ধর্মরাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম - আনিসুজ্জামান

 

....যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল, অনেকে সে তত্ত্বের উদ্গাতা বলে জানেন স্যার সৈয়দ আহমদ খানকে (১৮১৭-৯৮)। তাঁর বহু বক্তব্য এ ধারণা সমর্থন করে, তবে উল্টো কথাও তিনি বলেছিলেন। ১৮৮৪ সালে স্যার সৈয়দ দু'টি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা দেন। জানুয়ারি মাসে গুরদাসপুরে তিনি বলেন:

Remember that the words Hindu and Mahomedan are only meant for religious distinction-otherwise all persons, whether Hindu or Mahomedan or even Christians who reside in this country, are all in this particular respect belonging to one and the same nation.

ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে তিনি বলেন:

With me it is not so much worth considering that their religious rights but that we inhabit the same land and are subject to the rule of the same government. These are the grounds upon which I call both the races which inhabit India by the word 'Hindu' by which I mean that they are the inhabitants of Hindustan.

স্বধর্ম ও স্বদেশের মধ্যে যে পার্থক্য এখানে করা হয়েছে, তা বিশেষ ভাবে বিবেচনার যোগ্য। ধর্ম সম্পর্কে স্যার সৈয়দের আরেকটি মৌলিক ধারণার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, তাও ভেবে দেখা যেতে পারে। তিনি মনে করতেন যে, সকল নবীই মানব সমাজে অভিন্ন ধর্ম বিশ্বাস (দীন) প্রচার করেছিলেন, কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের কালোপযোগী ভিন্ন জীবন বিধান (শরীয়া) বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। বিশ্বাস অপরিবর্তনীয় বা শাশ্বত; বিধান পরিবর্তনীয় ও ইহজাগতিক। পূর্বগামী নবীদের আনীত বহু আইন কুরআন শরীফ বাতিল করে দিয়েছে, কেননা ইতিহাসের অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে সেসব আইন প্রয়োগযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিল। স্যার সৈয়দ যে এভাবে ইহজাগতিক ও পারলৌকিককে আলাদা করে দেখতে পেরেছিলেন, এটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

স্যার সৈয়দ আহমদের পরবর্তী প্রজন্মের ভারতীয় মুসলমানদের সুযোগ্য প্রতিনিধি মনে করা হয় মওলানা মোহাম্মদ আলীকে (১৮৭৮-১৯৩১)। ইসলামের ঐক্য ও মুসলমানের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে তাঁর বেশ কিছু বক্তব্য আছে। তবে ধর্মীয় অস্তিত্ব ও দেশগত পরিচয়কে তিনিও পৃথক করে দেখেছিলেন। তিনি ভারতবর্ষের জন্য একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পক্ষপাতী ছিলেন: সে যুক্তরাষ্ট্র কেবল রাজনৈতিক নয়, ধর্মীয় যুক্তরাষ্ট্রও। প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে তিনি বলেছিলেন:

Where God commands...I am a Muslim first, a Muslim second and a Muslim last and nothing but a Muslim... My first duty is to my maker, not to HM the king nor to my companion Dr Monje...But where India is concerned, where India's freedom is concerned, where the welfare of India is concerned, I am an Indian first, an Indian second, an Indian last and nothing but an Indian...I belong to two circles of equal size but which are not concentric. One is India and the other is the Muslim world...we belong to these circles...and we can leave neither.

সমাজ-রাজনীতি-সাংবাদিকতা-ধর্মতত্ত্বের ক্ষেত্রে অল্প বয়সে আত্মপ্রকাশ করে মওলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৮-১৯৫৮) গণ্য হয়েছিলেন মওলানা মোহাম্মদ আলীর সমসাময়িক একজন বিশিষ্ট নেতা ও চিন্তাবিদ বলে। ইসলামের বাইরে তিনি কিছুই ভাবতে চাননি এবং তাই এক সময়ে ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক করা মুসলমানের পক্ষে নীরব ধর্মদ্রোহিতার তুল্য জ্ঞান করেছিলেন। ১৯১২ সালে তিনি স্পষ্টই লিখেছিলেন যে, ইউরোপে জাতি শব্দ সহস্র হৃদয় স্পন্দিত করে, আর মুসলমানের হৃদয় যাতে স্পন্দিত হয়, তা হলো আল্লাহ বা ইসলাম শব্দ। খিলাফত-আন্দোলনের সময়ে তিনি খিলাফতের একটি নতুন তত্ত্ব উপস্থাপিত করেন এবং ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে হিন্দুর সঙ্গে সহযোগিতা করা মুসলমানের কর্তব্য বলে স্থির করেন। পরে অসহযোগ আন্দোলনের কালে তিনি যে তত্ত্বে উপনীত হন, তাতে তিনি আজীবন নিষ্ঠ ছিলেন। এই তত্ত্বের মূল তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন হজরত মুহম্মদের মদিনা চুক্তিতে, যাতে মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে মদিনাবাসীকে উম্মা ওয়াহিতা বা একটিমাত্র সম্প্রদায় বলে অভিহিত করা হয়। এটিকে নজির হিসেবে ধরে নিয়ে তিনি ভারতের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন এবং এভাবে ইসলামের সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের পাশাপাশি ভারতবাসীর অখণ্ড সত্তায় আস্থা জ্ঞাপন করেছিলেন।

তবে ভারতীয় রাজনীতির ধারা এবং শাসনব্যবস্থা-সংস্কারের গতি ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের দিকে। একদিকে বাস্তব জীবন ও রাজনীতি হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করছিল। অন্যদিকে মর্লি-মিন্টো সংস্কারে মুসলমানের স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্বের যে ব্যবস্থা করা হয়, মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারে তা ব্যাপকতা লাভ করে। স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথা স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবির পোষকতা করেছিল।

১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলে দু'টি স্বাধীন সার্বভৌম ও স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানানো হয়। পরে, ১৯৪৬ সালে এপ্রিল মাসে, দিল্লীতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ দলীয় আইনসভা সদস্যদের সম্মেলনে দু'টি রাষ্ট্রের জায়গায় পাকিস্তান নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়। লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান নামটি উল্লেখ করা হয়নি এবং ভাবী রাষ্ট্রের ধর্মীয় চরিত্র সম্পর্কেও কোনো আভাস দেওয়া হয়নি। ১৯৪৩ সালে মুসলিম লীগের দিল্লী অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ (১৮৭৬-১৯৪৮) রাষ্ট্রের নাম প্রসঙ্গে যা বলেন, তার সারমর্ম এই : লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান কথাটাই ব্যবহার করা হয়নি। হিন্দুরা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে গিয়ে বলে যে, এতে পাকিস্তান চাওয়া হয়েছে। হিন্দুদের সংবাদপত্রের একাংশ এবং ব্রিটিশ পত্র-পত্রিকা পাকিস্তান কথাটা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। তবে আমি তাদের ধন্যবাদ দিই এজন্য যে, এর ফলে অনেকগুলো শব্দের বদলে এই একটি শব্দ ব্যবহারের সুযোগ তারা করে দিয়েছেন।

১৯৪৩ সালের মুসলিম লীগ অধিবেশনে আরো একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ঘটে। অধিবেশন শুরু হবার আগে একদল প্রতিনিধি প্রস্তাব করেন যে, পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সংবিধান কুরআনের ভিত্তিতে রচিত হবে বলে মুসলিম লীগকে ঘোষণা করতে হবে। বোম্বাইয়ের ড. আবদুল হামিদ কাজী এই অধিবেশনে উত্থাপনের জন্য একটি প্রস্তাবের খসড়াও প্রচার করেছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল যে, পাকিস্তানের সংবিধান রচিত হবে হুকমত-ই-ইলাহিয়ার অর্থাৎ প্রথম চার খলিফার হাতে প্রণীত নীতিসমূহের ভিত্তিতে। কিন্তু প্রস্তাব উত্থাপনের সময় আসার আগেই সভাপতির ভাষণ প্রদত্ত হয় এবং তাতে এ প্রসঙ্গে জিন্নাহ বলেন:

The Constitution of Pakistan can only be framed by the millat and the people. Prepare yourselves and see that you frame a Constitution to your heart's desire. There is a lot of misunderstanding. A lot of mischief is created. Is it going to be an Islamic Government? Is it not begging the question? Is it not a question of passing a vote of censure on yourself? the Constitution and the Government will be what the people will decide.

এর পরে ড. কাজী তাঁর প্রস্তাব উত্থাপন করেননি। তিনি খুশি হয়েছিলেন কিনা বলা মুশকিল। কেননা জিন্নাহর বক্তৃতায় একদিকে যেমন বলা হয়েছিল যে, পাকিস্তানের সরকার ইসলামী হবে না এমন মনে করা আত্মনিন্দার শামিল; অন্যদিকে তেমনি বলা হয়েছিল যে, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই কেবল জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী সংবিধান রচনা করবে।

তবে মুসলিম লীগের অনেক নেতাই বিভিন্ন সময়ে এমন উক্তি করেছিলেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্র ব্যবস্থা হবে কুরআনের নির্দেশ অনুরূপ। অনেকেই আবার এসব কথায় আস্থা জ্ঞাপন করেননি। জমিয়ত-আল-উলামায়ে হিন্দের সভাপতি মওলানা হুসেন আহমদ মদনী (১৮৭৯-১৯৫৭) জিন্নাহকে উদ্‌ধৃত করে বলেছিলেন যে, পাকিস্তান যে ধর্মীয় রাষ্ট্র হবে না, জাগতিক রাষ্ট্র হবে, তা এঁদের কথা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। জিন্নাহ এবং অন্যান্য মুসলিম নেতাকে তিনি ইসলাম সম্পর্কে কেবল অজ্ঞ নন, উদাসীন বলে অভিযুক্ত করেছিলেন এবং তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে এঁদের পক্ষে ১৯৩৭ সালের শরীয়া আইন সমর্থন না করার ও ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের বিরোধিতা না করার দৃষ্টান্ত দিয়েছিলেন। জিন্নাহকে তিনি অভিহিত করেছিলেন কাফেরে আজম বলে (কেউ কেউ বলেন, আহরার নেতা মওলানা মজহার আলী আজহারের দু'টি ছন্দোবদ্ধ চরণে প্রথম এই বিদ্রূপপূর্ণ উক্তি করা হয়) এবং মুসলিম লীগে যোগদান ইসলাম বিরোধী কাজ বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন। জামাতে ইসলামীর আমীর মওলানা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী (১৯০৩-৭৯) তো স্পষ্টই বলেছিলেন যে, জিন্নাহ থেকে শুরু করে মুসলিম লীগের নিম্নপর্যায়ে কর্মীদের কারো দৃষ্টিভঙ্গি ইসলাম সম্মত নয় এবং কোনো সমস্যাকে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ক্ষমতা তাঁদের নেই। জাতীয়তাবাদ - তা ভারতীয় মুসলিম জাতীয়তাবাদ হলেও এবং গণতন্ত্রের ধারণা পাশ্চাত্য সংস্কৃতিজাত বলে তা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। পাকিস্তান, তাঁর মতে, কাফেরানা রাষ্ট্র - যার নাম তিনি দিয়েছিলেন না-পাকিস্তান। অবশ্য উল্টো কথা বলার মতো আলেমও পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগের সমর্থক আলেমদের সংগঠন জমিয়ত-আল-উলামায়ে ইসলাম উপরিউক্ত সমালোচনার জবাবে বলেছিলেন যে, মুসলিম লীগে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন লোকের অভাব থাকলে তেমন লোকদের উচিত মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে সে অভাব দূর করা। তবেই অধার্মিক পাশ্চাত্যপন্থী নেতাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তান ধার্মিক ব্যক্তিদের নেতৃত্বে শরীয়ার শাসন প্রবর্তনে সমর্থ হবে।

সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে ভারতীয় মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাস ভূমির দাবি সত্ত্বেও দেশটিতে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার কোনো সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ছিল না। মুসলমানেরা যাতে নিজের অভিপ্রায় অনুযায়ী জীবন গঠন করতে পারেন, তার নিশ্চয়তা লাভই ছিল পাকিস্তানের লক্ষ্য। ১৯৪৬-এ রয়টারের প্রতিনিধিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জিন্নাহ বলেন: 

The new state would be a modern democratic state with sovereignty resting in the people and the members of the new nation having equal rights of citizenship regardless of their religion, caste or creed. 

তাই এটা বিস্ময়কর নয় যে, পাকিস্তান গণপরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনে, ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্টে, সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন:

You are free to go to your mosques or any other place of worship in this State of Pakistan. You may belongs to any religion or caste or creed that had nothing to do with the business of the State...you will find that in course of time Hindus would cease to be Hindus and Muslims would cease to be Muslims, not in the religious sense, because that is the personal faith of each individual, but in the political sense as citizens of the State.

জিন্নাহর এ-উক্তি কেবল ইসলামী রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টাদের ক্ষুণ্ণ করেনি, জি. এম. সৈয়দের মতো মুসলিম লীগ বিরোধী নেতাকেও একথা বলতে প্ররোচিত করেছিল যে, এতে জিন্নাহর chastened mood-এর প্রকাশ ঘটেছে এবং লীগের এত কালের কর্মসূচী ও সংগ্রামের অন্তরালবর্তী মৌলিক নীতি বিসর্জন দেওয়া হয়েছে।

তবে জিন্নাহর অনুসারীরা অল্পকালের মধ্যেই তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে প্রধানমন্ত্রী লিয়াতর আলী খান পাকিস্তানে সংবিধান সংক্রান্ত যে Objective Resolution উত্থাপন করেন, তাতে প্রথমেই রাষ্ট্রের - শুধু রাষ্ট্রের নয়, সমগ্র বিশ্বজগতের - সার্বভৌমত্ব বলা হয়েছে আল্লাহর এবং রাষ্ট্রকে যদিও স্বাধীন ও সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্র বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে, তবু এই রাষ্ট্রের মুসলিম অধিবাসীরা যাতে কুরআন শরীফ ও সুন্নায় বর্ণিত ইসলামের শিক্ষা ও আবশ্যকতা অনুযায়ী ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনযাপন করতে পারেন, তার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। ১৯৫০ সালের মূলনীতি কমিটির রিপোর্টেও এর প্রতিধ্বনি করা হয় এবং সেই সঙ্গে যোগ করা হয় যে, রাষ্ট্রপ্রধান হবেন একজন মুসলিম। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা নির্বাচনী অঙ্গীকারের শীর্ষদেশেও লেখা হয়েছিল:

নীতি: কোরান ও সুন্নার মৌলিক নীতির খেলাফ কোন আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবনধারণের ব্যবস্থা করা হইবে।

১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভায় এই নামান্তরের প্রস্তাব করেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (১৮৯৩-১৯৬৩)। সভায় মওলানা ভাসানী বলেন যে, এই প্রস্তাব অনেকদিন ধরেই তাঁদের বিবেচনাধীন ছিল। তবে ভাষা আন্দোলনের সময়ে মুসলিম লীগ যেরকম মিথ্যে প্রচার করে, তা স্মরণ করেই সংগঠন যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় না করা পর্যন্ত তাঁরা নাম বদলাবার ঝুঁকি নিতে চাননি। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে এই নীতির সংযোজন অনুরূপ বিবেচনাপ্রসূত কিনা তা বলা যায় না। তবে মওলানা ভাসানী পরেও কুরআন ও সুন্নার সঙ্গে সংগতির কথা বলেছেন।

১৯৫৬ সালে যখন পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান গৃহীত হয়, তখন দেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করা হয়। গণপরিষদে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিদের অনেকে দেশের এই নামকরণের বিরোধিতা করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভায় স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথার পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপিত হলে শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-৭৫) যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার অংশবিশেষ এখানে উদ্‌ধৃতিযোগ্য: 

আমার এক বন্ধু বলেছিলেন যে, তারা মাইনরিটিদের সমানভাবে দেখবেন। আমি জিজ্ঞাসা করি, কিভাবে সমানভাবে দেখবেন - ইসলামিক রিপাবলিক নাম চেঞ্জ করে দিয়ে? ইসলামিক রিপাবলিক না হয়ে পাকিস্তান রিপাবলিক হোক, আমরা একথা নিয়ে ফাইট করেছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম, রাজনীতিতে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সব সমান হবে - সত্য এবং সাম্যের নীতির উপর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে।...স্যার, আমরা হেড অফ দি স্টেট মুসলমান করে দিলাম। ইসলামিক রিপাবলিক অফ পাকিস্তান নাম করলাম। এইভাবে দুই জাতি তো করেই দিলাম, তার উপরেও যদি সেপারেট ইলেকশন হয় তাহলে কি হয়? দুই জাতির ভিত্তিতে আমাদের পাকিস্তান হয়েছে। এর পরও যদি আজকে আলোচনা করা হয় যে, পাকিস্তানে আমরা দুই জাতি, একটা হিন্দু আর একটা মুসলমান, তাহলে একটা প্রোভোকেশন দেয়া হয়। আজ যদি পূর্ব বাংলার এক কোটি হিন্দু বলে যে, আমাদের আলাদা জায়গা অর্থাৎ একটা হিন্দু স্টেট দিতে হবে, তাহলে কি হবে? পাকিস্তানের খাতিরে, পাকিস্তানের ইনসাফের খাতিরে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের খাতিরে আমি আমার বন্ধুদের অনুরোধ করবো তাঁরা যেন এই সেপারেট ইলেকটরেটের প্রস্তাব উইথড্র করেন।

এই বক্তৃতায় যে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে, তা বিকশিত হচ্ছিল অনেকদিন ধরে। বিশেষ করে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর থেকে পূর্ব বাংলার রাজনীতি ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। ভাষা আন্দোলনের আগে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ ছিল দেশের একমাত্র সংগঠন যার দ্বার সকল সম্প্রদায়ের নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত ছিল। ভাষা আন্দোলনের পরে আমরা দেখি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠনরূপে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা, অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে গণতন্ত্রী দলের আত্মপ্রকাশ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগে পরিণতি এবং দেশের এই অংশের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী মুসলিম লীগের আওয়ামী লীগে রূপান্তর। ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভায় যুক্ত নির্বাচন প্রথার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ এই ক্রমবর্ধমান অসাম্প্রদায়িক চেতনারই বহিঃপ্রকাশ।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে যুক্ত নির্বাচন বিল উত্থাপন করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি স্মরণীয় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তার অংশবিশেষ এরকম :

It may appear strange to those who have not been able to adapt themselves to the change in political outlook resultant on the creation of Pakistan that I who was an advocate of the two-nation theory in undivided India, and whose contribution to the creation of Pakistan was perhaps not insignificant, and who belived in separate electorate in undivided India, should advocate joint electorate in Pakistan as a salutary constitution-al principle...Separate electorate was a device to secure proper representation in the Legislatures for the Muslim minority; it took something away from the majority population; it was certainly never meant to be a device to safeguard the intersts of the majority population...

...The two-nation theory was advanced by the Muslims as a justification for the partition of India and the creation of a State made up of geographically contiguous units where the Muslims were numerically in a majority. Once the State was created, the two-nation theory lost its force even for the Muslims. If it is still persisted in, it will logically lead to the partition of Pakistan... The Muslims who were a nationality in undivided India, are now citizens in their own country Pakistan, in which every citizen, whatever may be his religion, is a member of the Pakistani nation. There is, thus a radical difference between the conception of the Millat-i-Islam which transcends geographical boundaries, and the conception of a Pakistani nation or qaum which has boundaries and has a peculiar entity which differ-entiates it from other nations. Circumstances thus have changed, and so must our political outlook change with the establisment of Pakistan.

গণপরিষদে কিন্তু এই প্রশ্নে আপসরফা হলো এভাবে যে, পূর্ব পাকিস্তানে হবে যুক্ত নির্বাচন প্রথা আর পশ্চিম পাকিস্তানে থাকবে স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রথা। পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য কতটা গড়ে উঠেছিল, তা এ থেকে সহজেই বোঝা যায়। তাই একদিকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র, অন্যদিকে তার দুই অংশে দুরকম নির্বাচন প্রথা।

পাকিস্তানে পরবর্তী পনেরো বছরে অন্যান্য বিষয়ে বিরোধের মতো রাষ্ট্র জীবনে ধর্মীয় অনুষঙ্গ এবং অসাম্প্রদায়িকতার - কোনো কোনো ক্ষেত্রে বলা যায় ধর্মনিরপেক্ষতা বা ইহজাগতিকতার - বিরোধ তীব্র হয়েছে। ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করে ১৯৬২ সালে দেশের দ্বিতীয় সংবিধান প্রবর্তিত হয়। রাষ্ট্রের নাম ফিরে আসে পাকিস্তান রাষ্ট্রে - অর্থাৎ নাম থেকে ইসলামী কথাটা বাদ যায়। তবে রাষ্ট্রের মূলনীতিতে কুরআন ও সুন্না এবং ইসলামী জীবনধারার কথা বলা হয় এবং তার জন্য ইসলামী আদর্শ বিষয়ক একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের বিধান রাখা হয়। ১৯৬২ সালের সংবিধান রদ হয়ে যায় ১৯৬৯ সালে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান যে Legal Framework Order জারি করেন, তাঁতে বলা হয় যে, নির্বাচনের পর যে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে সে সংসদের দ্বারা প্রণীতব্য সংবিধানে "Islamic ideology which is the basis for the creation of Pakistan" অটুট রাখতে হবে। এই কারণে ১৯৭০ সালে যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল, কুরআন ও সুন্নার পরিপন্থী আইন প্রণয়ন থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি তাদের প্রত্যেককেই দিতে হয়েছিল।

জেনারেল আইউব খান ও জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মতো সামরিক শাসক ও রাষ্ট্রপ্রধান সংবিধানের ইসলামী চরিত্র রাখতে আন্তরিকভাবে আগ্রহী ছিলেন, এ কথা বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে, ক্ষমতায় থাকার জন্য, সাধারণ মানুষকে ভোলাবার জন্য, তাঁদের প্রয়োজন ছিল রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের যোগ ঘটানোর। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মুহম্মদ মুনীর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা বিবৃত করেছেন:

...When I was a member of Ayub's Cabinet in 1962 and the Political Parties Bill was under discussion a person moved and amendment to the bill proposing that no party would be formed the object of which was opposed to the 'Ideology of Pakistan'. On this Chaudhry Fazal Ilahi who was recently retired as President of Pakistan, rose from his seat and objected that then 'Ideology of Pakistan' shall have to be defined. On this the member who had moved the original amendment replied that the ideology of Pakistan was Islam, but nobody asked him the further question. "What is Islam?" The amendment to the bill was therefore passed as the member who supported the amendment was Maulvi Abdul Bari of Lyallpur who was a supporter of Ayub. Nobody can say anything to the contrary where Islam is mentioned. Ayub was then in Karachi and I could not contact him. When he returned I mentioned to him the incident and he remarked, "What will the world say about it all".

বিচারপতি মুনীর যে বলেছেন - ইসলাম কী, এ বিষয়ে কেউ আর প্রশ্ন করলো না - তার একটা ইতিহাস আছে। পাঞ্জাবে ১৯৫৩ সালে আহমদীয়া বিরোধী দাঙ্গা সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য তাঁর নেতৃত্বে বিচারপতি কায়ানীকে নিয়ে যে কোর্ট অফ ইনকোয়ারি গঠিত হয়, তাতে তাঁরা দেখতে পান যে, ইসলাম কী এবং মুসলমান কে, সে বিষয়ে কোনো দুজন আলেম একমত হতে পারেননি। কোনো কোনো আলেমের মতে, আল্লাহর আইন কুরআন ও সুন্নায় পাওয়া যায় বলে ইসলামী রাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তির বা সমষ্টির আইন প্রণয়নের অধিকার নেই এবং আল্লাহর আইন ব্যাখ্যা করার অধিকার রয়েছে কেবল শাস্ত্র জ্ঞানীদের।....


Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]