রাহুল সাংকৃত্যায়ন এর চোখে উগ্র হিন্দুত্ববাদ [পর্ব-তিন]

 

আমি বুঝেছিলাম, যৌবনের আনন্দ যা আমি উপভোগ করতে চাই, নিজের জম্মভুমিতে থেকে সেটা সম্ভব নয়। কোশল জাতি ও কুলের লোক ক্ষেপে উঠবে, আর পৈতৃক ধন সম্পত্তিও খোয়াতে হবে। আমার মাথায় এক বিচিত্র পরিকল্পনা এলো। আমি এক নাট্য-মন্ডলী গঠন করলাম, মগধের বাইরে গিয়ে। আমার এক গুণী ও কলাকুশলী তরুণ বন্ধু সেখানে ছিল। মূর্খ, ধুর্ত ও চাটুকার বন্ধু আমি কোনোদিন পছন্দ করি না। আমার নাট্য-মন্ডলীতে অনেক সুন্দরী তরুণীকে নিয়ে এসেছিলাম, এদের সকলেই বারবনিতা ছিল না। ‘রত্নাবলী’, ‘প্রিয়দর্শিকা’ প্রভৃতি নাটক এই নাট্য-মন্ডলীতে অভিনয় করবার জন্যে লিখলাম। তারুণ্যের আনন্দের সঙ্গে আমি শিল্পকলার মিলন ঘটালাম, আর তা দেখে সহুদয় দর্মকেরা আমার প্রশংসাই করতো। জীবনের আনন্দ আমি উপভোগ করলাম, সঙ্গে সঙ্গে ‘রত্নাবলী’, ‘প্রিয়দর্শিকা’ ইত্যাদি আপনাদের সামনে উপস্থিত করলাম। যারা শুধু নিজের ব্যক্তিকেন্দ্রিক আনন্দ পূরণ করবার জন্যই সব কিছু করে, তারা ভোগী। লোকে বলবে, রাজা হর্ষকে তোষামোদ করার জন্যেই আপন নাটকসমূহ তার নামে প্রকাশ করেছি। কিন্দু তারা জানে না। যেসময় প্রবাসে বসে এইসব্ নাটক লিখি তখন হর্ষকে আমি শুধু নামেই জানতাম। সেসময় আমি এও জানতাম না যে, আগামী দিনে হর্ষ আমাকে আমন্ত্রণ করে তার দরবার কবি করে রাখবে। আত্মগোপনের তাগিদে - শুধু নিজেকে গোপন করার জন্যেই এইসব নাটকের রচয়িতা হিসাবে আমি হর্ষের নাম দিয়েছি। এইসব নাটক যারা পড়ে, তারা এর মূল্য জানে। এগুলো সম্পৃর্ণ মৌলিক রচনা। আমার দর্শকগণের মধ্যে গুনীজন থাকতো বহুল সংখ্যায়। দলে দলে আসতো পন্ডিত, রাজা, কলাবিদ। যদি তারা প্রকৃত নাট্যকারের নাম জানতে পারতো, তাহলে আমি আর নাট্য-মন্ডলীর সূত্রধার হয়ে থাকতে পারতাম না, সকলেই মহাকবি বাণের পশ্চাদ্বাবন করতে শুরু করতো। কামরুপ থেকে সিন্ধু এবং হিমালয় থেকে সিংহলের অনুরাধাপুর পর্যন্ত - হর্ষ ছাড়া অন্যান্য প্রায় সকল রাজ দরবারেই নাটক অভিনয় করেছি। ভেবে দেখুন, যদি কামরুপেশ্বর, সিংহলেশ্বর বা কুন্ডুলেশ্বরের গোচরীভুত হতো যে, আমিই নাটক রচনাকারী মহাকবি বাণভট্র তবে আমার পর্যটন, আমার আনন্দোপভোগের কি দশা হতো? আমি কোনো রাজার দরবারী কবি হয়ে থাকতে চাইনি। হর্ষের রাজ্যে যদি আমার জম্মভুমি না হতো, তবে তার দরবারী কবিও হতাম না, পিতার সম্পত্তিই আমার কাছে যথেষ্ট ছিল।

হর্ষের বর্ণনা অনুসারে আপনাদের মনে হতে পারে যে, আমি একজন গণিকাসক্ত লম্পট। বস্তুত আমার নাট্য-মন্ডলীর মধ্যে গুণিকাদের স্থান খুবই নগণ্য। তবু যারা এসেছিল, তারা তাদের নৃত্য-গীত অভিনয় কলার সৌষ্ঠব গুণেই এসেছিল, এখানে তার উৎকর্ষের চর্চা হতো। আমার সময় নাট্য গগনের তারকারা আসতো ভিন্ন পথ ধরে। ভাবীকালে কি হবে জানি না, কিন্তু আমার সময় দেশের সব তরুণীরা - তা সে ব্রাক্ষণ কন্যা বা বেণিয়ার মেয়ে হোক না কেন, রাজা ও সামন্তবর্গের সম্পত্তি বলে গন্য হতো।

আমার পিসীমাকে মগধের এক সামন্ত বলপূর্বক নিয়ে গিয়েছিল। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পিসীর আয়ুও শেষ হলো বলা চলে। পিসীমা ফিরে এলেন আমাদের ঘরে। আমার প্রতি তাঁর অশেষ স্নেহ ছিল। আমি কোনোদিনই তাঁর সামন্ত সম্বন্ধের ওপর কটাক্ষ করিনি। আর এই অবলার দোষ কি? সুন্দরী তরুণীদের প্রথম অধিকারী হতো মুষ্টিমেয় সামন্ত। আর সুন্দরী তরুণীর সংখ্যা খুব বেশী ছিল তা নয়। সামন্ত রাজারা ছলে বলে কৌশলে যুবতীদের পাওয়ার চেষ্টা করতো। পতির কাছে যাওয়ার পূর্ব রাত্রে কোথাও কোথাও সামন্তদের সঙ্গে রাত্রিবাস করতে হতো; কারণ এরা যে তাদেরই সম্পত্তি! সাধারণ লোকে একে ধর্ম-মর্যাদা মনে করতো।

ব্রাক্ষণ ও বেনিয়ারা আপন কন্যা, পত্নী ও বোনেদের ডুলিতে করে এক রাত্রের জন্যে রাজান্তঃপুরে পৌছে দিতো। ডুলি না পাঠাবার অর্থই ছিল সর্বনাশ ডেকে আনা। আর মেয়ে পছন্দ হলে তো কথাই ছিল না, রাজান্তঃপুরের প্রমোদগৃহে রাখা হতো স্থায়ীভাবে। তারা যে রানী হতো, তা মনে করার কারণ নেই, পরিচারিকার সম্মান কপালে জুটতো। রাণী হওয়ার সৌভাগ্য শুধু রাজকুমারী এবং সামন্ত কুমারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অন্তঃপুরের এই হাজার হাজার তরুণীর অধিকাংশই এমন ছিল, যারা মাত্র এক রাতের জন্যে রাজা অথবা সামন্তের সঙ্গ লাভ করেছে। এই হতভাগিনী নারীদের যৌবন কিভাবে ব্যর্থ হয়েছে সেটা একবার ভেবে দেখুন। আমার নাট্য-মন্ডলীর অভিনেত্রীরা আসতো এইসব অন্তঃপুরের প্রমোদাগার থেকেই, কিন্তু পালিয়ে বা চুপিচুপি নয়। ভালোই বলুন আর মন্দই বলুন, রাজা ও সামন্তবর্গকে কথার জালে নিজের পক্ষে টেনে আনতে আমি ছিলাম সিদ্ধবাক। অবশ্য রাজনীতি আমার বিষয়বস্তু ছিল না, আমায় তারিফ করে যে শত-শত পত্র পাঠাতো রাজা ও সামন্তরা, সেগুলো আজও সাক্ষী হয়ে আছে। যখন কলা সম্বন্ধে প্রশংসায় এরা পষ্ণমূখ হতো, আমি তখন বিলাপ করতে শু রু করতাম। বলতাম, "আর কি করবো বলুন! কলাকুশলী তরুণী থাকা সত্ত্বেও পাওয়া যায় না।"

"তরুণী থাকা সত্ত্বেও পাওয়া যায় না?"

"একবার চুম্বন, পরে আলিঙ্গন বা এক রাতের শয্যাসঙ্গিনী করার পর যেখানে হাজার হাজার তরুণীকে অন্তঃপুরের বন্দিনী করে রাখা হয়, সেখানে কলাকুশলী তরুণী পাওয়া যাবে কেমন করে।?"

"ঠিকই বলেছ, আচার্য! আমিও অনুভব করছি, কিন্তু একবার অন্তঃপুরে গ্রহণ করার পর এদের আমি বের করে ‍দেই কি করে?"

তারপর আমি তাদের পথ বাতলে দিতাম। রাজকন্যা, সামন্তকন্যা ও রাজান্তঃপুরিকাগণের জন্য নাচগান অপরিহার্য। আহার ও পানীয়ের মতো এ সব তাদের প্রয়োজন। আমার দলের চতুর নারীদের আমি পাঠিয়ে দিতাম। রাজা নিজেই কলাশিক্ষার জন্য আপন অন্তঃপুরিকাদের উৎসাহিত করতেন। যাকে গ্রহণ করা আমার প্রয়োজন মনে হতো তার কাছে অন্তঃপুরের দুঃখকষ্ট এবং কলাবিদের জীবনের আনন্দ বিশদভাবে বর্ণনা করা হতো। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও শোনানো হতো যে, নটীদের সম্মান রাজান্তঃপুরে কত বেশী, তারা কুশলী নটী হতে পারলে ভবিষ্যতে সুযোগও আছে! এসব বলার পর অনেক তরণীর পক্ষেই সম্মত হওয়া স্বাভাবিক ছিল, যদিও আমি তাদের ভেতর থেকে যোগ্যতমাকেই বাছাই করে নিতাম। জীবনে মাত্র একটি রাত সম্ভোগের জন্য যেখানে রাজারা হাজার হাজার তরূণীকে অবরোধ করে রাখে, সেখানে অন্তঃপুরে পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ করেও কিছু বন্ধ করা যায় না বুড়ো কঞ্জুস ব্রাহ্মণ তাদের তারণ্যের আনন্দ রোধ করতেও পারে না।

আমি যখন বিধবাদের ‘সতী’ হওয়ার বিরোধিতা করলাম তখন ভণ্ড শিরোমণি ব্রাহ্মণ এবং রাজারা মহা শোরগোল তুললো। তারা প্রচার করতে লাগলো, আমি ভ্রূণ হত্যা একবারেই সমর্থন করি না। কিন্তু এখানে এ কথা স্বীকার করতে আমার এইটুকু দ্বিধা নেই যে, আমি বিধবা বিবাহ সম্পূর্ণ সমর্থন করি। প্রাক গুপ্ত শাসনে আমাদের ক্ষত্রিয়গণ যেখানে গোমাংস বিনা কোনো আতিথ্যকে স্বীকার করতে চাইতেন না, সেখানে এখন গোমাংস ভক্ষণকে ধর্মবিরুদ্ধ বলে গণ্য করা হয়। যেখানে আমাদের ঋষিগণ বিধবাদের জন্য দেবর বা দ্বিতীয় বর সম্পূর্ণ ধর্মসঙ্গত বলে মনে করতেন এবং কোনো ব্রাহ্মণী বা ক্ষত্রিয়া বিধবা তরুণী ছয় মাস বা এক বছরের অধিক পতিবিধুরা থাকতে পারতো না, সেখানে বিধবা বিবাহ এখন ধর্মবিরুদ্ধ বলে গণ্য হচ্ছে! গুপ্ত রাজবংশের যুগেই এই জঞ্জালের, এই নতুন (হিন্দু) ধর্মের গোড়াপত্তন হয়, আর এর প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য আপন পাটরাণী করে রেখেছিলেন নিজেরই বড় ভাই রামগুপ্ত'র সধবা স্ত্রীকে।

তরুণী বিধবাদের স্ত্রী হিসাবে রাখতে চাইলে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরও আটকাতে পারেন না, আর কোন মুখেই বা আটকাবেন যখন স্ব-স্ব পত্নী বর্তমান থাকতেও তাঁরা নিজেরাই পর স্ত্রীর পিছনে ছুটতে দ্বিধা করনেনি! তরুণীদের বিধবা করে রাখার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম ভ্রুণ হত্যা, কারণ সন্তান সৃষ্টি করে তাকে পালন করার অর্থেই হলো বিধবা বিবাহ স্বীকার করে নেওয়া। যা থেকে লোকে রেহাই পেতে চায়। এই ভয়ে এখন ব্রাহ্মণ এবং সামন্তরা কৌলীন্য সিদ্ধ করার এক নতুন কৌশল আবিষ্কার করেছে। সে হলো বিধবাদের জীবন্ত দগ্ধ করা। স্ত্রীলোকদের এইভাবে জীবন্ত পুড়িয়ে মারাকে এই সব লোক মহাপুণ্য বলে প্রচার করে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ তরুণীকে বলপূর্বক অগ্নিসাৎ করতে দেখেও যে দেবতাদের হৃদয় বিগলিত হয় না, তারা পাথরের গড়া, নয়তো তাদের অস্তিত্বই নেই। এরা বলে বেড়ায় স্ত্রীলোকেরা স্বেচ্ছায় সতী হয়। ধূর্ত, ভণ্ড, নরাধম! এত মিথ্যা কেন? এই সব রাজান্তঃপুরের শত শত স্ত্রীলোক, যারা পুরুষের সঙ্গ হয়তো সারা জীবনে একবার পেয়েছে, যাদের তোমরা আগুনে পুড়িয়ে সতী বানাচ্ছ, তাদের মধ্যে ক’জন আছে যাদের ঐ নরপশুদের সঙ্গে এতটুকু প্রণয় ছিল? আজীবনের জন্য যারা বন্দী করে রেখেছিল, তাদের সঙ্গে প্রেম! আর ওদের বিয়োগে পাগল হয়ে আগুনে ঝাঁপ দেবার যে এক-আধটি দৃষ্টান্ত রয়েছে, সে পাগলামীও দু’চার দিনে প্রশমিত করা যেতে পারে। আত্মহত্যা ধর্ম! রসাতলে যাক ভণ্ড পুরোহিত আর রাজাদের ধর্ম। প্রয়াগের অক্ষয়বট থেকে যমুনায় ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করাকে এরা ধর্ম আখ্যা দিয়েছে, যার ফলে প্রতি বছর এমনি হাজার হাজার পাগল মৃত্যুবরণ করে ‘স্বর্গ’ এ উপস্থিত হচ্ছে। উত্তরাখণ্ডের সৎপথে গিয়ে তুষারে জমে যাওয়াকে এরা ধর্ম আখ্যা দিয়েছে, যার ফলে প্রতি বছর শত সহস্র মানুষ সৎপথের শৈত্য ‘স্বর্গ’ যাত্রা করছে! এ সমস্ত অনাচারের বিরুদ্ধে আমি ঠিকমতো প্রতিবাদ করতে পারিনি, কারণ আমাকে ব্রাহ্মণদের মধ্যে, রাজার আশ্রয়ে থাকতে হতো। রাজার আশ্রিত হয়েছি, কিন্তু নিজে থেকে এই আশ্রয় গ্রহণ করিনি। আমার নিজের যে সম্পত্তি ছিল তাতে সংযত ভোগপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারতাম। আমার সময়ের রাজা এবং ব্রাহ্মণদের চেয়ে আমি অনেক বেশী সংযমী হতে পারতাম। হর্ষ এবং অপর রাজাগণের মতো আমি লক্ষ সুন্দরী উপভোগকারী হওয়ার আকাঙ্খা পোষণ করিনি। খুব বেশী হলে একশ’ সুন্দরী আছে যাদের সঙ্গে কোনো না কোনো সময়ে আমার প্রণয় হয়েছিল। কিন্তু আমার বাড়িঘর, সম্পত্তি সব কিছুই হর্ষের রাজ্যে অবস্থিত। যখন তার কাছ থেকে দূতের পর দূত আসতে লাগলো, তখন কি করে আমি তার দরবারে যেতে অস্বীকার করি? হ্যাঁ, আমিও যদি অশ্বঘোষ হতাম, সংসার সম্বন্ধে উদাসীন থাকতাম তাহলে হর্ষের কোনো পরোয়া করতাম না।

হর্ষের সম্বন্ধে যদি আমার গোপন মতামত জিজ্ঞাসা করেন, তবে আমি বলবো যে, তার সময়ে সে মন্দ লোক বা মন্দ রাজা ছিল না। আপন ভ্রাতা রাজ্যবর্ধনের সঙ্গে তার অত্যন্ত সম্প্রীতি ছিল। ভাইয়ের জন্য যদি ‘সতী’ হওয়ার বিধান ধর্মনায়কগণ দিতো অথবা তার সামান্য ইঙ্গিত করতো, তবে সে-ও তাই করে বসতো। কিন্তু তার মধ্যে অনেক দোষও ছিল এবং সব চেয়ে বড় দোষ ছিল মিথ্যা ঠাট দেখানো। প্রশংসার আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে সে সম্বন্ধে নিস্পৃহ দেখাতো; সুন্দরীদের সম্বন্ধে কামনা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে কামনা রহিত বলে জাহির করতো। যশোস্পৃহা সত্ত্বেও যশ থেকে দূরে থাকার প্রয়াস পেতো। হর্ষকে না জানিয়ে আপন নাটকসমূহকে ‘নিপুণ কবি হর্ষ’ প্রচার করেছি। রাতদিনের সঙ্গ লাভের পরও সে কখনও আমাকে বলেনি, ‘বাণ, এখন এই নাটকগুলিকে তোমার নামেই প্রচারিত হতে দাও।’ এ কাজ তার পক্ষে একেবারেই সহজ ছিল। তার অধীন সামন্ত দরবারে শুধু একবার ‘শ্রীহর্ষো নিপুণ কবি’ এই জায়গায় ‘শ্রীবাণো নিপুণ কবি’ এই নামে নাটকের অভিনয় করালেই হতো।

জগৎ যেমন রয়েছে তাকে ঠিক তেমনিভাবে চিত্রিত করায় আমার আগ্রহ। আমি বারোটি বছর যদি পর্যটনে না কাটাতাম, তবে সম্ভবত এই আগ্রহ জন্মাতো না, জন্মালেও আমি সেটা চরিতার্থ করতে পারতাম না। আমি যেখানে অচ্ছোদ সরোবরের বর্ণনা দিয়েছি, সেখানে হিমালয়ের পর্বতের এক সুন্দর দৃশ্য আমার মানসপটে ছিল। কাদম্বরী ভবনের বর্ণনায় হিমালয়ের দৃশ্য ছিল। রত্নাবলী'তে নিজেরই দেখা এক বৃদ্ধ দ্রাবিড় ধার্মিককে আমি বসিয়েছি। কিন্তু শুধু এইটুকু চিত্রণে আমি আমার লেখনীকে বিশ্রাম দিতে চাইনি। রাজন্যবর্গের প্রাসাদ, অন্তুঃপুর এবং তাদের ধন-দৌলতের চিত্রণ আমি আমার গ্রন্থে করেছি; কিন্তু আমি পর্ণকুটির এবং তার দুঃখ-দুর্দশাপূর্ণ জীবনকে চিত্রিত করতে পারিনি, যদি করতাম তবে ঐ সব রাজপ্রাসাদ এবং রাজসম্পদ ভোগীদের ওপর এমন গভীর কালিমা লেপন করতে হতো যে, প্রতি পঞ্চম বছরে প্রয়াগে রাজকোষ - ভুল বলা হলো, উদ্ধৃত্তকোষ উজাড় করা হর্ষ আমাকে শুধু লম্পট উপাধি দিয়েই সন্তুষ্ট থাকতো না।

...........................................................................................

মরণের পর মুক্তি এবং নির্বাণ প্রাপ্তির যে কথা তোমরা বলো, কি অর্থ আছে তার?

যে লক্ষ লক্ষ দাসকে পশুরন্যায় আবদ্ধ রেখে ক্রয়-বিক্রয় করা হচ্ছে, তাদের কেন মুক্ত করার চেষ্টা করো না? প্রয়াগের মেলায় একবার রাজা শীলাদিত্যকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, "মহারাজ, আপনি যে বড় বড় বিত্তশালী মঠ এবং ব্রাহ্মণদের মাঝে প্রতি পঞ্চম বৎসরে এত ধন-দৌলত বিতরণ করছেন, সেগুলি যদি দাসদাসীদের মুক্ত করার কাজে লাগাতেন, তাহলে কি তাতে কম পুণ্যের কাজ হতো?"

একান্ত সময় আলোচনা করার কথা বলে শীলাদিত্য এ প্রশ্ন এড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু সেই ‘অন্য সময়’ও আমি খুঁজে বের করলাম। রাজার ভগ্নী ভিক্ষুণী জোর করেই সে সুযোগ সৃষ্টি করে দিলো। রাজ্যশ্রীর সামনে আমি দাসদাসীদের নরক-যন্ত্রণার চিত্র তুলে ধরলাম। তার হুদয় বিগলিত হয়ে গেলো। তারপর যখন আমি বললাম যে, অর্থ দিয়ে এই সনাতন বংশ পরস্পরায় বন্দী মানুষের মুক্তি দান করা সবচেয়ে পুণ্যের কাজ, তখনই সে কথা তার মনে ধরে গেলো। বেচারী সরল হৃদয়া স্ত্রীলোক, দাসত্বের আবরণে লুকায়িত বড় বড় স্বার্থের কথা সে কি জানে? সে কি করে জানবে যে, যেদিন মাটিকে স্বর্গে পরিণত করা যাবে, আকাশের স্বর্গ সেদিন হেলে পড়বে! আকাশ-পাতাল, স্বর্গ-নরক কায়েম রাখার জন্য, তাদের নামে লাভের কারবার চালানোর জন্য পৃথিবীতে স্বর্গ-নরক, রাজা-ভিখারী, দাস-স্বামীর প্রয়োজন হয়।

রাজা নির্জনে বসে আলোচনা করলো। প্রথমে সে বললো, “একবার অর্থ ব্যয় করে তাদের আমি মুক্ত করতে পারি, কিন্তু দারিদ্র্যের চাপে সে মুক্তি বিকিয়ে যাবে।”

“ভবিষ্যতের জন্য মানুষের ক্রয়-বিক্রয় দন্ডনীয় করে দিন।”

এরপর সে চুপ করে ভাবতে লাগলো। আমি তার সামনে ‘নাগানন্দের’ নাগের দৃষ্টান্ত তুলে ধরলাম, যে অপরের প্রাণরক্ষার জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে চেয়েছিল। ‘নাগানন্দ’ হর্ষরাজের সৃষ্ট নাটক বলে কথিত, সুতরাং কি জবাব দেবে সে? শেষকালে সে জানালো যে, দাসদাসীদের মুক্ত করায় সে ততটা কীর্তি লাভের আশা রাখে না, যতটা রাখে শ্রমণ-ব্রাক্ষণদের ঝুলি ভরায় বা বড় বড় মঠ মন্দির  নির্মাণে। এই দিন আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো, সে শীলাদিত্য নয় - শীলান্ধকার।

বেচারা শীলাদিত্যকেই বা আমি কেন দোষ দিই? আজকাল কুলীন নাগরিক হওয়ার লক্ষণই হলো যে, সকলেই পরস্পরকে বঞ্চনা করে চলেছে। পুরাতন বৌদ্ধগ্রন্থে বুদ্ধকালীন রীতিনীতির কথা পাঠ করে আমি জেনেছি, পূর্বে মদ্যপান জল পানেরই সামিল ছিল। মদ্যপান না করাকে সেসময় উপবাস ব্রত বলে মনে করা হতো। আজকাল ব্রাহ্মণেরা মদ্যপান নিষিদ্ধ করেছে এবং প্রকাশ্যে মদ্য পান করায় শাস্তি পেতে হয়। এসবের পরিণাম কি? দেবতার নামে, সিদ্ধি সাধনার নামে লুকিয়ে ভৈরবীচক্র চলছে। ব্রহ্মচর্য নিয়ে মহা শোরগোল শুরু হয়েছে, কিন্তু পরিণাম? ভৈরবীচক্রে আপন-পর সকল স্ত্রী ভোগাধিকারভুক্ত। এর চেয়েও জঘন্য ব্যাপার, দেবতার বরদানের নামে সেখানে মাতা-ভগ্নী-কন্যা পর্যন্ত ভোগাধিকারভুক্ত হয়ে উঠেছে। আর পরিব্রাজক, ভিক্ষু এদের আখড়াগুলি অপ্রাকৃতিক ব্যভিচারের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে।

যদি সত্যই এই জগৎকে দেখাশোনার কেউ থাকতো, তবে এই বঞ্চনা, এই অন্ধকার এক মুহূর্তের জন্যও সে বরদাস্ত করতো না।

একবার আমি কামরূপ গিয়েছিলাম। সেখানকার রাজা নালন্দার ভক্ত এবং মহাযানের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাবান। আমি বলেছিলাম, “মহাযাত্রী বোধিসত্ত্বের ব্রতকে আপনি মান্য করেন, যে ব্রতে বলা হয়েছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত একটিও প্রাণী বন্দী হয়ে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত নির্বাণ আমার কাম্য নয়। মহারাজ আপনার রাজ্যে অনেক চণ্ডাল আছে, যারা দণ্ড হাতে নিয়ে নগরে আসে আর রাস্তায় আওয়াজ করতে করতে যায়। তারা লোককে সচেতন করে দেয়, যাতের তাদের ছোঁয়া লেগে কেউ যেন অস্পৃশ্য না হয়। তারা হাতে করে পাত্র বয়ে নিয়ে চলে, যাতে তাদের অপবিত্র থুতু নগরের পবিত্র মাটিতে না পড়ে। কুকুরকে স্পর্শ করলে মানুষ অপবিত্র হয় না, তার বিষ্ঠাও নগরকে চির দূষিত করে রাখে না। তবে কি চণ্ডালেরা কুকুরের চেয়েও অধম?”

“কুকুরের চেয়ে অধম নয়। এদের মধ্যেও জীবন প্রবাহ নিহিত আছে, যা বিকাশিত হয়ে বৌদ্ধিক উৎকর্ষে পৌঁছাতে পারে।”

“তাহলে রাজ্যে ঢোল বাজিয়ে ঘোষণা করে দিন না যে, আজ থেকে কোনো চণ্ডালকে নগরে আসতে দণ্ড অথবা কিদানী বয়ে আনতে হবে না?”

“এ আমার শক্তির অতীত; সমাজ ব্যবস্থা এমনভাবেই রচিত হয়েছে।”

“বোধিসত্ত্বের ধর্মে - মহামানবের কি এই ব্যবস্থা?”

“কিন্তু এখানকার সকল প্রজা তো মহামন্ত্র অনুসরণ করে চলে না।”

“গ্রামে, শহরে সর্বত্র আমি ত্রিরত্নের জয়দুন্দুভি বেজে উঠতে দেখেছি।”

“হ্যাঁ, কথা তো ভালোই। যেদিন আমি এ কথা ঘোষণা করবো, সেই দিনই আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরা আমার বিরুদ্ধে এই বলে তুফান সৃষ্টি করবে যে, সনাতন কাল থেকে চলে আসা এক সেতুকে আমি উড়িয়ে দিচ্ছি।”

“বোধিসত্ত্বায় জীবনের মহিমা সম্বন্ধে অহর্নিশি যে উপদেশ প্রচারিত হচ্ছে, কারও ওপর কোনো প্রভাবই কি তার পড়েনি? আমি বিশ্বাস করি মহারাজ, নিশ্চয় এর প্রভাব পড়েছে এবং যদি বোধিসত্ত্বের ন্যায় আপনি আপনার সমস্ত কিছু ত্যাগ করার জন্য প্রস্তত হন, তবে আপনাকে অনুসরণ করে চলার পথিকও পাওয়া যাবে।”

“রাজ্যের ভিতরকার প্রশ্নই শুধু নয়, পরমভট্টারকদেবও অসন্তুষ্ট হয়ে উঠবেন।”

“শীলাদিত্য! যে ‘নাগানন্দ’ নাটকে বোধিসত্ত্বের উজ্জ্বল চিত্র অঙ্কিত করেছে?”

“হ্যাঁ, প্রচলিত লোকাচার উঠিয়ে দেওয়া তাঁরও ক্ষমাতাধীন নয়।”

“এমন কথা যদি তথাগত, যদি আর্য অশ্বঘোষ অথবা নাগার্জুন মনে করতেন?”

“তাঁদের সাহস ছিল, তবু রীতি বর্জন করে তাঁরাও বেশী দূর যেতে পারেননি।”

“বেশীদুর নয়, অল্প দূরই আপনি চলুন মহারাজ, কিছুদূর আপনি অগ্রসর হন।”

“আপনি কি আমাকে নিজ মুখ দিয়ে কাপুরুষ বলিয়ে ছাড়বেন?”

“কাপুরুষ বলছি না। কিন্তু শুনুন, ধর্ম আমাদের কাছে এক নাগপাশ বিশেষ!”

“আমার অন্তরকে জিজ্ঞাসা করলে আমি ‘হ্যাঁ’ বলবো, রসনাকে জিজ্ঞাসা করলে সে পরিষ্কার ‘না’ বলবে অথবা একেবারেই মৌনব্রত ধারণ করবে।”



Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]