সাঈদীর ফাঁসীর রায় নিয়ে মিথ্যাচার এবং সেগুলোর উত্তর - নিঝুম মজুমদার [পর্ব-দুই]
আপনারা এরই মধ্যে সকলেই জানেন যে, ১৯৭১ সালের নরঘাতক, খুনী, ধর্ষক, গণহত্যাকারী দেলু কিংবা দেইল্লা রাজাকারের ফাঁসীর আদেশ হয়েছে। এই আদেশ হয়েছে ১৯৭১ সালে তার সকল ঘৃণ্য কর্মকান্ডের জন্য। ১৯৭১ সালে দেলু রাজাকারের সকল কর্মকান্ডের একটি সার সংক্ষেপ নিচের ছবিতে প্রকাশ করা হলো।
নাম জালিয়াতিঃ
দেইল্লার এইসব কর্মকান্ডের বিচার যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ট্রাইবুনাল-১ এ চলছিল তখন দেইল্লা রাজাকারের আইনজীবীরা ট্রাইবুনালে প্রমাণ করবার চেষ্টা করছিল যে, একাত্তর সালের যে দেলু শিকদার বা দেইল্লা রাজাকারের কথা অভিযোগে বলা হচ্ছে সেই ব্যক্তি আর বর্তমানের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো দেলোয়ার হোসেন সাঈদী এক ব্যক্তি নয়। এই প্রমাণ করবার চেষ্টা হিসেবে দেলু রাজাকার আদালতে এও বলেছে যে, তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট যদি দেখা হয় তবে সেখানে তার নাম দেলোয়ার হোসেইন সাঈদী লেখা রয়েছে। সুতরাং অভিযোগের দেলু বা দেইল্লা রাজাকার সে নয়, বরং ভিন্ন ব্যক্তি। কিন্তু বিধি বাম। এডুকেশন ডট নেট নামে একটি ওয়েবসাইট একদিন প্রকাশ করে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর নাম ও বয়স কেলেংকারীর কথা। তাদের অনুসন্ধানী রিপোর্টটি ছিল অত্যন্ত তথ্যবহুল এবং সেখানে সকল প্রমাণ দিয়েই কথা বলা হয়েছিল। এই ওয়েবসাইটের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে যে, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী বলে আজকে আমরা যাকে চিনি সেই সাঈদী দাখিল এবং আলিম পরীক্ষার সার্টিফিকেটে নাম দেয় আবু নাঈম মোঃ দেলোয়ার হোসাইন। উল্লেখ্য যে, সাঈদী দাখিল পাশ করে ১৯৫৭ সালে দারুস সুন্নাত শর্শীনা মাদ্রাসা থেকে এবং আলীম পাশ করে ১৯৬০ সালে বরই পাড়া মাদ্রাসা থেকে। এসময় সাঈদী তার জন্ম তারিখ ব্যবহার করে ০১-০১-১৯৪৫, যার মানে দাঁড়ায় সাঈদী জন্যের ১২ বছর বয়সেই দাখিল পাশ করে যা এক কথায় সম্ভব না। এখানকার প্রাপ্ত তথ্য থেকেই জানা যায় যে, সাঈদী তার আলিম ও দাখিল পরীক্ষায় উল্লেখিত ওই নামটি পরিবর্তন করতে উদ্যোগী হয় ২০০৮ সালের ৫ ই নভেম্বর। যার মানে দাঁড়ায় দাখিল পাশ করবার প্রায় ৫১ বছর পর এবং আলিম পাশ করবার ৪৮ বছর পর সাঈদী তার নাম পরিবর্তন করে রাখে দেলোয়ার হোসেইন সাঈদী। নিচে দেলু রাজাকারের সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা আলিম পাশ এর সার্টিফিকেটের স্ক্যান কপি দেয়া হলো।
নাম পরিবর্তন সংক্রান্ত আইনঃ
অথচ নাম পরিবর্তন সংক্রান্ত আইনে আছে যে সার্টিফিকেটে নামে ভুল থাকলে এই ভুল সংশোধন করতে হবে পাশ করবার ২ বছরের মাথায়। কিন্তু ৫১ বছর পর সাঈদী কিভাবে তার নাম পরিবর্তন করলো এটার উত্তর কোনোভাবেই দিতে পারেনি নাম ও বয়স সংশোধন সংক্রান্ত তৎকালীন কমিটির সদস্য সাবেক মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোঃ ইউসুফ (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), মাদ্রাসা বোর্ডের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক হাফিজুর রহমান (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও বর্তমান চেয়ারম্যান মোঃ আবদুর নূর এবং মাদ্রাসা বোর্ডের উপ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আবু ছালেহ আহমেদ। উল্লেখ্য যে, এই মোহাম্মদ আব্দুর নূর ২০০৩ সালে সাঈদীর সুপারিশেই তৎকালীন সময়ে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। নিচের ছবিতে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে, সাঈদী যখন নাম পরিবর্তন করে তখন দৈনিক সংগ্রামে যে এফিডেভিটের বিজ্ঞাপন দিয়েছিল সেটি। লক্ষ্য করে দেখুন যে, এইখানে সাঈদী তার বয়স লিখেছে ০১-০১-১৯৪৫।
এফিডেভিটে যা লেখা রয়েছে তা হুবহু নীচে উল্লেখ করা হলোঃ
'আমি দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদী জন্ম তাং ০১-০১-১৯৪৫ ইং পিতা মাওলানা ইউসুফ সাঈদী বাড়ি নং ৯১৪ শহীদবাগ ঢাকা। আমি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দা। আমি পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড বর্তমানে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডর অধীনে আলিম ও দাখিল পাস করি, দাখিল পাসের সন ১৯৫৭ ১ম বিভাগ রোল নং ৩৯২০ কেন্দ্র সারসিন। দাখিল পরীক্ষায় ভুলবশত: আমার নাম দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদীর পরিবর্তে আবু নাঈম মোহাম্মদ দেলাওয়ার হুসাইন লিপিবদ্ধ হয়েছে। আলিম পাসের সন ১৯৬০ সাল রোল নং ১৭৬০ কেন্দ্র খুলনা বিভাগ ৩য়। আলিম পরীক্ষায় ভুলবশত: আমার নাম দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদীর পরিবর্তে আবু নাঈম মোহাম্মাদ দেলাওয়ার হুসাইন লিপিবদ্ধ হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আমার শুদ্ধ ও সঠিক নাম হবে দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদী। এ ব্যাপারে আমি অদ্য ৫/১১/২০০৮ ইং নোটারী পাবলিক ঢাকা এর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে আমার নাম সংশোধনের বিষয়ে হলফ করলাম। দেলাওয়ার হুসাইন সাঈদী, পিতা মাওলানা ইউসুফ সাঈদী, বাড়ি নং ৯১৪ শহীদবাগ, ঢাকা। সংগ্রাম পি-৭২১২/০৮'
পাঠক লক্ষ্য করুন, এই এফিডেভিটের মাধ্যমে সাঈদী ২০০৮ এর নভেম্বর ৫ তারিখে কেবলমাত্র তার নাম পরিবর্তন করে।
বয়স জালিয়াতিঃ
পাঠক, নীচের এই ছবিটির দিকে তাকিয়ে দেখুন। সাঈদী নভেম্বর ৮, ২০০৮ সালে তার বয়স পরিবর্তন করবার জন্য এফিডেভিট জমা দিচ্ছে। সাঈদী তার সার্টিফিকেটে এতদিন লিখে রেখেছিল যে, তার জন্ম ১৯৪৫ সালে। যেই হিসেবে সাঈদী ১২ বছর বয়সে দাখিল পাশ করে। যেহেতু সাঈদী বুঝতে পেরেছে যে, এত কম বয়সে দাখিল পাশ করা যায় না, সেহেতু সে আবার তার বয়স পরিবর্তন করছে। কিন্তু এইখানেও সাঈদী আইন ভঙ্গ করেছে। কেননা বয়স সংক্রান্ত এফিডেভিটের ক্ষেত্রে এফিডেভিট করতে হয় ব্যক্তির মাকে কিংবা বাবাকে, যদি জীবিত থাকে। কিন্তু ২০০৮ সালে সাঈদীর মা জীবিত থাকতেও সাঈদী নিজে নিজে সাক্ষর করে এফিডিভেট করছে, যেটি সম্পূর্ণ রূপে অবৈধ।
আবার নীচের ছবিটি লক্ষ্য করুন যেখানে সাঈদী ২০০৮ সালের নভেম্বরের ৮ তারিখে সাক্ষরের স্থানে লিখেছে 'দেলোয়ার হোসেন সাঈদী', সেখানে মাত্র ২২ দিনের মাথায় নির্বাচনী প্রত্যয়নপত্রে সাঈদী তার সাক্ষর পরিবর্তন করে লিখেছে 'আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী', মানে দাঁড়াচ্ছে সাঈদীর সাক্ষর দুই জায়গায় দুই রকম মাত্র ২২ দিনের ব্যবধানে।










Comments