রাহুল সাংকৃত্যায়ন এর চোখে উগ্র হিন্দুত্ববাদ [পর্ব-এক]
‘পুরনো দেবতারাই তো যথেষ্ট, তবে এই নতুন ব্ৰহ্মের আমদানির প্রয়োজন কি?’
‘পুরুষানুক্রমে বহু যুগ ধরে কেউ ইন্দ্র, ব্ৰহ্মাকে প্রত্যক্ষ দেখেনি। তাই এখন অনেক লোকের মনেই সন্দেহ হতে আরম্ভ করেছে।‘
‘তাহলে ব্ৰহ্ম সম্পর্কে সন্দেহ হবে না কেন?’
‘সেই জন্যেই ব্ৰহ্মের রূপ বর্ণনা আমি এমনভাবে করেছি যে, তাকে প্রত্যক্ষ দেখার কথাই উঠবে না। দেবতারা ছিল সাকার-আমার কল্পিত ব্ৰহ্ম নিরাকার। নিরাকার তাই যত্রতন্ত্র সর্বত্রই বিরাজমান–তাই তা দেখবার প্রশ্ন ওঠে কি? প্রশ্ন ওঠে শুধু সাকার দেবতাদের সম্পর্কে।’
‘তুমি যে নিরাকার ব্রহ্মের কথা বলছ তাতে উদ্দালক আরুণির মতো ব্ৰাহ্মণদেরও মতিভ্রম ঘটায়। তোমার মতলবটা কি, তুমি কি প্রজাদের ভ্রমাচ্ছন্ন রাখতে চাও?’
‘লোপা! তুমি তো আমায় জানো, তোমার কাছে কি-ই বা লুকোতে পারি? এই যে রাজশক্তি একে হাতের মুঠোর মধ্যে রাখার জন্য এর প্রয়োজন আছে। যারা সন্দেহ করবে তাদের বিদ্যাবুদ্ধিকেই এ দিয়ে খাটো করা যাবে–তাদের নিজেদের জ্ঞান সম্পর্কে নিজেদেরই সন্দেহ জাগবে। কারণ, যারা দেবতার যজ্ঞ বা পূজার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে তারা আমাদের ঘোরতর শত্রু।’
‘কিন্তু তুমিও তো বলছ, ব্ৰহ্ম সত্তাহীন নয়-ব্রহ্মের সত্তা ও দর্শনের কথাও বলছ।’
‘সত্তা আছে, কাজেই অনুভব-গ্ৰাহ্য হওয়া চাই। কিন্তু তা ইন্দ্রিয় দ্বারা নয়, কারণ তাহলেই সন্দেহবাদীরা ইন্দ্রিয় দ্বারা (চাক্ষুষ) দেখতে চাইবে। তাই আমি বলেছি, ব্রহ্মের দর্শন পেতে হলে সূক্ষ্ম ইন্দ্ৰিয় দ্বারাই সেটা সম্ভব, আর সূক্ষ্ম ইন্দ্ৰিয় লাভ করতে হলে চাই সাধনা। আর সাধনার যে ফিরিস্তি দেওয়া হয়েছে তাতে মানুষ ছাপান্ন পুরুষ ধরেও বিশ্বাস অটুট রাখতে পারবে–ভ্ৰমাচ্ছন্ন থাকবে। আমি পুরোহিতদের স্থূল হাতিয়ারকে নিষ্ফলা ভেবেই এ হাতিয়ার আবিষ্কার করেছি। লোপা, তুমি কি কখনও শবরদের পাথর ও তামার হাতিয়ার দেখেছ?’
‘হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের জঙ্গলে গিয়ে দেখেছি।’
‘যমুনার ওপরে আমরা গিয়েছিলাম বটে। আচ্ছা শবরদের পাথর ও তামার হাতিয়ার আমার কালো লোহার সামনে টিকতে পারে?’
‘না, পারে না।’
‘পারে না তো! তাই বলছিলাম, বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্রের পুরনো দেবতারা বা ব্ৰাহ্মণদের যাগ-যজ্ঞ আগেকার বুদ্ধিমানদের যাও বা সন্তুষ্ট করতে পারতো এখন তা সন্দেহবাদী তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমান জ্ঞানী লোকদের কাছে ব্যৰ্থ।’
‘তাদের কাছে তোমার সৃষ্ট এই ব্ৰহ্ম-তাও কিছু না। তুমি ব্ৰাহ্মণ জ্ঞানীদের ধরে ধরে শিষ্য বানাচ্ছ, তাদের ব্ৰহ্মজ্ঞান শেখাচ্ছ, অথচ তোমারই ঘরে বসে তোমার কথাকে সরাসরি মিথ্যা বলে মনে করি।’
‘কারণ, তুমি আসল ব্যাপারটা আমার আসল রহস্য (উপনিষদ) জানো।’
‘ব্রাহ্মণ যদি জ্ঞানীই হবে, তবে কেন তোমার রহস্য তারা জানবে না?’
’সেটা তো তুমিও দেখতে পাচ্ছ। কোনো ব্ৰাহ্মণ হয়তো উপনিষদ পরীক্ষা করে দেখতে পারে, কিন্তু তারাও আমার উপনিষদকে আত্মস্বার্থে উপর্যুক্ত হাতিয়ার বলে মনে করবে। ওদের পৌরোহিত্য ও গুরুগিরির ওপর মানুষের অবিশ্বাস এসে গেছে যার পরিণাম সব রকম দক্ষিণা হতে বঞ্চিত হওয়া। ফলে চড়ার জন্য অশ্বরথ, খাবার জন্য উত্তম খাদ্য, থাকার জন্য প্রাসাদ এবং ভোগের জন্য সুন্দরী দাসী থেকে বঞ্চিত হওয়া।’
‘এ তো ব্যবসা।’
‘ব্যবসা তো নিশ্চয়ই। আর এতে লোকসানের ভয় নেই। এই জন্যই জ্ঞানী ব্ৰাহ্মণ সমিধ (যজ্ঞকাষ্ঠ) হাতে আমার কাছে শিষ্য হতে আসে। আর আমিও ব্রাহ্মণদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তাদের ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করি।’
‘এ অত্যন্ত নিকৃষ্ট চিন্তা, প্রবাহণ!’
‘তোমার কথা স্বীকার করি। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সব থেকে উপযোগী পন্থা। বশিষ্ঠ এবং বিশ্বামিত্রের নৌকা হাজার বছরও কাজ দেয়নি। কিন্তু প্রবাহণের নির্মিত নৌকায় দু’হাজার বছর পরও পরাধনভোগী রাজা ও সামন্তরা পার হতে পারবে। যজ্ঞরূপী নৌকাকে আমি অদৃঢ় বলে মনে করি, লোপা! তাই আমি এ দৃঢ় নৌকা নির্মাণ করেছি। এর সাহায্যে ব্ৰাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণ মিলিতভাবে ঐশ্বৰ্য ভোগ করতে পারবে। কিন্তু, ব্রহ্মের থেকেও বড় হবে আমার দ্বিতীয় আবিষ্কার, লোপা!’
‘কোন আবিষ্কার?’
‘মরে গিয়ে আবার এ পৃথিবীতে ফিরে আসা-পুনর্জন্ম!’
‘এ তো সবচেয়ে বড় জালিয়াতি!’
‘কিন্তু খুব কার্যকরী পন্থা। একদিকে সামন্ত, ব্রাহ্মণ এবং ব্যবসায়ীদের হাতে অপার ভোগরাশি সঞ্চিত হবে, অন্যদিকে সাধারণ প্রজা নিঃশেষ হয়ে যাবে। আবার এ সব নির্ধনদের, যেমন শিল্পী, কৃষক এবং দাসদাসীদের বিক্ষুব্ধ করার জন্যে কিছু লোক প্রচার শুরু করেছে, ‘তুমি তোমার শ্রমশক্তি অন্যকে দিয়ে কষ্ট করছ। ওরা তোমাকে বিশ্বাস করাতে চায় যে, তুমি কষ্ট ও ত্যাগ করলে মরে স্বর্গে যাবে। কিন্তু কেউ স্বর্গে মৃত জীবকে সুখভোগ করতে দেখেনি।’ এরই জবাব হলো, এ সংসারে উঁচু-নিচু ভাব, ছোট-বড় জাতি, ধনী নির্ধনের যে প্রভেদ, তা হলো পূৰ্বজন্মকৃত ফল। আমি এভাবে পূর্বেকার সুকর্ম-দুষ্কর্মের ফল প্রত্যক্ষভাবে দেখিয়ে দিয়েছি।’
‘এভাবে চোরও তার চুরি করা জিনিসকে পূর্বজন্মের রোজগার বলতে পারে।’
‘কিন্তু তার জন্য আমরা প্রথম থেকেই দেবতা, ঋষি এবং জনসাধারণের বিশ্বাসের সহায়তা গ্রহণে কৃতকার্য হয়েছি। সে জন্যেই অপহৃত জিনিসকে পূর্বজন্মের রোজগার বলে স্বীকার করা হবে না। বিনা পরিশ্রমলব্ধ ধনকে আমরা প্রথমে দেবতার কৃপায় পাওয়া বস্তু বলে চালাতাম। কিন্তু যখন দেখলাম, দেব-কৃপার ওপর সন্দেহ শুরু হয়েছে, তখন আমাদের একটা নতুন ব্যাখ্যা উপস্থিত করা প্রয়োজন হলো। ব্ৰাহ্মণদের চিন্তাশক্তিও লোপ পেয়েছে। প্রাচীন ঋষিদের মন্ত্র মুখস্থ করতেই চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর কাটিয়ে দেয়, ফলে অন্য কোনো গভীর বিষয় কখন আর চিন্তা করবে!’
‘প্রবাহণ! তুমিও কি মুখস্থ করতে দীর্ঘ সময় এভাবে কাটিয়ে দাওনি?’
‘মাত্র ষোল বছর। চব্বিশ বছর বয়সে আমি ব্রাহ্মণদের বিদ্যা শেষ করে বইয়ের সংসারে প্রবেশ করেছিলাম। এখানে আমি পড়াশুনার প্রচুর সুযোগ পেয়েছি। রাজ্য শাসনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলি জানার পর আমি দেখলাম, ব্ৰাহ্মণদের নির্মিত পুরনো নৌকা বর্তমানের জন্য অদৃঢ়।’
‘তাই তুমি দৃঢ় নৌকা নির্মাণ করেছ?’
‘সত্যি কি মিথ্যা সেটা আমার প্রশ্ন নয়; আমার প্রশ্ন হলো, কার্যোপযোগিতা নিয়ে। সংসারে ফিরে আসা পুনর্জন্মের কথা আজ নতুন মনে হচ্ছে ঠিকই, আর তুমি এর অন্তৰ্গত স্বাৰ্থও জানো। কিন্তু, আমার ব্রাহ্মণ চেলারা তো এই নিয়ে এখন থেকেই মাতামাতি শুরু করেছে। পিতরদের এবং দেবতাদের (পিতৃ-যান, দেব-যান) পথ বুঝবার জন্য এখনি মানুষ বার বছর পর্যন্ত গরু চরাতে প্ৰস্তুত। তুমি আমি থাকবো না, কিন্তু এমন সময় আসবে যখন সমস্ত দরিদ্র প্রজা এই পুর্নজন্মের আশায় সারা জীবনের তিক্ততা, কষ্ট এবং অন্যায়কে হাসিমুখে মেনে নেবে। স্বৰ্গ ও নরক বুঝবার এ কেমন সোজা উপায় আবিষ্কার করেছি, বলো তো লোপা?’।
‘কিন্তু, নিজের স্বার্থের জন্য মানুষকে চির-সর্বনাশের পথে ঠেলে দিচ্ছ।’
‘বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্ৰও পেটের দায়ে বেদ রচনা করেছিল, উত্তর পঞ্চালের রাজা দিবোদাসের শবর-দুর্গ অধিকারের পর কবিতা রচিত হয়েছিল। পেটের সংস্থান করা অন্যায় নয়। আমরা যখন হাজার হাজার বছরের জন্য আপন পুত্র-পৌত্ৰাদি, ভাই-বন্ধুদের পেটের সংস্থান করি তখন শাশ্বত যশের ভাগী হই।(১) প্রবাহণ এমন কাজই করছে, যা পূর্বগামী ঋষিগণও করতে পারেননি–ধর্মের অন্ন ভক্ষণকারী ব্রাহ্মণরাও পারেনি।’
‘তুমি অতি নিষ্ঠুর প্রবাহণ।’
‘কিন্তু আমি আমার কাজ যোগ্যতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছি।’
(১) ত্বং তদুক্থমিন্দ্ৰ বর্হণাক : প্রয়চ্ছতা সহাসা শূর-দৰ্ষি।
অবগিরেৰ্দাসং শংবরং হন্ প্ৰাবী দিবোদাসং চিত্রভিরূতী।।
(ঋগ্বেদ ৬। ২৫। ২৫)।
..........................................................................................রাহুল সাংকৃত্যায়ন চর্যাপদের কবিরা ছাড়াও ঐ আমলের বৌদ্ধ ধর্মের গুরুদের 'আধা পাগল' বলে সম্বোধন করেছেন বৌদ্ধের মূল শিক্ষা থেকে সরে এসে বৈদিক যুগের নানা কুসংস্কারকে এডপ্ট করার জন্য। আলেকজান্ডার আসার অনেক আগে থেকেই গ্রিকরা অবিভক্ত উপমহাদেশে এসে বসবাস শুরু করেছিল এবং এদের অনেকে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে এই মতবাদ গ্রহণ করেছিল। উগ্র হিন্দুরা এদের 'যবন' বলে সম্বোধন করতো। এরা গ্রিক সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য তাদের অসাধারণ ভাস্কর্য ও শিল্পকলার জ্ঞানকে অবিভক্ত উপমহাদেশে প্রয়োগ করেছিল। এজন্য উপমহাদেশের তিন দেশ ছাড়াও আফগানিস্তান, নেপাল ইত্যাদি জায়গায় ঐতিহাসিক জায়গাগুলোতে, বিশেষ করে গুহার ভেতর 'যবন' কারিগরদের নাম পাওয়া গেছে। যদিও চাড্ডিগণ সিন্ধু সভ্যতার মতো এগুলোও নিজেদের বলে দাবি করে নির্লজ্জের মতো। গ্রিক বংশোদ্ভূত বৌদ্ধদের দেশীয় ভাইরা পূর্বসূরীদের শিল্পকলা ও ভাস্কর্য প্রীতি বর্জন করে উগ্রতাকে বেছে নিয়েছিল। যেমন- শ্রীলংকার সিগিরিয়া গুহায় এই মুহূর্তে মাত্র কয়েকটা পেইন্টিং আছে। একসময় শত শত পেইন্টিং ছিল (ইতিহাসটা অশ্লীল)। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দান করার পর ভিক্ষুরা প্রায় সব পেইন্টিং নষ্ট করে ফেলেছে এই অজুহাতে যে, এগুলো তাদের ধ্যানের মনোযোগ নষ্ট করে (মুসলমান মোল্লাদের মতো যেকোনো জায়গায় যৌন সুড়সুড়ির উপাদান খুঁজে পাওয়ার স্বভাব)! বিখ্যাত লেখক রাহুল সাংকৃত্যায়ন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের যৌনতা সংক্রান্ত ভণ্ডামির কথা লিখে গেছেন। এছাড়া আরও কিছু গবেষণামূলক বই আছে যেগুলো থেকে জানা যায় তারা মাদ্রাসার মোল্লাদের মতো সমকামিতায় লিপ্ত হয় গোপনে, উপরে লোক দেখানো নারী সংক্রান্ত উন্নাসিকতা দেখালেও। অন্যদিকে ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চগুলোতে মূর্তি রাখা নিষিদ্ধ।
..........................................................................................
"....সাকেত কখনও কোনো রাজার রাজধানীতে পরিণত হয়নি। বুদ্ধের সমসাময়িক কৌশল রাজ প্রসেনজিতের একটি রাজপ্রাসাদ এখানে ছিল, কিন্তু রাজধানী ছিল ছয় যোজন দূরে অবস্থিত শ্রাবন্তীতে (সহেট-মহেট)। প্রসেনজিতের জামাতা অজাতশত্রু কৌশলের স্বাধীনতা হরণ করার সঙ্গে সঙ্গে শ্রাবন্তীরও সৌভাগ্য বিলুপ্ত হলো। অতীতে সরযু তটে অবস্থিত সাকেত পূর্ব (প্রাচী) থেকে উত্তরের (পাঞ্জাব) যোগাযোগ পথে অবস্থিত থাকায় শুধু জলপথের বাণিজ্যের জন্যই নয়, স্থলপথের বাণিজ্যেরও এক বড় কেন্দ্র ছিল। বহুদিন পর্যন্ত তার এই অবস্থা অটুট ছিল। বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্যের শিষ্য মৌর্য মগধ রাজ্যকে প্রথমে তক্ষশিলা পর্যন্ত, পরে যবনরাজ সেলুকাসকে পরাজিত করে হিন্দুকুশ পর্বতমালা থেকে পশ্চিমে হিরাত এবং আমুদরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। চন্দ্রগুপ্ত ও তার মৌর্য বংশের শাসনেও সাকেত বাণিজ্য কেন্দ্রের বেশী কিছু ছিল না। মৌর্য বংশ ধ্বংসকারী সেনাপতি পুষ্যমিত্র প্রথমে সাকেতকে রাজধানীর মর্যাদা দিয়েছিল, কিন্তু তা-ও সম্ভবত পাটলীপুত্রের প্রাধান্যকে ক্ষুণ্ণ করে নয়। পুষ্যমিত্র অথবা তার শুঙ্গ বংশের শাসনকালে বাল্মীকি যখন রামায়ণ রচনা করেন, তখন অযোধ্যার নাম প্রচারিত হলো। এইভাবেই সাকেত অযোধ্যা বলে পরিচিত হয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, অশ্বঘোষ বাল্মীকির কাব্যের রসাস্বাদন করেছিলেন। কালিদাস যেমন চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের আশ্রিত কবি ছিলেন, তেমনি বাল্মীকিও যদি কখনও শুঙ্গ বংশের আশ্রিত কবি থেকে থাকেন অথবা কালিদাস যেমন চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য এবং কুমারগুপ্ত এই দুই পিতা-পুত্রকে তাঁর ‘রঘুবংশ’-এ রঘু এবং ‘কুমারসম্ভব’-এ কুমার রুপে চিত্রিত করেছেন, তেমনি বাল্মীকি যদি শুঙ্গ বংশের রাজধানীর মহিমাকে উন্নীত করবার জন্যই বৌদ্ধ জাতকের দশরথের রাজধানীকে বারাণসী থেকে সরিয়ে সাকেত বা অযোধ্যায় এনে থাকেন এবং শুঙ্গ সম্রাট পুষ্যমিত্র বা অগ্নিমিত্রকেই রামরুপে মহিমান্বিত করে থাকেন - তবে বিস্ময়ের কিছু নেই। সেনাপতি পুষ্যমিত্র আপন প্রভুকে হত্যা করে সমগ্র মৌর্য সাম্রাজ্যকে অধিকার করতে সমর্থ হয়নি। সারা পাঞ্জাব যবনরাজ মিনান্দরের দখলে চলে গেলো এবং পুষ্যমিত্রের পুরোহিত ব্রাহ্মণ পতঞ্জলি-পুষ্যমিত্রের সময়ে এই নগরের নাম সাকেতই ছিল - অযোধ্যা নয়।...."
- 'ভোলগা থেকে গঙ্গা', রাহুল সাংকৃত্যায়ন
..........................................................................................
"রাজধানী পুরুষপুর (পেশোয়ার) গিয়ে অশ্বঘোষ দেখলো সেখানে শক, যবন, তুরস্ক, পারশী তথা ভারতীয় সংস্কৃতির একত্র সমাবেশ। যবন নাট্যকলাকে অশ্বঘোষ আগেই ভারতীয় সাহিত্যে স্থান দিয়েছিল। যবন দর্শনের গভীর অনুশীলনের পর তার বহু বিশেষত্ব, বিশ্লেষণ শৈলী এবং অনুকূল তত্ত্বসমূহকে নিয়ে ভারতীয় দর্শন, বিশেষ করে বৌদ্ধদর্শনকে সে সমৃদ্ধ করে তোলে। বৌদ্ধদের যবন দর্শন গ্রহণ করবার পথও প্রশন্ত করে দেয় অশ্বঘোষ। তার পরে অপরাপর ভারতীয় দার্শনিকেরাও এই চেষ্টা করেছে এবং বৈশেষিক আর ন্যায়ের পথে সকলের আগে আগে চলেছে। পরমাণু, সামান্য দ্রব্যগুণ, অবয়বী ইত্যাদি তত্ত্ব এরা যবনদের নিকট থেকেই গ্রহণ করেছে। অশ্বঘোষের হৃদয়কে বিশাল করে দিয়েছিল প্রভা, কাজেই তার কাছে আপন-পর ভেদ ছিল না। প্রভার প্রেরণায় সে বহু কাব্য আর নাটক লেখে। তার অনেক কিছুই আজ লুপ্ত হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও প্রকৃতি তার প্রতি অত্যন্ত প্রসন্ন ছিল, তাই উনিশ শত বছর পরে মধ্য এশিযার মহাবালুকারাশি গোবী অশ্বঘোষের ‘সারিপুত্র’ প্রকরণকে (নাটক) মানুষের হাতে তুলে দেয় [জর্মন ভারত-তাত্ত্বিক অধ্যাপক লুডার্স ১৯১১ খৃষ্টব্দে সারিপুত্র প্রকরণ নাটকের তালপত্রে লিখিত খন্ডিত পুথি আবিষ্কার করেন]। অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত' আর ‘সৌন্দরানন্দ’ দুই অমর কাব্য।"
- 'ভোলগা থেকে গঙ্গা', রাহুল সাংকৃত্যায়ন
উল্লেখ্য, এই প্রভা ছিলেন কবির প্রেমিকা। তিনি বৌদ্ধ হওয়ার 'অপরাধে' কবির বাবা তাকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন। পরে প্রভা আত্মহত্যা করেন। অন্যদিকে কবির মায়েরও মৃত্যু হয়, যিনি প্রভাকে পছন্দ করতেন। মা-বাবার অনুমতি ছাড়া সংঘে ভিক্ষু হিসেবে গ্রহণ করার নিয়ম নেই দেখে কবি তার বাবাকে আত্মহত্যার ভয় দেখান। শেষে তার বাবা অনুমতি দিতে রাজি হয়।
"অশ্বঘোষ, যবন তরুণ বুদ্ধপ্রিয়ের সঙ্গে কয়েকটি যবন নাটকের প্রাকৃত রূপান্তর পড়লো এবং তাদের কলাকৌশল নিয়ে আলাপ-আলোচনা করলো। যবন কলাবিদ্যাকে স্মরণীয় করে রাখবার জন্যে নাটকের চিত্রপট সমূহের সে নামকরণ করলো যবনিকা। সংস্কৃত, প্রাকৃত, গদ্য-পদ্য দু’রকমভাবেই লিখলো সে। এই সময় প্রাকৃত ও সংস্কৃতের এতটা আবেদন ছিল যে, সম্ভান্ত্র পরিবারগুলোতে তা অনায়াসবোধ্য ছিল। এই ‘উর্বশী-বিয়োগ’ হলো প্রথম ভারতীয় নাটক এবং অশ্বঘোষ প্রথম ভারতীয় নাট্যকার। এটাই কবির প্রথম প্রয়াস, তবু তা পরবর্তী ‘রাষ্ট্রপাল’, ‘সারিপুত্র’ ইত্যাদি নাটক থেকে কম সুন্দর হয়নি।"
[ঐ]
“আর তাই আজ বললে তুমি। ব্রাক্ষণদের পাষন্ডতাকে আমি অসীম ঘৃণা করি - ঘৃণায় আমার সর্বাঙ্গ জ্বলতে থাকে । তারা বলে বেড়ায়, আমরা বেদ-শাস্ত্রকে অনুসরণ করি, কিন্তু বহু পরিশ্রম এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে সমগ্র ব্রাক্ষণ্য-বিদ্যা অধ্যয়ন করেও কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না, কি তারা অনুসরণ করে। পুরাণের্ কোনো ঋষিবাক্য উদ্ধৃত করলে বলবে - আজকাল এ সবের প্রচলন নেই। হয় যুক্তির পথে চলো, নয় তো ঋষিবাক্য অনুসরণ করো! পুরাতন বেদনীতি যদি কেউ ভঙ্গ করে, তবেই না নতুন রীতি প্রবর্তিত হয়। ভন্ড, কাপুরুষ , স্বার্থপররা পুষ্ট বাছুরের মাংস আর মোটা দক্ষিণা পেলেই খুশি। আশ্রয়দাতা রাজা এবং সামন্তগণ যাতে প্রসন্ন হয় সেই কাজেই এরা সদা প্রস্তুত।”
“দরিদ্র হলে কাউকেও নিজেদের ধর্মে স্থান দেয় না এরা…”
“হ্যাঁ, অন্যান্য দেশ থেকে আগত যবন, শক, আভীর ইত্যাদি জাতিসমূহকে এরা ক্ষত্রিয় বলে রাজপুত্র বলে স্বীকার করে নিয়েছে। কারণ, তাদের হাতে ক্ষমতা এবং অর্থ ছিল। তাদের কাছে থেকে এরা মোটা-মোটা দক্ষিণা পেতো। কিন্তু স্বদেশের শুদ্র, চণ্ডালদের চিরতরে দাস করেই রেখেছে এরা। যে ধর্ম মানুষের হৃদয়কে উদার করে তুলতে পারে না, যে ধর্মের বিকাশ শুধু টাকার থলি বা শাসন ক্ষমতার অপেক্ষায় পড়ে থাকে, আমি তাকে মানুষের পক্ষে অত্যন্ত কলঙ্কজনক মনে করি। জগৎ পরিবর্তনশীল, ব্রাহ্মণদের প্রাচীন ধর্মগ্রস্থ থেকে আজকের গ্রন্থাবলী পর্যন্ত সমস্ত পড়ে তাদের আচার ব্যবহারেও পরিষ্কার পরিবর্তন দেখতে পেয়েছি! কিন্তু এদের সঙ্গে কথা বলো, দেখবে এরা সমস্ত কিছুকেই শাশ্বত সনাতন প্রতিপন্ন করতে চাইছে। একে এক ধরনের জড়তাই আখ্যা দেওয়া যায় প্রভা।”
“তোমার এই সমস্ত বিষোদগারের কারণ আমি নই তো!”
“কারণ হওয়া তো প্রশংসারই কথা প্রভা! তুমি আমার কবিতায় নতুন প্রাণ, নতুন প্রেরণার সঞ্চার করেছ। আমার অন্তদৃষ্টিতেও নতুন প্রাণ, নতুন প্রেরণা সৃষ্টি করে তুমি আমার উপকার করেছ। এতদিন ভাবতাম যে, জ্ঞানের সর্বোচ্চ শিখরে আমি আরোহণ করেছি, এই মিথ্যা দম্ভের সহজ স্বীকৃতি হলো ব্রাহ্মণকুল। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি, জ্ঞান সমুদ্রের পরিধি ব্রাহ্মণদের শ্রুতি আর তাদের তাল এবং ভূর্জপত্রের পুথিতেই সীমাবদ্ধ নয়, সে এ সবের চেয়ে অনেক বিশাল।”
“আমি সামান্য এক নারী মাত্র।”
“সামান্য নারী বলেই যদি কেউ তাকে নীচ বলে, তবে সে আমার ঘৃণার পাত্র।”
“যবনকুলে নারীদের সম্মান অন্যদের চেয়ে বেশী। যদি কেউ নিঃসন্তান থেকে মরেও যায় তবু এক স্ত্রী বর্তমানে সে দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারে না।”
“আর এই ব্রাহ্মণেরা শত শত বিবাহ করে বেড়ায় শুধু দক্ষিণা লাভের আশায়, ছিঃ! কোনো যবন যে ব্রাহ্মণ্যধর্মকে মানে না এতে আমি খুব খুশি।”
“বৌদ্ধ হলেও পূজাপাঠের জন্য আমাদের মধ্যে ব্রাহ্মণেরা আসে।”
“স্বার্থরক্ষার জন্য যবনদের যখন ক্ষত্রিয় বলে অভিহিত করেছে, তখন দক্ষিণার আশায় এটুকুই বা করবে না কেন!”
“আমি কি তোমার ব্রাহ্মণত্বের অহঙ্কার ভেঙ্গে দেবার কারণ হয়ে দাঁড়ালাম?”
“তাতে মন্দ কিছু হয়নি। ব্রাহ্মণত্বের দম্ভ যদি তোমার আমার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চায় তো সে দম্ভ আমার কাছে ঘৃণার বস্তু।”
[ঐ]
Comments