ধর্ম ও নারী - কৃষ্ণা বসু
আমাদের এই পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে, যত ধর্ম গ্রন্থ রয়েছে তার সবই পুরুষের রচনা - এই কথাটি সবচেয়ে বেশি করে মনে রাখবার মতো বিষয় বলেই মনে করি। কি পুরাণ, কি রামায়ণ-মহাভারত, কি বাইবেল, কি কোরান, কি বৌদ্ধধর্মের গ্রন্থরাজি, সমস্ত ধর্মগ্রন্থই পুরুষের সৃষ্টি। যে সমাজে আমরা বাস করি, জন্মগ্রহণ করি, নিঃশ্বাস নিই, শিক্ষিত ও পালিত হয়ে উঠি, জীবনযাপন করি, আত্মীয়-পরিজন সন্তানদের সঙ্গে পারিবারিক জীবন অতিবাহন করি, তার সমস্তটাই তৈরি করেছেন পুরুষরা; স্বভাবতই তাই, পুরুষের স্বার্থে, পুরুষের নিজের প্রয়োজনে সমস্ত রকম বিধিব্যবস্থা, সকল মূল্যবোধ এবং আচরণ বিধি পুরুষেরাই নির্মাণ করে দিয়েছে তা। সেখানে সমস্ত ধর্মে মেয়েদের হেয় করা হয়েছে, হীন চোখে দেখা হয়েছে, দমিত করে রেখে দেওয়া হয়েছে; কোথাও আত্মসম্মানে মাথা উঁচু করে বাঁচতে দেওয়া হয়নি। 'মনু' নামক বিধান কর্তাটির দ্বারা আমাদের পৌরাণিক যুগের ভারতীয় সমাজের বিধান যা তৈরি হয়েছিল তার প্রতিটি পদক্ষেপে নারীর প্রতি চূড়ান্ত অপমান, দুরন্ত লাঞ্ছনার মনোভাব সুতীব্রভাবে প্রকাশ পেলো, 'মনু' থেকেই মানব কথাটির জন্ম, আমরা এও জানি। সেই মনু তাঁর বিধানে নারী জাতি সম্পর্কে স্পষ্ট দ্বিধাবিহীন নির্দেশ দিচ্ছেন-
'পিতা রক্ষতি কৌমরে ভর্তা রক্ষতি যৌবনে।
রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি।।'
- কুমারী কালে রক্ষা করবেন পিতা, যৌবনকালে রক্ষা করবেন নারীকে তার স্বামী আর বার্ধক্যে তাকে রক্ষা করবেন পুত্রেরা, স্ত্রী জাতির কোন স্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্র্য নেই। এই হলো মহামতি মনুর নির্দেশ মানব প্রজাতির প্রতি, সমস্ত নারীদের সম্পর্কে। নারীর জীবনের সমস্ত অধ্যায়কে পুরুষ দ্বারা পূর্ণ, নিয়ন্ত্রিত রাখার, তার সর্ব প্রকারের স্বাধীনতাকে হনন করার এই ছিল ধর্মীয় নির্দেশ হিন্দুদের। মনু আরো বিচিত্র নির্দেশ দিয়েছেন নারী প্রজাতির সম্পর্কে তার বিধানে, সে সমস্ত বিধান পর্যালোচনা করলে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন যে কোন আধুনিক শিক্ষিত নারীর আমূল বিস্মিত ও ব্যথিত হবারই কথা। মনু তাঁর বিধানে সর্ব প্রকারে নারীকে পুরুষের কাছে কুণ্ঠিত, দয়াপ্রাপ্ত, হীন এবং অপমানিত দেখতে চেয়েছেন; ধারাবাহিকভাবে পুরুষের প্রতি প্রবল পক্ষপাত এবং নারীকে দমিত, সংকুচিত করে রাখার চক্রান্ত তাঁর বিধানের ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে রয়েছে। মনুর নির্দেশ এর একটি তো উল্লেখ করেইছি, আরও বেশ কিছু নির্দেশ, আসুন, পাঠক আমরা অনুধাবন করি, আরো একটি নির্দেশ "শত দোষ থাকা সত্ত্বেও বিশ্বস্ত স্ত্রীর কাজ হবে সর্বদা স্বামীকে ভগবান স্বরূপ পূজা করা" - হে সংবেদনশীল, হৃদয়বান পাঠক অনুভব করুন, যে স্বামীর শত দোষ, অনেক ভুল যার, সেই স্বামীকে চোখ বুজে অন্ধের মতো সেবা শুধু নয়, পুজোও করতে নির্দেশ দিলেন মহামান্য মনু, যাঁর রচিত সংহিতা, 'মনুসংহিতা' হিন্দু সমাজে পবিত্র গ্রন্থরূপে সম্মানিত ও সম্ভ্রান্ত হয়ে রয়েছে। মনু আরো বলছেন "স্বামীকে ভগবান মানে পূজা না করলে, ঐ নির্দেশ লঙ্ঘন করলে এই বিশ্বে স্ত্রীদের মর্যাদার হানি হবে, পরের জন্মে শিয়ালের গর্ভে প্রবেশ করবে এবং ঐ পাপের জন্য বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে নারীরা শাস্তিভোগ করবে।" শুধু স্বামীর শত দোষ সত্ত্বেও তার কাছে ক্রীতদাসীর মতো পূজা ও সেবা নিয়ে উপস্থিত থাকাই নয়, তা না করলে সেইসব নারীদের শিয়ালের গর্ভে জন্ম হবে বলে অভিশাপ দিলেন মনু, এতখানিই, এত সুতীব্রভাবে নারীবিদ্বেষী তিনি। এই মনুই হিন্দু ধর্মের আচরণবিধির প্রধান প্রবক্তা ছিলেন। এর পূর্বে আদি বৈদিক যুগে অবশ্য নারীর কিছু স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদা ছিল, নারী ঋত্বিকাও ছিলেন সেই বেদের যুগে। মনু আরও বলছেন, লুব্ধ করছেন নারী জাতিকে এই বলে যে, "যে মহিলা নিজের চিন্তা, কাজ ও কথাকে সংযত করে ভগবানরূপী স্বামীকে কখনোও উপেক্ষা করে না, মৃত্যুর পর সে স্বামীর সঙ্গে স্বর্গবাস করবে এবং গণ্য হবে ধার্মিক নারী হিসেবে।” - ভেবে দেখুন পাঠক, নারীর ধার্মিকতার একটি মাত্র ক্ষেত্র, তা হলো শত দোষ যুক্ত স্বামীকে সেবা ও পূজা করে যাওয়া! কী অপমানকর, হীন প্রস্তাব, একবার হে আধুনিক পাঠক, আপনি ভাবুন! যে সর্ব অর্থে অশ্রদ্ধার পাত্র, তাকে অশ্রদ্ধা না করে তাকে পূজা করলে স্বর্গবাস ও ধার্মিক সুনাম কেনা যাবে; এই-ই ছিল নারীদের প্রতি মনুর বিধান। মনু আরও কী কী বিধান দিয়েছেন, আসুন পাঠক, আমরা তার পর্যালোচনা করি, মনু বললেন, "পরিবারের পুরুষেরা ভোগ-বাসনায় লিপ্ত থাকলেও মহিলারা দিনে রাতে সর্বসময় সেই পুরুষদেরই অধীনে এবং শাসনে থাকবে।" - কামনা-বাসনায়, বহুগামিতার স্রোতে ভাসমান পুরুষটির পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকবে তার পরিবারের নারীদের মুঠোর মধ্যে পুরে রাখবার, শাসন ও পীড়ন করবার; এই যে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার চূড়ান্ত নির্দেশ, এই যে নারীকে পুরুষের অধীন করে রেখে দেবার গূঢ় প্ররোচনা মনু রচনা করলেন, তাকে মাথায় করে রেখেছিল আমাদের হিন্দু সমাজ-ই এতদিন ধরে। মনু অন্য পরবর্তী নির্দেশে বলছেন, "স্বামী সুদর্শন অথবা কুৎসিত হলেও নিজের বয়স আর সৌন্দর্যের প্রতি মহিলারা দৃষ্টি রাখবে না"; পুরুষ মানুষ হলো সোনার আংটি তার আবার বেঁকা টেরা - এই প্রবচনও তো আমাদের সমাজেরই তৈরি করা। মাননীয় মনুর মতে নারী তার স্ত্রী সৌন্দর্য সম্পর্কে-ও সচেতন থাকবে না, পুরুষটি সুন্দর বা কুৎসিত যাই হোক্, নারীর নিজের সৌন্দর্যের সঙ্গে তার প্রতি তুলনা করবে না। যে বিজিত এবং হেয়, সামাজিকভাবে যাকে হীন এবং নিকৃষ্ট জীব বলে দেখতে শেখানো হয়েছে, সে তার ভর্তা, যিনি ভরণপোষণ করেন, সেই রক্ষাকর্তা স্বামীর সঙ্গে নিজের তুলনা করবে কোন্ সাহসে? এইসব তো নারীর করণীয়, আর তার বিপরীতে ধর্মবেত্তা সংহিতা রচয়িতা কী বলছেন পুরুষদের করণীয় বিষয় সম্পর্কে? মনু বলছেন, "স্বামীর কর্তব্য হলো স্ত্রীর প্রতি কড়া নজর রাখা; তার কারণ দেখাতে গিয়ে মনু জানাচ্ছেন, "পরপুরুষের প্রতি আসক্তি, অস্থির মেজাজ আর নিষ্ঠুর হৃদয়ের জন্যে স্বামীর প্রতি তাদের আনুগত্য থাকে না", অর্থাৎ যে নারীকে দয়া এবং মমতার উৎস রূপে আমরা জেনেছি, সেই নারীই মনুর মতে নিষ্ঠুর হৃদয়ের অধিকারী, পরপুরুষের প্রতি আসক্ত এবং অস্থির মেজাজের মানবী, এসবই তাদের ওপর পুরুষের প্রবল প্রতাপকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যবস্থা, একথা বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধিরও দরকার হয় না। মনুর সংহিতার অনুসরণে তৈরি হলো যে সমাজ, সেই সমাজেই শুধু নারীকে হেয় ও হীন করা হয়নি, হত্যা এবং হেলাফেলার চক্রান্তে ফেলে দেওয়া হয়নি, পৃথিবীর সব ধর্মেই নারীকে অপমানিত, লাঞ্ছিত, দমিত করে রাখার সুপরিকল্পিত ব্যবস্থার খবর আমরা পাই।
যে বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে আমাদের শ্রদ্ধা ও বিনতির অন্ত নেই; পরবর্তী কালের কাব্যে-সাহিত্যে সর্বত্র যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধার অঞ্জলি নিবেদন করা হয়েছে সেখানেও নারী জাতি সম্পর্কে, মাতৃ জাতি সম্পর্কে অশ্রদ্ধার মনোভাবের শেষ নেই। এমনকি স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ স্ত্রীলোকদের নির্বাণ লাভের যোগ্য বলেও বিবেচনা করেননি। বুদ্ধ এও মনে করতেন, স্ত্রীলোকদের সংসর্গে পুরুষেরাও নির্বাণের স্বর্গ থেকে দ্রষ্ট ও বঞ্চিত হবে। বুদ্ধ তার শিষ্যদের স্ত্রীজাতির প্রতি মনোযোগ, তাদের দিকে তাকানোও নিষেধ করেছিলেন। নারীর প্রতি মনোযোগী হলেই, নারীর দিকে তাকালেই যেন পুরুষের বিচ্যুতি ঘটবে; বুদ্ধ বলেছিলেন যে শ্রমণ নারীকে নারী হিসাবে দেখে, নারীকে নারী হিসাবে স্পর্শ করে, সে কখনো বুদ্ধের শিষ্য হবার যোগ্যও নয়। হিন্দুধর্মে যে বলা হয়েছিল 'নারী নরকের দ্বার' সেই কথারই যেন একটু ভিন্ন রকমের প্রতিধ্বনি শুনলাম আমরা, করুণাঘন বুদ্ধের কণ্ঠে! আমরা একথাও কি ভুলতে পারি যে এই গৌতম-ই আপন স্ত্রী ও পুত্রকে পরিত্যাগ করে গিয়েছিলেন এবং তার বিহারে নারী ও পুরুষের জন্য সম মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত ছিল না। নারীর সঙ্গে সম্পর্কের স্বাভাবিকতাকে হেয় চোখে দেখাই ছিল এইসব ধর্ম প্রচারক ব্যক্তিত্বদের কাজ।
সুপ্রাচীন ইহুদি ধর্মেও নারীকে চূড়ান্ত হীন ও তুচ্ছ করে দেখা হয়েছে। যে নারীর থেকে পুরুষের জন্ম ও বিকাশ, সেই নারীর প্রতি তার কৃতজ্ঞতার অন্ত থাকার কথা নয়, সেই নারীকে ঘৃণা করতে শিখিয়েছে ইহুদি ধর্ম। জুডাইজম-এ বলা হয়েছে 'নারীর থেকেই পাপের জন্ম'। যে নারী সর্ব অর্থে পুরুষের জীবনে প্রয়োজনীয় ও পূজনীয়, যে নারী মা ও ধাত্রী, যে নারী প্রেমিকা ও পত্নী, যে নারী ভগ্নী বা কন্যা; সেই নারীকেই ইহুদি ধর্মে বলা হয়েছে, "নারীই হচ্ছে মৃত্যুর দূত"। যে নারীকে বলা হয়েছিল মৃত্যুর দূত সেই নারীকেই, বহু নারীকেই বহু বিবাহে গ্রহণ করতে সেদিনের পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাধা ছিল না। ইহুদিধর্মে বলা হয়েছে 'নারী হচ্ছে সমাজের নিকৃষ্ট জীব'; সমস্ত প্রাচীন ধর্মে নারীকে নিকৃষ্ট জীবরূপে দেখার এই যে আয়োজন, এর থেকে বোঝা যায় পিতৃ প্রাধান্যের সমাজে পুরুষকে বড় করে দেখানোর, পুরুষের সব দোষ উপেক্ষা করার, পুরুষের মহিমা ও পৌরুষকে প্রতিষ্ঠার করার জন্য এইসব মানবীবিরোধী, মানবতাবিরোধী কথা প্রচার করা হতো।
বাইবেল নামের খ্রীষ্টানদের সর্বমান্য ধর্মগ্রন্থে, 'তাদেরই ভালো মেয়ে বলা হয়েছে যারা অনুগত, বিশ্বাসী, গৃহরক্ষা ও সন্তান পালনে ইচ্ছুক,'। অর্থাৎ নারীর ক্ষেত্রটি সব ধর্মেই শুধু পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেখা হয়েছে, বৃহৎ জগৎ সংসার তার কাছে অনায়ত্ত, অনধিগম্য এবং অপ্রবেশ্য। আদম এবং ইভের গল্পে বলা হয়েছে পুরুষের শরীর থেকেই নারীর জন্ম হয়েছে, নারীর শরীর থেকে পুরুষের নয়; কী আশ্চর্য! সমস্ত প্রকৃতি জগৎ, এমনকি মানব সমাজেও নারীর শরীর থেকেই পুরুষের জন্ম হয়, এই সত্যকেও উল্টে দেবার কী অদ্ভুত ধর্মীয় চক্রান্ত। হিন্দু ধর্মেও বলা হয়েছে সৎ, চিৎ অবং আনন্দ এর সমন্বয়ে যে সচ্চিদানন্দ পরম ব্রহ্মের সৃজন, তিনি তাঁর হ্লাদিনী অর্থাৎ আনন্দ শক্তিকে বিশ্লিষ্ট করে শ্রীরাধিকাকে নির্মাণ করলেন ও মিলন লীলায় রত হলেন। সমস্ত অনিবার্য প্রাকৃতিক অমোঘ সত্যের বাইরে গিয়েও ধর্মবেত্তারা দেখাতে চাইলেন, পুরুষের একটা অংশ থেকেই নারীর সৃষ্টি! পুরুষের প্রয়োজনে নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
আমাদের এক হাজার বছরের বাঙলা সাহিত্যের দিকে তাকালে আমরা দেখি ধর্মীয় বাতাবরণ সমগ্র বাঙলা সাহিত্যকে ঘিরে রেখেছে সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই। সেই যে রক্ষণশীল হিন্দু রাজাদের প্রতাপে ঘরছাড়া, তাড়া-খাওয়া বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা লুকিয়ে লুকিয়ে সন্ধ্যা ভাষায় ধর্মীয় সাধন-ভজনের কথা লিপিবদ্ধ করে গেলেন, সেখানে তো দেখছি, ধর্ম ও ধর্মীয় সাধন-ভজনের বাণীই বাঙলা ভাষার সাহিত্যের প্রথম সূচনার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। প্রকৃত সত্যের দিকে তাকালে এই কথাটিই বলবার হয়ে দাঁড়ায় যে, সমগ্র প্রাচীন ও মধ্যযুগের এমনকি প্রাক আধুনিক যুগের সাহিত্যটাই ছিল ধর্ম নির্ভর, সামান্য দু একটি ব্যতিক্রম ছিল না তা নয়, তবে তা শতাংশের হিসাবেও আসে না। এই ধর্ম নির্ভরতা সাহিত্যের মূলভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছিল, এখানে নারী সম্পর্কিত যাবতীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও লেখালেখি ছিল সামন্ত সমাজের মূল্যবোধ দ্বারা চালিত ও প্ররোচিত। তবে নর-নারীর সম্পর্কের মধ্যে যেহেতু প্রেম একটি প্রবল অনুভূতি হয়ে দেখা দেয়, আর প্রেমেও পুরুষতন্ত্র তার প্রতাপ ও প্রতিপত্তি বিস্তার করতে কিছু কম যায় না, তবুও একমাত্র প্রেমাতুর পদগুলিতেই নারীকে পাবার আশায় সম্ভবত পুরুষ তার বিনতি ও আকৃতিকে কিছুটা প্রকাশ করে ফেলেছে। চর্যাকার যেখানে বলছেন-
"উচা উচা পাবত তহি বসই সবরী বালী
মোরদি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গিবত গুঞ্জরী মালী।***
উমত সবরো পাগল সবরো মা কর গুলী গুহাডা তোহোরি নিঅ ঘরনী নামে সহজ সুন্দরী।
নানা তরুবর মৌউলিল রে গঅনত লাগেলী ডালী
একেলী সবরী এ বন হিন্ডুই কর্ণকুণ্ডলবজ্রধারী।
তি অ ধাউ খাট পড়িলা সবরো মহাসুখে সেজি ছাই লী সবরো ভূজঙ্গ নৈবামনি দারী পেমভ রাতি পোহাইলী।
হিঅ-তাবোলা মহাসুহে কাপুর খাই
সুন নৈরামনি কণ্ঠে লইয়া মহাসুখে রাতি পোহাই।"
এই যে বর্ণনা, এখানে বর্ণিত আদিরস, যে ধর্মীয় প্রণোদনায় সৃজিত হোক না কেন, তাতে নরনারীর সম্পর্কের প্রেম বাসনার দিকটি উদ্ভাসিত হয়েই উঠেছে - উঁচু উঁচু পর্বতে থাকে শবর কন্যাটি। মাথায় তার ময়ূর পুচ্ছ, গলায় তার গুঞ্জা ফুলের মালা, সুতীব্র রূপমোহে, আসঙ্গ লিপ্সায়, এই শবরী যে নিজস্ত্রী তা ভুলে তাকে পরস্ত্রী মনে করে শবর উন্মাদ হয়ে ওঠে। পুষ্পে পত্রে গাছগুলি ভরে ওঠে, শবরী একাকিনী বনে বনে বিচরণ করে। তখন খাট পাতা হলো, শয্যা বিরচিত হলো, কর্পূর বাসিত তাম্বুল সেবন করে দুজনেই অনুরাগে রক্তিম হয়ে উঠলো। নিবিড় মিলন সুখে রাত্রি অতিবাহিত হলো। এই বিবরণে কোথাও ধর্মের পূজাচর্নার স্তব-স্তুতি নেই, রয়েছে জীবনের প্রতি আদি রসাত্মক আকৃতির বাস্তব নির্ভর বর্ণনা। এখানে ধর্ম প্রচ্ছদ মাত্র হয়ে থেকেছে, ভিতরে পাণ্ডুলিপি অন্য কথা বলে। ধর্ম নির্ভর এই সাহিত্যকর্মে আদি রসের আসঙ্গ লীলায় কোনো বাধা ছিল না, কিন্তু এসব পদে নারীর যথার্থ সামাজিক অবস্থানটিকে চিনে নিতে পারা যায় না। ঐ যে চর্যাকার বললেন, 'একেলী সবরী এ বন হিন্ডুই কর্ণকুণ্ডল বজ্রধারী' - একাকিনী নারীটির অরণ্যচারিতা তার স্বাধীন সত্তার কথাই কিছুটা জানায় আমাদের। আর এ কথা আমাদের তো মনেও রাখতে হবে যে, সম্পদের উচ্চ শ্রেণীর মানুষদের জীবনে নারীরা পরনির্ভরশীলা ছিল, তাদের কোনো অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, স্ব-উপার্জন ছিল না, কিন্তু নিম্নবর্গের মানুষদের মধ্যে নারীরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করেছিল; কৃষিতে, পশু মাংস বিক্রয়ে, সম্পন্ন ঘরের গৃহ কর্মে সহায়তায় এইসব নারীরা স্বাধীন উপার্জনের উপায় খুঁজে নিয়ে ছিল, তাদের একক চলাচল নিষিদ্ধ ছিল না, যা ছিল সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত ঘরের, বনেদী ঘরের মহিলাদের ক্ষেত্রে একেবারেই নিষিদ্ধ বস্তু।
চর্যাপদ লেখা হয়েছিল আনুমানিক নবম-দশম শতাব্দীতে, এরপর তুর্কি বিজয়ী মুসলমান শাসনের প্রথম পর্বে এ দেশে, এ ভাষায় এমনই এক সংকট সময় সূচিত হয়েছিল যে সাহিত্য সৃজনের কাজ প্রায় বন্ধই ছিল, অন্তত দুশো বছরের মতো সময় ছিল অন্ধকারে ঢাকা। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বা শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভ নামের যে গ্রন্থটি এরপর আবিষ্কৃত হলো, তার আদি-অন্ত খণ্ডিত পুঁথিটিতে কবি বাসুলিসেবক বড়ু চণ্ডীদাস তেরটি খণ্ডে রাধা নাম্নী একটি গ্রাম্য কন্যাকে গোপবালক কৃষ্ণ কীভাবে প্রেমে নিমজ্জিত করে পরে প্রত্যাখ্যান করেন তারই কাহিনী নিবেদন করেছেন। যতই ধর্মীয় তত্ত্ব তাৎপর্য দিয়ে এই কাহিনীকে অলৌকিক মহিমা দেওয়া হোক না কেন, ধর্ম এখানে প্রচ্ছদ হয়ে থেকেছে, প্রচ্ছদ হয়ে থেকে ভিতরের পাণ্ডুলিপিকে আড়াল করেছে। ধর্ম প্রাচীন পর্যায়ের ও মধ্য যুগের সব শিল্পসাহিত্য প্রয়াসকেই আচ্ছন্ন করে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং এই ধর্মই মূল্যবোধ থেকে সব মানবিক প্রয়াস, সকল কিছুরই সার্থকতা নিরূপণ করতে চেয়েছে। ধর্ম এক প্রধান নিয়ামক শক্তি রূপে দেখা দিয়েছে। মানুষের সমস্ত আচরণের অভিভাবক সেজে বসেছে এই ধর্ম, ধর্মের যে তাত্ত্বিক দিক তার থেকে অনেক বেশি করে ভূমিকা রচনা করেছিল ধর্মের প্রায়োগিক দিকটি, আর সেই ধর্ম, সর্বক্ষেত্রে কি হিন্দু কি মুসলমান, কি বৌদ্ধ কি খৃষ্টান - সর্বত্র প্রায় নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি আগেকার দিনের মানুষের বাঙলা সাহিত্যের প্রাচীন বা আদি-মধ্য-অন্ত যুগেও ধর্মীয় তাৎপর্য ছাড়া, ধর্মীয় যুক্তি ছাড়া, ধর্মীয় প্রচ্ছদ ছাড়া কিছু রচনা করাও অসম্ভব ও অসাধ্য ব্যাপার ছিল। গ্রাম্য গোপবালক ও গোপকন্যার প্রণয় কাহিনী তাই ধর্মীয় তাৎপর্যে যুক্ত হয়ে পরিবেশনের যোগ্য হয়ে উঠেছিল। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নাট গীতিকাব্যটিতে রাধা-বড়াই-কৃষ্ণের সংলাপ ও সঙ্গীতের সবচেয়ে বড় মহিমাই ছিল এইটি যে, সেটি লেখা হয়েছিল লীলাপটু বিষ্ণুর নব্য অবতার রূপ কৃষ্ণের প্রেমকে কেন্দ্র করে, মানুষ সেখানে বড় নয়, মানুষকে ছাড়িয়ে অনেক অনেক বড় হলেন মানুষেরই তৈরি করা দেবতারা। রাধা যখন অন্তরতর আকুলতার থেকে বলেন-
"বন পোড়ে আগ কুড়ায়ি জগজনে জানী
মোর মন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পনী।"
তখন শ্রীরাধিকার এই হৃদয় দহনকে লৌকিক রমণীর হৃদয় দাহ বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে ধর্মের শাসন। শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ক কাব্য কলার সূত্রপাত বাঙলায় বড়ু চণ্ডীদাসকে কেন্দ্র করে হলেও এই বাঙলায় কৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলী সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তিটির ব্যক্তিত্বের অভিঘাত সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল তিনি শ্রীচৈতন্যদেব। কৃষ্ণ নামক মানুষটিকে তিনি মানবাধিক দৈবী মহিমায় বৃত ও আবৃত করে তুললেন এবং রাধিকা নামের মানবীটিকে-ও সেই মানবাধিক দেবতারই একটি বিশিষ্ট অংশ বলে চিনিয়ে দিতে চাইলেন সকল সাহিত্য অনুরাগী মানুষজনদের কাছে। চৈতন্যদের নামক চরিত্রটির মজাই হলো এই যে, তিনি একই সঙ্গে অন্তজ, সমাজের প্রান্তবাসী মানুষজনকে কোল দিয়েছেন, নাম সংকীর্তনের ভাববিহ্বল কর্মকাণ্ডে সকলকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছেন; আবার রাধা-কৃষ্ণ নামক দুটি লৌকিক চরিত্রকে অলৌকিক মহিমায় আবৃত, আচ্ছন্ন ও উত্তীর্ণ করেছেন। ব্যক্তি মানুষ হিসাবে; ধর্ম প্রচারক, নাম গান প্রচারক হিসাবে তিনি নেমে এসেছিলেন সাধারণ, অতি সাধারণ মানুষের স্তরে। আর গোপবালক কৃষ্ণ ও গোপকন্যা রাধাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন দৈবী মহিমার লোকাতীত স্তরে; আমি বলতে চাইছি, মধ্য যুগের এই সাংঘাতিক জরুরী ধর্ম ব্যক্তিত্বটি যার গভীর প্রভাব সেদিনের ও পরবর্তী মানুষজনের ওপর পড়েছিল, তিনি একই সঙ্গে আচরণীয়-পালনীয় ধর্মকে নামিয়ে এনেছিলেন উচ্চ কোটির থেকে নিম্ন কোটির অগণ্য সাধারণ মানুষের স্তরে, আবার সেই সঙ্গে লোকায়ত চরিত্র রাধা কৃষ্ণকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন লোকোত্তর মহিমার স্তরে-ও। ধর্মীয় এই প্রক্ষেপ চরিত্র দুটিকে আমাদের কাছের চেনা লোক করেও দূরের বস্তু করে রেখে দিয়েছে একই সঙ্গে। রাধা আর কৃষ্ণ সাধারণ নারী আর পুরুষ নয়, কৃষ্ণ সচ্চিদানন্দ পরম ব্রহ্ম আর রাধা তাঁরই একটি অংশ। তাঁরই হ্লাদিনী শক্তি এটা জানবার পর স্বভাবতই তাদের সম্পর্কে একটি ধর্মীয় দূরত্ব তৈরি হয়, রক্ত মাংসের নর ও নারীরূপে তাদের ভাবতে সুনির্দিষ্টভাবে নিষেধ করেছিলেন সেই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব শ্রীচৈতন্যদেব। ফলে চৈতন্য সমকালীন ও চৈতন্য পরবর্তী সমস্ত বৈষ্ণব পদসাহিত্যের ওপর যাঁর সবচেয়ে বেশি প্রভাব সেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুই প্রধান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে সমস্তটাকে আচ্ছন্ন করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তবুও ধর্মীয় বাতাবরণ ভেদ করে, ধর্মের প্রবল মুষ্টি ছাড়িয়ে মানবিক সংবেদনায় রাধা নামক নারীটি যখন পুরুষ কৃষ্ণের অন্যানুরাগের বহুগামিতার জ্বালা পোড়ায় জর্জরিত হতে হতে কেঁদে ওঠেন, তখন তাঁর কান্না ভরা উচ্চারণের মধ্য দিয়ে হাতে এসে লাগে তাঁর লবণ অশ্রু, ধর্মের ওপরে জীবনের জয় এইখানেই। চণ্ডীদাসের রাধা বলছেন,
'যুবতী হইয়া/শ্যাম ভাঙাইয়া/এমতি করিল কে?
আমার পরাণ/যেমতি করিছে/তেমতি হউক সে!'
উদ্ধৃতিতে এই প্রশ্ন চিহ্নটি ছিল না, আমরা সংযুক্ত করে দিলাম, অর্থের যথার্থতার জন্যই। বিদ্যাপতির শ্রীরাধিকা, কৃষ্ণ তাকে ত্যাগ করে যাবার পরে যে হাহাকার ভরা কান্না কেঁদেছেন তাতে দৈবী ও ধর্মীয় মহিমা আরোপ করে আমরা চুপ করে থাকি। প্রতারক কৃষ্ণের প্রতি, বিস্মৃতিপরায়ণ কৃষ্ণের প্রতি আমাদের কোনো অভিমান হয় না, অভিযোগ হয় না, সর্বটাকেই ধর্মীয় তাৎপর্যে দেখে তার মানবিক প্রবঞ্চনার দিকটুকুকে ভুলে যাই আমরা, এমনই আমাদের ধর্মানুরাগ। রাধা যখন কাঁদছেন,
"হরি গেড মধুপুর হাম একাকিনী।
ঝুরিয়া বুঝিয়া মরি দিবস রজনী।।"
অথবা
"সুন ভেল মন্দির সুন ভেল নগরী।
সুন ভেল দশদিশ সুন ভেলা সগরী।।"
তখন রাধার সেই দিবস-রজনী ব্যাপি কেঁদে কেঁদে মরা আর সমস্ত জীবনব্যাপী শূন্যতার ওপর ধর্মীয় মহিমা আরোপ করে তাকে মানবিক সংক্ষোভের জায়গা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়; এক কাল্পনিক ভাব সম্মেলনের পদ সৃষ্টি করে বিচ্ছিন্না, প্রবঞ্চিতা রাধার রক্ত-মাংসের মানবিক কষ্টকে ঢেকে দেওয়া, চেপে দেওয়া হয়; প্রবঞ্চক, নিষ্ঠুর, বহুনারীতে নিরত, কামুক কৃষ্ণকে দেওয়া হয় ধর্মীয় মহিমা ও গরিমা।
ধর্ম সমস্ত সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডের ওপর তার প্রবল থাবা বিস্তার করে বসে ছিল, একথা তো আগেই বলেছি বারে বারে। তুর্কি বিজয়ের পরে যে নবাবী আমল ও মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো, তাতে বাঙলার সামাজিক জীবনে এক বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়ে উঠেছিল, দীর্ঘ দু-শো বছর ছিল তার অন্ধকার ছায়া, আমাদের সামাজিক জীবনের ওপর। উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা যাঁরা এই মুসলমান শাসনের আগে সেন রাজাদের রাজত্বকালে অহংকৃত ও উদ্ধত ছিলেন; নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের ঘৃণার চোখে, অবজ্ঞার মনোভাবেই দেখতেন, তাঁরা এই বিধর্মী পরিবেশে নিম্ন বর্ণের মানুষদের সঙ্গে কিছুটা নৈকট্য-ও স্থাপন করলেন। হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এতকাল ধরে বহু কু-সংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, বর্ণ বিভেদ, উচ্চ বর্ণের সঙ্গে নিম্ন বর্ণের জল-অচল সম্পর্ক; জড়তা, হীনতা বাসা বেঁধেছিল, সেই অচলায়তনে এসে লাগলো জোর আঘাত। উচ্চ কোটির আর্য সংস্কৃতি গর্বী বর্ণ হিন্দু এবং নিম্ন কোটির অনার্য সংস্কৃতি যুক্ত সাধারণ মানুষ এই মুসলমান শাসনের আঘাতে একাকার হয়ে গেলো। একই ধর্ম সম্প্রদায়ে থেকেও হিন্দুরা নিজেরাই বিভাজিত ছিল নানা উপ সম্প্রদায়ে। শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব, সৌর, গাণপত্য - বিভাজিত এই পাঁচটি হিন্দু সম্প্রদায়ই পরস্পরের ধর্মমত সম্পর্কে ছিল অসহিষ্ণু, ক্ষমাহীন ও প্রখর সমালোচনা প্রবণ। তাই তুর্কি বিজয়ের পরে বন্ধ সংস্কৃতি ও সাহিত্যে আর্য-অনার্য মিলন সম্ভব হয়ে উঠলো, অনার্য দেব দেবীদের আর্যিকরণ হলো, সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের কাছে পূজা পেলেন এই সব অনার্য দেবতারা। দেবতাদের সেই ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি দখলের লড়াই-এ অনার্য দেবদেবীদের যে প্রাধান্য সূচিত হলো, তারই কাব্যকাহিনী মঙ্গলকাব্যগুলিতে রচনা হয়েছিল। সেখানে আমরা দেখেছি মনসাকে, যিনি সাপের দেবী; সেখানে আমরা দেখলাম বন্য পশু পালনের দেবী চণ্ডীকে, আমরা পেলাম অনার্য দেবতা ধর্ম ঠাকুরকে, আমরা পেলাম এরকম আরো বহু অনার্য দেব-দেবীকেও। সেখানে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে কাব্যগুলি রচিত হলেও মানব মানবীর জীবনের সংক্ষোভ, আঘাত, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা - সবই ধর্মের প্রচ্ছদে ধরা রয়েছে। বিশেষত নারী জীবনের অপমান, জ্বালাপোড়া ধর্মীয় প্রচ্ছদ ভেদ করে সংবেদনশীল পাঠকের বুকে এসে লাগে, মনসামঙ্গল কাব্যে স্বামী পরিত্যক্তা মনসার ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ের খবর তার ধর্মীয় মহিমাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে অবারিত হয়ে পড়েছে, মনসা বলছেন,
"জনম দুখিনী আমি জন্মে গেল কাল।
যেই ডাল ধরি আমি ভাঙ্গে সেই ডাল।।
শীতল ভাবিয়া যদি পাষাণ লই কোলে।
পাষাণ আগুন হয় মোর কর্মফলে।।"
পশু পালনের দেবী চণ্ডী আর আর্য দেবী চণ্ডী একাকার হয়ে গিয়েছেন চণ্ডীমঙ্গল নামের কাব্যটিতে, সেখানেও ধর্ম প্রচারের ছলে সে সময়ের জীবনই ধরা পড়েছে; সেই জীবন যেখানে সামন্ততান্ত্রিক বাতাবরণে প্রতি পদক্ষেপে নারীকে হেয় করা হয়, ঘৃণা করা হয়, লাঞ্ছনা করা হয়, দমিত করে রাখা হয়, সেই সমাজের যথাযথ ছবিটি ধরা পড়েছে এমন বহু বর্ণনায় ও সংলাপে, যা পড়লে বিস্ময়ের আর অবধি-ও থাকে না। দেবপূজা প্রচারের ধর্মীয় তাৎপর্য ছাপিয়ে দেখা দিয়েছে সে সমাজের যথার্থ ছবিটি। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে ধনপতি সদাগরের আচরণে নারী জাতির প্রতি তার মনোভাব অবারিত হয়ে পড়েছে,
"পূজাগৃহে উপনীত হৈল ধনপতি।
জয় দিয়া পূজে চণ্ডী খুল্লনা যুবতী।।
বামপথী হইয়া করিস কার পূজা।
ইহা শুনি যদি মোরে ক্রোধ করে রাজা।।
পুনর্বার জ্ঞাতি বন্ধু যদি ছল ধরে।
পরীক্ষা তোমারে কত দিব বারে বারে।।
কারো ঘরে নাহি আছে হেন পাপ বধূ।
খুল্লনা গর্জিয়া তবে ক্রোধে বলে সাধু।।
এতেক বলিয়া সাধু জ্বলে কোপানলে।
লঙ্ঘিয়া দেবীর ঘট ধরে তারে চুলে।।
ভূমিতে দেবীর ঝারি গড়াগড়ি যায়।
নিকট হইয়া সাধু ঠেলে বাম পায়।।
কেমন দেবতা এই পূজিস ঘট ঝারি।
স্ত্রী লিঙ্গ দেবতা আমি পূজা নাহি করি।।"
সমাজের নেতৃস্থানীয় ধনপতি সদাগরের আপন স্ত্রীর প্রতি কী চমৎকার ব্যবহার! স্ত্রী প্রহার করা, চুলের মুঠি ধরে মারা, পূজারতা স্ত্রীর পূজার আয়োজনকে লাথি মেরে ফেলে দেওয়া, এসবই বেশ পৌরুষ ব্যঞ্জক দৃশ্যাবলী! সবচেয়ে আশ্চর্যময় বাক্যটি হলো ধনপতি সদাগর আস্ফালন করে বলেছে 'স্ত্রী লিঙ্গ দেবতা আমি পূজা নাহি করি।।' - সমস্ত স্ত্রীজাতিই তার মতো সম্মানিত ধনী, প্রতিষ্ঠিত পুরুষের কাছে অপমানের, ঘৃণার পাত্রী; এমনকি ধর্মীয় বাতাবরণে আশ্রয় প্রাপ্ত স্ত্রী দেবীরও তার পৌরুষ আস্ফালনের থেকে মুক্তি নেই; সমস্ত ধর্মীয় পরিমণ্ডলে, ধর্মীয় পরিবেশে রচিত সাহিত্যে নারীকে কেবলই দেওয়া হয়েছে হেলা, হেলাফেলা, অপমান, প্রহার, অবজ্ঞা ঘৃণা আর ঘৃণা।
নারীকে কি অন্য মূর্তিতেও দেখেনি এই উদ্ধত পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমাজ? হ্যাঁ, যে মূর্তিগুলি আঁকবার পশ্চাতে অন্য উদ্দেশ্য জায়মান ছিল, তা হলো নারীর প্রেমার্ত কিম্বা বিরহ বিধুর রূপ আঁকবার প্রয়োজন কখনো অনুভব করেছেন ধর্মীয় কাব্যের রচয়িতারা, কখনো বা নারীর জননী রূপটিকেও কিছু মহিমা দিয়ে এঁকেছেন এঁরা। তার কারণ, নারীকে প্রেমময়ী এবং স্নেহময়ী করে দেখলে পরিবার প্রধান এই সমাজের পুরুষের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। নারীকে ভোগ করা, নারীকে ব্যবহার করা, সংসারে বিনা পারিশ্রমিকে তার শ্রমকে কাজে লাগানো, সন্তান পালনের ধারাবাহিক কাজটি তাকে দিয়ে করিয়ে নেওয়া - এসবই ছিল এই সব ছবিকে বড় করে দেখানোর পেছনের কারণ।
বিখ্যাত পণ্ডিত আগস্ট বেবেল তাঁর বিখ্যাত 'Woman in the Past, Present And Future' গ্রন্থে লিখেছিলেন, "মানব জাতির মধ্যে নারীই সর্বপ্রথম দাসত্বের শৃঙ্খল পরেছে। নারীর দাসত্ব শুরু হয়েছে ইতিহাসে দাস প্রথারও পূর্বে"। ইতিহাসের সেই আদি যুগে নারীকে সমাজের সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে, ধনোপার্জনের ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল; তাকে করা হয়েছিল গৃহবন্দী। সেই দাসীত্ব, গৃহ সেবাদাসীত্ব নারীর আজও ঘোচেনি - সেই সুপ্রাচীন যুগে যখন ধর্মমত তৈরি হচ্ছিল, ধর্মগ্রন্থ লেখার সূচনা হয়েছিল তখন থেকেই নারী ছিল বন্দিনী, সেবাদাসী, পুরুষের অনুকম্পার পাত্রী; ফলে সমস্ত ধর্মগ্রন্থে সকল ধর্মমতে কী হিন্দুধর্ম, কী খৃষ্টধর্মে, কী ইহুদী ধর্মে, কী বৌদ্ধ ধর্মে, কী ইসলামে সর্বত্র মেয়েদের হীন-অপমানিত-নিকৃষ্ট শ্রেণীর জীব হিসাবেই দেখা হয়েছে, এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য।
প্রকৃতি তাঁর সৃষ্টি কার্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পুরুষ মানুষকে অসহায় করে রেখেছেন, সেই বিষয়টি হলো সন্তানের পিতৃত্বের বিষয়ে সুনিশ্চয়তা। পিতৃত্ব প্রমাণিত ছিল না, বিশ্বাস ও অনুমান নির্ভর ছিল, পিতৃত্বের সুনিশ্চয়তার বিষয়ে পুরুষের এই অসহায়তার জন্যই পুরুষ মানুষ মেয়েদের ওপরে, সমগ্র নারী জাতির ওপর নানাবিধ মূল্যবোধ আরোপ করেছে। যে নারী সৎ তাকে সতী বলা হয়, তবে একথা আমরা কে না জানি যে 'সতী' নারী বলতে শারীরিকভাবে বিবাহিত পুরুষটির প্রতি একনিষ্ঠতাকেই বোঝায়। যে নারী হীন মনোভাবের হতে পারেন, তিনি মিথ্যাভাষিণী-ও হতে পারেন, চোর বা ইতরও হতে পারেন, কিন্তু শুধুমাত্র স্বামীর প্রতি অন্ধ একনিষ্ঠতাই সতীত্বের শর্ত বলে সমাজে ধরে নেওয়া হতো। নারীকে এ বাবদ মানুষ বলেই গণ্য না করে, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসাবেই দেখা হতো, তাই সেই যন্ত্রটির প্রতি নানাবিধ 'না' আরোপ করা হয়েছিল। পুরুষ তার উপার্জিত বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির যথার্থ উত্তরাধিকারী চাইতো বলেই নারীর ওপর সহস্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, নারীকে অবরোধে বেঁধেছে, নারীকে অবিশ্বাসও করেছে। আমরা তো জানি প্রজানুরঞ্জনের নামে প্রকৃত প্রস্তাবে নিজের সন্দেহকেই মূল্য দিয়েছিলেন রামচন্দ্র, যিনি হিন্দুধর্মের এক প্রাচীন প্রতীক বলা চলে। ধর্মের দৃষ্টিতে ধর্মরাজ্য বা রামরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, যে রাজ্য থেকে গর্ভবতী স্ত্রীকে বার করে দেন দেশের ধর্ম ও নীতির প্রতিভূ রাজা রাম এবং তাকে নির্বাসন দেবার পর সুদীর্ঘকাল প্রায় পনের বছর তাঁর খোঁজও রাখেননি সেই ধর্মানুযায়ী মহৎ রাজা রামচন্দ্র! জন্ম মুহূর্তের সূচনায় শুধু বীজ বপনের তাৎক্ষণিক কাজটুকু ছাড়া পুরুষের প্রয়োজন সন্তান পালনের ক্ষেত্রে যে কত তুচ্ছ হতে পারে, পিতা ছাড়াও সন্তানের অস্তিত্ব সম্ভব, লব-কুশই তার প্রমাণ, প্রাচীন মহাকাব্যটি লব-কুশের বিকাশ বৃত্তান্তে পিতার ভূমিকা যে কত গৌণ হতে পারে, তা যথাযথভাবে দেখিয়ে দিয়েছে। আমাদের ধর্মে চিরদিন সীতাকে-সাবিত্রীকে নারীত্বের শীর্ষবিন্দু রূপে দেখানো হয়েছে, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মাথা পেতে নিয়ে পিতৃতান্ত্রিক নির্যাতনের মুকুট পরেছিলেন এঁরা, তাই এঁরা মহৎ নারী, সমস্ত নারীকুলের আদর্শ এঁরা - এরকমই শিখিয়েছে সমাজ, শিখিয়েছে ধর্ম ও লিঙ্গ রাজনীতির স্বার্থপরতা।
পৃথিবীতে যত রকমের রাজনীতি রয়েছে, তা প্রাচীনকাল থেকে ধর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবেই জড়িত ছিল। আর সবচেয়ে কুৎসিত, সবচেয়ে প্রাচীন, সবচেয়ে নিন্দাযোগ্য রাজনীতি হলো লিঙ্গ রাজনীতি। পুংলিঙ্গ ও স্ত্রী লিঙ্গে এই যে বিভাজন, তা সুপ্রাচীন কাল থেকে ধর্মকে আশ্রয় করেই বেড়ে উঠেছে, প্রসারিত ও পল্লবিত হয়েছে। সমাজের এই যে জঘন্য লিঙ্গ রাজনীতি, যার বলি হয়েছে অজস্র শিশুকন্যা, যাদের মায়ের পেট থেকে পড়বার পর এবং পড়বার আগেই হত্যা করা হয়; এর দ্বারা বোঝানো হয় যে, মেয়েদের জীবন পুরুষের জীবনের তুলনায় কম মূল্যবান এবং তার সেই নিকৃষ্ট জীবনকে, সেই জীবনের সকল দিককে ঘৃণা করতে প্ররোচিত করে এই সামন্ত সমাজ ও এই সমাজের ধর্ম। ধর্ম শব্দটি এসেছে ধৃ+ম (মন)-ক - এই প্রত্যয় নিষ্পন্ন করে। যা ধারণ করে তাই ধর্ম; যা শুভকারক, শ্রেয় তাই ধর্ম - তো, এই শুভকারক, শ্রেয় বস্তুটি নারীর কোন শুভ করেছে তা এই বিগত সহস্রাব্দের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে। ধর্মের আশ্রয়েই তাকে কোথাও মৃত স্বামীর জলন্ত চিতায় পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়েছে, তাকে কোথাও সারা জীবনের বৈধব্যের লাঞ্ছনাময় জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে, তাকে মাতৃগর্ভে মেরে ফেলা হয়েছে; নবজাতিকাকে নুন দিয়ে, কাঁচা ধান দিয়ে, আকন্দ আঠার রস দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। যে ধর্ম এই সব মারণযজ্ঞকে প্রশ্রয় দিয়েছে; নারীকে ঘৃণা করতে, নারীকে দমিত রাখতে, নারীকে নিকৃষ্ট জীব ভাবতে প্ররোচিত করেছে, সেই সব ধর্মের অন্ধকার দিকগুলি আবার এই সুপ্রাচীন উপমহাদেশে জেগে উঠতে চাইছে। এই লক্ষণ কোনোমতে শুভ ও সুন্দর নয়; সকল শিক্ষিত, সচেতন মানুষের এইসব ধর্মের গূঢ়-গোপন প্ররোচনার বিষয়ে অতন্দ্র সচেতনতা, সতর্কতা কামনা করি।

Comments