প্রবীর ঘোষের চোখে যৌনতা [পর্ব-চার]

 


যৌনতার পিছনে সহজ প্রবৃত্তির তাগিদ নিশ্চয়ই থাকতে পারে। কিন্তু সে তাগিদ যখন কোনও ব্যক্তিকে দাসে পরিণত করে, তখন তা মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক হতে বাধ্য।

সামগ্রিকভাবে ব্যক্তিগত যৌন মুক্তি এই সমাজ কাঠামোকে বজায় রেখে বাস্তবায়িত করার চিন্তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এই সমাজ কাঠামোয় ব্যক্তিগত যৌন মুক্তি ধনী পুরুষ বা নারীর কামের কাছে দেহকে পণ্য করার গ্লানিতে পর্যবসিত অথবা বেলেল্লাপনার পাঁকে নিমজ্জিত। নারী-পুরুষের সাম্য বিনা, মানুষের সাম্য বিনা যৌন মুক্তি সম্ভব নয়। যতদিন অসাম্য থাকবে, ততদিনই থাকবে যৌন অবদমন। এই সত্যের সূত্র ধরেই বলা যায় - যৌন মুক্তির বা যৌন স্বাধীনতার দাবি যদিও ধনতান্ত্রিক সভ্যতারই দাবি, তবু এই দাবি প্রতিষ্ঠার মধ্যেই রয়েছে ধনতন্ত্রের ধ্বংসের বীজ। কারণ, যৌন স্বাধীনতার একান্ত অনিবার্য শর্ত সাম্য, নারী-পুরুষে সাম্য, মানুষে মানুষে সাম্য, মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। আর এই সাম্য ধনতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর ধ্বংস ছাড়া সম্ভব নয়। মুক্ত যৌন প্রণয়ের আবশ্যিক শর্ত হওয়া উচিত অবদমনহীন, শোষণহীন, বন্ধুত্ব ও বিশ্বাস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মানবীয় সম্পর্ক।

যৌন প্রণয়ের সঙ্গে সঙ্গে নারী প্রগতি এবং সামগ্রিক নারী মুক্তির চিন্তাকে বাস্তবায়িত করা এই সমাজ কাঠামোকে বজায় রেখে সম্ভব নয়। কারণ পুরুষতন্ত্র টিকে রয়েছে এই সমাজ কাঠামোর তৈরি শ্রেণি বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা, ধর্মীয় কুসংস্কার ও পুরুষতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের উপর। ধর্ম ও পুরুষতন্ত্রের সাংস্কৃতিক বোধের ভিত টলিয়ে দিতে পারলে টলিয়ে দেওয়া সম্ভব অসাম্যের রাষ্ট্রীয় কাঠামো, অসাম্যের পুরুষতন্ত্রকে। তার জন্য আর কিছু নয়, প্রাথমিকভাবে শুধু প্রয়োজন চিন্তার প্রয়োজনীয় স্বচ্ছতার ব্যাপ্তি ঘটনোর আন্তরিক চেষ্টা। এরই সূত্র ধরে শুরু হবে আন্দোলন, বিপ্লব, অসাম্যের সংস্কৃতি পাল্টে দেবার বিপ্লব।

'যৌন মুক্তি' ও 'যৌন প্রণয়' শব্দ দুটি অনেকবার ব্যবহার করা হয়েছে। শব্দ দুটি যাতে সাধারণে বিভ্রান্তি সৃষ্টি না করে, তাই শব্দ দুটির অর্থ পরিষ্কার করে ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বের সূত্রে স্বাভাবিক ভালোবাসাই যৌন মুক্তি বা যৌন প্রণয়ের ভিত্তি; যেখানে প্রেমিক-প্রেমিকা কেউ কাউকেই স্ট্যাটাস নির্ভর বস্তু-সামগ্রী, সম্পত্তি বা পণ্য বলে মনে করবে না।

এই নারী-পুরুষ একসঙ্গে বিবাহিত জীবন কাটাতে পারে অথবা 'লিভ-টুগেদার' করতে পারে। কিংবা লিভ টুগেদার না করেও দু-জনে দুজনের সঙ্গে মুক্ত যৌনতা উপভোগ করতে পারে। এর মধ্যে অবাধ যৌনতা বা 'সেক্স পারভারশন' নেই। আমরা 'Free Sex' (যৌনমুক্তি বা মুক্ত যৌনতা) এবং 'Sex pervertion' (অবাধ যৌনতা)-কে একই পর্যায়ের মনে করবো না।

যুক্তিবাদী সমিতির সদস্য চৈতালী প্রশ্ন করেছিলেন - বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, বন্ধুত্বই যদি যৌন প্রণয়ের ভিত্তি হয় এবং পিতা-কন্যা, মাতা-পুত্র বা ভাই-বোনের বেলায় যৌন প্রণয়ের ভিত্তি যদি দৃঢ় থাকে, তবে কি তাদের যৌন প্রণয়কে আমরা স্বাগত জানাবো?

যৌন উশৃঙ্খলা বা অবাধ যৌনতা বন্ধ করতেই এক সময় কিছু সম্পর্কের মধ্যে যৌন সম্পর্ককে 'অজাচার' বা বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছিল। ভারতে জাত-ধর্ম-প্রাদেশিকতার বিভিন্নতার সঙ্গে সঙ্গে 'অজাচার'-এর সংজ্ঞা পাল্টে গিয়েছে। দক্ষিণ ভারতে মামা-ভাগ্নির বিয়ের রীতি আছে। মুসলিম সমাজে জ্যেঠতুতো, খুড়তুতো ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ের চল আছে। এটা বলতে পারি, আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক আরোপিত, এই সম্পর্কও অপরিবর্তনীয় নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে। পাল্টাবেও। সুতরাং এই কাল ও স্থানের গণ্ডিতে দাঁড়িয়ে চৈতালীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। এর উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ।

সমিতির আর এক সদস্য তণিমা। নারী-পুরুষ সম্পর্ক নিয়ে ওর বক্তব্য - 'একগামী' কথাটাই মিথ্যে। এই যে জয়দেব একগামিতাকে আদর্শ বলে মনে করে, সেও স্বীকার করে সুন্দরী দেখলে ওর হার্টবিট বাড়ে। সুন্দরীকে কামনা করে। আসলে জয়ের একগামিতা একটা ভণ্ডামি। আমি স্বীকার করি স্বাস্থ্যবান, সুন্দর যুবক দেখলে মনটা আমার কেমন কেমন করে। সহজাত প্রবৃত্তিটাই আমাদের বহুগামী। উন্নততর সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে আমরা ভাবতে শিখেছি, শুধুমাত্র যৌনতার জন্য যৌনতা খারাপ। কিন্তু তারপর আমার মনে হয়, একজন নারী বা পুরুষের জীবনে একাধিক পুরুষ বা নারী আসতেই পারে যাদের সঙ্গে বিশ্বাস-শ্রদ্ধা-বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে। তাদের একাধিক অর্থাৎ দ্বিতীয় জনের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হলে, তাকে কি তুমি নীতিহীন সম্পর্ক বলবে? বললে সেখানে তোমার যুক্তি কী?

বলেছিলাম, একাধিক জনের সঙ্গে গভীর ও বিশেষ বন্ধুর সঙ্গে যৌন সম্পর্ককে সমর্থন করছিস। বুঝলাম। কিন্তু সেই একাধিক জন মানে কত জন? ২, ৩, ৫, ১০ নাকি আরও বেশি জন? আমি বলি কী, এ নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। সুস্থ বিতর্কই দিক দেখাতে পারে।

তণিমার বক্তব্য - প্রেম তো রেশনের চাল নয়, যে একাধিককে বিলোলে ফুরিয়ে যাবে। এখনই আমার সঙ্গে বিতর্ক চালাতে তোমার অসুবিধা কোথায়? রবীন্দ্রনাথ থেকে গান্ধি যদি বিভিন্ন সময়ে বা একই সময়ে একাধিক মহিলাকে ভালোবাসতে পারেন, তবে অন্যের বেলায় কেন আমরা বহু'র প্রতি ভালোবাসাকে খারাপ বলবো? তবে তো একই কারণে রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধিকেও খারাপ বলতে হয়।

সুলেখিকা ও বন্ধু মল্লিকা সেনগুপ্তের কথায়, "পৃথিবীর ইতিহাসে পুরুষ নারীকে সবচেয়ে বড় যে ধাপ্পাটি দিয়েছে তা মনোগ্যামি। অর্থাৎ এক নারী-এক পুরুষের যৌননিষ্ঠার ব্যবস্থা যার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে আধুনিক পরিবার।....পুরুষ শপথ নিলো যৌন-একনিষ্ঠতার, কিন্তু ক'জন পুরুষ তা পালন করলো? ব্যাপকহারে শুরু হলো গণিকাবিলাস ও পরস্ত্রীচর্চা।"

একটা প্রশ্ন উঠে আসে, পুরুষরা পরস্ত্রীচর্চা করলে স্ত্রীরা অনিবার্যভাবে পরপুরুষচর্চা করতোই।

আদিম সাম্যের সময় থেকেই পুরুষ ও নারী বহুগামী ছিল। তখন সব নারীই ছিল সব পুরুষের এবং সব পুরুষই ছিল সব নারীর। এমন চিন্তা এসেছিল সহজাত যৌন প্রবৃত্তি ও স্বতঃস্ফূর্ত সাম্য চিন্তা থেকে।

পরিবার চিন্তার উদ্ভব ও প্রয়োগের ব্যাপারটা সবচেয়ে বড় ধাপ্পা বলে আমার মনে হয়নি। গোষ্ঠীর সঙ্গে সঙ্গে গোষ্ঠীপতির উদ্ভব হয়েছে। গোষ্ঠীপতিরা অন্যদের চেয়ে বেশি সম্পদ ও বহুপত্নী ব্যবস্থার প্রচলন করে। এই ব্যবস্থাই ব্যাপ্তি পেয়েছিল সামন্ত প্রভু, নবাব-রাজা-রাজড়াদের সময় থেকেই। বহু বিবাহ, বহু রক্ষিতা হারেম ইত্যাদির আবির্ভাব। অবশ্য রানিরা ও হারেমবাসীরাও বহুগামী ছিল। ওদের 'সতীত্ব' রক্ষার জন্য খোজা প্রহরী দিয়ে পাহারার ব্যবস্থা ছিল। এসবই ছিল ব্যর্থ প্রয়াস। প্রহরীকে ঘুষ দিয়ে অন্দরমহলে পুরুষ আনা হতো। খোজাকে দিয়ে কাম নিবৃত্তি ও সমকামিকতার মধ্য দিয়ে উত্তাপ প্রশমনের সব ব্যবস্থাই ছিল।

বাবু কালচারের সময় ধনী বাবুরা ডজন ডজন বেশ্যা পুষতো। বাগানবাড়িতে বাঈজি নাচতো। আর বিবিরা চাকর-বাকর, কর্মচারী এবং বাবুর মোসাহেবদের দিয়ে কাম মেটাতো।

বহুগামিতা পুরুষদের একচেটিয়া ছিল না। মল্লিকা যখন পুরুষদের গণিকাবিলাস ও পরস্ত্রীচর্চার কথা বলেন, তখন আর একটি সত্য প্রকাশিত হয়ে পড়ে - পরস্ত্রীরাও পরপুরুষচর্চায় মাততো।

'যৌনতা' একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। জন্তু থেকে মানুষ প্রত্যেকের মধ্যেই এই সহজাত প্রবৃত্তি কাজ করে। মানুষের সুসংস্কৃতিই মানুষকে সংযত, প্রেমময় ও একগামী করতে পারে।

আবার এমনও দেখেছি, সুসংস্কৃতির পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা বন্ধে কড়া আইন ও তার প্রয়োগ বহুগামীতা এবং বেশ্যাবৃত্তি বন্ধ করতে খুবই সক্ষম। তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ নেপাল ও ভারতের স্বয়ম্ভর গ্রামগুলো।

সুসংস্কৃতি একটু একটু করে গড়ে ওঠার বিষয়। যেসব নারী-পুরুষদের মধ্যে সুন্দর যৌন চেতনা গড়ে ওঠেনি, তাদের অনেকেই মিলনের সময় বাড়তি উত্তেজনা আনতে বা একঘেয়েমি কাটাতে দু-জনেই অন্যের সঙ্গে মিলিত হওয়ার গল্প বলে। এরা বহুগামী। যারা আত্মরতির সময় বিভিন্ন পুরুষ বা নারীকে কল্পনা করে আনন্দে ভেসে যায়, তারাও বহুগামী। আবার কেউ বা মিলনের সময় চোখ বুজে মনে মনে অন্য কারও সাথে কল্পনায় ভেসে যায়, তাকে কী বলবেন?

বনের বাঘকে তাড়ানো যায়। মনের বাঘকে তাড়াতে পারে একমাত্র উন্নততর চেতনা।

একগামী মানে অবশ্য আজীবন একজনের সঙ্গেই যৌননিষ্ঠ থাকবে - এমনটি অবশ্যই নয়। যে মানুষের জীবন বেশি গতিময়, জীবনে উত্থান-পতন বেশি, তাদের বন্ধুরাও পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রেমিকা বা প্রেমিক একজন 'বিশেষ বন্ধু'। এই 'বিশেষ বন্ধুত্ব'ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাল্টাতে পারে। জীবনে যেমন পুরনো বন্ধুদের কেউ কেউ বিদায় নেয়, কেউ কেউ আসে - তেমন কোনও 'বিশেষ বন্ধু' জীবনে এলে স্বাগত জানানোই উচিত।

একদিন সুমিত্রা বললেন, "বছর পঞ্চাশেক হলো এদেশে গর্ভ নিরোধকের ব্যবহার শুরু হয়েছে। পুরনো সমাজচিত্রের পরিচয় পেলেই দেখা যায় - সে সময়ে সর্বদাই মেয়েদের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার একটা ভয় কাজ করতো। তটস্থ থাকতেন মা-বাবারা। মেয়েদের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলাও বারণ থাকতো। মেলামেশা তো দূরস্থান, 'কখন কী হয়ে যায়?'

একটা খুব খারাপ উদাহরণ মনে এলো। যাঁরা কুকুর পোষেন তাঁরা বুঝবেন। মোটামুটি নিরীহ কুকুরকে অনেকেই রাস্তায় ছেড়ে দেন - একটু ঘুরে ঘরে আসুক। কিন্তু যাঁদের বাড়িতে মেয়ে কুকুর, তাঁরা অতিমাত্রায় রক্ষণশীল। ফিনাইল দিয়ে ধোওয়া হয় বাড়ির চারপাশ যাতে কুকুরীর গন্ধ না বাইরে ছড়ায়। আর বাইরে ছেড়ে দেওয়া তো অসম্ভব! কখন কী আপদ জুটিয়ে আনে - ঝামেলা পোহাতে হবে মালিককে। অজাত-কুজাতের কুকুরের সঙ্গে মিশে বংশপরিচয়হীন ছানার জন্ম দিলে সেগুলোকে বিক্কিরিও করা যাবে না। তার চেয়ে সময়মতো পাত্রস্থ করা ভালো। মোট কথা 'স্বাধীনতাহীনতা'।

বড্ড কুশ্রী একটা উপমা। কিন্তু এটাই রূঢ় বাস্তব। ব্যাটাছেলেরা তো আর 'সন্তানসম্ভব' হয়ে ঘরে ফেরে না, ঘুরুক না তারা যত খুশি।"

প্রথম প্রেমে কিশোর-কিশোরীদের আলাপচারিতায় ঘুরে ফিরে আসে মুগ্ধতা - প্রেমিকাকে দেখে, প্রেমিককে দেখে, চাঁদ দেখে, তারা ভরা আকাশ দেখে, ফুল দেখে, সমুদ্র দেখে, পাহাড় দেখে। মুগ্ধতার মধ্যে অনেক কিছুই ঘটে, মুহূর্তের আবেগ প্রাণ দেয়, প্রাণ নেয়। বয়েস তো বসে থাকে না। সবুজ আম পাতার মতো কিশোর-কিশোরীরা সমাজের ধূলিতে মলিন হয়। সমস্যার কাঁটায় রক্তাক্ত হয় জীবন। বোধোদয় হয় জীবনটা আদৌ রোম্যান্টিক সৌধ নয়। সমাজ কাঠামোর অদ্ভুত ছাঁচে মুগ্ধ প্রেমিক নিজের অজ্ঞাতে কখন যেন পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি হয়ে পড়ে। প্রেমিকা হয়ে ওঠে আদি অকৃত্রিম 'নারী', পুরুষতন্ত্রের তৈরি 'নারী'।

প্রেম বা দাম্পত্য জীবনের আদর্শ সম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রাথমিক ও আবশ্যিক শর্ত যৌনতা নয়, তাহলে গণিকা ও লম্পটরাই হতো সেরা প্রেমিকা ও প্রেমিকের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। নয় চটুল আলাপচারিতা অথবা দূর থেকে এক ঝলক দেখার জন্য পিচগলা রাস্তায় পাক্কা পাঁচ ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা। প্রেম বা দাম্পত্য জীবনের প্রাথমিক ও আবশ্যিক শর্তই হলো বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা এবং মতাদর্শগত মিল। এই শর্তগুলো অনুপস্থিত থাকলে আলাপচারিতা, আবেগ, কষ্টের প্রতীক্ষা বা যৌনতার দ্বারা আর যাই প্রমাণিত হোক, প্রেমের উপস্থিতি প্রমাণিত হয় না। যে দম্পতির জীবনে এইসব প্রাথমিক ও আবশ্যিক শর্তগুলো অনুপস্থিত সেখানে সম্পর্কের বোঝা টানা অর্থহীন, নীতিহীন এবং সুস্থ মানসিকতার পরিপন্থী। এক্ষেত্রে স্ত্রী বা স্বামীর জীবনে বন্ধু হিসেবে কোনও পুরুষ বা নারী যদি বসন্তের হাওয়া নিয়ে আসেন, তাকে স্বাগত জানানো মানসিকতার দিকে থেকে একান্তই কাম্য। উভয়ের বন্ধুত্ব শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার উত্তাপে বিকশিত হয়ে যদি শারীরিক মধুর সম্পর্ক স্থাপন করে, তাকে তো শ্রদ্ধা জানাবোই, স্বাগত জানাবোই। তার পরিবর্তে শ্রদ্ধাহীন, বন্ধুত্বহীন নারী-পুরুষের সম্পর্ককে স্বাগত জানানো কি আদৌ সুযুক্তির পরিচয় হতো? বন্ধুত্ব, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষের মধ্যে যখন সুস্থ শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তখন তার চেয়ে সুন্দর, তার চেয়ে শ্রেয় সম্পর্ক আর কিছু হয় না। যে সম্পর্ক মন্ত্রের জোরে শৃঙ্খলিত নয়, অন্তরের জোরে যুক্ত, তাই শ্রেয়। আমার এই কথাগুলো যেহেতু আন্তরিক, তাই স্ত্রীর ক্ষেত্রে মত পরিবর্তনের কোনও প্রশ্নই আসে না।

আবার যেখানে নারী-পুরুষ শুধুমাত্র যৌন উত্তেজনার আগুন পোহাতে নতুন নতুন অ্যাডভেঞ্চারে মেতে ওঠে, সেখানে এইসব মূল্যবোধহীন, ভোগসর্বস্ব, বিকৃতকামী নারী-পুরুষদের সুস্থ-সমাজ ও সুস্থ সংস্কৃতির শত্রু ছাড়া আর কিছুই মনে করার অবকাশ থাকে না। বন্ধুত্বহীন, মতাদর্শহীন, শ্রদ্ধাহীন কাম তাড়িত নারী-পুরুষদের যৌনচার, যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা আরো বহুজনের মধ্যে ভোগসর্বস্ব সংস্কৃতির বীজ বপন করবেই, সমাজকে পচন ধরাবেই - এই পরিবেশগত প্রভাবের সত্যকে মাথায় রেখে প্রতিটি সুস্থ সমাজ সচেতন মানুষের ঘৃণা নেমে আসা উচিত ওদের উপর। শৃঙ্খলিত নারী-পুরুষদের মুক্তির জন্য নতুন মূল্যবোধ গড়ে তোলার প্রয়োজনে, নতুন সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রয়োজনে, নারী-পুরুষের দাম্পত্য সম্পর্ককে, যৌন সম্পর্ককে, যুক্তির নিরিখে বিচার করতে হবে এবং তার প্রয়োগ করতে হবে নিজেদের জীবনে। ফলে নারী-পুরুষের নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠবে স্বত্বাধিকারের ভিত্তিতে নয়, বন্ধুত্বের ভিত্তিতে নিজের জীবনে এই প্রয়োগের জন্য চাই নিষ্ঠা ও সাহস - তেজে উদ্দীপ্ত সাহস।

এ জাতীয় চিন্তাধারা স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে - এই অভিযোগ বাস্তবিকই কতটা গ্রহণযোগ্য একটু দেখা যাক।

হিন্দুদের বহুগামী বিয়েতে অবশ্যই বহু নারীর উপর একটি পুরুষের যৌন স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত, স্পষ্টতই যা স্বেচ্ছাচার। ইংরেজদের প্রভাবে এ যুগের হিন্দুরা একগামী বিয়ে করলেও নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকার দরুন আজও এই বিয়ের মধ্য দিয়েও একটি পুরুষ একটি নারীর ওপর যৌন স্বত্বাধিকারই প্রতিষ্ঠিত করে, যা স্পষ্টতই স্বেচ্ছাচারিতা। যে ক্ষেত্রে নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর, সে ক্ষেত্রেও একগামী বিয়ে যৌন স্বত্বাধিকারের ওপরেই প্রতিষ্ঠিত - একজনের উপরে আর একজনের স্বত্বাধিকার। প্রেমহীন যৌন স্বত্বাধিকার সুবিধাবাদী লাম্পট্য ছাড়া কিছুই নয়, স্বেচ্ছাচারিতা ছাড়া কিছুই নয়।

মুসলমান সমাজে যেখানে বহুগামী বিয়ে প্রচলিত সেখানে বহু নারীর উপর এক পুরুষের যৌন স্বত্বাধিকার সন্দেহাতীতভাবে মর্মান্তিক স্বেচ্ছাচারিতা। স্ত্রী আদালতে স্বামীর বিরুদ্ধে জোর করে সহবাসের অর্থাৎ ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন, এমনটা বিলেতে ঘটলেও আমাদের দেশে দুর্লভ। নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে সামান্যতম দাম না দিয়ে স্বামীরা তো অহরহই সহবাস করছেন, স্বত্বাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে মোদ্দা কথায় ধর্ষণই করছেন - একি স্বেচ্ছাচারিতার নিদর্শন নয়? নাকি বিয়ে করার সুবাদে, যৌন স্বত্বাধিকার লাভ করার ফলে স্ত্রীকে যখন-তখন ধর্ষণ করা যায়?

এই ধরনের স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিয়ে কখনওই কাম্য হতে পারে না।

এই স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠা ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদা ও স্বতন্ত্র সত্তা খর্বকারী এবং সমাজের অগ্রগমন ব্যাহতকারী। সহধর্মিণী, প্রেমিকা, সহযোদ্ধার চেয়েও নারীর বড় পরিচয় হয়ে ওঠা উচিত সে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, স্বাধীন, স্বতন্ত্র সত্তা - এর মধ্যে কোথাও প্রেম ও দাম্পত্যের রক্ষণশীলতা নেই, ব্যক্তিত্বকে বেঁধে রাখার ফাঁদ পাতা নেই।

ষাটের দশকের শেষে ও সত্তরের দশকের গোড়ায় রাজনীতি সচেতন বহু প্রেমিকা-প্রেমিকা প্রাতিষ্ঠানিক বিবাহ পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে নতুনভাবে তাঁদের দাম্পত্যজীবন শুরু করেছিলেন। নিজের নিজের পার্টি কমিটির কাছে তাঁরা জানাতেন বিয়ে করার সিদ্ধান্তের কথা। পার্টি কমিটির অনুমোদন পাওয়ার পর বিবাহ সভা ডাকা হতো। এ সভায় শালগ্রাম শিলা সাক্ষ্য থাকতো না, থাকতো না কোনও ধর্মীয় মন্ত্র উচ্চারণ। হতো না কোনও মালাবদল, শুভদৃষ্টি। নবদম্পতি পাঠ করতেন মাও সে তুং-এর কিছু উদ্ধৃতি। উপস্থিত সকলে গান ধরতেন - বিপ্লবী গণসংগীত। আনন্দের অঙ্গ হিসেবে খাওয়া-দাওয়াও হতো। এইসব দাম্পত্য বন্ধনগুলো যে শেষ পর্যন্ত অটুট ছিল, এমন নয়। অনেক স্বামী-স্ত্রী এবং প্রেমিক-প্রেমিকা মতাদর্শগত পার্থক্য গড়ে উঠতেই শ্রদ্ধাহীন, বন্ধুত্বহীন, দাম্পত্য জীবন, প্রেমের সম্পর্ক ছিন্ন করে পরস্পরের থেকে দূরে সরে গেছেন।

রাজনীতি সচেতন, আদর্শ সচেতন, মূল্যবোধ সচেতন, আত্মমর্যাদা সচেতন, স্বাধীন মানসিকতা সম্পন্ন দম্পতিদের বিচ্ছেদ তুলনামূলকভাবে অসচেতন ও স্বল্প সচেতন দম্পতিদের চেয়ে অনেক বেশি ঘটে। দু'জনেই যখন আদর্শ-সচেতন, মূল্যবোধ-সচেতন, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন, রাজনীতি ও সমাজনীতি সম্পর্কে সচেতন তখন আদর্শগত দ্বন্দ্ব দেখা দিতেই পারে - সেটা একপক্ষের আদর্শচ্যুতির জন্যে যেমন হতে পারে, তেমনই আদর্শগত মতপার্থক্য থেকেও হতে পারে। এই দ্বন্দ্ব নিয়ে 'প্রেমিক-প্রেমিকা' অথবা 'স্বামী-স্ত্রী'র সম্পর্ক অটুট রাখা অবাঞ্ছিত মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কী?

আমি যে পাড়ায় থাকি, সে পাড়ায় মধ্যবয়স্ক ও বয়স্কদের একটি তাসের আড্ডা আছে। সন্ধ্যায় আড্ডার প্রায় প্রত্যেকেই আসেন, তাস খেলেন, রাতে বাড়ি ফিরে যান। বদলি, স্থায়ী অসুস্থতা ও মৃত্যু ছাড়া আড্ডার কোনও সদস্য বিদায় নেননি, আমার দেখা পনেরোটি বছরের মধ্যে। এই একই চিত্রের পুনরাবৃত্তি দেখতে পাবেন অন্যান্য পাড়ার তাস বা দাবার আড্ডার ক্ষেত্রে। কিন্তু আমাদের যুক্তিবাদী সমিতির সভ্যদের ক্ষেত্রে এমন অবস্থা আমরা গত আট-নয় বছরে আদৌ দেখিনি। যখনই কোনও সদস্য লোভ বা ভয়ের দ্বারা চালিত হয়ে সমিতির আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন, আমাদের সমিতির অন্যান্য সভ্য-সভ্যাদের সঙ্গে তাঁর তীব্র দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। পরিণতিতে বিচ্যুতকে অন্য সভ্যদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়েছে।

আজ আমার প্রতি যে গভীর বিশ্বাস ও ভালোবাসা সমিতির সভ্য-সভ্যাদের আছে, আমি বিচ্যুত হলে সেই বিশ্বাস ও ভালোবাসায় ভাঙন ধরতে বাধ্য। তারও পরে সভ্য-সভ্যাদের সঙ্গে আমার অতীত সম্পর্ক অটুট থাকা যেমন অসম্ভব, তেমনই নীতিহীন। তাসের আড্ডার সভ্য এবং আমাদের সমিতির সভ্যদের মধ্যে আদর্শগত সচেতনতার পার্থক্যের দরুনই দ্বন্দ্ব দেখা না দেওয়ার এবং দেখা দেওয়ার পার্থক্য আমরা লক্ষ্য করি। তাস, দাবার আড্ডার কোনও মতাদর্শগত সংগ্রাম নেই বলেই দ্বন্দ্বেরও সম্ভাবনা নেই। আর আমাদের সমিতির ক্ষেত্রে তীব্রভাবে মতাদর্শগত সংগ্রাম আছে বলেই দ্বন্দ্বও তীব্রতর হয়ে ওঠে। এই একই ব্যাপার ঘটে প্রেমিক-প্রেমিকা ও স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে।

আদর্শ সচেতন নর-নারীদের 'সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব' দেখা দেবার সম্ভাবনা যেমন অচেতনদের তুলনায় বেশি, তেমনই আদর্শগত মত পার্থক্যের পর তাঁরা জোর করে একটা দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রাখবেন - এটাও প্রত্যাশিত নয়, শ্রদ্ধা আকর্ষণ করার মত নয়। পাশাপাশি সাধারণ গৃহবধূ নানা ঝড়-ঝাপটা এবং অত্যাচার সহ্য করেও দাম্পত্য সম্পর্ক অটুট রাখতে সচেষ্ট থাকেন, স্বামীর প্রতি অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা এবং আদর্শগত সচেতনতার অভাবের দরুন।

স্ত্রী ও পুরুষের নানা ধরনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে। অনেক সময় মতাদর্শগত মিল থেকে, উভয়ের প্রতি উভয়ের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস থেকে গড়ে উঠতে পারে মধুর বন্ধুত্বের সম্পর্ক - যেখানে দেহ মিলন বন্ধুত্বকে আরও সমৃদ্ধতর, দৃঢ়বদ্ধ করতে পারে। এ মিলন স্বত্বাধিকার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়, নারী ও পুরুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও বন্ধুত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। এমন মিলনই তো সংস্কারমুক্ত মানসিকতার লক্ষণ, সুস্থতার লক্ষণ।

প্রাতিষ্ঠানিক বিয়ের মধ্য দিয়ে যেহেতু যৌন স্বত্বাধিকার এবং প্রচলিত সংস্কার আমাদের 'অস্থিতে-মজ্জায়' মিশে গেছে, তাই আমরা মেনে নিই - বিয়ে করার সঙ্গে সঙ্গে একটি নারী ও একটি পুরুষের যথাক্রমে অন্য পুরুষ ও অন্য নারীকে ভালোবাসার অধিকার বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক গভীর বন্ধুত্ব বর্জিত হয়ে প্রধানত যৌন স্বত্বাধিকার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হলেও জীবনের প্রায় বাকি অর্ধেকটা সময় সেই ভালোবাসাহীন দাম্পত্য সম্পর্ককেই বোঝার মতো বয়ে বেড়ানোটাই আমাদের সমাজের 'ট্রাজিক ট্রাডিশন' হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবনের এই শ্রেষ্ঠ অর্ধেকটা সময়ে ভালোবাসার মতো মানুষের সংস্পর্শে এলেও, মতাদর্শগতভাবে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকলেও সেই সমস্ত সুন্দর ইচ্ছেগুলোকে দিয়ে চিতা সাজিয়ে 'দাম্পত্য পবিত্রতা' রক্ষা করার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় সংস্কারাচ্ছন্ন অনগ্রসর মানসিকতারই পরিচয়। নারী-পুরুষের প্রেম - সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা নেয় মানসিক মিল, মতাদর্শের মিল; শাঁখা, সিঁদুর বা মন্ত্রোচ্চারণ নয়। গতানুগতিক যুগল সম্পর্কের ছক ভেঙেই আমাদের খোঁজ করতে হবে নির্ভুল আত্মপরিচয়ের, স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীন অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার।

পুরুষশাসিত আমাদের এই সমাজে পুরুষেরা তাদের স্বার্থে যে নীতিবোধ ও মূল্যবোধ চাপিয়ে দিয়েছে, তাতে আদর্শ নারীর গুণ হিসেবে ঘোষিত হয়ে আসছে পতি-সেবা, সন্তান-পালন, পতির পরিবারের সেবা ইত্যাদি। পতি-দেবতার শত লাঞ্ছনা ও অত্যাচার সহ্য করে টিকে থাকা নারীকে সমাজ চিহ্নিত করেছে মহান পতিব্রতা রমণী হিসেবে। পতির চিতায় জীবন্ত দগ্ধ হওয়া নারীকে পূজ্যপদ দেওয়া হয়েছে 'সতী' হিসেবে। যদি বলি, এসবই পুরুষ দ্বারা নারী শোষণের অপচেষ্টা বই কিছুই নয়, তবে অন্যায় বলা হবে কি? তবে এক্ষেত্রে নারীরা সাধারণভাবে কিছুটা 'দাস-নারী'র মতোই অবস্থান মেনে নিয়ে চলেন। এ-ক্ষেত্রে আমি 'শোষণ' শব্দটিকে ব্যবহার করেছি একটি উপমা বা প্রতীক হিসেবে। যেমন ফুটবল খেলার ধারা বিবরণী দিতে গিয়ে ধারাভাষ্যকার যদি বলেন, "মারাদোনা বিদ্যুৎ গতিতে বল নিয়ে ছুটছেন", তার মানে কি সত্যিই মারাদোনা সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার গতিতে ছুটে চলেছেন? সামাজিক শোষণ বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি এ বইতে সেই অর্থে শব্দটি একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে ইতিমধ্যে, অর্থাৎ যার সঙ্গে উৎপাদন ব্যবস্থার সরাসরি যোগাযোগ আছে, এ 'শোষণ' কিন্তু তা নয়, বরং এভাবে বলা যেতে পারে, একটা নির্দিষ্ট সামাজিক কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই সমাজের মাথারা নারী-পুরুষদের বর্তমান অবস্থানকে ধরে রাখতে নারী-পুরুষ সম্পর্কের এই মূল্যবোধকে চাপিয়ে দিয়েছে। সমাজের মাথারা যেহেতু পুরুষ, তাই প্রচলিত মূল্যবোধের ক্ষেত্রে পুরুষরা সাধারণভাবে কিছুটা সুবিধাজনক জায়গায় আছে। 'পুরুষদের দ্বারা নারী শোষণ' বলতে এই অবস্থানগত সুবিধার ফলকেই বোঝাতে চাইছি। এটা মাথায় না রাখলে 'শোষণ' শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহারে কেবল বিভ্রান্তিই বাড়বে। সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেকটাই ফেমিনিস্টদের অর্থাৎ তথাকথিত নারী-মুক্তির সমর্থকদের অনর্থক হট্টগোলের মতোই শোনাবে।

এসব বলার অর্থ এই নয়, আমি পুরুষদের সুবিধাজনক অবস্থার সমর্থক বা এই ব্যাপারটাকে মেনে নেওয়ার পক্ষপাতী। এমনকী এও বলি না - আমূল অর্থনৈতিক সংস্কার হওয়ার আগে পর্যন্ত এ ব্যাপারে চুপচাপ থাকতে হবে। সন্দেহ নেই, এসবই মানবিকতার প্রতি চূড়ান্ত অপমান এবং আমি সমস্যার মূলকে স্পষ্টভাবে চিনে নিতে চাইছি। 'মাতৃত্বেই নারীত্বের চরম সার্থকতা' - এমন লাগাতার প্রচার চালিয়ে নারীকে শুধু সন্তান উৎপাদনকারী এবং যৌন উত্তেজনা ভোগকারী যন্ত্র হিসেবে কাজে লাগাতে চেয়েছে পুরুষশাসিত এই সমাজ। সমাজ আরোপিত এই নীতিবোধ ও মূল্যবোধ কখনওই যুক্তিসংগত বলে মেনে নেওয়া যায় না। নারীর উপর পুরুষের শাসন ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কিছু নারী-পুরুষ যে প্রতিবাদ ও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, তাকে কারও দৃষ্টিতে মূল্যবোধের অবক্ষয় বলে মনে হতেই পারে। আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছি - অগ্রবর্তী অংশের মূল্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সমাজের মূল্যবোধও পালটায়। পরিবর্তনের হাওয়া লাগুক নারী-পুরুষ প্রণয় সম্পর্ক, দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে। যুগল নারী-পুরুষের মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠুক গভীর বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে। ভেঙে যাক যৌন স্বত্বাধিকারের উপর গড়ে ওঠা, বস্তু-সামগ্রী বিবেচনায় গড়ে ওঠা, মূল্যবোধহীন শারীরিক সম্পর্কের ওপর গড়ে ওঠা যুগল সম্পর্ক। নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্নকে সার্থক করার প্রয়োজনেই গড়ে উঠুক যুক্তির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নারী-পুরুষের সুন্দর সম্পর্ক নিয়ে নতুন মানবিক মূল্যবোধ।

- 'যুক্তিবাদের চোখে নারীমুক্তি', প্রবীর ঘোষ 

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]