প্রবীর ঘোষের চোখে যৌনতা [পর্ব-এক]

 


"....বিতর্কিত লেখিকা তসলিমার কলমে ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে ঝলসে উঠেছিল ক্ষোভ। উপায় বাতলে ছিলেন-নারীদের ধর্ষকের ভূমিকা নিতে, পুরুষদের ধর্ষণ করতে। সুসংস্কৃতির, সুচেতনার পক্ষে এমন নিদান মানা কিছুতেই সম্ভব নয়। কারণ এতে সমাজে নারী ধর্ষক বাড়বে বই কিছু নয়। একজন সমাজ সচেতন মানুষের চোখে একজন ধর্ষক পুরুষ বা নারী-যেই হোক না কেন, তার পরিচয় ধর্ষক, সমাজবিরোধী।....

গত কয়েক বছরে 'নারী স্বাধীনতা'র নামে নতুন এক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ব্যাপক প্রচারাভিযান শুরু হয়েছে একটি বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠীর নেতৃত্বে। ওই পত্রিকাগোষ্ঠী তসলিমা নাসরিনকে পুরুষতান্ত্রিকতার কট্টর বিরোধী এবং নারী স্বাধীনতা ও নারীমুক্তির প্রধানতম চিন্তা-নায়িকা হিসেবে হাজির করতে যে বিপুল প্রচার চালিয়েছে, তা এক কথায় অভূতপূর্ব। প্রচারের ফসল হিসেবে এপার বাংলায় ইতিমধ্যে তসলিমার লেখা নিয়ে এক ধরনের হুজুগ বা গণউন্মাদনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। হুজুগের স্রোতে বানভাসি হতে চলেছে নারীমুক্তির ভিত্তিমূল। বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যে সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে তসলিমা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তাতে আমরা আপ্লুত। যে নির্ভীকতার সঙ্গে দীপ্ত ঘোষণা রেখেছেনএক বৃহৎ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে - প্রাণ দিতে পারেন যুক্তিবাদ ও মানবতার জন্য - তার জন্য হাজারো কুর্নিশ জানাই। কিন্তু তসলিমার জীবন দর্শনে কোথায় যেন একটা তাল কেটে যাওয়ার সুর। এই তসলিমার লেখাগুলোর যে সুর জনমানসকে, নারী-মানসকে প্রভাবিত করেছে, তা হলো - ধর্ষণের বদলা ধর্ষণ, বেলেল্লাপনার বদলা বেলেল্লাপনা, পতিতাপল্লির বদলা পতিতপল্লি। তসলিমা, খারাপ পুরুষের বদলা খারাপ নারী সৃষ্টির মধ্য দিয়ে কোন নারীজাগরণ, কোন নারীমুক্তি আপনি ঘটাতে চাইছেন? কোন মূল্যবোধ আপনি প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন? তসলিমা, আপনি পুরুষ চিত্রকরদের তুলির ছোঁয়ায় শিল্প হয়ে ওঠা নিতম্ব, উরু দেখে বদলা হিসেবে নারী চিত্রকরদের আঁকতে বলেছেন পুরুষাঙ্গ। আপনি এরপর লেখেন, "আমরা আমোদিত হতে চাই, পুরুষ-শরীর দেখে। আমরাও তৃষ্ণার্ত হতে চাই, আহ্লাদিত হতে চাই।” তসলিমা, আপনি চিত্রকরের তুলিতে শিল্পের সৌন্দর্যের বদলে পর্নোর উত্তেজনা যখন পেতে চান, তখন আপনার মানসিক সুস্থতা বিষয়ে কোনও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সন্দিহান হলে তাঁকে খুব একটা দোষ দেওয়া যাবে কি? তসলিমা, আপনার মতো একজন কথাশিল্পীর কাছে চিত্র বা ভাস্কর্য যখন শিল্প না হয়ে শুধুমাত্র তীব্র কামতৃষিতদের তৃষ্ণা নিবারণের পণ্য হয়ে দাঁড়ায় তখন দুঃখ পাই। তসলিমা, দুঃখ এ'জন্যেও হয়, যখন দেখি বারবার পুরুষরা আপনার ভালোবাসার বিনিময়ে দিয়েছে প্রতারণার জ্বালা। আপনার মনে হতেই পারে - পুরুষ প্রেম দিতে পারে না, যেমনটা আরও অনেক নারীরই মনে হয়। তসলিমা, একইভাবে বহু পুরুষেরও মনে হতে পারে-

নারী প্রেম দিতে জানে না

দিতে জানে নদীর মতন, ফুলের মতন দেহ।

নারী প্রেম নিতে জানে না,

নিতে জানে শরীরের তাপ ও ভালোবাসাহীন ভালোবাসার স্বীকৃতি।

এ'কথা রোজই মনে হয় না,

তবু এক - একদিন মনে হয়

যখন দেখি, পরিচিত নারীদের ভিড়ে

বুকের গভীরে বুক পড়ে আছে - তেমনি

একা স্পর্শহীন হয়ে।

জানি, 'নারী' শব্দগুলোকে কেটে সেখানে 'পুরুষ' বসিয়ে দিলেও তা বহু নারীর জীবনেই সত্য হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এটা কখনওই শেষ কথা হয়ে উঠতে পারে না। এরপরও আমরা বলবো - মানুষে বিশ্বাস হারানো অনৈতিক। এরপরও প্রত্যাশা রাখবো, ঘৃণিতকে ঘৃণা করার পরও প্রতারিত মানুষের মস্তিষ্ককোষে উদ্দীপিত হোক সেই কবিতার নির্যাস-

আমি খুব বোকা ছিলাম,

ভাবতাম, ভালোবাসলেই বুঝি

ভালোবাসার প্রজাপতি বুকে এসে বসে

আমি খুব বোকা ছিলাম,

ঘনভার অন্ধকারে ঘুমন্ত মানুষের সামনে 

ভালোবাসার মাদুর বিছিয়ে ভাবতাম, 

ভোরের আলো ফুটলেই ওদের ভালোবাসা 

শিউলি হয়ে ঝরে ঝরে আমাকে ঢেকে দেবে।

আমি খুব বোকা ছিলাম,

বিশ্বাস করতাম সেই পুরনো কথাটায় 

ভালোবাসলেই বুঝি ভালোবাসা পাওয়া যায়। 

মানুষই আমাকে চালাক করেছে, 

কিন্তু মানুষের মুখোমুখি হলেই 

হাসনাহানার গন্ধে স্নাত হতে হতে 

সবকিছু তালগোল পাকিয়ে

আবার আমি বোকা হয়ে যাই।

প্রতারণাময়-প্রেম অসুস্থ-প্রেম, আমাদের বর্তমান সমাজ কাঠামোরই ফলশ্রুতি, আমাদের সমাজের সাংস্কৃতিক পরিবেশেরই ফলশ্রুতি। আমাদের সমাজের সাংস্কৃতিক পরিবেশ পাল্টে নারী-পুরুষের সুস্থ ভালোবাসার সংস্কৃতি গড়ার পথনির্দেশ না দিয়ে আপনার লঘু প্রতিবাদী মন নারী-পুরুষের মধ্যে যে খারাপ হওয়ার সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, তা সুস্থ সমাজের পরিপন্থী। সাম্য-ভাল, অসাম্য-খারাপ। এই প্রচলিত বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আপনি স্বেচ্ছায় বা অন্যের দ্বারা চালিত হয়ে চাইছেন, সমাজে উচ্ছৃঙ্খল পুরুষদের উপস্থিতির পাশাপাশি উচ্ছৃঙ্খল নারী সৃষ্টি করে হাজির করতে। স্বাধীনতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা বা স্বেচ্ছাচারিতা তো এক নয়? তসলিমা, আপনি স্বচালিত হয়ে অথবা কোনও গোষ্ঠীর দ্বারা চালিত হয়ে, সচেতন বা অচেতনভাবে কিন্তু একটা অমানবিক সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার পক্ষেই, ভোগসর্বস্ব সমাজব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার পক্ষেই ওকালতি করছেন। আজকের পৃথিবীর ভোগবাদের, অসাম্যের, ক্ষয়িষ্ণু ভাবধারারই স্বার্থ রক্ষা করতেই আপনাকে দিয়ে বিপ্লবী নারীর মুখস্থ পার্ট কেউ আউড়িয়ে নিচ্ছে না তো? আপনি সাম্যে বিশ্বাসী, মানবতাবাদ, যুক্তিবাদে বিশ্বাসী - আমার মুখোমুখি আমাকেই সতেজ কণ্ঠে জানিয়েছিলেন। কিন্তু আপনার সমাজ বদলের চিন্তা ধারাতেই তো খাদ ধরা পড়ছে তসলিমা। এই চিন্তা-ভাবনা নারী-মুক্তির অনুগামী কখনওই নয়, বরং নারীবাদী সেজে নারীবাদের প্রতি আক্রমণ। তসলিমা, বাস্তবিকই আপনার কি একবারের জন্যেও মনে হয়নি, বর্তমান সমাজ কাঠামোই পুরুষতন্ত্রের প্রাণশক্তি? আপনি কি বাস্তবিকই বুঝতে পারেননি 'সমাজ কাঠামো' ও 'সরকার' এক নয়? সরকার যাবে, সরকার আসবে, রাজনৈতিক নেতারা গদিতে আসবেন, একদিন বিদায় নেবেন - কেউই অনিবার্য নন। অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে, শোষণের সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখে শোষক। সহায়তা করে শাসক ও বুদ্ধিজীবীরা। শোষণ চলবে, বৈষম্য চলবে অথচ নারীবাদের মুক্তি ঘটবে - এই অবাস্তব চিন্তায় আপনি কি বিশ্বাস করেন? এই সমাজ কাঠামোর বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার সে সুখ-স্বপ্ন আপনি নারীদের দেখাচ্ছেন, তা কি আপনার অজ্ঞতা প্রসূত? নাকি পরিকল্পিত ভণ্ডামি? অসাম্যের সমাজ কাঠামোর বিরুদ্ধে আপনার নীরবতাই আমাদের ভাবায়, তসলিমা। তসলিমা আপনার লেখা নারীমুক্তির লেখা নয়, পুরুষ বিদ্বেষে জর্জরিত লেখা আপনি লেখেন। গোটা দুই 'পতিত' আর ছ-সাতটি 'রক্ষিত' হলে জমতো বেশ। এমন চটুল ভোগসর্বস্ব, পর্ণো-প্রিয়তাধর্মী লেখার মধ্য দিয়ে কোন মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে চলেছেন তসলিমা? তসলিমা, আপনার 'ইমেজ' আজ বিদ্রোহী নারীর। এই ইমেজ গড়ে ওঠার পিছনে আপনার দায়-দায়িত্ব আপনি স্বীকার করতে পারেন, আবার নাও পারেন। কিন্তু বাস্তব সত্য এই - আপনি চান বা না চান, প্রচার মাধ্যমগুলোর পরিকল্পিত মগজ ধোলাইয়ের কল্যাণে এই ইমেজ আপনার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মিলে-মিশে একাকার হয়ে রয়েছে। আপনার কাছে এবং আপনার ইমেজ সৃষ্টিকারী প্রচার মাধ্যমগুলোর কাছে একটা সাদা-সাপটা প্রশ্ন - তসলিমা নামক বিদ্রোহীনীর বিদ্রোহটা ঠিক কার বিরুদ্ধে? কোন সমাজ-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে? সুসমাজ গড়ে তুলতে পুরনো মূল্যবোধ আমরাও ভাঙতে চাই। আমরাও বিশ্বাস করি - মানুষের তৈরি সমাজের নিয়মকে মানুষের অগ্রগমনের স্বার্থে ভাঙ্গার, পাল্টে দেবার অধিকার ও ক্ষমতা মানুষেরই আছে। কিন্তু ভাঙার পর যা গড়ে উঠবে বা পড়ে থাকবে, তা সুন্দর কী অসুন্দর হবে, সেটা নির্ভর করে বিদ্রোহী বা বিপ্লবী মানুষদের দক্ষতা, শৃঙ্খলাবোধ বা অদক্ষতা, উচ্ছৃঙ্খলতার উপর, তাদের দর্শনের উপর। এও তো আমরা ইতিহাস থেকেই শিক্ষা নিয়েছি - গড়ার নিয়ম জানা না থাকলে শুধু ভাঙার খেলা খেলে কখনও কোনও আন্দোলন, কোনও সমাজ অগ্রগতি ধরে রাখা সম্ভব নয়। তসলিমা, আপনিও কি মনে করেন, সমাজের সাংস্কৃতিক ও আর্থিক পরিবেশের প্রধান নিয়ন্ত্রক শক্তি শোষক-শাসক-প্রচারমাধ্যম ও তাদের সহায়ক বুদ্ধিজীবী শ্রেণী? তসলিমা, আপনার বিদ্রোহী সত্তা সমাজ কাঠামোর নিয়ন্ত্রক শক্তির বিরুদ্ধে আশ্চর্য রকমের নীরব কেন? সমাজ কাঠামোর বিরুদ্ধে সরবতা আপনার স্পনসরকারীদের বেপসন্দ বলে? সরকারের বিরুদ্ধে বলুন, প্রচার-মাধ্যম আপত্তি তুলবে না। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ুন, প্রচার মাধ্যম সে খবর পাবলিককে খাওয়াবে। আপনি সিস্টেমের বিরুদ্ধে বলুন, প্রচার মাধ্যমগুলো সর্বশক্তি দিয়ে আপনার বিরোধিতা করবে। কারণ, 'সিস্টেম' বা সমাজ কাঠামো বজায় আছে বলেই রাজা যায়, রাজা আসে, সরকার যায়, সরকার আসে, শোষণ চলছে-চলবে।...."

- 'যুক্তিবাদের চোখে নারীমুক্তি', প্রবীর ঘোষ

.......................................................................................

যৌনকর্মী'রা কোনও অর্থেই কর্মী কি?

"ওয়ার্কস উইদাউট ইন্ডাসট্রি নেহি হো সাকতা।" হিন্দি দৈনিক 'জনসত্তা'-র সাংবাদিক অরবিন্দ চতুর্বেদী 'যৌনকর্মী' শব্দের তীব্র বিরোধিতা করে একথা বলেছিলেন। তাঁর কথায়, কর্মী কেবল তিনি, যিনি শিল্পে উৎপাদনের জন্য শ্রমদান করেন। যেহেতু যৌনতা নিয়ে কোনও ইন্ডাসট্রি নেই এবং হওয়া কাম্য নয়, তাই 'যৌনকর্মী' শব্দটা ব্যবহার করা যায় না। এই কথাগুলো একটা বিশেষ তাৎপর্যময় দিনে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন। দিনটি ছিল ১০ ডিসেম্বর ১৯৯৭, 'বিশ্ব মানবাধিকার দিবস'। এই দিনটির স্মরণে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল 'হিউম্যানিস্টস অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া' ও হিন্দি সাপ্তাহিক 'জনসংসার'। আলোচনার বিষয় ছিল - 'যৌনকর্মী, মানবাধিকার ও নারীমুক্তি'।

অরবিন্দ চতুর্বেদী প্রস্তাব দেন, "যৌনতা বিক্রি করে বা দেহ বিক্রি করে যারা জীবনধারণ করে, তাদের 'যৌনজীবী' 'দেহজীবী' বলে চিহ্নিত করা হোক। কিন্তু কিছুতেই 'যৌনকর্মী' বলে নয়। 'দেহজীবী'রা 'শ্রমিক' হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পাওয়ার দাবিকে প্রতিষ্ঠা করতেই নিজেদের 'যৌনকর্মী' বা 'সেক্স ওয়ার্কার' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। শ্রমিক হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি পাওয়ার অর্থ, যৌনতা ব্যবসা চালাবার সরকারি স্বীকৃতি আদায়।"

বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ ও বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত পল্লব সেনগুপ্তের কথায়, “প্রচলিত অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর মালিক-শ্রমিক বিন্যাসের মধ্যে এঁদের (যৌনজীবী) ফেলা যায় না। দ্বিতীয়ত: ট্রেড ইউনিয়ন গড়ার একটি প্রাসঙ্গিক শর্ত হচ্ছে সবনিম্ন মজুরির হার বিধিবদ্ধ করানো এবং শ্রমিকের অভিজ্ঞতা এবং যোগ্যতা অনুসারে তাঁর মজুরির ক্রমবর্ধমান হারের বিন্যাস করা। এই বিশেষ ক্ষেত্রে সেগুলো নির্ণয় করা - অন্তত এই ট্রেড ইউনিয়ন আইনের মাধ্যমে অসাধ্য কি-না জানি না, তবে অবশ্যই দুঃসাধ্য। যদি এঁদেরকে অসংগঠিত ঠিকে শ্রমিক হিসেবেও গণ্য করা হয়, তাহলেও কিন্তু সমস্যাটা মেটে না। তাই সবচেয়ে বড় কারণ হলো এঁদের শ্রমটা উৎপাদন বা নির্মাণ অথবা সহায়তা প্রদানমূলক নয়। পক্ষান্তরে একইসঙ্গে নৈতিকতা, জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক পরিচ্ছন্নতার প্রশ্নগুলো এখানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে বাধ্য। এঁরা যে জীবিকার মাধ্যমে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করেন, সেই রুজি-রুটির উপায়টা তো ঘরামির কাজ, কিংবা মোট বওয়া বা লোকের বাড়িতে বাসন মাজা বা ঘর মোছার মতো গোপনতাহীন কোনও ধরনের শ্রমদান নয়।...আসলে এঁদের জীবিকাটাই তো এমন, যার কোনও সামাজিক স্বীকৃতি নেই, যাকে সম্মানজনক নীতিগত বিচারে সুসঙ্গত বলে ধার্য করা যায়।” (আমরা যুক্তিবাদী ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল, '৯৮ সংখ্যা)

ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি'র সে সময়কার সহ-সভাপতি, উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট আইনবিদ বীণা চৌধুরীর কথায়, উৎপাদনের সঙ্গে গণিকাবৃত্তির কোনও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পর্ক নেই, সুতরাং ওঁরা শ্রমিক বলে আইনত আখ্যা পেতে পারেন না। গতর খাটিয়ে খেলেও শ্রমিকদের অধিকার বা মর্যাদা পেতে পারেন না। চিহ্নিত হতে পারেন না 'যৌনকর্মী' হিসেবে।...তৃতীয় বিশ্বে যখন চারদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জয়জয়কার, তখন নারীকে এই 'যৌনকর্মী' সম্বোধন নারীর অবস্থান কোথায় তা সহজেই অনুমেয়। এই ঘৃণ্য ও অবমাননাকর দেহ ব্যবসাটিকে টিকিয়ে রাখা ও তার সপক্ষে বিভিন্ন অনৈতিক যুক্তি খাড়া করে শ্রমিকদের অধিকারের দাবিতে নারী আন্দোলনের নামে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দালালদের উৎসাহ দান, এক ঘৃণ্য চক্রান্ত ছাড়া কিছু নয়।

দেহোপজীবীদের পক্ষে একটি নতুন স্লোগান খুবই জনপ্রিয় হয়েছে, "গতর খাটিয়ে খাই, শ্রমিকের অধিকার চাই"। তারই পাশাপাশি নিজেদের 'যৌনকর্মী' বা 'সেক্স ওয়ার্কার' হিসেবে প্রচার রেখেছে। বেশ কিছু প্রচারমাধ্যম ইতিমধ্যেই দেহোপজীবীদের 'যৌনকর্মী' বা 'সেক্সওয়ার্কার' বলে উল্লেখ করছে। এই নিয়ে ইতিমধ্যে বিতর্কও উঠেছে। সমস্ত পেশাকেই কি মর্যাদা দেওয়া যায়, না মর্যাদা দেওয়া উচিত? সব পেশাকেই কি সমাজ চালিয়ে যাওয়ার অধিকার দেবে? গতর খাটানোটাই যদি একটা পেশাকে মর্যাদা দেওয়ার বা অধিকার দেওয়ার শর্ত হয়, তবে তো স্মাগলার থেকে ড্রাগ পেডলার, খুনে থেকে পকেটমার - প্রত্যেকের পেশাকেই মর্যাদা ও অধিকার দিতে হয়। কারণ এসব পেশাতেও যথেষ্ট শ্রম দিতে হয়।

শ্রমের মর্যাদা ও অধিকার পাওয়ার দাবিটা যে যৌনতা ব্যবসাকে আইনি করার প্রথম ধাপ এবং এই পেশায় মানুষদের প্রলুব্ধ করার অপচেষ্টা, এটা আমাদের বুঝতে হবে।" - 'হিউম্যানিস্টস্ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া'র সাধারণ সম্পাদক সুমিত্রা পদ্মনাভন স্বাগত ভাষণে (আলোচনা সভা : যৌনকর্মী, মানবাধিকার এবং নারীমুক্তি) এই কথাই দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন। তাঁর কথায়, গণিকাবৃত্তি সম্মানজনক করতে পারলে মেয়েদের প্রলুব্ধ ও প্রতারিত করা সহজ হবে ভেবেই 'যৌনকর্মী' নামটা চালু করার অপচেষ্টা চলছে। 'ব্যাঙ্ককর্মী', 'রেলকর্মী', 'স্বাস্থ্যকর্মী'র মতো 'যৌনকর্মী' শব্দটার মধ্যে কাজের একটা স্বীকৃতি ও সম্মান প্রচ্ছন্নভাবে রয়ে গেছে। তাই গণিকা, বেশ্যা, দেহজীবী ইত্যাদি শব্দের পরিবর্ত হিসেবে 'যৌনকর্মী' শব্দটা ব্যবহারের চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছে।

বেঁচে থাকার জন্য কত মানুষ কত বেআইনি কাজ করছে। তারা কী ধরনের প্রতিকূল অবস্থায় পড়ে এইসব বেআইনি কাজ করছে, তা জানলে আমরা হয়তো মানুষটির প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারি। তারা সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে আগ্রহী জানলে আমাদের কেউ কেউ হয়তো সাধ্যমতো সহযোগিতা করতেও এগিয়ে আসতে পারি। কিন্তু তাদের বেআইনি কাজকে কি সমর্থন করতে পারি?

বন্ধ কারখানার শ্রমিক সংসার চালাতে, অসুস্থ বাচ্চার মুখ চেয়ে চুরি-ডাকাতির পথ বেছে নিয়েছে - এটা শুনলেই কি আমরা চুরি-ডাকাতিকে আইনি ঘোষণা করার পক্ষে মত দেবো?

দেহজীবীর যৌন আনন্দ দেওয়াকে 'সেবা' বলে প্রচারে নেমেছে দেহজীবীরা। তাদের পরবর্তী যুক্তি - হাসপাতালের নার্সরা সেবাকর্মী হলে তারাও সেই অর্থে সেবাকর্মী। দেহোপজীবীদের এই যুক্তির আশ্রয় নিয়ে ড্রাগ পেডলাররা ড্রাগের আনন্দ দেওয়াকে 'সেবা' বলে প্রচার শুরু করলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে?

কবি দীপশিক্ষা পোদ্দারের কথায়, "এক শ্রেণির বিকৃত রুচির নীচ, ভ্রষ্ট, কামুক পুরুষকে এন্টারটেন করার অর্থ সমাজসেবা? ভাবতে অবাক লাগে, একজন নারীর প্রকৃত অধঃপতন প্রক্রিয়াকে কী করে 'সমাজসেবা' বলে নারীই দাবি করতে পারেন? এ হলো নিজেদের 'যৌনকর্মী' বলে এস্টাব্লিশ করতে হিজিবিজি যুক্তি।"

'ওমেন সহযোগ'-এর চেয়ারপার্সন, নারীদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, হিন্দি সাহিত্যিক কুসুম জৈন মনে করেন, "ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো পৃথিবীকে অবাধ যৌনতার ব্যবসাস্থল বানাতে সচেষ্ট।"

বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলো তাদের লক্ষ্য। চাইছে গরিব দেশগুলোতে অবাধ যৌনতা ব্যবসাকে ভ্রমণ ব্যবসার অন্যতম অঙ্গ হিসেবে চালু করতে। ধনী দেশগুলোর লক্ষ্যকে সার্থক করতে কাজে নামিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাদের। ওরা একদিকে যৌনতা ব্যবসাকে আইনি করতে চাইছে, আর একদিকে এইডস বিষয়ে সচেতন করতে কোমর বেঁধে নেমেছে। এখন কলকাতার রেডলাইট এলাকাগুলোতে বেশ্যার দালালের চেয়ে 'স্বেচ্ছাসেবী'দের ভিড় বেশি। এইডস-এর চেয়ে ভারতে ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, আন্ত্রিকে মৃত্যুর সংখ্যা বোধহয় কয়েক হাজারগুণ বেশি। কিন্তু এইসব রোগের বিরুদ্ধে লড়াইতে না নেমে 'স্বেচ্ছাসেবী'দের এইডস নিয়ে লড়াইতে নামার পিছনে রয়েছে অর্থ লোভ।

বেশ্যাবৃত্তি যে কোনও মানুষের পক্ষেই অত্যন্ত মর্যাদাহানিকর বৃত্তি। এই বৃত্তিকে মহান করতেই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর নেতৃত্বে বেশ্যাদের 'যৌনকর্মী' নামে সমাজে পরিচিত করবার চেষ্টা চলছে। প্রতিটি প্রগতিশীল মানুষের উচিত গোটা দেশকে বেশ্যাখানা বানাবার এই চক্রান্তকে প্রতিহত করা।

মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায় প্রাবন্ধিক, সমাজসেবী ও নারীবাদী হিসেবে পরিচিত। তাঁর সঙ্গে দেহোপজীবীদের সাম্প্রতিক আন্দোলন নিয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি এক ডাক্তারের নাম করে বললেন, "উনি এখন গণিকাদের নতুন দালাল হয়েছেন। গণিকাদের জাতীয় সম্মেলনে (১৪ থেকে ১৬ নভেম্বর, '৯৭) বলেছেন - ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের মতোই একটা সম্মানজনক বৃত্তি হলো গণিকাবৃত্তি। শুনেছি ওঁর একটি কিশোরী মেয়ে আছে। জানি না উনি মেয়েকে এই বৃত্তি নিতে উৎসাহিত করবেন কি-না!"

ওই ডাক্তার নিজের মেয়েকে উৎসাহিত করলেও এটা আদৌ প্রমাণিত হতো না যে, গণিকাবৃত্তি সম্মানজনক পেশা। অনেক মানুষ আজও নিজের প্রমোশন, ব্যবসাবৃদ্ধি ও অর্থ রোজগারের নেশায় নিজের বউ, বোন, মেয়েকে এক্সপ্লয়েট করে। এদের মনুষ্যত্ব তলানিতে এসে ঠেকেছে বললেও বেশি বলা হয়।

'রেডলাইট' এলাকার বাইরে গৃহস্থ পরিমণ্ডলে দ্রুত বাড়ছে গণিকাবৃত্তি। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় স্মাগলিং যেমন প্রায় প্রতিটি পরিবারেই ঢুকে পড়েছে, তেমনই সীমান্তরক্ষীদের তুষ্ট করতে 'দেহ-দান' এখন জল-ভাত। সীমান্তবর্তী এলাকায় মাল নিয়ে কয়েক দিনের জন্য অপেক্ষারত ড্রাইভার ও খালাসিদের কাছে দেহবিক্রি করা এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার। স্কুল কলেজের ছাত্রী, বেকার মেয়ে, গৃহবধূদের অনেকে বাড়তি রোজগার ও নিষিদ্ধ উত্তেজনা উপভোগ করতে কলগার্ল কিংবা কোম্পানি-উওম্যান (যারা কোম্পানির ক্লায়েন্টদের যৌন আনন্দ দেয়) হিসাবে কাজ করে। এরা তথাকথিত গণিকা বলে গণ্য নয়। ঠিক এই বর্গভুক্ত না হলেও গণিকা হওয়ার জন্য পা বাড়িয়েই রয়েছে - এটুকু আমরা বলতেই পারি। যৌনতা ব্যবসা আইনি হলে অসম্মানের হবে না। তখন এইসব পার্টটাইমাররা ফুলটাইমের হবেন। গরিব শ্রমজীবী মহিলাদের দাবি আদায়ে লড়াই সংগঠিত করার চেয়ে মেয়েদের ফুসলিয়ে গণিকা বানাবার লোভ হাতছানি দেবে সমাজ সচেতন যুবকদের। এভাবেই একটু একটু করে গোটা দেশটাকে বেশ্যালয় বানাবার চেষ্টা চালাচ্ছে বহুজাতিক সংস্থাগুলো। স্বেচ্ছাসেবীদের বাড়বাড়ন্ত দেখে গোটা দেশের পুরুষরাই বেশ্যার দালাল বা পুরুষ বেশ্যা হয়ে উঠবে। এই 'সম্মানজনক' পেশায় সবাই শামিল হলে শেষ পর্যন্ত দেশটা উন্নতির কতটা শিখরে পৌঁছতে পারবে, তার সঠিক হদিস নিশ্চয় ওই ডাক্তারবাবুই দিতে পারবেন।

[ঐ]

....................................................................................

'লিগ্যাল এইডস কমিশন'-এর প্রাক্তন এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান বিশিষ্ট আইনবিদ, গীতানাথ গঙ্গোপাধ্যায় মনে করেন, "যৌনতা ব্যবসায়ীদের স্বশাসিত বোর্ড গঠনের দাবি ভুল ধারণার ফসল। একটা কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে পতিতাবৃত্তির কোনও প্রয়োজন নেই। বরং আমাদের উচিত প্রসটিটিউট মুক্ত সমাজের কথা চিন্তা করা। এমন একটা কার্যক্রম ওদের সামনে তুলে ধরা উচিত যাতে ওরা এই অমানবিক জীবন থেকে বেরিয়ে এসে পুনর্বাসন পেতে পারে, সমাজের মূল স্রোতে ফিরতে পারে। আমাদের দেখতে হবে যাতে, সমাজের সব স্তরের মানুষ মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার অধিকার পায়। ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে 'রাইট অফ লাইফ'-এর উল্লেখ আছে। এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট 'রাইট অফ লাইভ উইথ ডিগনিটি'কেও ভারতের নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকারের মর্যাদা দিয়েছে। যৌনতা ব্যবসা চালাবার দাবিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলে চালাবার চেষ্টাটাও ভুল চিন্তা থেকেই বেরিয়ে এসেছে।"

[ঐ]

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]