বামিয়ান ও তালিবান, হিন্দু তালিবান - গৌতম রায়

 

আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশে গৌতম বুদ্ধের দেড় হাজার বছরের প্রাচীন পাথুরে মূর্তির উপর তালিবানদের কামান দাগার সংবাদে গোটা বিশ্ব শিহরিত এবং ক্ষুব্ধ। এই ক্ষোভ স্বাভাবিক। প্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতির নিদর্শন এমন বর্বরতার সঙ্গে একবিংশ শতাব্দীতে ধ্বংস হতে দেখলে ক্ষোভ জাগবে বৈকি! নিন্দায় মুখর সকলেই। ইউরোপের মধ্যযুগীয় কালাপাহাড় 'বার্বার'দের সঙ্গে তুলনা টানা এক্ষেত্রে অনিবার্য। অনিবার্য হুন নরপতি অ্যাটিলা, চেঙ্গিজ খান, তৈমুর লঙ, নাদির শাহ, আহমদ শাহ আবদালি ও গজনির সুলতান মামুদের সঙ্গে তুলনাও। তুলনা কিন্তু অপেক্ষাকৃত সভ্যদের সঙ্গেও টানা দরকার। জানা দরকার, রোমানরা কীভাবে জেরুজালেমে ইহুদিদের সিনাগগ ধ্বংস করেছিল। খ্রিষ্টানরা কীভাবে ধ্বংস করেছিল স্পেনের ইসলামি স্থাপত্যকে। সুসভ্য ও সংস্কৃতিগর্বী ফরাসিরা কীভাবে মিশর অভিযানের সময় স্ফিংক্সের মূর্তিকে লক্ষ্য করে চাঁদমারি চালিয়েছিল, নেপোলিয়ন বোনাপার্টের হস্তক্ষেপে যা কোনওক্রমে রক্ষা পায়, সে ইতিবৃত্তও প্রসঙ্গত স্মরণ করা দরকার। কী করে ভুলে যাওয়া সম্ভব দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায় সমৃদ্ধ ঐতিহ্যশালী ইনকা, মায়া ও অ্যাজটেক সভ্যতা ধ্বংসকারী স্পেনীয়দের বর্বতার কথা? অ্যাপাচি ইন্ডিয়ানদের সভ্যতা যে নৃশংস অমানবিকতায় মুক্ত দুনিয়ার স্থপতিরা ধ্বংস করেছিলেন, তালিবান বর্বরতা তার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ। হাইতি সহ ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে এবং আফ্রিকায় ফরাসি ভাগ্যান্বেষীরা যে বর্বরতার স্বাক্ষর রেখেছিল, পর্তুগালের জেসুইট যাজকরা ব্রাজিল ও আফ্রিকায় ভূমিপুত্রদের ধর্মান্তরিত ও 'সভ্য' করতে যে বীভৎস শ্মশানশয্যা রচনা করেছিল, তালিবানদের বর্বরতা কি তার চেয়েও হিংস্র? বিধর্মী বা বিজাতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির নিদর্শন ধ্বংস করা বা চুরি সভ্যতাভিমানেরই উল্টো পিঠ। সভ্যতাই এই বর্বরতাকে তার জঠরে প্রসবিত করে। যে বিজিত, বিজেতা যদি সভ্যতায় তার থেকে নিকৃষ্ট হয়, তবে এই ধ্বংস ও তাণ্ডব আরও রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। তালিবানরা এক্ষেত্রে তাদের সব পূর্বসূরিদের চেয়ে নিজেদের উৎকৃষ্ট ও উন্নততর গণ্য করে। তারাই চূড়ান্ত বিজেতা। অন্তত তাদের ধারণা সে রকমই। অবশিষ্ট বিশ্বের কাছে যা সমগ্র মানব সভ্যতার মূল্যবান সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, তালিবানদের কাছে তা বিজিত পৌত্তলিকদের নিকৃষ্ট সভ্যতার বর্জনীয় আবর্জনা মাত্র। তাদের কী দায় আছে সেই আবর্জনাকে রক্ষা করার? বর্বরতার জন্য তালিবানদের সঙ্গে যাদের তুলনা করা হচ্ছে, তাদের প্রায় কেউই ধর্মের দোহাই দিয়ে মূর্তি বা ধর্মস্থান ধ্বংস করেনি। বরং বিজিতের মনে ত্রাস সৃষ্টিই ছিল তাদের তাণ্ডবের প্রধান লক্ষ্য। অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মস্থান আক্রান্ত হতো ধর্মস্থান বলে নয়। ধর্মীয় কারণে নয়, সোনাদানার মতো ঐহিক ঐশ্বর্যের মজুত ভাণ্ডার হিসাবে। সুলতান মামুদ তো অন্তত সেই কারণেই সোমনাথ মন্দির সহ একের পর এক হিন্দু উপাসনাগৃহ ধ্বংস করেছিলেন। উপাসনা ছাড়া আরও অনেক কিছুই সেখানে হতো, কিংবা বলা যায়, উপাসনা ছাড়া আর সব কিছুই সেখানে হতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হিন্দু পুরোহিতদের বঞ্চিত, বিক্ষুব্ধ অংশই লুণ্ঠনকারীদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসতো, চিনিয়ে দিতো গর্ভগৃহের অবস্থান, তার নীচে বানানো চোরা কুঠুরির হদিশ। সুলতান মামুদ আর যাই হোন, খুব ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন না, অন্তত ইসলামের প্রসারের জন্য তিনি এই লুঠতরাজ চালাননি। তাঁর লুণ্ঠন কর্মে অমুসলিমরা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবে এমন মূর্খ তিনি ছিলেন না। পরবর্তীকালে ঔরঙ্গজেব কিছু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন বটে, তবে সেটাও ধর্মের কারণে নয়। ঠিক যে জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলমান হয়েও তিনি বেশ কিছু মসজিদও ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। মন্দির হোক বা মসজিদ, তা পূজার্চনার পবিত্র কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়ে রাজদ্রোহ, আমির-ওমরাহদের রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র কিংবা নির্ভেজাল পুরুত-পাণ্ডার যৌন ব্যভিচারের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, এমন সংবাদ পেলে তবেই ঔরঙ্গজেব ফৌজ পাঠাতেন। অনেক ক্ষেত্রে হিন্দু রাজারাই মন্দির ধ্বংস করার জন্য তাঁকে অনুরোধ করেছেন। তাই এই ঔরঙ্গজেব যখন একাধিক বিখ্যাত মন্দির-মঠকে নিষ্কর জমি দান করেন, রক্ষণাবেক্ষণ বা সংস্কারের অর্থ জোগান, তাতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের অবিশ্বাস জাগলেও ইতিহাসের ছাত্রদের খটকা লাগে না।

তথাকথিত হিন্দু ভারতে কিন্তু ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার জন্য প্রতি ধর্মীয় ধর্মস্থান ধ্বংস করার ভুরি-ভুরি নজির রয়েছে। বীরশৈবরা লিঙ্গায়েতদের মন্দির ভেঙেছে, শাক্তরা বৈষ্ণবদের মন্দির ভেঙেছে; শৈব, শাক্ত ও বৈষ্ণবরা মিলে বা আলাদাভাবে বৌদ্ধ ও জৈনদের মঠ, আশ্রম, সংঘ, স্তূপ ভেঙেছে। ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের প্রতি ভারতেতিহাসের বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ বৌদ্ধদের কাছ থেকেই এসেছিল, যেমন এসেছিল অসংগঠিত চার্বাকপন্থীদের কাছ থেকেও। এই চ্যালেঞ্জকে যে নৃশংসতায় হিন্দু কট্টরবাদীরা দমন করেছে, তালিবানদের লজ্জা দেবার পক্ষে তা যথেষ্ট। প্রাচীন কাশ্মীরের ইতিহাসকার কলহন রচিত আখ্যায়িকা 'রাজতরঙ্গিনী'তে এক শ্রেণীর রাজকর্মচারীর কথা আছে, যাদের নামই ছিল 'দেবোৎপাটননায়ক'। নামেই প্রকাশ, এরা দেবালয় ধ্বংস করতো। হিন্দু রাজার রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়াতেই মন্দিরে

জমা ধনরত্ন লুঠ করে কোষাগার পূর্ণ করার এই উদ্যোগ। এ সবই বলা নিষ্প্রয়োজন; নিতান্ত জাগতিক কারণে ধর্মস্থানে আক্রমণের নমুনা, বিধর্মীর ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করা যার উদ্দেশ্য নয়। তুলনায় হিন্দু মৌলবাদী ধর্মগোষ্ঠীগুলির পরস্পরের বিরুদ্ধে আক্রমণ কিংবা অন্য ধর্মাবলম্বীদের মঠ-মন্দির ধ্বংসের তাণ্ডব অনেক বেশি আধ্যাত্মিক প্ররোচনাপ্রসূত। নিজের গোষ্ঠী ধর্মের প্রসার কিংবা পরধর্মের পীড়ন যার প্রেরণা।

স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়, পর ধর্মো ভয়াবহ - এ ধরনের কোনও সুভাষিত কি ইসলামে আছে? বলা বাহুল্য নেই। তবে তালিবানরা বামিয়ান বুদ্ধের মূর্তি ভাঙার প্রেরণা কোথায় পেলো? তালিবান প্রধান মোল্লা মহম্মদ ওমর বলছেন, ইসলামই তাঁদের প্রেরণা। এ কথা ঠিক যে বহু দেবতার পূজা বন্ধ করে কেবল 'আল লাট'-এর আরাধনা চালু করার জন্য হজরত মহম্মদ ৩৬৪টি মূর্তি ভেঙে দিয়েছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন - এক আল্লা-ই সত্য, আর সব মিথ্যা। কিন্তু ওই একবারই। তাঁর গোটা ধর্মীয় জীবনে আর কখনও তিনি পৌত্তলিকতাবাদীদের উপর খড়গহস্ত হননি। বরং কোরানে সর্বাদাই অন্যের ধর্মবিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করতে, সহ্য করতে বলা হয়েছে। কোরান স্পষ্ট বলেছে - 'তোমার ধর্ম তোমরা কাছে, আমার ধর্ম আমার কাছে'। ইসলামে মূর্তি পূজা নিশ্চয় নিষিদ্ধ। মুসলমানের পক্ষে মূর্তি পূজা নিন্দনীয়। কিন্তু অমুসলমানকে মূর্তিপূজা থেকে নিরস্ত করার কিংবা তার পূজিত বা নির্মিত মূর্তি ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ মহম্মদ কখনও দেননি। বরং মহম্মদের প্রয়াণের পর দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুখ প্যালেস্টাইনকে জয় করার পর চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন যে, খ্রিস্টানদের গির্জা, মা মেরি ও যিশুর মূর্তি বা ম্যুরাল, ক্রুশ কিছুরই কোনও ক্ষতি করা হবে না। এক ইহুদির শবযাত্রার সময় মহম্মদ শ্রদ্ধাবশত উঠে দাঁড়ালে তাঁর সঙ্গীরা যখন অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিল, ও তো মুসলমান নয়, তিনি তাদের পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, তা বলে তো ও কম মানুষ নয়? অন্য ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীর প্রতি এই সম্মান ও শ্রদ্ধা মহম্মদ আগাগোড়া অনুশীলন করেছেন। আর সে জন্যই তাঁর জীবৎকালেই ইসলাম আফগানিস্তানে প্রবেশ করলেও এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী খালেদ ইবন ওয়ালিদ সদলে আফগানিস্তানের বহু মানুষকে ইসলামে দীক্ষিত করলেও বামিয়ান বুদ্ধরা কখনও বিপন্ন বোধ করেনি। খ্রিস্টীয় দশম শতকেই কার্যত গোটা আফগানিস্তান তার বৌদ্ধ অতীত পিছনে ফেলে মুসলিম হয়ে যায়। তার পরে হুনরা ছাড়াও চেঙ্গিজ, তৈমুর, মামুদ, মহম্মদ ঘোরি, নাদির শাহ, আহমদ শাহ আবদালি, সকলেই আফগানিস্তান শাসন করেছে। কেউই কখনও পৌত্তলিকতার বিরোধিতা করতে গিয়ে বুদ্ধমূতি বা বৌদ্ধ সংঘারাম ধ্বংস করেনি। কারণ ইসলামে তেমন কোনও নির্দেশ ছিল না। 'মূর্তিপুজো করো না' - এমন নির্দেশ বিশ্বাসীদের প্রতি নিশ্চয় ছিল। কিন্তু 'যারা মূর্তি পুজো করে, তাদের মূর্তি ভেঙে দাও' - এমন ফতোয়া কোরান-হাদিশে কোথাও নেই। সে জন্যই ইরান, মিশর, এমনকী পাকিস্তানও কিছুটা বিলম্বিত প্রতিক্রিয়ায় বামিয়ান বুদ্ধের উপর তালিবানি তাণ্ডবের নিন্দা করেছে। ভারতের একের পর এক মুসলিম নেতা ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, অসংখ্য মসজিদের ইমাম, মুসলিম পার্সোনাল ল' বোর্ডের চেয়ারম্যান তালিবানি হামলার কঠোরতম নিন্দা করেছেন। শায়ের রচনা করে উর্দু কবি বলেছেন - 'জমিন পর গির রহে হ্যায় ঘর খুদা কে, ফরিস্তে আসমান পর রো রহে হ্যাঁয়।' চুপি-চুপি নয়, সাংবাদিকদের বৈঠকখানায় ডেকে নয়, এই ধিক্কার জ্ঞাপনের জন্য মসজিদের ইমামরা বেছে নিয়েছিলেন ইদের নমাজের লগ্নটিকে, যখন কোটি-কোটি মুসলমান ইমামের কথা শুনতে মসজিদ প্রাঙ্গণে সমবেত। তালিবানি অপকাণ্ডকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে তাঁরা যে আধ্যাত্মিক সততা ও সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, তা অনুকরণীয়। মুসলিম বিশ্ব যে তালিবানদের পাশে নেই, সেটাই যেন এর ফলে আরও প্রকট হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও যে তালিবানরা তাদের মূর্তি ধ্বংসের সিদ্ধান্তে অবিচল থেকেছে, তার কারণ ইসলামের পবিত্রতা সম্পর্কে তাদের ভ্রান্ত ধারণা। মূলত পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদ্রাসায় কোরান-হাদিশের পাঠ নেওয়া এই অর্ধশিক্ষিত উলেমাদের মনে হয়েছে, ইসলামের শুদ্ধতা রক্ষা করতে গেলে বিশ্বকে পৌত্তলিকতামুক্ত করতে হবে এবং তা করার দায়িত্ব যথার্থ মুসলমান হিসাবে তাদের উপরেই বর্তেছে। ইরান, সৌদি আরব বা পাকিস্তান যে ইসলাম অনুশীলন করে, তালিবানদের মতে তা পশ্চিমী প্রভাবে দূষিত, বিকৃত হয়ে গেছে; তার আদিম শুদ্ধতা, সারল্য হারিয়ে গেছে। উদারনৈতিক ইসলাম তাদের মতে ইসলামই নয়। কেবল তারাই পারে নবির সময়কার অপাপবিদ্ধ, সরল ইসলামকে অবিকল পুনরুজ্জীবিত করতে। এজন্য তারা এমনকী দেশীয় ঐতিহ্যের বিরোধিতায় দাঁড়াতেও প্রস্তুত, প্রস্তুত অনৈসলামিক ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতেও। তাদের আফগান পূর্বপুরুষরাই যে হেরাট, কান্দাহার, বামিয়ান ও কাবুলের বৌদ্ধ মূর্তি ও সংঘারামগুলি দীর্ঘ সাধনায় গড়ে তুলেছিলেন, এগুলির সঙ্গে যে জড়িয়ে রয়েছে সেই পূর্বসূরিদের আধ্যাত্মিক সাধনা, তাঁদের শিল্পী ও কারিগরদের অতুলনীয় দক্ষতা ও অনুপম নন্দনচেতনা, এ সব কথা তালিবানদের বলে কোনও লাভ নেই। যদি তালিবানরা কোনও ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হতো, যদি গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক উজ্জীবন ও পুনর্গঠনের ব্রত হতো সেই নবজাগ্রত জাতীয়তাবাদের মর্মবস্তু, তবে দেশের সভ্যতা-সংস্কৃতির ঐতিহ্য তাদের কাছে মূল্যবান পরিগণিত হতো। তখন দেখা দিতো ঐতিহ্য সম্পর্কে স্পর্শকাতরতা, ঐতিহ্যরক্ষায় সংগঠিত ও পরিকল্পিত উদ্যোগ। অতীত ঐতিহ্য তখন আফগান জাতীয়তাবাদের ভবিষ্যৎ বিকাশ ও অগ্রগতির প্রেরণা হয়ে উঠতো। কিন্তু তালিবানরা সে ধরনের কোনও ধর্মনিরপেক্ষ এজেন্ডা নিয়ে কাবুলের মঞ্চে অবতীর্ণ হয়নি। তাদের কাছে তাই ইতিহাস চেতনা বা ঐতিহ্যানুরাগ প্রত্যাশা করে লাভ নেই।

তালিবানদের বর্বরোচিত ধ্বংসলীলার নিন্দায় বিশ্বব্যাপী ঐকতানে ভারতের, বিশেষত ভারতীয় পার্লামেন্টের গলা মেলানো অনেকের কাছেই বিসদৃশ ঠেকেছে। ভারতীয় সংসদ একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব নিয়ে বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি সহ যাবতীয় আফগান প্রত্ন নিদর্শন নিরাপদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ভারতে নিয়ে আসার প্রস্তাবও রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে দিয়েছে। আট বছরের কিছু বেশি আগের এক দিন এই নির্বাচিত ভারতীয় সংসদই কিন্তু মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টায় সাড়ে চারশো বছরের প্রাচীন একটি ইসলামি স্থাপত্যের ধূলিসাৎ হওয়া নীরবে প্রত্যক্ষ করেছে, সেই ধ্বংসযজ্ঞে প্রকারান্তরে পৌরোহিত্য করেছেও বলা যায়। যারা সরাসরি অকুস্থলে হাজির থেকে সেদিন ধ্বংসোন্মাদ উগ্র হিন্দু করসেবকদের বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিতে উৎসাহ দিয়েছিল, মসজিদ ধ্বংসের পর প্রকাশ্যে উল্লাস ও হর্ষ প্রকাশ করেছিল - নিয়তির কী বিচিত্র পরিহাস - তারাই আজ ভারতীয় সংসদে তালিবানদের নিন্দা প্রস্তাবের বয়ান রচনা করেছে। আরও চমকপ্রদ ঘটনা, ধর্মনিরপেক্ষ বামপন্থীরা সেই প্রস্তাব অনুমোদনও করেছেন। একুশ শতকের সূচনায় বামিয়ান বুদ্ধের মূর্তি ধ্বংস করার চেয়ে বিংশ শতকের শেষে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা কি কম বর্বরতা? যে নিজে বর্বর, অন্যের বর্বরতার নিন্দা তার মুখে শুনবো কেন? এমনকী বামপন্থী সাংসদদেরও মনে এ প্রশ্ন জাগেনি। তাঁরা সংসদীয় প্রস্তাবে কোনও সংযোজনী বা প্রতিবাদ নথিভুক্ত করাবার চেষ্টা করেননি, বরং মুসলিম মৌলবাদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্বের বজ্রনির্ঘোষে গলা মিলিয়েছেন। যে হিন্দুত্ববাদীরা আজ ভারত ভাগ্যবিধাতা, তাদের অনেক কর্মসূচিই অথচ তালিবানদের কাছ থেকে সরাসরি ধার করা বলে মনে হয়। তালিবানদের মতো তারাও চায় না মহিলারা পর্দা ছেড়ে পুরুষের পৃথিবীতে সমান মর্যাদা ও দক্ষতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক। তাদের মতে, যেমন তালিবান এবং নাৎসিদের মতেও, মেয়েদের স্থান রান্নাঘরে এবং স্বামী শয্যায়। শিক্ষা মেয়েদের জন্য নয়, চাকরি তো নয়ই। রাস্তাঘাটে মেয়েদের বেশি ঘোরাঘুরি না করাই ভালো, খোলামেলা পোষাক তো একেবারেই পরা উচিত নয়। এই গরমের দেশেও ওতে নাকি ছেলেদের প্রবৃত্তিকে উস্কে দেওয়া হয়। আধুনিক শিক্ষা অর্থাৎ বেদে-উপনিষদে-পুরাণে-সংহিতায় নেই এমন শিক্ষা না দিলেই ভালো, মৃত ভাষা সংস্কৃত এবং হিন্দু নৈতিকতার চর্চাই হওয়া উচিত ভারতীয় শিক্ষার মেরুদণ্ড, সেই সঙ্গে বৈদিক গণিত। তা বলে আবার বাৎস্যায়ন, কালিদাস, মাঘ, ভাস, জয়দেব পড়লে চলবে না, ওতে আবার চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে! তালিবানরা যেমন কোরান-হাদিশের বাইরে পাঠ্য কিছুর অস্তিত্বই স্বীকার করে না, সংস্কৃতির ব্যাপারে কোনও উদারনৈতিক বহুত্ববাদ তালিবানদের মতোই হিন্দু মৌলবাদীদেরও ভয়ানক অপছন্দ। সামাজিক আচরণেও সনাতনপন্থী হওয়া ভালো; জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন, কার্ড পাঠানো, বিবাহবার্ষিকী উদযাপন, উত্তর বৈবাহিক মধুচন্দ্রিমা যাপন ইত্যাদি পাশ্চাত্য অবক্ষয়ের লক্ষণ, ছেঁটে ফেলতে পারলেই ভালো। আর প্রাক বৈবাহিক সহবাস, বিবাহ বহির্ভূত সহবাস, নারীর যৌন স্বাধীনতা - এসব কথা শুনলেও পাপ!

দৃষ্টিভঙ্গির এত সাযুজ্যের জন্যই তালিবানদের সঙ্গে গোঁড়া হিন্দুদের তুলনা শুরু হয়েছে এবং 'হিন্দু তালিবান' শব্দটি জনপ্রিয় হচ্ছে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ব্যাপারে তালিবানদের সঙ্গে হিন্দু গোঁড়াদের এমনকী পরিমাণগত পার্থক্যও নেই, গুণগত পার্থক্য তো ছিলই না। গুজরাতে যেভাবে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরঙ দল ও আর এস এস খ্রিস্টধর্মে অন্তরিত জনজাতীয়দের নিগ্রহ করেছে, তাদের বাইবেল পুড়িয়েছে, গির্জা ভেঙেছে, পাদ্রি ঠেঙিয়েছে, সন্ন্যাসিনী ধর্ষণ করেছে, তাতে অহিন্দুদের কাছে হিন্দু কতখানি আকর্ষণীয় ও গ্রহণীয় হয়েছে কে জানে, তবে হিন্দুত্বকে যে ভারতের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা গেছে, তাতে সংশয় নেই। ওড়িশায় হিন্দুত্বের এই আত্মপ্রতিষ্ঠা খ্রিস্টান মিশনারিদের জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারার মধ্য দিয়ে অর্জিত। সেই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের নায়ক যখন হিন্দু সমাজে পুরাণ পুরুষের মর্যাদা পেতে থাকে, নিরক্ষর গ্রামবাসীদের মধ্যে রটিয়ে দেওয়া হয় তার অবতারত্বের মহিমা, তখন ভারতীয় তালিবানদের স্বরূপ চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। অচিরেই অধর্ম থেকে ধর্মকে রক্ষা করতে ধরাধামে অবতীর্ণ দারা সিংহ শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী হয়ে ফুটপাতের ক্যালেন্ডার শিল্পে স্থান পেলো বলে!

অন্য ধর্ম এবং সেই ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্কে তালিবানি অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পেতে দেখেছি মকবুল ফিদা হুসেন চিত্রিত নগ্নিকা সরস্বতীর বিরুদ্ধে বজরঙ্গ আস্ফালনে, কাওয়ালি গায়ক নুসরত ফতে আলি খান এবং গজল গায়ক গুলাম আলির অনুষ্ঠান ভণ্ডুলে শিব সৈনিকদের জঙ্গিয়ানায়। তালিবানরা আফগানিস্তানের বৌদ্ধ ঐতিহ্য সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল নয় বলে তাদের যে সমালোচনা হচ্ছে, ভারতের ইসলামি ঐতিহ্য সম্পর্কে বিদ্বেষ ও ঘৃণার মনোভাব পোষণ করার জন্য একই ধিক্কার তো হিন্দু মৌলবাদীদেরও প্রাপ্য। ভারতের ইতিহাসকে কেবল হিন্দু গৌরবের ইতিবৃত্ত বলে ভেবে নেওয়ার ফলে মধ্য যুগের সমৃদ্ধ ইসলামি সংস্কৃতি-সভ্যতার ঐশ্বর্যকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। এতে যে ভারতীয় সভ্যতাই আরও রিক্ত হয়ে পড়ে, মৌলবাদীদের তা কে বোঝাবে? ভারত থেকে কেড়ে নেওয়া হোক তার ছশো বছরের মুসলিম শাসনের ইতিহাস, সুলতানি ও মুঘল স্থাপত্য, মুঘল চিত্রকলা, হিন্দুস্তানি মার্গ সঙ্গীত, ফার্সি ও উর্দুতে রচিত অনুপম কাব্য সাহিত্য, শের শাহ-টোডরমল্লর রাজস্ব নীতি। ভারতীয় সভ্যতাই কি তাতে আরও দরিদ্র হয়ে যাবে না? এসব কেড়ে নিলেও তো কেড়ে নেওয়া যাবে না সত্য পির, মানিক পিরকে; সেলিম চিস্তি, ইতমদউদ্দৌলাকে; পায়জামা-পাঞ্জাবিকে, উর্দু শায়েরিকে, বিরিয়ানি-কোর্মাকে। তবু চেষ্টা মুসলিম ইতিহাস থেকেও হিন্দু অর্জন ও কৃতিত্বের কণা খুঁটে বের করার, মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে হিন্দু বিদ্রোহীদের বীরগাথা রচনার। আর তা থেকেই শিবাজি, রানা প্রতাপ, গোবিন্দ সিংহের পুরাণ কথার সৃষ্টি, আকবর-মান সিংহের বিরুদ্ধে বারো ভূঁইঞার কাল্পনিক প্রতিরোধের অতিরঞ্জিত উপাখ্যান, আর তা নিয়ে দ্বাদশ তুর্কি অশ্বারোহীর বিক্রমে পরাস্ত বাঙালি রাজবৃত্তের (লক্ষণ সেন) গ্লানি অপনোদনের জন্য রচিত আত্মরতি!

তালিবানদের নিন্দায় ভারত যত উচ্চকণ্ঠই হোক, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে কথা বলার নৈতিক অধিকার অটলবিহারীর ভারতের নেই। বামিয়ান বুদ্ধের ভগ্নাবশিষ্ট মূর্তি সংরক্ষণের প্রস্তাবও সুদর্শন-আডবাণীর ভারতের নেই। কেননা তাঁরা যখন এই প্রস্তাব দিচ্ছেন, তখনই দিল্লির কুতুব মিনার চত্বরে একটি প্রাচীন মসজিদ প্রাঙ্গণে সংঘ পরিবারের লেঠেলরা গণেশমূর্তির সামনে যজ্ঞ আয়োজন করছে। কাশী ও মথুরা থেকে মসজিদ অপসারণ বা ভাঙার কর্মসূচি সংঘ পরিবার এখনও বাতিল করেনি, কেবল বি জে পিকে সংসদীয় গরিষ্ঠতা টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করার জন্য সাময়িকভাবে মুলতুবি রেখেছে। ভারতের শাসক দল বি জে পিও কখনও হিন্দুত্বের এজেন্ডা, রামমন্দির নির্মাণ কী কাশী-মথুরার মসজিদ ধ্বংসের কর্মসূচি খারিজ করার শপথ নিচ্ছে না, কেবল কোয়ালিশন রাজনীতির বাধ্যবাধকতার জন্য তা স্থগিত রাখার কথা বলছে। এর মধ্যে কোনও লুকোছাপাও নেই, যেমন নেই তালিবানদের পৌত্তলিকতা বিরোধিতায়। সুতরাং এমন একটি সাম্প্রদায়িক শাসক গোষ্ঠীর হাতে প্রাচীন সভ্যতার স্মারক নিরাপদ থাকবে, এ বিষয়ে নিঃসংশয় হওয়া কঠিন। অবশ্য বুদ্ধ মূর্তি বলেই হিন্দুত্ববাদীরা এত দরদি হয়ে পড়েছে। একদা বুদ্ধ ও তাঁর ধর্মের সঙ্গে যত প্রবল সংঘাতই হয়ে থাক, এখন তো আর ভারতে যথেষ্ট সংখ্যক বৌদ্ধ নেই, শিখদের মতো যাঁরা হিন্দু ধর্ম থেকে স্বাতন্ত্র্যের বেয়াড়া দাবি তুলে বসবেন, বিষ্ণুর অবতারে রূপান্তরিত করেও যাঁদের তুষ্ট করা যাবে না। যদি পরিস্থিতি তেমন হতো কিংবা যদি আম্বেডকর অনুগামী নয়া বৌদ্ধরা শক্তিশালী সামাজিক-অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসাবে এ দেশে প্রতিষ্ঠিত থাকতো, তবে কিছুতেই আডবাণী-যোশীরা ভগ্ন বুদ্ধমূর্তির শোকে এত উতলা হতেন না কিংবা তালিবানদের প্রতি পবিত্র ক্রোধে এত উদ্দীপ্ত বোধ করতেন না। বামিয়ানের আক্রান্ত স্মারকগুলি যদি কোনও ইসলামি সভ্যতার প্রত্ন নিদর্শন হতো, বাজপেয়ীদের বয়েই যেতো সেগুলির সুরক্ষার জন্য বিচলিত হতে! বামিয়ানের ঘটনায় ভারত সরকারের উদ্বেগ ও নিন্দাবাদকে অতএব গুরুত্ব দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। ইউরোপ-আমেরিকার সুসভ্য, শ্বেতাঙ্গ পাশ্চাত্য জনমতেরও কি অধিকার আছে তালিবানদের ভর্ৎসনা করার? এরাই না এই সেদিনও কৃষ্ণাঙ্গদের ক্রীতদাস বানিয়ে খাটিয়েছে, মেরেছে, উজাড় করেছে? এরাই তো বর্ণ বৈষম্যকে রাষ্ট্রনীতি হিসাবে অনুশীলন করার অমানবিকতা দেখিয়েছে। এখনও কু-ক্লুক্স-ক্ল্যান কিংবা স্কিনহেড-এর মতো বর্ণ বিদ্বেষী সন্ত্রাসবাদীদের পৃথিবীর মাটি থেকে নির্মূল না করে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে, 'এথনিক ক্লিনজিং' চালিয়ে আস্ত জনগোষ্ঠীকে 'নেই' করে দিচ্ছে। এদের কণ্ঠে সভ্যতাভিমানের উচ্চারণ, সভ্যতার অমূল্য নিদর্শন নষ্ট হওয়ার সন্তপ্ত শোকগাথা অরওয়েলীয় প্রতারণার মতো নির্মম ঠেকে না?


Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]