হুজুর সাইদাবাদী: মন্তরে সন্তান লাভ! [প্রবীর ঘোষ-পর্ব এক]
হুজুর সাইদাবাদী বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সুফী সাধক। বছর চল্লিশের এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারীর দাবিদারের পিছনে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা যত নিউজ প্রিন্ট খরচ করেছেন, তার ভগ্নাংশও অন্য কোনও পীর বা সাধকদের পিছনে হয়নি। হুজুর মাঝে মাঝেই ভক্তদের টানে কলকাতায় আসতেন। সবাইকে তো আর চিঠি দিয়ে তাঁর আগমনবাণী পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়, তাই হুজুর নিজের ছবিসহ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দিতেন কবে থেকে কবে কলকাতায় থাকবেন, কোথায় থাকবেন, কখন দর্শন দেবেন। সাধারণভাবে তিনি উঠতেন এসপ্ল্যানেডের গ্রান্ট স্ট্রিটের হীরা হোটেলে। হীরা হোটেল এমন একটা এলাকায়, যে এলাকা শাসন করে কলকাতার অপরাধী জগতের কিছু নামী-দামীরা। হুজুর সাইদাবাদীর পুরো নামটা বেশ বড়-আলহাজ্ব হুজুর দেওয়ান মোহাম্মদ সাইদুর রহমান চিশতি সাইদাবাদী। সংক্ষেপে হুজুর সাইদাবাদী। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার জনপ্রিয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে কলকাতায় এলেন। জানালেন, থাকবেন ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি। ঠিক করে ফেললাম, হুজুর সাইদাবাদীর মুখোমুখি হবো। মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা একটিই-পেশাদার গুণ্ডা ও খুনে। খবর পেয়েছি, কলকাতা ভ্রমণকে নিরুপদ্রব রাখতে আধ্যাত্মিক জগতের হুজুর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা অপরাধ জগতের এক নবাবের সাহায্য নিয়েছেন। পেশাদার গুণ্ডা ও খুনেরা হুজুরকে ঘিরে গড়ে তুলেছে এক বলয়। প্রতিরক্ষার বলয়। কলকাতার যুক্তিবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করার বলয়। হুজুর সাইদাবাদীর সম্বন্ধে ইতিমধ্যে অনেক খবর সংগ্রহ করেছি। বাংলাদেশের সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ও যুক্তিবাদী বন্ধুরা ইতিমধ্যে পাঠিয়েছেন সেখানে হুজুর সাইদাবাদী বিষয়ে প্রকাশিত কিছু পত্র-পত্রিকা। পড়েছি 'বর্তমান দিনকাল', 'সাপ্তাহিক সাংবাদিক', 'সপ্তাহিক নিপুন', 'বঙ্গবাসী', 'পাক্ষিক শেষ সংবাদ' ইত্যাদি। পত্রিকাগুলো হুজুরের দোয়া আর দাওয়ার কীর্তিতে ঠাসা। গাদা গুচ্ছের দম্পতির ছবি, যারা হুজুরের দয়ায় সন্তান পেয়েছে। ছবি আছে সেসময়কার রাষ্ট্রপতি হুসেন মহম্মদ এরশাদের সঙ্গে হুজুরের। ভক্তদের দাবি বেগম জিয়া থেকে শেখ হাসিনা-প্রত্যেকেই হুজুরের দরবার শরীফে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। দুষ্টেরা বলবেন-একজন সমাজ বিরোধীর হাতে কয়েক লক্ষ ভোটার থাকলে দেশের রাষ্ট্রপতি সমাজ বিরোধীকে সেলাম ঠুকবেন-এ যুগের রাজনীতিতে এটাই নীতি। হুজুরের ভক্ত সংখ্যা তো আরও বেশি। এরশাদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন এক টাকার বিনিময়ে হুজুরকে ঢাকায় সাড়ে চার বিঘা জমি দিয়েছিলেন। সাড়ে চার বিঘা জমি জুড়ে হুজুরের বিশাল পাঁচতলা বাসভবন। ইসলামি স্থাপত্য শিল্পের এক নিদর্শন। দরবার শরীফ ঘিরে মাদ্রাসা ও মসজিদ সহ একটা কমপ্লেক্স গড়ে তোলার কাজ চলছে। বহু কোটি টাকার প্রকল্প। এখন যতখানি গড়ে উঠেছে তা কলকাতার পাঁচতারা হোটেল গ্র্যান্ড, পার্ক বা তাজ-বেঙ্গলকে টেক্কা দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। হুজুর এতটা বিত্তবান হওয়া সত্ত্বেও কোলকাতার কোনও পাঁচতারা হোটেলে না উঠে আস্তানা গাড়েন হোটেল হীরায়-এতে অনেকে অবাক হতে পারেন। আমি হই না। এখানে হুজুর গুণ্ডারাজের প্রোটেকশন পান। পান যুক্তিবাদীদের হাত থেকে বাঁচার নিশ্চিত আশ্বাস। পুরো হোটেলটাই বুক করার সুবিধা। হুজুরের মাদ্রাসা ইতিমধ্যেই বিশাল আকার নিয়েছে। ১৯৯১-তে মাদ্রাসার ছাত্র সংখ্যা দু হাজারের বেশি। প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার নারী পুরুষের ভিড় হয়। এঁরা আসেন সন্তান কামনায়, রোগমুক্তি ও সমস্যা মুক্তির বাসনায়। হুজুর দোয়া আর দাওয়া দেন। দর্শনী দশ টাকা, দাওয়ার দাম আলাদা। কমপ্লেক্স গড়ার কাজে কেউ কিছু দিলে নেওয়া হয়। ভক্তদের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক নেতা, শিল্পপতি, সাহিত্যিক, অভিনেতা, পেশায় সফল বিখ্যাত মানুষের অভাব নেই। ১৬ ফেব্রুয়ারি সকালে হাজির হলাম হীরা হোটেলে। বাইরে তখনই কোয়ার্টার কিলোমিটার লম্বা ভক্তের লাইন পড়ে গেছে। লাইনের টোকেন দিচ্ছে ও লাইন দেখভাল করছে বেশ কিন্তু স্বেচ্ছাসেবক। স্বেচ্ছাসেবকদের চেহারা সত্যিই সন্দেহজনক। দেখলাম পরিকল্পনা মত লাইনে আমাদের সমিতির অনেকেই হাজির। 'আজকাল' থেকে আসছি, হুজুর সাইদাবাদীর একটা ইন্টারভিউ নিতে চাই-রিসেপশন কাউন্টারে জানাবার পর জনা তিনেক মাতব্বর গোছের লোকের হাতে হোটেল ম্যানেজার আমাদের তুলে দিলেন। তিনজনের একজন আবার কলকাতার একটি উর্দু পত্রিকার সাংবাদিক। তিনজনই আমির মানুষ-বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। প্রায় এক ঘণ্টার মতো আমাকে ও চিত্র-সাংবাদিক কুমার রায়কে পুলিশি জেরা করলেন। কুমারের পত্নী শ্যামলী, দশ বছরের মিতালি ও হাঁপানিক্লিষ্ট ননী আমাদের সঙ্গী। বোঝালাম, হুজুরের ইন্টারভিউয়ের পাশাপাশি আমার ও কুমারের এই তিন আত্মীয়ের জন্য হুজুরের কৃপা চাইতে এসেছি। একই সঙ্গে 'রথ দেখা ও কলা বেচা' সারতে চাইছি। কুমারকে ওর পরিচয়পত্র দেখাতে হলো। আমাকে দেখে উর্দু সাংবাদিকের মনে হলো চেনা-চেনা। কিঞ্চিৎ মেকাপে একদম যে ধরা পড়িনি এই যথেষ্ট। শেষ পর্যন্ত বাধা টপকে দোতলায় গেলাম আমরা। বড় ঘর। ঘর জুড়ে পুরু গদির ওপর দুধ সাদা চাদর পাতা। হুজুর হাসিমুখে আমাদের আহ্বান জানালেন। হুজুরের পরনে ধবধবে সালোয়ার ও সূক্ষ্ম কাজ করা ধবধবে পাঞ্জাবি। একটা সাদা ওড়নায় মাথা-কান-গলা ঢাকা। মুখে চাপ দাড়ি ও গোঁফ। স্বাস্থ্যবান। হুজুরের সামনে একটা জলচৌকি পাতা। জলচৌকিও সাদা কাপড়ে ঢাকা। হুজুরের পাশে আমাদের জেরা করা তিনজনেরই দেখা পেলাম। হোটেলের সবগুলো ঘর হুজুর তাঁর বাংলাদেশী শিষ্যদের জন্য বুক করেছেন। এঁদের নিয়ে গিয়েছিলেন খাজা মাইনুদ্দিন চিশতী-তে। ফেরার পথে কলকাতায়। হোটেল জুড়েই হুজুরের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। প্রশ্নটা করতে উত্তর না দিয়ে হুজুর মোনালিসা মার্কা হাসি ফুটিয়ে তুললেন মুখে। হুজুরের মুখোমুখি বসলাম। কুমার ছবি তুলতে লাগলেন। আমাদের সঙ্গে আনা রোগীদের এই মুহূর্তে ঘরে প্রবেশাধিকার দেননি হুজুর। ওরা এক তলায় সোফায় বসে। ঠিক সময়ে নাকি ওদের ডেকে নেওয়া হবে। হুজুরের একপাশে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত কিছু পত্র-পত্রিকা। আর একপাশে সুন্দর একটি পাত্রে সাজানো আতা, খেজুর, আপেল, আঙুর, কলা। আর একটি পাত্রে আখরোট, খেজুর, কাঠবাদাম, পেস্তা, কাজু ইত্যাদি শুকনো ফল। একটা বেতের ধামায় ডিমের খোসা। হুজুরের দাবি, আধুনিক চিকিৎসা যে রোগীদের রোগমুক্ত করতে পারেনি, যে মহিলাদের মা হওয়ার অধিকার দিতে পারেনি, হুজুরের দোয়ায় তাঁরাই রোগমুক্ত হয়েছেন, কোল ভরে সন্তান এসেছে। দাবির সমর্থনে একগাদা পত্র-পত্রিকা আমার ও কুমারের সামনে হাজির করলেন। গাদা গাদা দম্পতির ছবি। এ-সবই নিঃসন্তানের সন্তান লাভের প্রমাণ-পত্র। বর্তমান দিনকাল-এর ২৬ জানুয়ারি-২৮ জানুয়ারি '৯১ সংখ্যাটি তুলে দিলেন। প্রচ্ছদ জুড়ে হুজুরের ছবি। ইনসেটে কলকাতার সাক্ষাৎপ্রার্থীদের ভিড়ের রঙিন ছবি। বইয়ের ভেতর বহু পাতাই শুধু কলকাতার ভক্তদের ভিড়ের নানা ছবিতে ঠাসা।
প্রশ্ন রাখলাম, 'স্বামী জন্মদানে অক্ষম, সেক্ষেত্রেও স্ত্রীর পক্ষে মা হওয়া সম্ভব। কিন্তু যে মহিলার সন্তান-ধারণ ক্ষমতাই নেই তিনিও আপনার দোয়ায় মা হয়েছেন-এমনটা কি ঘটেছে?'
মিষ্টি বাঙাল ভাষায় হুজুর বললেন, 'আল্লার রহমতে, দোয়ায় সবই সম্ভব। তিনি চাইলে পুরুষ মানুষেরও বাচ্চা হইবো। মেয়েরা হইল গিয়া মায়ের জাত। মা হওনের মধ্যেই তাগো জীবনের সার্থকতা, পূর্ণতা। তাই কেউ যখন মা হওনের বাসনায় আমার কাছে আসে, তারে ফিরাইতে পারি না।'
'সে-ক্ষেত্রে আপনি কী করেন?' জিজ্ঞেস করলাম।
'নিঃসন্তান দম্পতিকে আনতে হয় একটা কাঁচা ডিম ও একটা পাকা কলা। ডিম ধইরা থাকেন বউ। আমি দোয়া পইড়া ডিমে তিনবার টোকা দেই। আল্লার রহমত হইলে কাঁচা ডিম মুহূর্তে সিদ্ধ হয়। ডিমের কুসুম খাইতে বলি মা'রে। কলায় দোয়া পইড়া খাইতে বলি মা'রে।'
'আর রোগের ক্ষেত্রে?'
'কাগজে লেখা দোয়া দেই। রোগ বিশেষে দোয়ার কাগজ পানীতে ডুবাইয়া রাইখ্যা, সেই পানী দিনে একবার খাইতে কই। এই পানী সাতদিন থিক্যা আরও বেশি দিন পর্যন্ত খাইতে হইতে পারে। আবার কোনও ক্ষেত্রে দোয়ার কাগজ তেলে ডুবাইয়া রাইখ্যা সেই তেল মালিশ করতে কই। এই মালিশও সাত দিন থিক্যা বেশি দিন পর্যন্ত নির্দেশ দেই।'
তিন টোকায় ডিম সেদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটা দেখে একবার আমার চোখকে সার্থক করতে চাইলাম। দেখলাম পাঁচটি দম্পতি আমাদের সামনে একে একে এলেন। একটি করে দম্পতি ঘরে ঢুকছিলেন। হুজুর প্রতিটি মহিলাকেই 'মা' সম্বোধন করে তার মুখোমুখি বসাচ্ছিলেন। দুজনের মাঝে জলচৌকি। আমি পাশে বসে দেখছিলাম। কুমার ছবি তুলছিলেন। দম্পতির কাছে হুজুর সমস্যা জানতে চাইছিলেন। পাঁচ দম্পতিই এসেছেন সন্তান কামনায়। 'ডাক্তার দেখিয়েছিলেন? কতকদিন ধরে চিকিৎসা করাচ্ছেন? ডাক্তার কী বলেছেন?' ইত্যাদি প্রশ্নগুলো পরম মমতায় জিজ্ঞেস করছিলেন হুজুর। তারপর পাঁচজনকেই জিজ্ঞেস করলেন- 'কাঁচা ডিম আর পাকা কলা আনছেন?' প্রত্যেকেই এনেছিলেন। মহিলার হাত থেকে ডিমটা নিয়ে হুজুর জলে ডিমটা ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে জলটুকু মুছে ডিমটা তুলে দিচ্ছিলেন মহিলাটির হাতে। তারপর কয়েক সেকেন্ড দোয়া পড়ে ডিমে আঘাত করছিলেন প্রতিটি ক্ষেত্রে। ডিমের খোলা ফেটে যাচ্ছিল। পাঁচটার মধ্যে তিনটি ক্ষেত্রে ডিম কাঁচাই রয়ে গেল। দুটি ক্ষেত্রে অবাক হয়ে দেখলাম ডিম সেদ্ধ হয়ে গেছে! যাদের ক্ষেত্রে সেদ্ধ হয়নি, তাঁরা যে আল্লার রহমত পাননি, সে কথা অত্যন্ত দুঃখ ও বিনয় মিশিয়ে দম্পতিকে জানিয়ে দিচ্ছিলেন হুজুর। যে দু-জনের ডিম সেদ্ধ হলো, তাঁদের কাছে জানতে চাইলেন কলা এনেছেন কি? কলায় দুয়া পড়ে দিয়ে হুজুর সামান্য ইশারা করতেই হাজির দরজার গোড়ায় অপেক্ষামান কোনও শিষ্য। হুজুর আদেশ দিচ্ছেন-'এনারে সব নিয়ম কানুন ভালো কইরা বুঝাইয়া দাও।' দম্পতিদের নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন শিষ্যরা। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে দুজনেরই ডিম সিদ্ধ হয়েছে, তাদের সন্তান না হওয়ার কারণ স্বামীর অক্ষমতা। যে তিনজনের ডিম কাঁচা ছিল, সেই তিনজনই জানিয়ে ছিলেন সন্তান না হওয়ার কারণ স্ত্রী'র অক্ষমতা। হুজুর আমাদের ফল খাওয়ালেন। এবং জানালেন, 'আজ আর নয়। কাল আসেন রোগীগো নিয়া।' তারপর আমাকে বললেন, 'কাল রিক্সায় বল বেয়ারিংয়ের একটা লোহার বল অবশ্যই আনবেন।' কেন লোহার বল বেয়ারিং? এই প্রশ্নটা ভাবতে ভাবতে বারান্দায় পা বাড়াতেই দেখলাম শেষ দম্পতির মহিলা দুই শিষ্যের সঙ্গে একটা ঘরে ঢুকছেন। দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। সিঁড়ির গোড়ায় এখন দম্পতির পুরুষটি। জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনার স্ত্রীকে দেখতে পাচ্ছি না তো?'
'ও কিছু নিয়ম টিয়মগুলো বুঝে আসছে।' বললেন, সরল মানুষটি।
আজ ভিড় আরও বেশি। আমরা অবশ্য চটপট্ ওপরে যাওয়ার সুযোগ পেলাম। আমাদের পথম রোগী শ্যামলী নাথ। ঠিকানা: ১১/৫ যোগীপাড়া রোড, কলকাতা- ২৮। থ্যালাসেমিয়া রোগী। হুজুর বললেন, 'তোমার তো মা টিবি হইছে।' হুজুরের রোগ নির্ণয়ে এমন জব্বর ভুল দেখে শ্যামলী হুজুরের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিল। আমি সামাল দিলাম। হুজুরের দু-পাশেই দু-সারিতে সবুজ ও লাল কালিতে ছাপানো দোয়ার কাগজ রয়েছে। সবুজ কাগজটা দিয়ে বললেন, 'এটা জলে বিয়ে সকালে রাতে দুবেলা খাবেন এক মাস। লাল কাগজটা তেলে ডুবিয়ে সেই তেল বুকে পিঠে মালিশ করবেন এক মাস।' সাড়ে দশ বছরের মিতালি মুখার্জি থাকে ১২৬-এ সুকান্ত সরণি, কলকাতা ৮৫-তে। নেফ্রাটিসে ভুগছে। রোগের কথা বলায় হুজুর বললেন, 'বয়স কত?' বয়স শুনে জানালেন বারো বছরের নিচে কারও জন্য দোয়া করেন না। ননী ভৌমিক ২০/১বি জে এন ব্যানার্জি লেন, কলকাতা ৩৬-এর বাসিন্দা। হাঁপানিতে ভুগছেন কুড়ি বছর ধরে। তাঁকেও সবুজ ও লাল দোয়া দিলেন। জলে ভিজিয়ে পান করতে ও তেল মালিশ করতে বললেন। বেলেঘাটার কোলে ব্যারাকের তিমিরবরণ ঘোষদস্তিদার ও জয়া ঘোষদস্তিদার হাজির হলেন সন্তান কামনায়। জয়ার হাতের ডিমটা হুজুর নিয়ে একটা স্টিলের বাটিতে রেখে একটা বোতল জল ঢাললেন বাটিতে। ডিমটা একটু ধুয়ে তোয়ালেতে মুড়ে জয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে কয়েক সেকেন্ড দোয়া পড়ে একটা স্টিলের চামচ দিয়ে আঘাত করলেন ডিমে। খোলা ভেঙে যেতেই দেখা গেল ডিমটা সিদ্ধ হয়ে গেছে। আরও অবাক কাণ্ড কাঁচা ডিমে ডট পেনে দেওয়া চিহ্ন নেই এই ডিমে। জয়া, তিমির, কুমার এবং আমি ডিম পরীক্ষা করে স্পষ্টতই বুঝলাম ডিমটা পাল্টে দেওয়া হয়েছে তোয়ালে দিয়ে মোছার সময়ে। হুজুর একজন বড় দরের জাদুকর মাত্র। হাতটা সত্যিই ভালো। হুজুরের বিশাল ভাড়াটে সৈন্য-সামন্তের সামনে এই মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হঠকারিতা বিবেচনায় আমরা চুপ করে থাকতে বাধ্য হলাম। এরপরই ঢুকলেন আর এক হিন্দিভাষী দম্পতি। আমাকে ও কুমারকে হুজুর থাকতে বললেন। মহিলা ডিম বের করলেন, ডিমের গায়ে নীলাভ আভা দেখে হুজুর বললেন, 'এই ডিমে হবে না, সাদা ডিম নিয়ে আসতে হবে।' বুঝলাম, নীলাভ সিদ্ধ ডিম না থাকাতেই হুজুর তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা দেখানো থেকে বিরত থাকলেন। এবার আমার হাত থেকে লোহার গুলিটা চেয়ে নিয়ে একটা লাল দোয়া লেখা কাগজে রেখে কাগজটা মুড়িয়ে একটা উর্দু লেখা কবচে ঢুকিয়ে মোম দিয়ে কবচের মুখ বন্ধ করে কালো সুতো দিয়ে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে বললেন, 'এখন দশটা পঁচিশ। ঠিক একটা পঁচিশের পর কবচটা খুলে যদি দেখেন আল্লার রহমতে লোহা সোনা হয়ে গেছে, তবে আপনি এখানে সোজা চলে আসবেন। তিন ঘণ্টার আগে খুলবেন না। তবে কিন্তু রহমত পাবেন না, লোহা লোহাই থেকে যাবে।'
রিসেপশন কাউন্টারে দেখা পেলাম উর্দু পত্রিকার সাংবাদিকটির। তাঁর হাতেই খামবন্দি একটা চিঠি দিয়ে বললাম, 'এটা হুজুর সাহেবকে দেওয়ার কথা ছিল। আর উঠব না। আপনি প্লিজ এটা হুজুর সাহেবের হাতে দিয়ে দেবেন।'
'কিচ্ছু চিন্তা করবেন না, এক্ষুনি দিয়ে দিচ্ছি।'
Comments