পূর্ব পাকিস্তানে নকশাল আন্দোলন - প্রবীর ঘোষ

 

১৯৭০-'৭১ থেকেই খবর পাচ্ছিলাম পূর্ব পাকিস্তানের কিছু সাম্যকামীরা দেশটিকে স্বাধীন করতে অত্যন্ত অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। তখনকার রাজনৈতিক দলগুলোকে দুটো ভাগে ভাগ করা যায় - (১) পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে বিশ্বাসী ও (২) যারা বুর্জোয়া নির্বাচনে বিশ্বাস করে না, গোপনে কাজ করে। দ্বিতীয় দলে পড়তো কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী, পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) এবং পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। এর মধ্যে প্রথম দুটি পার্টি ১৯৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত একই ছিল। তারপর আলাদা হয়ে গেলো। পূর্ব পাকিস্তানের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দল দুটি তখন ও-দেশের জনগণকে প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করে চলেছে। 'কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী' দলের নেতা ছিলেন মোহাম্মদ তোয়াহা। আর 'পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)'র নেতা ছিলেন আলাউদ্দিন মতিন।

পূর্ব পাকিস্তান তখন আধা সামন্ততান্ত্রিক-আধা উপনিবেশিক দেশ। ওই দুটি নকশাল দলের সঙ্গে ভারতের নকশাল দলের যথেষ্ট মিল ছিল। ওরাও শহরাঞ্চলে ক্রমাগত অ্যাকশন - মূর্তি ভাঙা, স্কুল পোড়ানো আর ব্যক্তি হত্যার রাজনীতি শুরু করেছিল। কিছু দুর্নীতির কারণে গরিবির তলানিতে পৌঁছনো পূর্ব পাকিস্তানের এই লড়াকু মানসিকতাকে সমর্থন জানিয়েছিল বহু সংখ্যক পূর্ব বাংলার মানুষ। এই দুটি বিপ্লবী দলের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। তাত্ত্বিকভাবে তাদের তৈরি করার জন্য সামান্য কিছু প্রয়াস নিয়েছিলাম। কিন্তু 'পূর্ব বাংলার সর্বহারা পাটি' (সিরাজ শিকদার)-এর সঙ্গে আমার কোনও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। তখন আমার মনে হয়েছিল, দুই নকশাল দলই পাকিস্তান সেনাদের শাসন থেকে পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করবে। একই কথা মনে হয়েছিল রাশিয়া এবং আমেরিকারও। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নিক্সন তার প্রতিনিধি হিসেবে ম্যাকনামারাকে পাঠালেন নয়াদিল্লিতে। তিনি ইন্দিরার সঙ্গে বসলেন। বোঝালেন, পূর্ব পাকিস্তান কিন্তু পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এরপর সেখানে রাজ করবে নকশালরা। আপনি তৈরি থাকুন, আমাদের সবুজ সঙ্কেত পেলে সেনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন পাকিস্তানি সেনাদের ওপর। ও-দেশের নকশালদের ঝাড়ে-বংশে শেষ করুন। ইন্দিরা জানতে চেয়েছিলেন, আপনাদের সঙ্গে পাকিস্তানের যে যুদ্ধ চুক্তি আছে, পাকিস্তান আক্রান্ত হলে তো আপনারা ওদের সাহায্য করতে সেনা পাঠাবেন। ম্যাকনামারা অভয় দিয়ে বললেন, কোনও চিন্তা নেই। আমাদের সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে ঘোরাঘুরি করবে। কিন্তু আপনাদের বিরুদ্ধে কিছু করবে না। ইন্দিরা সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বললেন। প্রেসিডেন্ট জানালেন, হ্যাঁ অবশ্যই ঝাঁপাবেন। নচেৎ চীনপন্থী নকশালরাই ওখানে ক্ষমতা দখল করবে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ মুজিবর রহমান আবেগপূর্ণ ভাষণে লাঠি, হাতা, খুন্তি নিয়ে জনগণকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বললেন। শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। এদিকে মুজিবর রহমান পাকিস্তানের শাসক ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলি ভুট্টো-র সঙ্গে ২৫ মার্চ পর্যন্ত আলোচনা চালিয়ে গেলেন। তাঁর দাবি, আমাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হোক। তাহলেই দেখবেন পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি বিরাজ করবে।

'প্রচারে জাতির জনক মুজিব' তখন এক অসাধারণ পরিকল্পনা নিলেন। মুজিব তাঁর বাড়িতেই থেকে গেলেন। পাকিস্তান বাহিনী ২৫ মার্চ রাতেই মুজিবকে তাঁর বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করলো বিনা বাধায়। সামরিক বাহিনী বিপ্লবী ও নিরীহ মানুষদের ওপর আক্রমণ চালালো। ভারত সরকার পাকিস্তানে সেনা পাঠাবার আগে থেকেই পূর্ব বাংলার জনস্রোত আছড়ে পড়লো এপার বাংলায়। পূর্ব বাংলার অস্থায়ী রাজধানী পশ্চিমবঙ্গের মুজিবনগর। মুজিবনগর আকাশবাণী থেকে প্রচারিত হতে লাগলো রেডিওর খবর। এপার বাংলার গায়করা বিপ্লবী গান গাইছেন। আর দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আবেগঘন কণ্ঠে বক্তব্য রেখে মাতিয়ে দিচ্ছেন। মুজিব কন্যারা তখন বাঙ্গুর এভিনিউয়ের পিছনের দিকে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বাড়ির পাশেই থাকতেন। সে কী যুদ্ধ হলো রে বাবা। ভারতীয় সেনারা পূর্ববঙ্গে পা রাখতেই দমদমের বড় মস্তান থেকে কচিকাঁচা-কুচো মস্তানরাও পূর্ববঙ্গে দৌড়লো। সেখান থেকে বিড়ি-সিগারেট কিনে এনে দেখাতে লাগলো। লক্ষ লক্ষ হিন্দু বাঙালি উদ্বাস্তু হয়ে এপারে এলো। তাদের ভরণপোষণের জন্য ভারত সরকার UNO থেকে মোটা অর্থ সাহায্য পেলো। কংগ্রেস ও সিপিএম ক্যাডাররা ওষুধপত্র ও 'ডোল' দেওয়ার দায়িত্ব নিলো। আর এসব স্বেচ্ছাসেবীদের একটা বড় অংশই ওই উদ্বাস্তু নারীদের নেকড়ের মতো খুবলে খেতে লাগলো ডোলের বিনিময়ে। তারপর পূর্ব বাংলাকে স্বাধীনতার নামে ভারতের উপনিবেশ করলো ইন্দিরা। ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি মুজিব বাংলাদেশে পদার্পণ করলেন এবং নিজেই হয়ে গেলেন স্বঘোষিত 'জাতির জনক'। এটা স্বঘোষিত 'জ্যোতিষ সম্রাট'দের মতোই ঘটনা আর কী! ইন্দিরা ও সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের কংগ্রেস ও জ্যোতি বসুর সিপিএম পার্টি জোটবদ্ধভাবে এপার বাংলার নকশাল নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সেই সময় দেখলাম দমদম পার্ক স্কুলে মিলিটারি ক্যাম্প। একদিন সকালবেলায় হইহই করে একদল সেনারা আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেললো। সারা বাড়ি তোলপাড় করেও মার্কস-লেনিন-মাও-এর কোনও বই পেলো না, কোনও অস্ত্রও পেলো না। দেখলো, আমি একটি কচি বউকে নিয়ে সংসার করছি, আর স্টেট ব্যাঙ্কের চাকরি করি তার পরিচয়পত্র। দেখার পরও আমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। বললো, আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেবে। মা-দিদি-বোন তাদের চেল্লামেল্লির মধ্যেই বউ সীমা অজ্ঞানের অভিনয় করে ধুপ্পুস করে পড়ে গেলো। এসব দেখে ও সিপিএম-রা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা খবর দিয়েছে ভেবে সেনারা ফিরে গেলো। বাড়ির লোক স্বস্তি পেলো। আমার বই কখনও বাড়িতে থাকতো না, থাকতো আমার মগজে।


Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]