মনুসংহিতা [৯:৩]
নারীকে-
"পিতা রক্ষা করবে কুমারীকালে, স্বামী রক্ষা করবে যৌবনে।
বার্ধক্যে রক্ষা করবে পুত্ররা, স্ত্রী স্বাধীনতার যোগা নয়।"
মনুসংহিতা [২:৬৭]
"বিয়েই নারীর বৈদিক উপনয়ন।
পতিসেবাই গুরুগৃহবাস, গৃহকর্মই হোমস্বরূপ অগ্নিপরিচর্যা।"
মনুসংহিতা [৫:১৫৪]
"পতি সদাচারহীন, পরস্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কযুক্ত বা গুণহীন হলেও সতী স্ত্রী সেই পতিকে দেবতার মতই পুজো করবে।"
মনুসংহিতা [৫:১৫৫]
"স্ত্রী'র স্বামী ছাড়া পৃথক যজ্ঞ নেই, পতির অনুমতি ছাড়া ব্রত বা উপবাস নেই। নারী স্বর্গে যেতে পারে কেবলমাত্র স্বামী-সেবার সাহায্যেই।"
তৈত্তিরীয় সংহিতা [৬/৬/৮৫]
"যজমান, দীক্ষার দিনে গণিকা সাহচর্য বর্জন করবেন, তার পরদিন পরস্ত্রীর সাহচর্য এবং তৃতীয় দিন নিজ স্ত্রীর সাহচর্য বর্জন করবেন।"
মনুসংহিতা [৯:৪]
"নিঃসন্তান স্ত্রীকে বিয়ের দশ বছর পর ত্যাগ করা যায়, যে স্ত্রী শুধুমাত্র কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় তাকে ত্যাগ করা যায় বারো বছর পরে, মৃত সন্তানের জন্মদানকারী স্ত্রীকে ত্যাগ করা যায় পনের বছর পরে।"
মনু [৯:১৪] ঝগড়ুটে স্ত্রীকে তক্ষুনি ত্যাগ করার অধিকার দিয়েছেন। কিন্তু ঝগড়ুটে শুধু নয়, অত্যাচারী স্বামীকেও দেবতা জ্ঞানে পুজো করতে বলেছেন।
মহাভারত অনুশাসনপর্ব: ৩৮
"তুলাদণ্ডের একদিকে যম, বায়ু মৃত্যু, পাতাল, বাড়বানল, ক্ষুরধার বিষ, সর্প ও বহ্নিকে রেখে অপরদিকে নারীকে স্থাপন করলে ভয়ানকত্বে উভয়ে সমান সমান হবে।"
দেবীভাগবত [৯:১]
"নারীরা জোঁকের মত সতত পুরুষের রক্তপান করে থাকে। মূর্খ পুরুষ তা বুঝতে পারে না, কেননা তারা নারীর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে পড়ে। পুরুষ যাকে পত্নী মনে করে, সেই পত্নী সুখসম্ভোগ দিয়ে বীর্য এবং কুটিল প্রেমালাপে ধন ও মন সবই হরণ করে।"
মনুসংহিতা [৯:১৫]
"পুরুষ দেখামাত্রই তারা মেতে ওঠে বলে তারা চঞ্চলচিত্ত ও স্নেহশূন্য; তাই সুরক্ষিত রাখা হলেও তারা স্বামীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়।"
বৃহদারণ্যক উপনিষদ [১:৯:২:১৪]
"লাঠি দিয়ে মেরে নারীকে দুর্বল করা উচিত, যাতে নিজের দেহ বা সম্পত্তির উপরে আর কোনও অধিকার না থাকে।"
মনুসংহিতা [৯:২২]
"নদী যেমন সমুদ্রের সঙ্গে মিলনে নোনা হয়, নারীও তেমন; যেমন পুরুষের সঙ্গে বিবাহ হয়, তেমন পুরুষের গুণযুক্ত হয়।"
মহাভারতে ঋষি কুণির কন্যা সারাজীবন ধর্মপথে থেকে মৃত্যুশয্যায় জানতে পারলেন, চূড়ান্ত ধর্মপালনও একজন নারীর স্বর্গলাভের পক্ষে যথেষ্ট নয়। স্বর্গ প্রাপ্তির জন্য তাকে বিয়ে করতেই হবে। পুরুষদের কিন্তু স্বগে যেতে 'চিরকুমার' থাকা কোনও বাধা নয়।
মনুসংহিতা [৫:১৫৭]
"পতির মৃত্যুর পর পত্নী ফলমূলের স্বল্পাহার দ্বারা দেহ ক্ষয় করবে, তবু পর পুরুষের নাম করবে না।"
মনুসংহিতা [৫ঃ১৬৮]
"পত্নীর মৃত্যু হলে দাহ ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষে পুরুষ আবার বিয়ে করবে।"
..................................................................................
মনুসংহিতা [১: ৯৯]
"ক্ষুন্ন না হয়ে, প্রসন্নমনে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের সেবা করা শূদ্রগণের প্রধান কর্তব্য, এই নির্দেশ ব্রহ্মা দিলেন।"
'শূদ্র' নামের এই দাসদের পারিশ্রমিক বা বেতন দিতে হতো না। মনু বলেছেন - দাসত্বের কাজ নির্বাহ করার জন্য বিধাতা শূদ্রকে সৃষ্টি করেছেন[৮ঃ৪১৩]। কিন্তু দাসদের বাঁচিয়ে তো রাখতে হবে, বেগার খাটাবার জন্যই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। শিল্প ও কৃষির দ্বারা নিজেদের ভোগকে চরিতার্থ করার জন্য এসব শিল্প দাস ও কৃষিদাসদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সেজন্য মনু বিধান দিয়েছেন - শূদ্র ভৃত্যকে উচ্ছিষ্ট অন্ন, জীর্ণ বসন, জীর্ণ শয্যা বা ঘর দান করিবে [১০:১২৫]।
প্রায় বিনাখরচে শ্রমশক্তি বিনিয়োগের প্রয়োজনেই উচ্চবিত্তরা সৃষ্টি করেছিল 'শূদ্র' নামের বর্ণটি। আর সেই সৃষ্টির কাজে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল 'ঈশ্বর-নির্ভর ধর্ম'। ধর্মের নামে, ঈশ্বরের নির্দেশের নামে সেদিন শূদ্রদের 'মানুষ' বলে বিবেচিত হওয়ার সব অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছিল।
শূদ্রদের ধন উপার্জনের অধিকার ছিল, কিন্তু সেই ধন ভোগের কোনও অধিকার ছিল না। সব উপার্জিত ধনই দাস-মালিক গ্রহণ করবে, এই ছিল মনুর বিধান [৮:৪১৬ এবং ৪১৭]।
শূদ্রদের আর তিন বর্ণ থেকে আলাদা করে যাতে চেনা যায় এবং শূদ্ররা যেন প্রতিটি মুহূর্তে মনে রাখে তিন বর্ণের মানুষদের ক্রীতদাস হয়ে সেবা করার জন্যই তাদের জন্ম, তিন বর্ণের মানুষদের থেকে তারা ভিন্নতর জীব, মনুষ্যেতর জীব; সেজন্য শূদ্রদের প্রতি মাসে কেশ মুণ্ডনের নির্দেশ দিয়েছেন মনু। [৫:১৪০]
কথিত ঈশ্বরের নির্দেশে শূদ্রের না ছিল নাগরিক অধিকার, না ছিল ধর্মীয় অধিকার, না অর্থনৈতিক অধিকার।
......................................................................................
আসুন, আমরা বরং অসবর্ণ বিয়ের শুরুর ইতিহাসে ফিরি। মনু তাঁর বিধানে অসবর্ণ বিয়েকে অনুমোদন করেছিলেন। তবে একটি শর্ত ছিল। কোনও পুরুষ অন্য বর্ণের বা অন্য জাতের নারীকে বিয়ে করার আগে একটি সবর্ণের, অর্থাৎ নিজের জাতের মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। তারপর কাম প্রবৃত্তির দ্বারা চালিত হয়ে কোনও নারীকে স্ত্রী করতে চাইলে উচ্চ বর্ণের পুরুষ নিম্ন বর্ণের নারীকে বিয়ের জন্য গ্রহণ করতে পারতো। মনুসংহিতার তৃতীয় অধ্যায়ের ১২ তম শ্লোকে আছে:
"সবর্ণাগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকর্মাণি।
কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশো বরাঃ।
আর্য যুগে কামতাড়িত হয়ে ব্রাহ্মণ পুরুষ ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র নারীকে; ক্ষত্রিয় পুরুষ বৈশ্য ও শূদ্র নারীকে এবং বৈশ্য পুরুষ শূদ্র নারীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারতো। এই ধরনের বিয়েকে 'অনুলোম' বিয়ে বলা হতো। অনুলোম বিয়ের আগে একটি আবশ্যিক শর্ত পুরুষটিকে পালন করতে হতো। পুরুষটির একটি সবর্ণা স্ত্রী থাকলে তবেই সে অনুলোম বিয়ে করার অধিকার লাভ করতো। অনুলোম বিয়ে অবশ্য সমাজে খুবই নিন্দিত ছিল।
শূদ্র পুরুষদের উচ্চ জাতীয় নারীকে বিয়ে করা নিষিদ্ধ ছিল। নিম্ন বর্ণের পুরুষের উচ্চ বর্ণের নারীকে বিয়ে করা শাস্ত্রানুমোদিত ছিল না। এই ধরনের অ-অনুমোদিত বিয়েকে বলা হতো 'প্রতিলোম' বিয়ে।
মনুর মতে শূদ্রাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলে ব্রাহ্মণ পতিত হয়। (মনুসংহিতা, ৩য় অধ্যায়, শ্লোক ১৬ ও ১৭)। ব্রাহ্মণের শূদ্র নারীকে বিয়ে করার ব্যাপারে মনুর তথা সনাতন হিন্দুত্ববাদীদের আপত্তি তখনও ঘোরতর। এখনও কোনও ব্রাহ্মণ নিম্ন বর্ণের নারীকে বিয়ে করলে সেই গ্রাম বা অঞ্চলের মানুষ তাকে আর পুজো-আচার পুরোহিত হিসেবে ডাকে না। এমনকি কোনও পুরোহিত পরিবারের পুরুষ কোনও নিম্ন বর্ণের নারীকে বিয়ে করলেও সেই পরিবারের পুরোহিতরা পুজো করার অধিকার হারায়।
এতটা প্রবল আপত্তি অবশ্য ক্ষত্রিয়ের শূদ্রা বিয়ে করার ব্যাপারে মনুর ছিল না। বৈশ্যের শূদ্রা বিয়ে করার ব্যাপারে আপত্তি ছিল আরও স্তিমিত।
বৈদিক সমাজে 'অনুলোম' বা উচ্চবর্ণ পুরুষদের অসবর্ণ বিয়ে কম হলেও হতো। শ্রমজীবী শূদ্র মেয়েদের দেহ সৌন্দর্যের কারণেই এই ধরনের বিয়ে হতো। তবে এই বিয়ে কখনই 'প্রজাপত্য বিবাহ'-এর মর্যাদা পায়নি।
আর্য সমাজে আট রকমের বিয়ের কথা আমরা পাই। মনুই এই আট রকমের বিয়ের সংজ্ঞা ঠিক করে দিয়েছিলেন।
(এক) ব্রাহ্ম বিবাহ
"শাস্ত্র জ্ঞানসম্পন্ন ও চরিত্রবান পাত্রকে কন্যা পক্ষীয়েরা স্বয়ং আহ্বান করে, যথোচিত অভ্যর্থনা করে কন্যাকে সুচারু বস্ত্রে আচ্ছাদিত ও অলংকারে ভূষিত করে, ওই পাত্রকে যদি সম্প্রদান করেন, তবে তাকে 'ব্রাহ্ম বিবাহ' বলে (মনুসংহিতা, তৃতীয় অধ্যায়, শ্লোক ২৭)"
(দুই) দৈব বিবাহ
"যজ্ঞের অনুষ্ঠানকালে সেই যজ্ঞে যিনি পৌরোহিত্য করেন, তাঁকে যদি যজ্ঞের আয়োজক সালঙ্কারা কন্যা দান করেন, তবে সেই বিবাহকে বলে 'দৈব বিবাহ' (মনুসংহিতা, তৃতীয় অধ্যায়, শ্লোক ২৮)"।
(তিন) আর্য বিবাহ
"পাত্রের কাছ থেকে একটি গাভী ও একটি বৃষ, অথবা দুইটি গাভী ও দুইটি বৃষ নিয়ে ওই পাত্রকে যখন কন্যাদান করা হয়, তখন সেই বিবাহকে বলে 'আর্য বিবাহ' (মনুসংহিতা, তৃতীয় অধ্যায়, শ্লোক ২৯)।"
(চার) প্রজাপত্য বিবাহ
"পাত্র ও পাত্রী দু'জনে মিলে একসাথে গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করবে - বরের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর যথাবিধি অলংকার, বস্ত্র প্রভৃতির দ্বারা সুচারু-সজ্জিত কন্যাকে পাত্রের কাছে সম্প্রদান করে যে বিবাহ, তাকে বলে 'প্রজাপত্য বিবাহ' (মনুসংহিতা, তৃতীয় অধ্যায়, শ্লোক ৩০)।"
(পাঁচ) অসুর বিবাহ
"কন্যার পিতা ও অন্য গুরুজনকে যথেষ্ট ধন দানের মধ্য দিয়ে সন্তুষ্টি উৎপাদন করে কন্যাকে পাত্র কর্তৃক গ্রহণ করাকে বলে 'অসুর বিবাহ' (মনুসংহিতা, তৃতীয় অধ্যায়, শ্লোক ৩১)।"
'অসুর বিবাহ' শাস্ত্রমতে বিয়ে নয়। এই বিয়ে সাধারণত অসবর্ণ বিয়ে। পাত্র স্বেচ্ছায় কন্যার আত্মীয়-স্বজনকে ও কন্যাকে ধন দিয়ে কন্যাকে গ্রহণ করে থাকে। আর্য বিবাহের সঙ্গে রাক্ষস বিবাহের প্রধান পার্থক্য হলো, শাস্ত্রই আর্য বিবাহে 'এক-জোড়া গরু' অথবা 'দু-জোড়া গরু' কন্যাপক্ষকে পাত্র দেবে - এই বিধান দিয়েছে। আর্য-বিবাহ শাস্ত্রসম্মত বিয়ে। এই বিয়ে পাত্র ও পাত্রীর বাবা-মা, আত্মীয়রা ঠিক করেন। পাত্রের এই গো-দান সৌজন্যতার প্রতীক।
অসুর বিবাহে পাত্রীর রূপে-গুণে আকৃষ্ট হয়ে পাত্র দাম দিয়ে কন্যাকে কিনে নিয়ে বিয়ে করে। অসুর বিবাহে কন্যাপক্ষ কন্যাকে পাত্রের কাছে বিক্রি করে। মনুর মতে এই বিয়ে নিন্দনীয়।
"কন্যা বিক্রি করা গো-বধের মতোই পাপ কাজ (মনুসংহিতা, তৃতীয় অধ্যায়, শ্লোক ৫১)।"
অসুর বিয়ে শাস্ত্রসম্মত বিয়ে ছিল না। এই বিয়ে আর্য সমাজে নিন্দিত ছিল। তবু শেষ পর্যন্ত এই বিয়েকে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়ারও ব্যবস্থা ছিল। এর একটি কারণ যেমন উচ্চ বর্ণের কামনা-বাসনাকে রক্ষা করা, অপর কারণটি সম্ভবত নিপীড়িতা কন্যার ভবিষ্যৎ নিশ্চিন্ত করা।
(ছয়) গান্ধর্ব বিবাহ
"পাত্র-পাত্রী পরস্পরের প্রতি অনুরাগবশত যখন দেহ মিলনে আবদ্ধ হয়, তখন তাকে 'গান্ধর্ব বিবাহ' বলে। এই বিবাহ পাত্র-পাত্রীর গুরুজনের অনুমতির অপেক্ষা না করে মৈথুন ইচ্ছায় ঘটে থাকে (মনুসংহিতা, তৃতীয় অধ্যায়, শ্লোক ৩২)।"
গান্ধর্ব বিবাহের পরবর্তীকালে এই বিবাহ হোমাদি দ্বারা সিদ্ধ করে নেওয়ার বিধান ছিল। যেহেতু সেসময় রাজপুরুষরা রূপে বা গুণে মুগ্ধ হয়ে বহু নারীর সঙ্গেই মিলিত হতেন, তাই রাজপুরুষদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে আর্য সমাজ 'গান্ধর্ব বিবাহ'-কে অনুমোদন করেছিল। এমনকি রাজপুরুষ যৌন সঙ্গিনীকে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে চাইলে যেন দিতে পারে, সে কথা মাথায় রেখেই হোম করে গান্ধর্ব বিয়েকে সিদ্ধ করার বিধান দেওয়া হয়েছিল। উদাহরণ: কালিদাসের কাহিনিতে শকুন্তলা ও দুষ্মন্তর বিয়ে।
(সাত) রাক্ষস বিবাহ
"কন্যাকে জোর-পূর্বক হরণ করে বিয়ে করাকে বলে 'রাক্ষস বিবাহ' (মনুসংহিতা, তৃতীয় অধ্যায়, শ্লোক ৩৩)।"
যেহেতু রাজপুরুষরাই এই ধরনের রাক্ষস বিবাহ করার মতো শক্তিধর ছিলেন, তাই রাজপুরুষদের তুষ্টি বিধানের জন্য আর্য সমাজের পুরোহিতরা এই রাক্ষস বিবাহকে বিবাহ সংস্কার দ্বারা সিদ্ধ করার বিধান দিয়েছিলেন।
(আট) পৈশাচ বিবাহ
"নিদ্রায় অভিভূতা, মদ্যপানে বিহ্বলা, অপ্রকৃতিস্থা নারীকে নির্জনে নিয়ে গিয়ে পুরুষ যদি বলপূর্বক সম্ভোগ করে, তবে তাকে বলে 'পৈশাচ বিবাহ' (মনুসংহিতা, তৃতীয় অধ্যায়, শ্লোক ৩৪)।"
এই ধরনের বিবাহকেও পরবর্তীকালে বিবাহ সংস্কার দ্বারা সিদ্ধ করার বিধান দিয়েছিলেন আর্য সমাজের ধর্মগুরুরা। এই ধরনের বিয়েকে সিদ্ধ করার বিধান দেওয়ার পিছনে শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে পুরোহিত গোষ্ঠীর বা ক্ষত্রিয় বর্ণের সঙ্গে ব্রাহ্মণ বর্ণের সমঝোতাই ছিল প্রধান কারণ। সম্ভবত তারই সঙ্গে ছিল ধর্ষিতা কন্যার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা।
আর্য সাহিত্যে বা বৈদিক সাহিত্যে আমরা গান্ধর্ব বিয়ে ও রাক্ষস বিয়ের অনেক কাহিনি পাই। কাহিনিগুলোতে গান্ধর্ব বিয়েকে আদি রসে ও প্রেম রসে জারিত করে 'মহান' করার একটা কুশলী চেষ্টা রয়েছে। রাক্ষস বিয়ের বেলায় পাত্রকে মহানায়ক করা হয়েছে। তার বীরত্বকে 'মহান' করে তোলা হয়েছে। সাম্প্রতিককালে অবশ্য গান্ধর্ব বিয়ে ও রাক্ষস বিয়ে তার গৌরব হারিয়েছে এবং কন্যার গুরুজন দ্বারা কন্যা সম্প্রদানকেই গৌরবজনক বলে মনে করা হয়।
- 'প্রবাদ-সংস্কার-কুসংস্কার (১ম)', প্রবীর ঘোষ
.....................................................................................
'ব্যভিচারিণী' বলতে মনু ছয়টি 'ব্যভিচার দোষের' নারীকে চিহ্নিত করেছেন - স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ, যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ানো, অসময়ে ঘুম, নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে দীর্ঘদিন থাকা, মদ্যপান, খারাপ পুরুষের সংসর্গ!!
(মনুসংহিতা, অধ্যায় ৯, শ্লোক ১৩)
......................................................................................
মনুই আর্য শাসিত সমাজে বর্ণভিত্তিক বিভাজন তৈরি করেন। চারটি বর্ণ হলো - ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র।
"ত্রিভুবনের প্রজা বৃদ্ধির জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজের মুখ, বাহু, উরু ও পা থেকে যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণের সৃষ্টি করলেন (মনুসংহিতার অধ্যায় ১, শ্লোক ৩১)।"
মনুর সমাজ ব্যবস্থায় চার বর্ণের কাজ ভাগ করে দেওয়া হলো। ব্রাহ্মণদের কাজ তথা ধর্ম হলো - অধ্যাপনা, অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দানগ্রহণ। ক্ষত্রিয়ের কাজ তথা ধর্ম হলো - প্রজাপালন, অধ্যয়ন, দান, যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করা। বৈশ্যদের কাজ হলো - পশুপালন, বাণিজ্য, কৃষিকর্ম, ধনের বৃদ্ধির জন্য ঋণদান, অধ্যয়ন, দান ও যজ্ঞের আয়োজন করা। শূদ্রদের কাজ হলো - কোনও রকম ঈর্ষা, দ্বেষ না রেখে, বিষাদগ্রস্ত না হয়ে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন বর্ণের সেবা করা। এই চার বর্ণের বাইরের ভারতবাসীদের মনু চিহ্নিত করেছিলেন 'দস্যু' হিসেবে।
মনু তাঁর তৈরি অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থাকে কায়েম রাখতে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী ও শাসক গোষ্ঠীর আঁতাত অবশ্য প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছিলেন।
মনু বলছেন, "ব্রাহ্মণ ছাড়া ক্ষত্রিয়ের সমৃদ্ধি হয় না; আবার এইরকম ক্ষত্রিয় রাজার সাহায্য ছাড়া ব্রাহ্মণের পক্ষেও সম্পত্তি লাভ প্রভৃতি উন্নতি সম্ভব নয়। কিন্তু উভয় বর্ণ একত্র মিলিত হলেই তাঁরা সমগ্র জগৎ জয় করতে পারেন (মনুসংহিতা, ৯ম অধ্যায়, শ্লোক ৩২২)।"
অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থাকে স্থায়িত্ব দিতে আজও মনুর এই নীতিকে শাসকগোষ্ঠীরা মান্য করে চলেন। মনুর এই নীতি যে শেষ পর্যন্ত শোষণ ব্যবস্থা চালু রাখার দুর্নীতি ছাড়া কিছু নয়, এই সত্য বোঝাতে বাড়তি শব্দ প্রয়োগের কোনও প্রয়োজন দেখি না।
মনুর বিধান মতে - দাসত্বই শূদ্রের স্বাভাবিক ধর্ম। দাসদের কেনাবেচার পুরো হক ছিল দাস মালিক ও ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যদের। (মনুসংহিতা, অধ্যায় ৮ম, শ্লোক ৪১৩)।
দাসদের কি এই দাসত্ব প্রথার মতো অমানবিক প্রথা থেকে মুক্তি ছিল না? উত্তর - না।
"স্বামী কর্তৃক বিমুক্ত হলেও শূদ্র দাসত্ব থেকে বিমুক্ত হয় না। দাসত্ব কর্ম তার স্বাভাবিক, অতএব কে তাকে মুক্ত করতে পারে?" (মনুসংহিতা, অধ্যায় ৮ম, শ্লোক ৪১৪)
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের দিয়ে দাসের কোনও কাজ করানো ছিল অপরাধ। এই রকম অপরাধের জন্য ছয়শ পণ অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে। শূদ্ররাই কেবলমাত্র দাস হতো। দাসদের সাতটি ভাগে ভাগ করেছিলেন মনু।
(১) ধ্বজাহৃত - যুদ্ধে জয় করে যাকে দাস করা হয়েছে। যুদ্ধে পরাজিত হলেও ক্ষত্রিয়কে দাস হতে হতো না। পরাজিত ক্ষত্রিয় প্রভুর দাসেরা বিজয়ীর দাসে পরিণত হতো।
(২) ভক্তদাস - খেতে পাওয়ার আশায় যারা দাসত্ব স্বীকার করতো।
(৩) গৃহজ - ক্রীতদাসীদের গর্ভজাত সন্তান-সন্ততিরা ক্রীতদাসীর প্রভুর দাস-দাসী হয়ে যেতো।
(৪) ক্রীতদাস - আগের মালিকের কাছ থেকে যাকে কেনা হয়েছে।
(৫) দত্রিম - দাস মালিক পুণ্যলাভের আশায় অথবা ভালোবাসার দান হিসেবে কাউকে যখন দাস দান করতো।
(৬) পৈত্রিক - যারা বংশানুক্রমিকভাবে দাসত্ব করছে।
(৭) দণ্ডদাস - রাজার দেওয়া দণ্ড নিতে অস্বীকার করে যারা দাসত্ব মেনে নিতো। সাধারণত ভয়ংকর নিষ্ঠুর মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচতে এরা দাসত্ব করে বাঁচতে চাইতো। এই ধরনের দাসরা শূদ্র ছাড়া অন্য বর্ণেরও হতে পারতো। এইক্ষেত্রে আমরা দেখতে পেলাম মনুর বিধানের স্ববিরোধিতা। এমনি স্ববিরোধিতা অবশ্য আরও আছে অনেক জায়গাতেই।
মনু অবশ্য শূদ্র দাসদের দিনযাপন যাতে ভালোভাবে হয়, তার বিধান দিলেন। বললেন, "শূদ্র ভৃত্যকে উচ্ছিষ্ট অন্ন, জীর্ণ বসন, জীর্ণ শয্যা, শস্যহীন ধান দান করবে (মনুসংহিতা, ১০ম অধ্যায়, শ্লোক ১২৫)।"
সত্যি, কি মানবিক ব্যবস্থা বলুন তো! বিশ্রামহীন হাড়ভাঙা খাটুনির পর তাদের কাছ থেকে পরের দিনের শ্রম নিংড়ে নিতে দাস মালিকদের কি সুন্দর আর্যসুলভ বদান্যতা!
মনু অবশ্য একটা ভালো কাজ শূদ্রদের জন্য করেছিলেন। তাদের ধন অর্জনের অধিকার দিয়েছিলেন। এই অধিকারের সঙ্গে একটি 'তবে' যুক্ত করেছিলেন। বলেছিলেন, "তবে শূদ্র দাসের অর্জিত সব ধনই তার প্রভুকে দিয়ে দিতে হবে
(মনুসংহিতা, অধ্যায় ৮ম, শ্লোক ৮১৬ ও ৪১৭)।"
শূদ্র অচ্ছুত দাসেদের যাতে এক নজরেই চেনা যায়, তাই তাদের প্রতি মাসে মস্তক মুণ্ডন করতে হতো (মনুসংহিতা, অধ্যায় ৫, শ্লোক ১৪০)। নাম দেখেই যাতে দাস শূদ্রদের চেনা যায়, তাই মনু বিধান দিয়েছিলেন, "শূদ্রদের হীনতাবাচক নাম করতে হবে (মনুসংহিতা, ২য় অধ্যায়, শ্লোক ৩১)"। হীনতাবাচক নাম রাখাতেই শূদ্রদের অব্যাহতি নেই। বলা হলো, "নামের শেষে দাস ধরনের কোনও উপপদ যুক্ত করতে হবে (মনুসংহিতা, ২য় অধ্যায়, শ্লোক ৩২)।"
শূদ্র দাসদের প্রতি 'আর্য সভ্যতা'র যে দৃষ্টিকোণের পরিচয় আমরা পেলাম, তাতে 'আঙ্কেল টমস্ কেবিন'-এর নিষ্ঠুর করুণ কাহিনিও লজ্জা পাবে। এরপর মনুর হিন্দু ধর্মের এইসব বিধানকে 'কুসংস্কার' বলে ধিক্কার না দিলে ভবিষ্যতের ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
- প্রবাদ-সংস্কার-কুসংস্কার (১ম), প্রবীর ঘোষ
Comments