রাহুল সাংকৃত্যায়ন এর চোখে উগ্র হিন্দুত্ববাদ [পর্ব-দুই]
“....পুরকার থেকে ও জায়গা যৌধেয়দেরই ছিল। বহু প্রতাপশালী রাজা-মৌর্ষ, যবন, কেউই রাজকর আদায় করা ছাড়া আমাদের গণরাজ্যকে কোনো আঘাত করেনি। চন্দ্রগুপ্ত, যিনি নিজেকে বিক্রমাদিত্য বলেন এবং উজ্জয়িনীতে যাঁর দরবার বসে, সেই চন্দ্রগুপ্তের পূর্বপুরুষ যখন সিংহাসনে বসলো, তখন তারা যৌধেয়দের উচ্ছেদ করলো। যৌধেয়রা প্রতাপশালী সম্রাটকে কিছু কর দিতো, কিন্তু সম্রাট তাতে খুশী হলেন না। তিনি বললেন, ‘আমি এখানে উপরিক (গর্ভনর) নিযুক্ত করবো। এখানে আমার নিজের কুমারমাত্য (কমিশনার) থাকবে। আমি আমার সমগ্র রাজ্য যেভাবে শাসন করি, এখানেও তেমনি করবো। আমাদের গণ-নায়কগণ অনেক করে বোঝালো যে, যৌধেয়রা অনাদিকাল থেকে গণ-শাসন ছাড়া অপর কোনো শাসন জানে না; কিন্তু ক্ষমতামদমত্ত রাজা সে কথা মানে কেন? অবশেষে যৌধেয়রা আপন ইষ্ট গণদেবীর সামনে শপথ গ্রহণ করে তরবারি ধরলো। বহুবার তারা গুপ্ত সেনানীকে মেরে হঠিয়ে দিলো। যৌধেয়দের তুলনায় চার-পাচঁ গুণ বেশী সৈন্য নিয়েও গুপ্ত সেনানীরা রাজ্যটি করতে পারতো না। কিন্তু ব্রক্ষপুত্র থেকে মরু অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত সাম্রাজ্যের সমগ্র সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে যৌধেয়রা কতক্ষণ আপনাদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে পারে? গুপ্তদের সৈন্যেরা আমাদের শহর-গ্রাম সমস্ত ধ্বংস করে দিলো, নারীদের নৃশংসভাবে হত্যা করলো। আমাদের লোকেরা ত্রিশ বছর পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়েছিল। বেশী কর দিতেও তারা প্রস্তুত ছিল, কিন্তু চেয়েছিল, তাদের গণ-শাসন ব্যবস্থা যেন অক্ষুণ্ণ থাকে।”
“সৈন্য গণ-শাসন কেমন ছিল দাদু?”
“সেই শাসনে প্রত্যেকটি যৌধেয় মাথা উঁচু করে চলতো, কারও সামনে দীনতা প্রকাশ করতে তারা জানতো না। যুদ্ধ তাদের কাছে একটা খেলাবিশেষ ছিল। এই জন্যই তাদের বংশের নাম যৌধেয় হয়েছে!”
........................................................................................
“সে আরও প্রাচীন কথা ভাই। প্রথমে সর্বত্রই গণরাজ্য ছিল - রাজা বলে কিছুই ছিল না। সে সময় ব্রাক্ষণ আর ক্ষত্রিয়ের মাঝে কোনো প্রভেদ ছিল না।”
“ব্রক্ষ-ক্ষত্র একই বর্ণ ছিল দাদু?”
“হ্যাঁ, যখন প্রয়োজন হতো লোকে পূজা-পাঠ করতো এবং প্রয়োজন মতো অস্ত্র ধরতো। কিন্তু পরে বিশ্বামিত্র, বশিষ্ঠ এরা এসে বর্ণবিভাগ শুরু করলো।”
“ঠিক কথা, তাই তো এক পিতার দুই পুত্রের মধ্যে কেউ রন্তিদেবের মতো ক্ষত্রিয়, কেউ গৌরিথীতির মতো ব্রাক্ষণ ঋষি হতে লাগলেন।”
“এমন কথা কোথাও কেউ লিখেছে ভাই?”
“হ্যাঁ দাদু, বেদ এবং ইতিহাসে এমন কথা পাওয়া যায়। সংকৃতি ঋষির ঐ দুই পুত্র ছিল। এর চেয়েও কত বিচিত্র কথা পুরাণে পাওয়া যায়, যে সব কথা আজকালকার লোকে বিশ্বাস করে না। চর্মণবতী (চম্বল) তীরে দশপুর দেখেছ দাদু?”
...............................................................................................
“এই দশপুর রন্তিদেবের রাজধানী ছিল। আর চর্মণবতী নাম কি করে হলো সে এক আশ্চর্য কাহিনী। ব্রাক্ষণ সংকৃতির পুত্র, কিন্তু নিজে ক্ষত্রিয় রাজা রন্তিদেব অতিথি সেবার জন্য খুব প্রসিদ্ধ ছিল। সত্য যুগের ষোলো জন মহান রাজার মধ্যে একজন। রন্তিদেবের ভোজনশালার জন্য প্রতিদিন দু’হাজার করে গরু মারা হতো। তাদের চামড়া রসুইখানায় রাখা হতো। তা থেকে যে রস গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তো তাতে এক নদীর সৃষ্টি হয়। চর্ম থেকে উৎপত্তি বলে তার নাম চর্মণবতী।”
“বৎস, এ সব কি সত্যিই পুরাণে লেখা আছে?”
“হ্যাঁ দাদু, মহাভারতে পরিষ্কার লেখা আছে।”
“মহাভারতে ,অর্থাৎ পষ্ণম বেদে? গোমাংস ভক্ষণ!”
“রন্তিদেবের ওখানে অতিথিদের খাওয়ার জন্য এই গোমাংস রন্ধনের কজে দু’হাজার পাচক নিযুক্ত ছিল। সেই সঙ্গে ব্রাক্ষণ অতিথিদের সংখ্যাও এত বেড়ে উঠতো যে, মাংস কম পড়ে যাওয়ার ভয়ে পাচকরা মাংসের বদলে ঝোল বেশী করে নেবার অনুরোধ জানাতো। মহাভারতেই আছে-
তত্র ম্ম সৃদাঃ ক্রাশান্তি সুমৃষ্টমণিকুলা
সৃপং ভৃয়িষ্ঠমশ্লীধ্বং নাদ্য মাংসং যথা পুরা”
“ব্রাক্ষণেরা গোমাংস খেতো, কি বলছো ভাই?”
“মহাভারত হচ্ছে পষ্ণম বেদ - তাতে কি মিথ্যা লেখা হতে পারে দাদু!”
“দুনিয়া কি এত ওলট-পালট হয়ে গেলো?”
“উল্টে-পাল্টেই যায় দাদু, তবু নিজেদের খাঁটি ব্রাক্ষণ বলা এই সব দিবান্ধরা সকলের চোখেই ধুলো দিতে চায়। আমি যেমন বুঝতে পেরেছি যে, আমাদের পূর্বজ যৌধেয়রা ব্রাক্ষণদের এই ছলাকৌশল ছড়াবার আগের যুগের ধর্ম এবং রীতিনীতি মেনে চলতো।”
“হ্যাঁ, আর তারা কখনও ব্রাক্ষণকে নিজেদের চেয়ে উঁচু মনে করতো না।”
....................................................................................
“কিন্তু গুপ্তবংশ গো-ব্রাক্ষণের রক্ষক।”
“আচার্য, মুঢ় ব্যক্তিদের ধোঁকা দেবার মতো এই সব কথা আমি আপনার মুখ থেকে শুনবো আশা করি না। আপনি জানেন, আমাদের পুর্বজ ঋষিরা গো-রক্ষা করতেন গো-ভক্ষণের জন্য। ‘মেঘদুত’-এ আপনিই চর্মণবতীকে গো-হত্যা থেকে উদ্ভৃত রন্তিদেবের কীর্তি বলে বর্ণনা করেছেন-
ব্যালম্বেথাঃসুরভিতনয়ালস্তজাং মানয়িষ্যন
স্রোতোমুর্ত্তা ডুবি পরিণতাং রস্তিদেবন্য কীর্তিম”
“তুমি ধৃষ্ট সুপর্ণ, যদিও তুমি আমার প্রিয় শিষ্য।”
“আপনার তিরস্কার শুনতে আমি প্রস্তুত, কিন্তু আমি এটা সহ্য করতে রাজী নই যে আমার গুরু গণতন্ত্র হত্যাকারী গুপ্ত রাজার সামনে চাটুকারের মতো পড়ে থাকবেন।”
“তুমি ওদের গণতন্ত্র-হত্যাকারী বলছো কেন সুপর্ণ?”
“হ্যাঁ নন্দ, মৌর্য, শক আর হুনেরাও যে পাপ করেনি এই গুপ্তরা তাও করেছে। ভারতভূমি থেকে এরা গণ-রাজ্যের নাম মুছে দিয়েছে।”
“গণ-রাজ্য এ যুগের অনুকূল নয় সুপর্ণ। যদি সমুদ্রগুপ্ত এইসব গণ-রাজ্যকে কায়েম রাখতেন, তবে তিনি হুন এবং অপরাপর প্রবল শত্রুদের পরাস্ত করতে পারতেন না।”
“সফলতা! নিজ রাজ্য কায়েম করবার! দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য হবার! কিন্তু চাণক্যের বিশ্ববিশ্রুত বুদ্ধির সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত মৌর্য সাম্রাজ্যও বেশী দিন টেকেনি। বিক্রমাদিত্য আর কুমাগুপ্তও যাবৎচন্দ্র দিবাকর শাসন করবে না। কিন্তু এরা যে গণ-শাসনের চিহ্ন পর্যন্ত মুছে দিয়েছে তা কোন ধর্মকর্মের জন্য? অনাদিকাল থেকে চলে আসা গণ-রাজ্যের গণ-শাসনকে উচ্ছেদ করা কি অধর্মের কাজ নয়?”
“কিন্তু রাজা বিষ্ণুর অংশবিশেষ।”
“কুমার গুপ্ত নিজের সঙ্গে ময়ুরের চিত্র অস্কিত করবে এবং আগামী দিনের কোনো কবি তাকে কুমারের অবতার বলবে। এই ধোকাবাজী, এই বিকৃতি কিসের জন্যে? সুস্বাদু, দুগ্নধ চাল, আর মধুর মাংসসৃপের জন্যে, রাষ্ট্রের সমস্ত সুন্দরীকে আপন প্রমোদপুরে ঢুকাবার জন্যে, কৃষি আর শিল্পকর্মে নিষ্পেষিত মানুষের কষ্টোপার্জিত অর্থ আপন ভোগসুখে জলের মতো খরচ করবার জন্যে? আর এ জন্য আপনি গুপ্তদের ধর্ম-সংস্থাপক বলছেন! বিষ্ণু? হ্যাঁ, গুপ্তরা নিজেদের বৈষ্ণব বলে প্রচার করছে। ব্রাক্ষণেরা তাদের বিষ্ণুর অংশ বানাচ্ছে। মুদ্রার ওপর লক্ষীর মূর্তি অঙ্কিত করা হচ্ছে। বিষ্ণুর মুর্তি আর মন্দির তৈরীর জন্যে প্রজাদের ভাতে মেরে, তাদের সর্বস্ব লুট করে প্রচুর টাকা খরচ করা হচ্ছে এই আশায় যে, গুপ্তবংশের রাজত্ব অন্তকাল ধরে কয়েম থাকবে।”
“এ সব তুমি কি বলছো সুপর্ণ! রাজার বিরুদ্ধে এত কঠোর কথা কেন বলছো?”
“হ্যাঁ আচার্য, আজ আপনার সামনে বলছি, কোনোদিন পরমভট্টারক মহারাজের সামনেও বলবো। জীবিতাবস্থায় আমার পক্ষে এই ধোঁকাবাজী বরদাস্ত করা মুস্কিল। তবে এ ভবিষ্যতের কথা, কিন্তু আমি চাই আপনিও অশ্বঘোষের পদাঙ্ক অনুসরণ করুন।”
“আমি নিছক কবি; অশ্বঘোষ কবি এবং মহাপুরুষ দুই-ই ছিলেন। তাঁর কাছে সংসারের সুখভোগের কোনো মূল্য ছিল না, আমি চাই বিক্রমাদিত্যের প্রমোদশালায় সুন্দরীদের মতো সুন্দরী, চাই রক্তবর্ণ দ্রাক্ষাসুরা, চাই প্রাসাদ এবং পরিচারক। আমি কেমন করে অশ্বঘোষ হতে পারি? আমি ‘রঘুবংশ’ - এ ছদ্মনামে গুপ্তবংশেরই প্রশংসা করেছি, যাতে প্রসন্ন হয়ে বিক্রমাদিত্য এই প্রসাদ দিয়েছেন, কাঞ্চনমালার মতো যবন সুন্দরী আমাকে প্রদান করেছেন - পনেরো বছর আমার সঙ্গে থেকে ও যে আমাকে তার সোনালী কেশ-পাশে বেঁধে রেখেছে। আমি এখন ‘কুমারসম্ভব’ রচনা করছি, দেখ এ কাব্য আরও কত কি এনে দেয় আমার হাতে।”
“আমি বিশ্বাস করি না আচার্য, আপনি যদি ‘বুদ্ধ-চরিত্র’, ‘সৌন্দরানন্দ’ লিখতেন তবে আপনাকে বুভুক্ষায় মরতে হতো বা সর্বতোভাবে ভোগসুখ থেকে বঞ্চিত হতেন। এ আপনার ভুল ধারণা যে, রাজার ক্ষতি না করলে আপনার জীবন সম্পূর্ণ ঠিক হয়ে যাবে। আগামী দিনের কবিদের জন্য আপনি অত্যন্ত কু-উদাহরণ রেখে যাচ্ছেন। সকলেই কবি কালিদাসকে অনুকরণের নামে নিজেদের দোষ ঢাকতে চাইবে।”
“মহৎ কাব্যও আমি রচনা করবো।”
“কিন্তু এমন কিছুই লিখবেন না যাতে গুপ্তদের ভ্রষ্টাচার লোকে জানতে পারে।”
“সে আমার দ্বারা হবে না সুপর্ণ, আমি বড় নরম হয়ে পড়েছি।”
“রাজানুষ্ঠানে সকল পাপের সপক্ষে ধর্মের দোহাই তো দেবেন?”
“তারও প্রয়োজন আছে। এ ছাড়া রাজশক্তি দৃঢ় হতে পারে না, বশিষ্ঠ আর বিশ্বামিত্রও এ ধরনের কাজ করা প্রয়োজন মনে করেছিলেন।”
“বশিষ্ঠ আর বিশ্বামিত্রও কবি কালিদাসের মতো প্রাসাদ এবং সুন্দরীর লোভে এই পাপ পথে পা বাড়িয়েছিলেন।”
“সুপর্ণ, পুথিগত বিদ্যা ছাড়াও শুনলাম, যুদ্ধবিদ্যাও তুমি আয়ত্ত করেছো, যদি তোমার সম্মতি থাকে তবে মহারাজাধিরাজকে বলি। তোমাকে কুমারামাত্য বা সেনানায়কের পদে অভিষিক্ত দেখলে খুশী হবো আমি, মহারাজাও খুশী হবেন।”
“আমি কারও কাছেই নিজেকে বিক্রয় করবো না আচার্য।”
“আচ্ছা, রাজপুরোহিতের মধ্যে একটা স্থান যদি পাও?”
“ব্রাহ্মণদের স্বার্থপরতায় আমার ঘৃণা ধরে গেছে।”
“কি করবে তা’হলে?”
“আপাতত আরও বিদ্যা অর্জনের আমার বাসনা।”
.......................................................................................
উজ্জয়িনীতে অবস্থানকালে আমি শুধু নিজের জ্ঞান-পিপাসা তৃপ্ত করবার সুযোগই পাইনি, সেই সঙ্গে বিস্তৃত এই সংসারকে জানবার সুযোগও হয়েছে। সেখানে থাকতে, কাছে থেকে আমি দেখেছি, কেমন করে ব্রাহ্মণেরা রাজার কাছে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের বিক্রয় করে দেয়। এমন একটা সময় ছিল যখন অপরে স্বীকার না করলেও ব্রাহ্মণত্বের গর্ব আমার প্রবল ছিল। গ্রাম ছেড়ে আসবার পর আমি খাঁটি যবনদের দেখলাম, যারা প্রায়ই ভরূকচ্ছ থেকে উজ্জয়িনী আসতো। সেখানে তাদের বড় বড় পন্যশালা ছিল, আমি বহু শক, আভীর পরিবারে গিয়েছি, যাদের পূর্বপুরুষেরা এক শতাব্দী আগে উজ্জয়িনী, লাট (গুজরাট) এবং সৌরাষ্ট্রের শাসক মহাক্ষত্রপ ছিল। পাকা নারঙ্গী রঙ-এর গাল, রোমহীন মুখমণ্ডল এবং গোলাকার আঁখিযুক্ত হুনদেরও আমি দেখেছি - যুদ্ধে অত্যন্ত নিপুণ, কিন্তু অন্যদিকে তেমন প্রতিভা নেই। এইসব রকমারি মানুষজন দেখবার সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হলো বৌদ্ধবিহার (মঠ), যা একাধিক সংখ্যায় উজ্জয়িনীর বহির্দেশে রয়েছে। আমার মাতুল-কুলের লোকেরা বৌদ্ধ ছিলেন, আর বহু নাগর-ভিক্ষু এইসব মঠে থাকতেন। এ জন্য আমাকে প্রায়ই সেখানে যেতে হতো। ভরূকচ্ছতেও আমি একবার গিয়েছিলাম।
পুথি-পাঠ সমাপ্ত করে আমি দেশভ্রমণের সাহায্যে আমার জ্ঞান প্রসারিত করতে চাইলাম। এই সময় আমি জানতে পারলাম যে, বিদর্ভে অচিন্ত্যবিহার (অজান্তা) নামে এক প্রসিদ্ধ বিহার আছে সেখানে পৃথিবীর সকল দেশের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এসে থাকেন। আমি সেখানে গেলাম।
এতদিন পর্যন্ত আমি যেখানেই গিয়েছি, আমার সঙ্গে প্রচুর সম্বল এবং সঙ্গী নিয়ে গিয়েছি। এই প্রথম বার আমি নিঃসহায় নিঃসম্বল অবস্থায় বেরিয়ে পড়লাম। পথে চোর-ডাকাতের ভয় ছিল না; গুপ্তদের এই ব্যবস্থার প্রশংসাই করতে হবে। কিন্তু গুপ্তশাসন কি দেশের প্রত্যেক পরিবারকে এতই সমৃদ্ধশালী করে রেখেছে যে, বাটপারি, রাহাজানি সম্পূর্ণ উঠে গেলো? গুপ্তরাজেরা কর আদায়ের ব্যাপারে পূর্বতন সকল শাসককেই হার মানিয়েছে। রাজপ্রাসাদ তৈরীর কাজে কখনও এত অর্থ ব্যয়িত হয়নি। পাহাড়, নদী, সরোবর এমনকি সমুদ্রকে সশরীরে উঠিয়ে এনে এরা আপন সুরম্য প্রাসাদের সংলগ্ন করে রাখবার প্রয়াস পেয়েছে। এদের ক্রীড়া-উদ্যান সত্যিকারের বনের মতোই মনোরম। এখানে পিঞ্জরে আবদ্ধ হিংস্র পশু আর খোলা জায়গায় হরিণের দল ঘুরে বেড়ায়। ক্রীড়া পর্বতে স্বাভাবিক পার্বত্য বন-উপবন, জলপ্রপাত তৈরী করা হয়েছে। সরোবরের সঙ্গে যুক্ত কৃত্রিম জলস্রোতের ওপর সেতু আর নৌকার বহর দেখা যায়। হাতির দাঁত, সোনা, রূপা, নানা রকম রেশমী বস্ত্র এবং মহার্ঘ গালিচা প্রাসাদের অন্তর্দেশে সজ্জিত রয়েছে। প্রাসাদকে সজ্জিত করতে চিত্রকর তার তুলির সৌন্দর্যের সবটুকুই ঢেলে দিয়েছে। ভাস্কর তার মর্মর এবং ধাতু-নির্মিত মূর্তির সুন্দর রূপ বিন্যাস করেছে। বিদেশী যাত্রী এবং রাজদূতের মুখে আমি এই সব চিত্র এবং মূর্তির ভুরি ভুরি প্রশংসা শুনেছি, যাতে সত্যিই আমার শির গর্বোন্নত হয়ে উঠেছে। কিন্তু যখন আমি ক্ষুদ্র গ্রামের পর্ণ কুটিরের অবস্থা দেখি, তখন উজ্জয়িনীর এই সব প্রাসাদ আমার দেহের রক্ত চঞ্চল করে তোলে! মনে হয়েছে, গ্রামের এই দারিদ্র্যের কারণ এইসব প্রাসাদ।
গ্রামের নিপুণ শিল্পীরা নানা রকমের জিনিস তৈরী করে থাকে। স্ত্রীলোকেরা মিহি সুতা কেটে এবং তস্তুবায়রা তা দিয়ে সূক্ষ্ম বস্ত্র বয়ন করে। স্বর্ণকার, লৌহকার, চর্মকার আপন আপন শিল্প দক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকে। রাজপ্রাসাদের কলাচাতুর্যময় আসবাবাপত্রের নির্মাতারা এদেরই আত্মীয়-স্বজন। কিন্তু যখন আমি এদের দেহ এবং বাসগৃহের অবস্থা দেখেছি তখন বুঝতে পারি, এদেরই হস্তনির্মিত দ্রব্যসম্ভার এদের কাছে স্বপ্নময় স্বরূপ। এদের তৈরী শিল্প সামগ্রী গ্রাম থেকে নগর-শহরের সৌধ, প্রাসাদে চলে যায়। আবার সেখান থেকে অনেকে পশ্চিম সমুদ্রতীর ভরূকচ্ছ, আদিতীর্থ হয়ে পারস্য বা মিশরের পথ ধরে অথবা পূর্ব সমুদ্রতীরে তাম্রলিপ্ত হয়ে যবদ্বীপ, সুবর্ণদ্বীপ পৌঁছে যায়। ভারতে সামুদ্রিক বাণিজ্য এত শক্তিশালী কোনোদিনই হয়নি এবং আপন পণ্যের বিনিময়ে সমুদ্রপারের লক্ষ্মীও এত বেশী কখনও ভারতে আসেনি, কিন্তু এতে লাভ কার? সকলের চেয়ে বেশী গুপ্ত রাজাদের, তারা সকল পণ্যের ওপর অত্যধিক শুল্ক আদায় করে; তারপর সামন্ত প্রভুদের মধ্যে যারা বড় বড় রাজপদ বা জায়গীরের অধিকারী, তারা কারিগর এবং ব্যবসাদার দু’য়ের কাছে থেকেই লাভের অঙ্ক লোটে। ব্যবসাদারদের নাম সবশেষে করলেও এই তারাও লুণ্ঠন কর্মে নেহাত ছোট অংশীদার নয়। এদের সবাইকে দেখে আমার কাছে এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেছে, গ্রামের কৃষক এবং কারিগরেরা এত গরীব কেন এবং ছোট-বড় রাজপথসমূহকে সুরক্ষিত রাখবার জন্য গুপ্ত রাজাদের এত তৎপরতাই বা কেন? গ্রামে দারিদ্র্য আছে ঠিকই, তবে শহরের মতো হৃদয় বিদারক দৃশ্য গ্রামে কমই দেখা যায়। এখানে পশুর মতো ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য দাসদাসিদের হাট বসে না, ওদের ন্যায় শরীরে চাবুকের দাগ চোখে পড়ে না। আমার গুরু কালিদাস কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, পূর্বজন্মের কর্মফলস্বরূপ লোকে দাস হয়। যেদিন তাঁর মুখে আমি এই কথা শুনি সেইদিনই পূর্বজন্ম সম্বন্ধে আমার সমস্ত বিশ্বাস উবে গেলো। গুপ্ত রাজারা যেভাবে ধর্মকে সকল রকমে আপন অস্তিত্ব দৃঢ় করবার কাজে লাগিয়েছে, তাতে এখন সকল চিন্তাশীল লোকের মনেই এই অবিশ্বাস আসা স্বাভাবিক। কিন্তু যখন আমি সাধারণ প্রজাদের দেখতাম, তাদের এ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন মনে হতো - কেন? সম্ভবত তারা নিজেদের অসহায় মনে করতো। গ্রামবাসীরা শুধু আপন গ্রামের খোঁজ-খবরটুকু রাখতো - গ্রামের অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ জমির জন্য তারা যেভাবে লড়াই করতো সম্ভবত কুমার গুপ্তও নিজের কোনো প্রদেশের জন্য এত বিক্রমের সঙ্গে লড়তে পারতো না। কিন্তু গ্রামের সীমার বাইরে যাই ঘটে থাক, এরা তার কোনো খোঁজ রাখতো না। একটি গ্রামের ঘটনা আমার মনে আছে। সেখানে প্রায় চল্লিশটি কুটির ছিল, সবই খড়ের ছাউনি। গরমের দিনে উনুন থেকে একটা ঘরে আগুন লেগে যায়। সারা গ্রামের লোক জল নিয়ে সেই ঘরের দিকে দৌড়ে গেলো। কিন্তু একটি ঘরের এক দম্পতি ঘড়ায় জল ভরে আপন ঘরের কাছে বসে রইলো। সৌভাগ্যবশত গ্রামে একমাত্র ঐ একটিই ছিল, না হলে গ্রামের একটা ঘরও সেদিন রক্ষা পেতো না। সে সময় আমার যৌধেয় গণ-রাজ্যের কথা মনে পড়ে গেলো, যেখানে রাষ্ট্রের সকল লোক আপন রাষ্ট্রের জন্য জীবন-মরণ পণ করতে কুণ্ঠিত হতো না। এমনিতেই তো সমুদ্র গুপ্ত, চন্দ্রগুপ্ত, কুমার গুপ্তের দিগ্বিজয়ের জন্য লক্ষ লক্ষ লোক প্রাণ দিয়েছে, কিন্তু সে শুধু দাসের মতো অপরের লাভের জন্য - স্বাধীন মানুষের মতো নিজের এবং নিজ নিজ জনগণের হিতার্থে নয়।
জনসাধারণের মধ্যে মাত্র একশ’ বছরের এই গুপ্ত শাসনের প্রভাব লক্ষ্য করে আমার সমস্ত শরীর শিউরে উঠলো। আমি ভেবে দেখলাম, যদি এমন শাসন-ব্যবস্থা কয়েক শতাব্দী ধরে চলে, তবে এই দেশ সম্পূর্ণভাবে দাসের দেশে পরিণত হবে। যারা শুধু আপন রাজার জন্যই লড়তে-মরতে জানবে, যাদের মন থেকে এ চিন্তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে যে, সব মানুষেরই কিছু অধিকার আছে।
অচিন্ত্যবিহার বড়ই রমণীয়্, অর্ধচন্দ্রাকার নদীপ্রবাহ হরিৎবসনা পাহাড়ী উপত্যকার পাশ কেটে বয়ে চলেছে। এই ক্ষুদ্র অথচ সদানীরনা পাহাড়ী নদীর বামসতটে অবস্থিত পাহাড় কেটে শিল্পীরা কত গুহাময় সুন্দর মন্দির, নিবাসস্থল এবং সভাগৃহ তৈরী করেছে। এই সব গুহাভ্যন্তরেও রাজপ্রাসাদের মতো চিত্র মূর্তি ইত্যাদি সজ্জিত - যদিও তা বহু পুরুষের পরিশ্রমের ফলে এবং সম্ববত আগামী কয়েক শত পুরুষের জন্য্। অচিন্ত্য বিহারের ভিত্তিচিত্র সুন্দর, মর্মর-শিল্প সুন্দর। কিন্তু এগুলো গুপ্ত রাজপ্রাসাদের প্রতিদ্বন্দী হয়ে দাঁড়াতে পারে না, আর সে জন্য আমাকে তত আকর্ষণও করে না। হ্যাঁ, আমার কাছে আকর্ষণ ছিল এখানকার ভিক্ষুমন্ডলী। দেশ-দেশান্তরের লোক প্রেমভাবে এক হয়ে এক পরিবারের মতো বাস করছে। এখানে আমি সুদুর চীনের ভিক্ষুদের দেখেছি, পারসিক এবং যবন ভিক্ষুদের দেখেছি, সিংহল, যব এবং সুবর্ণদ্বীপের লোকও এখানে যথেষ্ট রয়েছে। জম্বুদ্বীপ, কম্বোজদ্বীপের নাম আমি এখানে এসেই শুনলাম এবং তাদের প্রাণবান অধিবাসীদের স্বচক্ষে দেখলাম; কপিসা, উদ্যান, তুষার এবং কুচা-র কাষায়ধারী পীতকায় ভিক্ষুদেরও এখানে দেখলাম; বাহিরের দেশগুলো সম্বন্ধে জানবার আমার প্রবল আকাঙ্কা ছিল। যদি এই সব বিদেশী ভিক্ষুদের পৃথক পৃথক সময়ে পেতাম, তবে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আমি এক একটি বছর কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু এক সঙ্গে এত অধিক সংখ্যায় সমবেত ভিক্ষুমন্ডলীর মধ্যে - বিপুল বৈভবের মাঝে পড়া দরিদ্র নিধির মতোই আমি নিজেকে অসহায় মনে করতে লাগলাম!
আমি দিঙনাগের নাম শুনেছিলাম। কালিদাস নিজে গুপ্তরাজ, রাজতন্ত্র এবং তাদের পরম-সহায়ক ব্রাক্ষণ্য ধর্মের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। আর কি অভিপ্রায় থেকে তা ছিলেন, সে কথা আগেই বলেছি। দিঙনাগকে তিনি তাঁর পরাক্রান্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করতেন। তিনি বলতেন, 'এই দ্রাবিড় নাস্তিকের সামনে শুধু বিষ্ণু নয়, তেত্রিশ কোটি দেবতারই সিংহাসন টলে ওঠে। রাজা ও ব্রাক্ষণের স্বার্থ রক্ষার জন্য ধর্মের নামে আমি যা কিছু কুটকৌশল বের করি, তার রহস্য তার কাছে অজ্ঞাত থাকে না।' মুস্কিল এই যে, বৃদ্ধ বসুবন্ধু দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজধানী অযোধ্যায় বছর কয়েক কাটিয়েছিলেন - রাজদরবারী হয়ে নয়, স্বাধীন, সম্মানিত গুরুর মর্যাদা নিয়ে। পরে গুপ্তদের নীচতায় নিরাশ হয়ে আপন জম্নভুমি পুরুষপুরে চলে যান।
লৌহ-তীর অথবা খড়গ নয়, তার চেয়েও তীক্ষ্ণ জ্ঞান এবং তর্কের অস্ত্র বিতরণ করবার ব্রত দিঙনাগ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করলেই চোখের সামনে ব্রাক্ষণত্বের সমস্ত মায়াজাল তাসের ঘরের মতো ধ্বসে পড়ে। আমি ছয় মাস অচিন্ত্যবিহারে ছিলাম। প্রতিদিন দিঙনাগের মুখ থেকে তাঁর সর্বব্যাপী উপদেশাবলী শুনতাম। দিঙনাগের মতো গুরু পাওয়ায় আমার গর্বের শেষ ছিল না। তাঁর জ্ঞান অত্যন্ত গভীর, আর বাক্য ছিল জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো। সংসারের বিস্তীর্ণ মায়াজাল দেখে আমার মতোই তিনিও ক্রোধোন্মত্ত হয়ে উঠতেন।
একদিন তিনি বলেছিলেন “সুপর্ণ প্রজা শক্তির সহায়তায় হয়তো কিছু করা যেতো, কিন্তু জনসাধারণ এখন পথভ্রষ্ট হয়ে বহু দূর চলে গেছে। তথাগত জাতি-বর্ণভেদ উঠিয়ে দেওয়ার জন্য অতীব প্রয়াস করেছিলেন। দেশের বাইরে থেকে যবন, শক, গুর্জর আভীর - যারাই আসতো, ব্রাক্ষণরা তাদের ম্লেচ্ছ বলে ঘৃণা করতো। কিন্তু তথাগতের সঙ্ঘ তাদের মানুষ বলেই স্বীকার করে নিতো। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত মনে হয়েছিল এ দেশ থেকে জাতিভেদ প্রথা মুছে যাবে, কিন্তু ভারতের দুর্ভাগ্য যে গুপ্ত সম্রাটরা এখন ব্রাক্ষণদের খপ্পরে এসে গেছে। গুপ্তরা যখন প্রথম ক্ষমতায় এলো, তখন ব্রাক্ষণরা তাদের ম্লেচ্ছ বলতো। কিন্তু কালিদাস তাদের গৌরব বর্ধনের জন্য ‘রঘুবংশ’ এবং ‘কুমারসম্ভব’ লিখলেন। গুপ্তরা আপন রাজবংশকে অনন্তকাল কায়েম রাখবার চিন্তায় পাগল হয়ে উঠেছে। ব্রাক্ষণরা তাদের এই আশায় ইন্ধন যোগাচ্ছে, কিন্তু ভদন্ত বসুবন্ধু এমন কোনো আশা তাদের দিলেন না। তিনি লিচ্ছবী গণতন্ত্রের আদর্শে ভিক্ষু সঙ্ঘের অনুগামী ছিলেন। ব্রাক্ষণরা বৌদ্ধদের প্রবল পরাক্রান্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে। তারা জনে, সারা দেশের বৌদ্ধরা গোমাংস খায়। এই জন্য ব্রাক্ষণরা ভারতে গোমাংস বর্জন, গো-ব্রাক্ষণ রক্ষার আন্দোলন শুরু করে। বৌদ্ধরা জাতি-বর্ণভেদ তুলে দিতে চায়। ব্রাক্ষণরা তাই বর্ণ বহির্ভুত যবন, শক ইত্যাদিকে উচ্চবর্ণে অভিষিক্ত করতে থাকে। এই ফাঁদ এত জটিল যে, অনেক বৌদ্ধ গৃহস্থ এতে জড়িয়ে আছে। এইভাবে প্রজাদের শক্তিকে ছিন্নভিন্ন করে তারা রাজশক্তি এবং ব্রাক্ষণ শক্তিকে দৃঢ় করতে চায়। কিন্তু এর পরিণাম আত্মঘাতী হবে সুপর্ণ, কারণ দাসেদের শক্তির ওপর ভিত্তি করে কোনো রাষ্ট্র শক্তিশালী হতে পারে না।”
Comments