-সমাজ চেতনা-সামাজিক দায়িত্ববোধকে গুলিয়ে দেয়, ভুল পথে চালিত করে। শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় ঐক্য ধনী-দরিদ্র শ্রেণীর বৈষম্য বা অনৈক্যকে বাস্তবে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে অবাস্তব এক 'ছেলে-ভোলানো ললিপপ' ছাড়া আর কিছুই হয়ে ওঠে না। বৈষম্যের অনৈক্যকে টিকিয়ে রেখে কখনই সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব নয়। এই ধরনের অনৈক্যের মধ্যেও ঐক্যের অলীক চিন্তা অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই উঠে এসেছে।"
- 'আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না', প্রবীর ঘোষ
.................................................................................
"....প্রণবেশবাবু হয়তো এমন যুক্তিহীন বক্তব্য পেশ করেছেন বিশেষ উদ্দেশ্যে। এবং তাঁর এই বক্তব্য পেশের পিছনে রয়েছে গভীর যুক্তি-বৃদ্ধি-ব্যক্তিস্বার্থ-শ্রেণীস্বার্থ। উদ্দেশ্য স্পষ্ট-শোষক শ্রেণীর ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করা। দায়িত্বটা কী? শোষিত মানুষ যেন যুক্তিবুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে তাদের শোষণের কারণ হিসাবে শোষকদের চিহ্নিত না করে। বিশ্বাসবাদের ধোঁয়াশায় তারা যেন শোষণের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে ভাগ্য, কর্মফল, ঈশ্বরের ইচ্ছা ইত্যাদিকে।....
ধুর মশাই, জ্যোতিষী আর ধর্মগুরু, যারা শোষিত মানুষদের গরু বানাতে চায়, তাদের খারাপ বললে দেশের সব্বাইকে খারাপ বলা হলো কী করে!! প্রতারককে 'প্রতারক' বললে দেশের লক্ষ-কোটি ভালো মানুষকে গাল-পাড়া হয় কীভাবে? ধর্মীয় মৌলবাদীদের পুরনো কৌশল, তাদের অন্যায়ের বা হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললে প্রতিরোধ ভাঙতে জনসাধারণের সেন্টিমেন্ট সুড়সুড়ি দিয়ে তাদের মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টি করা।...."
- 'আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না', প্রবীর ঘোষ
Comments