প্রবীর ঘোষের চোখে যৌনতা [পর্ব-দুই]

 


পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে বড় হয়েছিলেন ফ্রয়েড। আর দশটা ইউরোপীয় ইহুদি পরিবারের মতই তাঁর পরিবারের পুরুষরা সর্বশক্তিমান জিহোভার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করতেন। "প্রভু তোমাকে ধন্যবাদ, আমাকে নারী করে সৃষ্টি করনি বলে।" পরিবারের নারীরা প্রার্থনা করেছেন, "প্রভু তোমাকে ধন্যবাদ, তোমার ইচ্ছেমতো সৃষ্টি করেছ বলে।" ইহুদি পরিবারগুলোতে তিনি দেখেছেন পুরুষদের শোষকের ও শাসকের ভূমিকায় এবং নারীদের শোষিতের ভূমিকায়। লাগাতারভাবে অবদমিত নারী আর অবদমনকারী পুরুষ দেখতে দেখতে ফ্রয়েডের মনে হয়েছে নারী-পুরুষের এই অবস্থান, এই সম্পর্ক বুঝি বা প্রাকৃতিক, জৈবিক সহজাত, শাশ্বত। সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের চাপ কাটিয়ে তিনি প্রকৃত সত্যকে ধরতে পারেননি - পুরুষ ও নারীর যে সম্পর্ককে শাশ্বত বলে ধরে নেওয়া হয় তা বাস্তবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রভাবেরই ফল। এই পরিবেশই 'পুরুষালি' ও 'মেয়েলি' স্বভাবের স্রষ্টা। ফলে ফ্রয়েডের সংস্কারাচ্ছন্ন ভ্রান্ত চিন্তা ও রক্ষণশীলতা থেকে উদ্ভূত লিবিডো তত্ত্ব হয়ে দাঁড়ায় সহজাত প্রবৃত্তির তত্ত্ব, শাশ্বত প্রবৃত্তির তত্ত্ব। লিবিডো তত্ত্বে ফ্রয়েড বলেছেন, মানুষের প্রতিটি বাস্তব কাজই তার কাম নিয়ন্ত্রিত, জৈবিক প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত। 'লিবিডো' কী? কাম জীবনের চালিকাশক্তি। ফ্রয়েড বিশ্বাস করতেন পুরুষদের 'লিবিডো' বেশি এবং নারীদের 'লিবিডো' কম। লিবিডোই যেহেতু মানুষের বিকাশের কারণ, তাই সমাজ-বিকাশে পুরুষের ভূমিকাই মুখ্য। নারীর পক্ষে শ্রেষ্ঠত্বে পুরুষের প্রতিযোগী হওয়া সম্ভব নয়। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন, মানব প্রজাতির সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে শুধু এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই নয়, মানব প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্বও পুরুষের একচেটিয়া। এক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা শুধুমাত্র আধার এর। তাঁর ধারণায়, পুরুষ সন্তান চাইলে নারী সহযোগিতা না করলেও, সম্মতি না দিলেও সন্তান উৎপাদন সম্ভব, পুরুষের জোর খাটানোর দ্বারাই সম্ভব। কিন্তু পুরুষের সহযোগিতা না পেলে মানব প্রজাতি টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব বহন করা নারীর সাধ্যাতীত। ফ্রয়েডের তত্ত্বের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো - শৈশবে নারীর আবিষ্কার পুরুষের মতো তার দীর্ঘ লিঙ্গ নেই। সে লিঙ্গহীন। যেন লিঙ্গটি কেটে নেওয়া হয়েছে। যোনির উপরিভাগে ফুলের পাপড়ির মতো ভগাঙ্কুরকে বালিকা মনে করে, এটিই খণ্ডিত লিঙ্গ। বালিকা তার ভগাঙ্কুর দিয়ে হস্তমৈথুন করতে গিয়ে বুঝে ফেলে হস্তমৈথুনের জন্য পুরুষের লিঙ্গই সেরা। দুই লিঙ্গের এই পার্থক্য থেকে নারী হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকে। দীর্ঘকাল ধরে নারী মনের গভীর প্রত্যাশা পোষণ করে, তার লিঙ্গও একদিন পুরুষের মতো দীর্ঘ হয়। এমনকী যখন নারীর চেতন মন বাস্তববোধ দ্বারা বুঝতে পারে এমনটা ঘটা কখনই সম্ভব নয়, তখনও তার অবচেতন মনে প্রত্যাশা দানা বেঁধে জমাট হতেই থাকে। নারীদের সৃষ্টিশীল ও মননশীল কর্মজীবনের পিছনেও অনেক সময় থাকে অবদমিত বাসনার থেকে উদ্ভূত সৃষ্টির রূপ। [The Psychology of Women by Sigmund Freud; Translated by W.J.S. Sprott. The Hogaarth Press Ltd. London, Page No. 160-161]

ওই বইয়েই ১৬৫ পৃষ্ঠায় ফ্রয়েড মতপ্রকাশ করেছেন, নারীর তীব্র সন্তান কামনার পিছনে রয়েছে পুরুষ লিঙ্গের প্রতি তীব্র ঈর্ষা। নারীর সন্তান সুখ আরও বৈশিষ্ট্য অর্জন করে যদি ভূমিষ্ঠ শিশুটি হয় পুরুষ। ফ্রয়েড-এর এমনতর অদ্ভুত মনোবিশ্লেষণের পিছনে ছিল অবশ্যই পুরুষতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক পরিবেশে তাঁর বড় হয়ে ওঠা। তিনি বিশ্বাস করতেন, পুরুষরা নারীর তুলনায় শ্রেষ্ঠ, কারণ পুরুষদের দীর্ঘ লিঙ্গ যৌন উত্তেজনা উপভোগের পক্ষে শ্রেষ্ঠ। তাঁর চোখে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক - লিঙ্গের যৌন উত্তেজনা। ফ্রয়েডের এই তত্ত্ব যে বিশাল ভুলের চোরাবালুতে দাঁড়িয়ে রয়েছে পরবর্তীকালে তা প্রমাণিত এবং মনোবিজ্ঞানী ও মনোরোগ চিকিৎসকদের দ্বারা স্বীকৃত। পৃথিবীর তাবৎ মনোবিশেষজ্ঞদের মধ্যে সাড়া জাগানো মানুষের যৌন সম্পর্কের আকর গ্রন্থ "Human Sexual Response"-তে W. H. Masters and V.E Johnson (প্রকাশকাল ১৯৬৬)-এর গবেষণাকর্ম প্রকাশিত হয়েছে। তাঁরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন, সহজাত এবং জৈবিকভাবেই নারী, পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি কাম উপভোগ করে।

নারী খুব দ্রুত বারবার চরম যৌন উত্তেজনা উপভোগে সক্ষম, যে সক্ষমতা পুরুষের নেই। মাস্টার্স ও জনসন এর আধুনিক গবেষণা ফল লাভ করার আগে মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল নারীর যৌনসুখের খনি যোনি গহ্বর। এখন মাস্টার্স ও জনসনের সূত্র ধরে বারবার গবেষণার ফলে নারীদের সুখানুভূতির বিষয়ে ধারণাই গেছে পাল্টে। আজ প্রমাণিত নারীর যৌনসুখের আসল খনি ভগাঙ্কুর। পুরুষের কাম অঙ্গের ভিন্নতর কাজও আছে। কিন্তু নারীর এই ভগাঙ্কুরের একটিই কাজ - যৌন-সুখানুভূতির সৃষ্টি করা। সুতরাং যৌন উত্তেজনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাস্তবে ভগাঙ্কুর পুরুষের দীর্ঘ লিঙ্গের তুলনায় নিকৃষ্ট তো নয়ই, বরং অনেক বেশি উৎকৃষ্ট। নারী পুরুষ লিঙ্গকে ঈর্ষা করে না, করতে পারে না আরও একটি কারণে - দুই লিঙ্গের স্বমৈথুনজাত উত্তেজনার পরিমাপ নেওয়া বাস্তবে নারী বা পুরুষ, কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সচেতন নারী এই অভিজ্ঞতাই অর্জন করে থাকে, মৈথুন পরবর্তী বীর্যপাতের চূড়ান্ত আনন্দ ও উত্তেজনা লাভের পরে পরেই পুরুষ আবার যৌন আনন্দ উপভোগে অক্ষম, জৈবিক কারণেই অক্ষম। নারী কিন্তু লাগাতারভাবে একের পর এক যৌন উত্তেজনার চূড়ান্তে পৌঁছতে সক্ষম। নারী ঈর্ষা করলে করে বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণির পুরুষকে, পুরুষের লিঙ্গকে নয়।

ভারতের বহু প্রদেশেই নারী পরিবারের বোঝা। তাই জন্মের পরেই নারীকে হত্যা করা হয় নুন গলায় পুরে দিয়ে, শ্বাসরোধ করে বা খাটিয়ার পায়ের তলায় পিষে। পরিবারের কাছে যে নারী জন্মমুহূর্ত থেকেই মানুষ বলে বিবেচিত হয় না, যে নারী শিশুকাল থেকেই দেখে আসছে ভালোটুকু খাবে ভাই, পুরুষের খাওয়া শেষে এঁটো-কাঁটা উদরে পুরবে নারী, শিক্ষার অধিকার ভাইয়ের জন্যই সংরক্ষিত; রান্না-বান্না-বাসন মাজা-কাপড় কাচা-ঘর সাফাই এসব শিক্ষাই নাকি নারী জীবনের প্রকৃত শিক্ষা - সে নারী পুরুষকে ঈর্ষা করলে করবে এই বৈষম্যের কারণেই, এই সামাজিক কারণেই, পুরুষের লিঙ্গ লম্বা আকৃতির বলে নয়। নারীর সন্তান কামনার কারণও জৈবিক নয়, সমাজ-সাংস্কৃতিক। শৈশব থেকে নারীর মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ অনবরত একটি চিন্তার বীজ বুনে গেছে - "মাতৃত্বেই নারী জীবন সার্থক হয়ে ওঠে।” ফ্রয়েড নারী-পুরুষের অবস্থানকে সহজাত, শাশ্বত বলে ধরে নিয়েছিলেন। তিনি পুরুষ আধিপত্যকে মনে করেছিলেন - এই প্রাকৃতিক নিয়ম সহজাত। এসবই ছিল ফ্রয়েডের চিন্তার ভ্রান্তি, সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের বিশাল প্রভাব সম্পর্কে না জানার ফসল। ফ্রয়েড তাঁর অজ্ঞতা থেকেই মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের চেয়েও গুরুত্ব দিয়েছিলেন যৌনাঙ্গকে। মনোবিজ্ঞানের নামে, তাঁর তত্ত্বের অনেকটাই ছিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের ফসল। ফ্রয়েড সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রভাবের ফলশ্রুতি হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন, নারী প্রাকৃতিক নিয়মেই পীড়িত হওয়ার মধ্যে এক ধরনের সুখ অনুভব করে [Human Sexual Response গ্রন্থের ১৪৮-১৪৯ পৃষ্ঠায়]। ফ্রয়েডীয় এই 'মর্ষকাম' বা 'পীড়িত হওয়াতেই সুখ' তত্ত্বকে মেনে নিলে পুরুষ দ্বারা নারী পীড়নকেও স্বাগত জানাতে হয়, নারীর সুখের স্বার্থেই জানাতে হয়। ফ্রয়েডের এই চিন্তাও পুরুষতন্ত্রের কুসংস্কারেরই ফসলমাত্র। স্বামীর শত অত্যাচারের পর, শত লাম্পট্যের পরও স্ত্রী স্বামীর সুখেই সুখ অনুভব করুক, লম্পট স্বামী লাম্পট্যের জন্য দুরারোগ্য ব্যাধির শিকার হলে, তার সেবার মধ্যে দেহ লীন করে সুখ অনুভব করুক, পরিবারের প্রতি কর্তব্য, সন্তান পালন, রাঁধুনি ও দাসীগিরির পর পুরুষদের উচ্ছিষ্টের দ্বারা পেটের জ্বালা নিভিয়ে আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে নিজেকে চিন্তা করে সুখানুভূতিতে আপ্লুত থাকুক - এসবই পুরুষরা চায়। আর চায় বলেই প্রতিনিয়ত নারীদের মগজ ধোলাই করে নারীদের এইসব পীড়নকে আত্মত্যাগের মহত্ত্বে মুড়ে দিতে চেয়েছে। নারী যে বঞ্চিত হওয়ার পরেও আত্মত্যাগের সুখ অনুভব করে, তা কখনওই প্রাকৃতিক নিয়ম নয়, শাশ্বত নয়, সহজাত নয়। সম্পূর্ণভাবেই সাংস্কৃতিক কারণে নারী 'মর্ষকামী' হয়ে উঠেছে। সঠিক স্বচ্ছ চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হলে নারী আর 'নারী' না থেকে 'মানুষ' হয়ে উঠবে। তখন সে নতুন মূল্যবোধের দ্বারা পরিচালিত হয়ে নতুন সুখের স্বাদ গ্রহণ করতে সক্ষম হবে।

এই শতকের তিরিশের দশকের শুরু থেকে ষাটের দশকের শুরু পর্যন্ত পশ্চিমে ঘটেছিল রক্ষণশীলতার প্রত্যাবর্তন। নানা ধরনের রক্ষণশীলতার মধ্যে একটি ছিল নারীর মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টাকে প্রতিহত করে নারীকে আবার 'নারী' করে তোলা। এই সময় বিজ্ঞানের নাম করে সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞানের নামে নারীকে প্রাকৃতিক নিয়মেই পুরুষের চেয়ে হীন, পুরুষের শাসনে সুখী, খণ্ডিত মানুষ হিসেবে রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা প্রকট হয়ে উঠেছিল। নারী মুক্তির আন্দোলন, নারীর সমানাধিকার দাবির আন্দোলন যখন পশ্চিমে দানা বাঁধছে, পশ্চিমের মানুষরা বেশি বেশি করে বুঝতে পারছে নারীদের হীনতার কারণ প্রাকৃতিক বা সহজাত নয়, সাংস্কৃতিক, তখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীদের পায়ের তলায় দাবিয়ে রাখতে ফ্রয়েডের যৌনগন্ধী কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভ্রান্ত চিন্তাকে 'মনোবিজ্ঞানের নতুন তত্ত্ব'র ছাপ মেরে বাজারে ছাড়লো। শুধু তাই নয়, ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের জনপ্রিয়তা তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মহলের বুদ্ধিকে গুলিয়ে দিয়ে নারীদের যে বিপুল ক্ষতি করেছিল, পশ্চিমের কোনও ধর্ম নারীদের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। আজও আমাদের সমাজের মধ্যবিত্ত সুলভ মানসিকতাসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীরা মনোবিজ্ঞানের কথা উঠলেই ফ্রয়েডের কথা বলে বোঝাতে চান - ব্যাপারটা বেশ জানেন বোঝেন। কী বোঝেন? তাঁরা কি সত্যিই বোঝেন ফ্রয়েডের কুসংস্কারাচ্ছন্ন তত্ত্বকে মনোবিজ্ঞানের ছাপ মেরে চালাতে চেয়েছিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ? ফ্রয়েডের তত্ত্ব বহু আগেই বিজ্ঞানের হাতেই তামাদি হয়ে গেছে। তবু ফল্গুধারার মতো আজও মানুষের মনে ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব স্রোতবান রয়েছে।

ভারতের মতো শিক্ষার সুযোগহীন দেশের পক্ষে ফ্রয়েডের বিজ্ঞানের প্রলেপ লাগানো ব্যাখ্যার চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় স্বামী বিবেকানন্দের বাণী, বিবেকবাণী। বি. জে. পি. থেকে মার্কসবাদী - সব্বার চোখেই স্বামী বিবেকানন্দ মানবতাবাদী, যুক্তিবাদী, অবদমিতের বিরুদ্ধে উত্থিত বিবেক, ভারত-আত্মা ইত্যাদি বহুতর বিশেষণের যোগ্য অধিকারী। প্রচারের দৌলতে বিবেকানন্দ আজ প্রগতি, সাম্য ও মানবতার প্রতীক হিসেবে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এমন দৃঢ়বদ্ধ ধারণার পিছনে যুক্তি কতটুকু? তাঁর মানবতাবাদ ও সাম্য চিন্তা যে কী বিশাল রকমের ঠাট্টা তা তাঁর রচনাবলি পড়লেই ছত্রে ছত্রে হাতে গরম প্রমাণ পাওয়া যাবে।

আমাদের দেশের হিন্দু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যখন বিধবাদের উপর নিজেদের চরম অমানবিকতাকে ধর্মের প্রলেপে ঢাকতে সহমরণকে সতীর আদর্শ হিসেবে প্রচার করে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিতে সচেষ্ট হয়েছে তখন বিবেকানন্দও একইভাবে বলেছেন, "আদর্শের চরম অবস্থায় হিন্দু বিধবারা সহমরণে দগ্ধ হইতেন।"

[বাণী ও রচনা: স্বামী বিবেকানন্দ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০]

নিবেদিতাকে একবার বিবেকানন্দ বলেছিলেন, "জগতের চোখে সহমরণ প্রথা এত বড় কেন - ওতে ইচ্ছাশক্তির বিকাশ হয় বলে।" [স্বামীজিকে যেরূপ দেখিয়াছি, ভগ্নী নিবেদিতা, পৃষ্ঠা ১৮৩] 

সতীদাহ প্রথার প্রতি এমন নগ্ন সমর্থনে বিবেকানন্দের 'প্রগতি চিন্তা', যা নারী নির্যাতনে হিন্দু পুরুষতন্ত্রকে সমর্থন জানায়। বিবেকানন্দের সাম্যচিন্তা তো একবারের জন্যেও বিপত্নীকদের সহমরণে যেতে 'আদর্শের চরম অবস্থা' ইত্যাদিকে আবিষ্কার করে না!

তথাকথিত সাম্যবাদী বিবেকানন্দ নারী-পুরুষের সমানাধিকার, কোনওভাবেই মেনে নিতে পারেননি। তিনি পাশ্চাত্যের নারী স্বাধীনতার প্রতি শ্লেষ প্রকাশ করে বলেছেন, "ওদেশে (পাশ্চাত্যে) মেয়েদের দেখে আমার অনেক সময় স্ত্রীলোক বলেই বোধ হতো না - ঠিক যেন পুরুষ মানুষ। গাড়ি চালাচ্ছে, স্কুলে যাচ্ছে, প্রফেসরি করছে! একমাত্র ভারতবর্ষেই লজ্জা, বিনয় প্রভৃতি দেখে চক্ষু জুড়ায়।" [বাণী ও রচনা: পৃষ্ঠা-১৮]

প্রতিটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সমর্থক চায় নারীরা শিক্ষায়-দীক্ষায় পুরুষের সমকক্ষ হতে সচেষ্ট না হয়ে, মানুষ না হয়ে, নারী হিসেবেই তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করুক। নারীর শিক্ষা হবে খণ্ডিত মানুষে পরিণত হওয়ার শিক্ষা। নারীর শিক্ষা আবর্তিত হবে গৃহকর্ম, রন্ধন, সেলাই, সহ্যগুণ, সেবা, লজ্জা ইত্যাদি বিষয়ে উৎকর্ষতা লাভের মধ্যে। স্বামীজি ছিলেন এমনই এক পুরুষতান্ত্রিকতার সমর্থক। স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে বিবেকানন্দের মূল কথা ছিল - নারীরা শিখবে গৃহস্থালির কাজকর্ম, সেলাই, রান্না। নেবে ধর্ম শিক্ষা। বিধবা বিবাহ বিবেকানন্দ সমর্থন তো করেনই নি, বরং বহু ক্ষেত্রেই তিনি বিধবা বিবাহকে সমালোচনা করেছেন, কটাক্ষ করেছেন। তিনি একথাও বলেছেন, "বিধবাগণের স্বামী সংখ্যার উপরে কোন জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে না।" অথচ এমন কোনও তীর্যক উক্তি বিপত্নীকের বিবাহ নিয়ে একবারের জন্যেও তাঁর মুখ থেকে বর্ষিত হয়নি।

মানুষের একটাই ধর্ম হওয়া উচিত। তার নাম 'মনুষ্যত্ব'। মানুষের অধিকারের প্রতিষ্ঠা ও পরিপূর্ণ বিকাশের মধ্যেই মনুষ্যত্বের সার্থকতা। সেখানে কেউ যদি নারীকে মনুষ্যজাতি থেকে পৃথক করে উপদেশ দেন, "মনে রাখিও, কায়মনোবাক্যে পতিসেবা করা স্ত্রীলোকের প্রধান ধর্ম" - তবে তাঁকে মনুষ্যত্বের শত্রু হিসেবে গণ্য করতেই হয়। এর পরও এই উপদেশ প্রদানকারী বিবেকানন্দকে যখন কেউ মানবতাবাদী বলে সোচ্চারে ঘোষণা করেন, তখন তাকে 'আহাম্মক' অথবা 'অসৎ' ছাড়া আর কিছুই ভাবার অবকাশ থাকতে পারে না। সাম্যের পূজারি, সাম্যবাদী স্বামীজি তো কই একবারের জন্যেও ঘোষণা করেননি, "মনে রাখিও, কায়মনোবাক্যে পত্নীসেবা করা পুরুষলোকের প্রধান ধর্ম"। কেন করেননি? নারীর উপর পুরুষের একচ্ছত্র প্রভুত্বে তিনি বিশ্বাস করতেন বলেই করেননি, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখেননি বলেই করেননি। বিবেকানন্দ সেই পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিনিধি, যে পুরুষতন্ত্র স্ত্রীতে অনুরক্ত স্বামীকে 'স্ত্রৈণ' আখ্যা দেয়, যা হীনবাচক শব্দ হিসেবে সমাজে পরিচিত।

- 'যুক্তিবাদের চোখে নারীমুক্তি', প্রবীর ঘোষ

.........................................................................................

হত-দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষগুলোর দিকে তাকান যার অর্ধেক নারী, অর্ধেক পুরুষ। ভোরের আলো ফোটার আগেই মদন, চিন্তামণি, কুসুম, কেষ্ট বস্তা পিঠে ঝুলিয়ে ফুটপাথ বা ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে এসে দ্রুত এক থেকে আর এক ডাস্টবিনে ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে। লোহার আঁকশি দিয়ে ময়লা সরিয়ে আবিষ্কার করতে থাকে ছেঁড়া কাগজ, প্লাসটিক, লোহার টুকরো, বাতিল ব্যাটারি। ভোর না হতেই কুমির, হাঙরের কামড়কে উপেক্ষা করে খ্যাপলা জাল নিয়ে খাল-বিল চষে বেড়ায় আদুরি, হরি, শ্রীদাম, রেণু। মদন, চিন্তামণি, গোপাল, নিত্য, নুরবানু হাতে হাত মিলিয়ে, প্রচুর ঘাম ঝরিয়ে গড়ে তোলে প্রাসাদের প্রাথমিক উপাদান ইট। ইটের পাঁজা ও সিমেন্ট মাখা কড়াই মাথায় নিয়ে দুর্গা, আনারকলি, শেফালীরা বাঁশের মই বেয়ে উঠে গিয়ে যতীন, রাজেন, ইসমাইলদের জোগান দেয়। কুমড়ো, বেগুন, পটল, কলা নিয়ে ভোর ৪-১৫ মিনিটের তারকেশ্বর-হাওড়া ফার্স্ট লোকাল ধরে কমলা, সোনা, মিনতি। ওরা যখন হাওড়া ব্রিজে আনাজ নিয়ে বসে তখন বাড়িতে ছানা-পোনাগুলোকে রেখে পুরুষগুলোও বেরিয়ে পড়ে জন খাটতে কি রিক্সা টানতে। এদের গায়ে-মাথায় প্রতিদিন তেল পড়ে না, জল পড়ে না। রুক্ষ চুলের জঙ্গলে বাসা বাঁধে পরজীবী উকুন। চামড়া ফাটে। পেটের চিন্তায় সকাল থেকে রাত এত খেটেও পেট ভরে না। তেতে থাকা মাথা যখন-তখন জ্বলে ওঠে। চিল চিৎকারে মেয়ে-মরদে ঝগড়া করে। মারামারি করে। একমাত্র বিনোদন হিসেবে সংগমে মেতে ওঠে। এদের বিয়েতে সানাই বাজে না। উলু, শঙ্খ ধ্বনি উধাও। এরা পছন্দের মানুষের সঙ্গে এক কথায় ঘর বাঁধে। না পোষালে এক কথায় ঘর ভেঙে নতুন মানুষ খুঁজে নিতে একটু দ্বিধা করে না। এখানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার। শোষকদের কৃপণ আঙুলের ফাঁক দিয়ে যেটুকু স্বাধীনতা চুইয়ে পড়ে তাই এই সমাজের নারী-পুরুষ সমান ভাগে ভাগ করে নেয়।

এতটা শুনে অনেকেই বলবেন - রোজগেরে নারীর পুরুষের গোলামি করার দরকার হয় না। স্বীকার করছি - আর্থিক ক্ষমতার জোরকে কাজে লাগিয়েই বহু ক্ষেত্রে পুরুষ নারীকে কড়া শাসনে রাখে। কিন্তু এটাই পুরোপুরি সত্য নয়, তারই ছোট্ট দৃষ্টান্ত আমার চার্টার্ড বাসের সহযাত্রিণী মিসেস লোহিয়া, মিসেস মুখার্জি, চৈতালীদি, কবিতাদি'রা। ওঁদের মাথায় ও মুখে ঘোরে 'সানন্দা'র চাটনি, অপর্ণার বিয়ে, আনন্দলোকের গসিপ, শেয়ার-বাজার, রাজনীতি, রান্না-বান্না, শাড়ি, গয়নাগাটি, নারীত্ব, সতীত্ব, স্বামীসেবা, সন্তান-পালন। এরই মাঝে ড্রাইভারের কেবিনে বসা রিতা সান্যালকে নিয়ে নারী কণ্ঠগুলো মেকি চাপা গলায় ফিসফাস করেন আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে - রিতা ব্যাঙ্কের ছুটির পর পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে ক্যারাম খেলেন। সেই সময় সিগারেটও খান। অজয় ওর দু-নম্বর স্বামী - এক নম্বরের ভেড়ুয়া। আমার মিস্টার হলে পাছায় লাথি মেরে তাড়িয়ে দিতো।

কবিতাদিদের মত নারীরা আসলে কড়া স্বামীর অভিভাবকত্বে থাকতে ভালোবাসেন, স্বামীর গোলামি করতে ভালোবাসেন। এঁরা কড়া বাবার অভিভাবকত্বে এবং অবদমিত মাকে দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠার ফলে পুরুষ শাসিত থাকতে স্বস্তি পান, নিশ্চিন্ত বোধ করেন। 'সতীত্ব' ও 'মাতৃত্ব'-এর মধ্যেই খুঁজে পান নারী জীবনের সার্থকতা। এই চৈতালীদি, কমলাদি, মিসেস মুখার্জি, মিসেস লোহিয়ারাই তাঁদের পুত্রবধূদের পুত্রের গোলাম করতে নীতির মোড়কে মগজ ধোলাই করেন, কখনও বা দেন সরাসরি ধোলাই। অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও এইসব নারীদের পুরুষদের গোলামি থেকে মুক্ত করতে পারে না। এই বন্ধনের কারণ অবশ্যই সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশ। তাই নারীর সামগ্রিক মুক্তির জন্য শুধু অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই যথেষ্ট নয়, এর জন্য নারী মুক্তির আন্দোলনকারীদের 'স্বাধীনতা' শব্দের অর্থ বোঝার মতো চিন্তার স্বচ্ছতার একান্তই প্রয়োজন।

এই সত্যকেও খুঁজে বের করতে হবে, বুঝতে হবে - আর্থ-সামাজিক ও সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রধান নিয়ন্ত্রণ শক্তি কে? দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চাবিকাঠি কার মুঠোবন্দি? কে নিয়ন্ত্রণ করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, যে ব্যবস্থা 'নারী'কে 'নারী' করে রেখেছে, মানুষ হয়ে উঠতে দেয়নি? কে নিয়ন্ত্রণ করে দুর্নীতির সংস্কৃতি, ভোগবাদী সংস্কৃতি, ভাববাদী সংস্কৃতি? কার লালন-পালনে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম পৃষ্ট হয় - যে ধর্ম মনুষ্যত্বকে অবমাননা করতে শেখায়, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়, বঞ্চনার কারণ অনুসন্ধানে বঞ্চিতদের পথভ্রষ্ট করে? প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ, সত্য অনুসন্ধান করুন। সততার সঙ্গে, আন্তরিকতার সঙ্গে সত্য অনুসন্ধান করুন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এসবের নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে আপনি খুঁজে পাবেন শাসক ও শোষকের গোপন আঁতাতকে, যার আর এক নাম 'রাষ্ট্রশক্তি'। আমাদের এ কথাও মনে রাখতে হবে - সার্বিকভাবে নারী মুক্তির সঙ্গে আর্থ-সামাজিক ও সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রভাবের সম্পর্ক এবং এই দুই পরিবেশের সঙ্গে রাষ্ট্র শক্তির সম্পর্ককে বুঝতে পারাটা নারী মুক্তি আন্দোলনকে জয়যুক্ত করার প্রথম ধাপ। এই সম্পর্ক বিষয়ে যিনি স্বচ্ছ ধারণার অধিকারী, তিনিই নারী মুক্তি আন্দোলনের সুযোগ্য নেতৃত্ব দেবেন - এমন কথা আমি বলছি না। অনেক রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীই এই সবই ভালোই বোঝেন, কিন্তু তারপরও রাষ্ট্রশক্তির সহায়তা করে আখের গোছাতে অতি মাত্রায় আগ্রহী হয়ে পড়েন। বুদ্ধিজীবীদের সিংহভাগই রাষ্ট্রশক্তি ও প্রচার মাধ্যমগুলোর রোষদৃষ্টিতে পড়ার চেয়ে কৃপাদৃষ্টিতে পড়ায় বেশি আগ্রহী। তাই রাষ্ট্রশক্তি ও তার সহায়ক প্রচার মাধ্যমগুলোর পলিসির সঙ্গে সহযোগিতা করে রাষ্ট্রের সামগ্রিক 'মগজ ধোলাই' প্রক্রিয়াকে সার্থক করার মধ্য দিয়ে কিছু বাণিজ্য করে নেন। 

[ঐ]

....................................................................................

চিন্তায় এগিয়ে থাকা মানুষদের চোখে প্রাথমিকভাবে যৌন স্বাধীনতাকে সমর্থন ও যৌন শোষণকে ঘৃণা করাটা গুণ হিসেবে বিবেচিত হওয়াই স্বাভাবিক। এখানেই উঠে আসে যৌন স্বাধীনতার সংজ্ঞা নিয়ে বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা।

আমি প্রবীর ঘোষ আমার বাড়ির পরিচারিকা মেয়েটিকে নিয়ে মাঝেমধ্যে বিছানায় শুলে সেটাকে পাঠক-পাঠিকারা কীভাবে নেবে, জানতে ইচ্ছে করছে। আমাকে কি যৌন স্বাধীনতার পূজারি বলে 'হিরো' হিসেবে তুলে ধরবেন? নাকি যৌন শোষণকারী ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত করবেন?

সুস্থ যৌন স্বাধীনতায় বিশ্বাসীরা আমার এমন চরিত্রকে নিশ্চয়ই ঘৃণা করবেন - এই বিশ্বাস রাখি। সেই সঙ্গে এই প্রত্যাশাও রাখি, তাঁরা নিরপেক্ষ মনের মালিক। নিরপেক্ষ মন নিশ্চয়ই বলে যে কাজ করাটা আমার ক্ষেত্রে গর্হিত অন্যায়, সে কাজ যে-ই করুক, তা গর্হিত বলেই চিহ্নিত হবে। তসলিমা যদি পরিচারককে মাঝেমধ্যে বিছানায় তোলে, সে কাজকেও ঘৃণ্য বলতেই হবে নিরপেক্ষতার খাতিরে। তসলিমার যৌন শোষণকে কোনও ভাবেই 'যৌন স্বাধীনতা' বলে চিহ্নিত করতে পারি না। বিষয়টা ভিন্ন মাত্রা পায়, যখন তসলিমা লেখেন, কামনা তাড়িত তসলিমা তাঁর কর্মচারীকে নিয়ে বিছানায় শুতে মায়ের মুখের উপর ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন; তখন গা গুলিয়ে বমি আসে। এত নোংরা!

তসলিমা তাঁর আত্মকথায় অনেক বিশিষ্ট বাঙালি লেখকদের সঙ্গে তাঁর শারীরিক সম্পর্কের কথা লিখেছেন। লেখকদের নাম উল্লেখ করার মধ্যে কেউ কেউ তাঁর সারল্যের পরিচয় খুঁজে পেয়েছেন।

অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক-গায়িকা, লেখক, খেলোয়াড় ইত্যাদি কিংবদন্তি চরিত্রেরই বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে কোনও দুর্বল মুহূর্তে সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু তাঁরা সেসব নিয়ে বন্ধুদের কাছে রসালো নোংরা গল্প ফাঁদতে বসেন না। আপনার পাড়ার, অফিসের বা আত্মীয় লম্পট মানুষটির বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছেন? করলে দেখবেন, এদের একটা বিশেষ প্যাটার্ন আছে। এরা বাকপটু, স্মার্ট, রসবোধে ভরপুর, টার্গেট করা অপজিট সেক্সদের উপকার করাতে উঁচিয়ে থাকে। এরা যতটা পটাতে ওস্তাদ, ততটাই ওঁচা। পরিচিত, স্বল্প পরিচিতদের বিছানায় তোলার গল্প বন্ধুদের বলে বিকৃত আনন্দ পায়। এই বিকৃত আনন্দ পেতে সত্যি-মিথ্যে সব ধরনের গল্পো ফেঁদে বসে।

এখানেই রয়েছে সুপারস্টার তরলচিত্রদের সঙ্গে পেঁচি লম্পটদের অ্যাটিচুডের পার্থক্য।

এইসব লম্পটরা যাঁদের নাম প্রকাশ্যে এনে চরিত্রে কাদা মাখায় সেই মানুষরা এরপর আর কোনও দিনই কি লম্পটটির সঙ্গে কথা বলবেন? নিজেও পেঁচি লম্পট না হলে সৌজন্যতার খাতিরেও কথা বলবেন না।

তসলিমা একটি ব্যতিক্রমী চরিত্র। লেখক হিসেবে যথেষ্ট নাম-টাম হয়েছে, অথচ অ্যাটিচুডে পেঁচি লম্পটদের চরিত্রের সঙ্গে গভীর মিল রয়েছে। ব্যতিক্রমটা এখানেই। তসলিমা তার আত্মজীবনীমূলক লেখায় যাঁদের চরিত্র হনন করেছেন, তাঁরা একই যুক্তিতে তসলিমাকে ঘৃণা করেন। এবং এটাই স্বাভাবিক।

তসলিমার আত্মজীবনীতে উঠে আসা যৌন উচ্ছৃঙ্খলতাকে কোনও যুক্তিতেই আমরা 'সুস্থ যৌন স্বাধীনতা' বলতে পারি না। প্রেম থাকলে যৌন সম্পর্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শুধুমাত্র যৌনতার প্রতি ভালোবাসা কখনই 'প্রেম' নয়। যৌনতার জন্য যৌনতাই লাম্পট্য, অসুস্থ যৌন স্বাধীনতা যৌন উচ্ছৃঙ্খলা।

[ঐ]

..................................................................................

প্রেমের কিছু পূর্ব-শর্ত আছে। বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, সহযোগিতা, মতাদর্শগত মিল এবং স্বনির্ভরতা।

অর্থনৈতিকভাবে প্রেমিকা প্রেমিকের উপর নির্ভরশীল হলে অথবা উলটো হলে প্রেমের ভিত খুবই কমজোরি হয়ে পড়ে। আত্মমর্যাদার সঙ্গে, স্বতন্ত্র সত্তা বজায় রেখে প্রেমের সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে দু-জনেরই আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়াটা জরুরি। নতুবা প্রেমের সম্পর্কটা খাদ্য-খাদকের সম্পর্কে গিয়ে দাঁড়ানোটা শুধুই সময়ের অপেক্ষা।

প্রায় সমগ্র ভারতের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজে আর্থিকভাবে বরের উপর নির্ভরশীল বউদের অবস্থা সাধারণভাবে কম-বেশি একই রকম। 'স্বামী'র অর্থাৎ প্রভুর যৌন স্বাধীনতা একতরফাভাবে রক্ষিত হয়। যখন ইচ্ছে, যেভাবে ইচ্ছে ঘরে-বাইরে তার যৌন স্বাধীনতাকে প্রয়োগ করে।

ধনী ও শিল্পপতিদের পত্নীদের অনেকেই পতির টাকায় যৌন স্বেচ্ছাচার চালায়। মধ্যবিত্ত বউদের একটা বড় অংশই স্বামীর যৌনদাসী হয়ে পড়ে। কারণ ছোটবেলা থেকে মা-ঠাকুমার কাছে 'শিক্ষার' দৌলতে দেহ মিলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে না। সেটা একমাত্র পুরুষের অধিকার। রমণী পুরুষের রমণের জন্য। যে নারী নির্লজ্জের মতো রতি কামনা করে সে ভ্রষ্টা নারী, নষ্টা নারী।

এমন একটা ভাবনা থেকেই বিবাহিতা মহিলারা নিজের স্বাভাবিক যৌন প্রবৃত্তিকে গলা টিপে মারে। যৌন অবদমনের ফলে বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই এই নারীদের যৌন জীবন বিরক্তিকর একঘেয়েমিতে পরিণত হয়। অবদমিত যৌন আবেগের কারণে অনেকেই psycho-somatic disorder-এর শিকার হয়। 'Psycho-somatic disorder' শব্দের অর্থ 'মানসিক কারণে শারীরিক অসুখ'।

এমন যৌনদাসীদের আরও একটি অংশ স্বাভাবিক প্রবৃত্তি যৌন আবেগকে প্রশমিত করে অন্য পুরুষদের দ্বারা।

অবদমিত যৌন আবেগ থেকে বহু ধরনের অসুখ হতে পারে। যেমন - শরীরের নানা ধরনের যন্ত্রণা, কোনও অঙ্গে অবশতা, হাঁপানি, আলসার, আধকপালি, মাথা ব্যথা, কামশীলতা, পুরুষত্বহীনতা ইত্যাদি। তাই অবদমিত যৌন আবেগ সুস্থ যৌন স্বাধীনতার বিরোধী।

আবার যৌন আবেগ মেটাতে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন পদ্ধতিও সুস্থ সমাজের পক্ষে কাম্য নয়।

আমরা যাদের নিম্নবর্গের নারী বলি, তারা সাধারণভাবে শ্রমজীবী। ইটভাটা থেকে ছোট কারখানায়, ফুটের সবজি বিক্রেতা থেকে বাড়ির পরিচারিকা ইত্যাদি পেশায় এরা নিযুক্ত। এরা মিলনের সময় সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। বর বেশি শাসন ফলাতে গেলে নতুন মনের মানুষ খুঁজে নিয়ে নতুন সংসার পাতে। স্বনির্ভরতাই এদের যৌন স্বাধীনতার মূল উৎস।

[ঐ]

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]