প্রবীর ঘোষের চোখে যৌনতা [পর্ব-তিন]

 

২৭ আগস্ট, ১৯৯২ 'আজকাল' পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল - কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসিস্ট)-এর এক নেতাকে প্রেম করার অপরাধে অভিযুক্ত হতে হয়েছে এবং দলের সদস্যপদ ত্যাগ করতে হয়েছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সমিতির সদস্য পাচু রায়ের একটি চিঠি আজকালে প্রকাশিত হয় ৩০ আগস্ট। আলোচনার শুরুতেই চিঠিটি তুলে দেবার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।

"যতই কমিউনিস্ট পার্টি করি, যতই মার্কসবাদের কথা বলি, যতই 'লেনিনবাদ লেনিনবাদ' বলে চেঁচাই, সংস্কার আমাদের চেতনার আণবিক স্তরে বদ্ধমূল। বৃদ্ধ-বিপত্নীক সিপিএম নেতাটি ভুল বা অন্যায় কী করলেন বুঝতে পারলাম না। তাঁর প্রেমিকা বিগত দশ বছর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্করহিত। তাহলে এখানে পরস্পরের বন্ধু হয়ে বসবাস করতে অসুবিধা কোথায়? সাংবিধানিক অসুবিধা? বিবাহ বিচ্ছেদ হয়নি বলে? নাকি বুড়ো বয়সে আবার প্রেম ভালোবাসা কী? ওসব তো যৌবনের ব্যাপার, শারীরিক সক্ষমতার ব্যাপার, সিপিএম-এর হাওড়া নেতৃত্ব কি এই লাইনে ভাবছেন? আসলে সংবিধানের প্রতি, বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি, সামন্ততান্ত্রিক ধ্যানধারণার প্রতি এক দুরপনেয় আনুগত্য আমাদের মজ্জার আণবিক স্তরে প্রোথিত। মুখে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, বি জে পি-র বিরুদ্ধে ভোট বাক্সটাকে সামনে রেখে আসর গরম করা যায়, মালিকদের ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ সময়ে ট্রেড ইউনিয়ন করা যায়, ২২ এপ্রিল সাড়ম্বরে লেনিনের জন্মদিন পালন করা যায়, ৫ মে কার্ল মার্কসের জন্মদিনে মালা-ফালা দেওয়া যায়। কিন্তু মাটির কাছের সমস্যাগুলি যখন আসে তখন মাথার ভিতর বৃর্জোয়া জমিদারতন্ত্রের পোকাগুলি নড়েচড়ে বসে। তারাই তখন প্রাধান্য পায়। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির গণ্ডদেশে সাজোরে চপেটাঘাতও করেছিলেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। স্কুপস্কায়াকে কোনদিন সেই অর্থে বিয়ে করেননি। কার্ল মার্কস প্রচণ্ড ভালবাসতেন জেনি মার্কসকে, তৎসত্ত্বেও তাঁদের পরিচারিকার প্রেমে পড়েছিলেন, পার্টির পলিটব্যুরোর সামনে। একদিন বিবাহপ্রথা এবং বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিল পরিবারতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে। পরিবারতন্ত্র গর্বিত হয়েছিল শ্রেণি শোষণকে বজায় রাখতে। যদি কোনোদিন সাম্যবাদ আসে তবে শ্রেণি শোষণ যেমন বিলুপ্ত হবে, তেমনি লুপ্ত হবে পরিবারের প্রচলিত কাঠামো, লোপ পাবে বিবাহ নামক বহু লালিত প্রতিষ্ঠানটি।

সাধারণ মানুষ এতসব বুঝবেন না। হয়তো, তাঁরা বাঁচতে চাইবেন পুরনো ব্যবস্থাকে আঁকড়ে। কিন্তু যাঁরা নিজেদের মার্কসবাদী বলে সাইনবোর্ডে প্রচার করছেন তাঁদের ক্ষেত্রেও কি বুর্জোয়া অনুশাসন এত তীব্রভাবে প্রযোজ্য? তাঁরা কি এঙ্গেলস পড়েননি? নাকি ভোটের ডামাডোলে সেসব ভুলে গেছেন বেমালুম। দলত্যাগী শচীন্দ্রনাথের প্রতি আমার আন্তরিক অভিনন্দন রইল এই কারণে যে, পার্টি চেয়ার অটুট রাখতে মার্কসবাদ গ্রাহ্য সুন্দর সম্পর্ককে তিনি অসম্মান করেননি।"

এই চিঠি প্রকাশিত হওয়ার পর আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, আপনি কি এই চিঠির বক্তব্যের সঙ্গে একমত? উত্তরটা স্বভাবতই হয়েছে - হ্যাঁ। অমনি প্রশ্নও অনেকে করেছেন, কার্ল মার্কস-এর স্ত্রী অথবা মাও সে তুং-এর স্ত্রী যদি অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে সহবাস করতেন, তাহলে কি মার্কস বা মাও সে তুং বাস্তবিকই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারতেন?

প্রতিটি ক্ষেত্রেই উত্তর দিয়েছিলাম। যেহেতু দুই ইতিহাস প্রসিদ্ধ পুরুষের স্ত্রীরা এমন ঘটনা ঘটাননি এবং চরিত্রগুলির কেউই আজ জীবিত নন, তাই ভবিষ্যতে এমন ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাও শূন্য। অতএব মার্কস ও মাও কি করতে পারতেন এমন সম্ভাব্য উত্তরগুলির মধ্যে যে কোনোটিই ঠিক বা বেঠিক হতেই পারতো। মার্কস ও মাও ঠিক কি করতেন, দু'জনের মধ্যে একই ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতো কি না - এ সবের সঠিক উত্তর দেওয়া যখন একেবারেই অসম্ভব, তখন এ বিষয়ে আমিই বা কী উত্তর দেবো?

পুরুষ ও নারীর 'স্বামী-স্ত্রী' জাতীয় কোনও স্থায়ী সম্পর্কের ক্ষেত্রে বন্ধুত্বই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রাতিষ্ঠানিক বিবাহের ক্ষেত্রে এই বন্ধুত্বটাই সবচেয়ে গুরুত্বহীন বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। পত্রিকা খুলে 'পাত্রী চাই' - এর বিজ্ঞাপনের দিকে নজর দিলেই দেখতে পাবেন এ দেশের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সি এ, আই এ এস, আই পি এস, বি সি এস, ব্যাঙ্ক অফিসার ইত্যাদি পদের হিরের টুকরো ছেলেরা উর্বশী, মেনকা, রম্ভার খোঁজ করছেন। আর 'পাত্র চাই' বিজ্ঞাপনের দিকে যদি চোখ বোলান তাহলে দেখতে পাবেন, সুন্দরী আর শিক্ষিতা মেয়েরা হিরের টুকরো ছেলে খুঁজছেন। এক্ষেত্রে সাধারণত হিরের টুকরো ছেলেরা তাঁর সম্ভাব্য স্ত্রীকে গাড়ি, ফ্ল্যাট, ফ্রিজ, কম্পিউটার ইত্যাদির মতোই আভিজাত্যের প্রতীক অর্থাৎ স্ট্যাটাস সিম্বল একটি বস্তু-সামগ্রী হিসেবেই দেখেন। উর্বশী, মেনকা, রম্ভা অথবা সরস্বতীর দলও সাধারণত একইভাবে তাঁদের সম্ভাব্য স্বামীটিকে আর পাঁচটা স্ট্যাটাস নির্ধারক বস্তুসামগ্রী হিসেবেই বিবেচনা করেন। নারীরা যতই নারী স্বাধীনতা ও পুরুষের সমান অধিকার দাবি করুন না কেন, বেকার ছেলে বিয়ে করতে তো কখনওই বিজ্ঞাপন দেন না। তবে বেকার মেয়েরা কি করে প্রত্যাশা করেন রাজপুত্তুররা তাঁদের বিয়ে করবেন? আসলে মেয়েদের চেতনার অণুতে সংস্কার মজ্জায়-মজ্জায় ঢুকে গেছে স্বামীকে আভিজাত্যের নিদর্শন একটি বস্তু হিসেবে পরিমাপ করা, স্বামীকে নিজের চেয়ে অনেক বড় মাপের হিসেবে চাওয়া, নিজের ওপর স্বামীর স্বত্বাধিকার মেনে নেওয়া। এই চাওয়ার মধ্যে কোনও রকম ভাবেই একটি নতুন পুরুষের সঙ্গে আপন বন্ধু হিসেবে সম্পর্ক স্থাপনের আন্তরিক প্রচেষ্টা দেখতে পাই না।....

নারীরা যেমন সাধারণভাবে তাঁর চেয়ে কম ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, গুণসম্পন্ন পুরুষকে জীবনসঙ্গী করতে একেবারেই নারাজ, তেমনই সমব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সমপর্যায়ের অথবা উচ্চতর পর্যায়ের নারীকে দাম্পত্য জীবনে বন্ধু করে নিতে পুরুষরা একেবারেই গররাজি। ব্যতিক্রমী নারী ও পুরুষ নিশ্চয়ই আছেন, কিন্তু তাঁদের সংখ্যা এতই কম যে, শতকরা হিসেবের মধ্যে আসেন না।

দাম্পত্য জীবন গড়ে তোলার প্রথম শর্ত যখন হওয়া উচিত বন্ধুত্ব, তখন প্রথম শর্তটিকে দূরে সরিয়ে রেখে এ সমাজ যদি অন্য কোনও পরিমাপকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়, তবে তাকে যুক্তিনিষ্ঠ সমাজ সচেতন মানুষরা মেনে নেবে কেন?

কেন এমন একটা অসুস্থ মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত হয়ে গড়ে উঠেছে নারী-পুরুষ দাম্পত্য সম্পর্ক? এর জন্য অবশ্যই দায়ী সামাজিক পরিবেশ - যেখানে আমরা অহরহ দেখতে পাচ্ছি পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অদ্ভুত এক পরিমাপ পদ্ধতি, যেখানে আমরা নারীর আদর্শ বলতে সতীত্ব এবং পরিপূর্ণতা বলতে মাতৃত্বকে চিহ্নিত করি, সেখানে আমরা স্বামী-স্ত্রীর মানসিক দূরত্ব শত-যোজন হলেও হিমালয়ের চেয়ে ভারী সেই সম্পর্ককে বয়ে বেড়ানোর মধ্যেই সুনীতিকে খুঁজে পাই, যে পরিবেশ শৈশব থেকে আমাদের কানে মন্ত্র জপেছে, ছেলেরা সোনার মতো - কোনও কলঙ্কেই যা মলিন হয় না, আর নারী জীবনে কলঙ্ক স্পর্শ করলে তা কখনোই মোছে না। এমনি হাজারো জানা-বোঝা-শোনা আমাদের চিন্তাকে, আমাদের সংস্কারকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করছে। নারী-পুরুষের যুগল সম্পর্ক বিষয়ে এমন যুক্তিহীন চিন্তার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের নীতিবোধ।

সমাজে যে শৃঙ্খলা আনতে প্রাতিষ্ঠানিক বিবাহের সূচনা, সেই বিবাহই আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে নারীদের শৃঙ্খলিত করার এক প্রক্রিয়া।

নারী প্রাক-বিবাহিত জীবনে পিতার, বিবাহিত যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীনতা অবনত মস্তকে আজও মেনে চলেছে। পুরুষ শাসিত এই সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে 'কোটিতে গুটিক' নারী বিদ্রোহিনী হয়েছেন, শৃঙ্খল মুক্তির জন্য সোচ্চার হয়েছেন, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠেরা দীর্ঘকালীন মগজ ধোলাইয়ের শিকার হয়ে পুরুষের অধীনতা মেনে নেওয়ার মধ্যেই সুখ খুঁজে পেয়েছেন। বার্ট্রান্ড রাসেল একবার তীব্র বিদ্রূপ মেশানো রসিকতায় মন্তব্য করেছিলেন - পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদের স্বাধীনতা না থাকলেও পুরুষদের ছিল। তারা সুখী ছিল। জনসংখ্যার অর্ধেক সুখী থাকা কম কথা নয়। পরাধীন নারী সমাজের কিয়দংশও অসুখী ছিল না।

এইসব প্রাতিষ্ঠানিক বিয়েতে যেহেতু পাত্র-পাত্রীরা নিজেদের মধ্যে মতাদর্শগত মিলের মধ্য দিয়ে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার চেয়ে বস্তু সামগ্রী হিসেবে উভয়কে বিবেচনা করতে বেশি আগ্রহী থাকেন, তাই এই ধরনের বিয়ের মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র যৌন স্বত্বাধিকারই প্রতিষ্ঠিত হয়। মতাদর্শগতভাবে মিলহীন, প্রেমহীন, গভীর বন্ধুত্বহীন এমন দেহ মিলনকে 'সুবিধাবাদী লাম্পট্য' ছাড়া আর কিছু বলে অভিহিত করা যায় কি? এই ধরনের বিয়ে থেকে সাধারণত গভীর ও সুন্দর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে না, গড়ে ওঠে 'রুম মেট' জাতীয় এক ধরনের পরিচিতের সম্পর্ক যা এক সঙ্গে থাকা, খাওয়া ও ঘুমানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই সম্পর্ক যেহেতু মতাদর্শগত মিল ছাড়াই গড়ে ওঠে, তাই স্বামী রত্নটির জীবনে আর্থিক বিপর্যয় ঘটলে এবং তার দরুন পারিবারিক স্ট্যাটাসের বিশাল রকম পতন ঘটলে স্বামী গর্বে ও স্বামী প্রেমে মাতোয়ারা স্ত্রীর প্রেমও চটকে যায় - প্রায় সব ক্ষেত্রেই এমনটা হয়। এরপরও প্রায় ক্ষেত্রেই স্বামী-স্ত্রীর প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক অবশ্যই টিকে থাকে - কিন্তু তা ভালোবাসাহীন, বন্ধুত্বহীনভাবেই। আর্থিক বিপর্যয়ে প্রেম বিপর্যস্ত হবে - এমন পরিণতি ঘটার সম্ভাবনা কিন্তু মতাদর্শগত মিল থেকে গড়ে ওঠা সম্পর্কের ক্ষেত্রে শূন্য। মতাদর্শগত মিল থেকে গড়ে ওঠা সম্পর্ক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ভাঙে না, ভাঙে মতাদর্শের সংঘাতে।

স্ত্রীর উপর স্বামীর এমন স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণ যেমন অনেক ক্ষেত্রেই স্বামীর উপর স্ত্রীর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা, তেমনি অনেক সময় সামাজিক পরিবেশগত কারণে অনেক নারী ধরেই নেন, স্বামী-পুত্র-কন্যার সেবায় জীবন উৎসর্গ করার মধ্যেই নারী জীবনের সার্থকতা। আপনি যখন মা হিসেবে ছেলের জামা-প্যান্ট ধোয়া, ইস্ত্রি করা, স্কুলের টিফিন তৈরি করে গুছিয়ে দেওয়া, জুতোর পালিশ ঠিক রাখা ইত্যাদি কাজগুলো করেন স্নেহময়ী জননীর মহান কর্তব্য হিসেবে, তখন একবারের জন্যেও কি ভেবেছেন আপনার এমনতর কাজ-কর্মের ফলে যৌবনে পৌঁছে আপনার ছেলে প্রত্যাশা করবে তার স্ত্রীও এমনি করে গৃহকর্ম ও শিশু পালনের কাজগুলো একা হাতেই সামলাক। সে তখন নিশ্চয়ই স্ত্রীকে গৃহকর্ম, শিশুপালন ইত্যাদি বিষয়ে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসবে না। আপনার মেয়ে যৌবনে পৌঁছে আপনার প্রভাবে এটাই ধরে নেবে এসব কাজ করার একক দায়িত্ব একজন আদর্শ স্ত্রী ও মা হিসেবে তারই। এখনও আমাদের সমাজে সাধারণভাবে প্রচলিত স্ত্রী চাকুরিরতা হলেও তার উপরই বর্তায় গৃহকর্ম ও শিশু পালনের ঝক্কি। এমন এক অবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ভাগ পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় যেমন পুরুষদের ওপর বর্তায়, তেমনই কিছুটা দায়ভাগ অবশ্যই নারীদের যাঁরা এই ধারাকে স্থায়ী রাখার মানসিকতা সন্তানদের মধ্যে তৈরি করে চলেছেন। আমার এসব কথা অনেকের কাছেই নিন্দিত হবে জানি। এই ধরনের কথা বলার দরুন ইতিমধ্যেই কিছু কিছু কথা শুনতে হয়েছে। যেমন, "এমনতর মতের বিকাশ সমাজে স্বেচ্ছাচারিতাই বৃদ্ধি করবে। নারী-মুক্তির নামে, স্ত্রী-পুরুষের সমানাধিকার অর্জনের নামে পশ্চিম দুনিয়ার নারীরা ষাটের দশকে যে অন্তর্বাস পোড়ানোর আন্দোলনে নেমেছিলেন তার পিছনে যৌক্তিকতা রয়েছে বলে কি আপনি রায় দেবেন?" আমার এক পরিচিতা এ প্রশ্নও রেখেছিলেন, "আপনি যে সব যুক্তি মুখে দেন, কাজের বেলায় সে সব যুক্তিকে কি মেনে নিতে পারেন? আপনার স্ত্রী যদি অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলেন, আপনি কি পারবেন সেই সম্পর্ককে মেনে নিতে?” আর এক পরিচিতা একথাও বলেছিলেন, "আমি আপনার যুক্তিতেই বিশ্বাস করি। মনে করি, আমি স্বামীর কেনা দাসী নই। যার সঙ্গে ইচ্ছে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলবো। জীবনকে উপভোগ করবো। আমার এমন জীবনযাপন পদ্ধতিকে আপনি ঘৃণা করেন - আমি বুঝি। যদি ঘৃণাই করেন তো মুখে নারী মুক্তির কথা বলেন কেন? এ কি ভণ্ডামি নয়?"

খোলামনে এইসব নিন্দার যৌক্তিকতা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে বসলে মন্দ হয় না। প্রতিবাদীরা আসলে 'মুক্তি', 'স্বাধীনতা' ইত্যাদি শব্দগুলোর প্রকৃত অর্থই ধরতে পারেননি। মূল্যবোধহীন, দর্শনহীন কোনও আন্দোলনই প্রকৃত অর্থে মানব প্রগতি, মুক্তি বা স্বাধীনতা আনতে পারে না। পৃথিবীতে সর্বকালে প্রগতিবাদী, মুক্তিকামী, স্বাধীনতাকামী, বিপ্লবীদের সংগ্রাম মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। মূল্যবোধহীন, দর্শনহীন অনাদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম প্রকৃত মুক্তিকামী ও স্বাধীনতাকামীদের চিন্তাকে ঘুলিয়ে দিতে পারে মাত্র। কিন্তু কোনও অর্থেই মূল্যবোধহীন আন্দোলন 'মানব মুক্তির' বা 'শ্রেণি মুক্তি'র সমার্থক শব্দ হয়ে উঠতে পারে না। যা হয়ে উঠতে পারে তা হলো উচ্ছৃঙ্খলতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়।

নারী স্বাধীনতা বা নারী মুক্তির নামে যাটের দশকে অন্তর্বাস পোড়ানোর যে আন্দোলন সূচিত হয়েছিল, তারই পরিণতিতে কানাডায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে নারীদের অভিনব বিক্ষোভ। সে দেশের আইনে পুরুষেরা অনাবৃত বক্ষে প্রকাশ্য স্থানে চলাফেরা করতে পারে, নারীরা পারে না। নারীরা বক্ষ উন্মুক্ত রেখে ঘুরে বেড়ালে অশালীন আচরণের দায়ে ধরা পড়তে হয়। এই বৈষম্যের প্রতিবাদে কিছু নারী মিছিল করে পথে নেমেছিলেন বক্ষ অনাবৃত রেখেই। অর্থাৎ আইন অমান্য।

পাশ্চাত্যে নারী মুক্তির আন্দোলনে দেখতে পাই দর্শনের পরিবর্তে ইস্যুভিত্তিক ধাঁচ। কখনও ওরা নারীমুক্তির দাবি ঘোষণা করেছে অন্তর্বাস পুড়িয়ে, কখনও বা প্রকাশ্যে বক্ষ উন্মুক্ত ও নগ্ন হয়ে ঘোরাঘুরি করার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে নারীর মুক্তিকে আবিষ্কার করেছে। কখনও বা নারীকেই নারীর জীবন-সঙ্গিনী হিসেবে বেছে নেবার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে স্বাধীনতার পূর্ণতা খুঁজে পেয়েছে। এই নারী মুক্তির নেত্রীরা যেসব দাবি আদায়ের মধ্য দিয়ে নারী মুক্তি আন্দোলন বাস্তবিকই আনবেন বলে মনে করেছেন, সেই দাবিগুলো প্রতিষ্ঠিত হলেও বাস্তবে এর দ্বারা নারী সমাজের মুক্তি কখনওই প্রতিষ্ঠিত হবে না, হতে পারে না। অনাবৃত বক্ষ বা শরীর নিয়ে ঘোরাফেরা নারী মুক্তি ও নারী প্রগতির যদি চূড়ান্ত নিদর্শন হিসেবে গণ্য হয়, তবে বলতেই হলো ভারতীয় নারীরা মুক্ত নারী - কারণ ভারতবর্ষের অধিকাংশ মানুষের লজ্জা নিবারণের জন্য প্রয়োজন মেটাবার মতো কাপড় কেনার সামর্থ্যই যেখানে নেই, সেখানে সংখ্যাগুরু নারীরা যে ব্লাউজ এবং তারও তলায় অন্তর্বাস পরবে না, এটাই স্বাভাবিক। তাদের এই অন্তর্বাস পরিধান না করা নারী প্রগতি এবং নারী মুক্তিরই সাক্ষ্য বহনকারী ভাবলে তা হবে অযৌক্তিক। 'মুক্তি', 'প্রগতি', 'স্বাধীনতা' শব্দগুলোর সঙ্গে 'মূল্যবোধ' ও 'দর্শন'-এর সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে। আর তাই মূল্যবোধহীন, দর্শনহীন তথাকথিত নারীবাদী আন্দোলনকে উচ্ছৃঙ্খলতা ছাড়া আর কিছু নামে চিহ্নিত করা যায় না।

একইভাবে কিছু পুরুষ যদি তাদের অধমাঙ্গ অনাবৃত রেখে প্রকাশ্যে চলাফেরা করার মধ্যে এবং নারীর মতো প্রসাধন করার মধ্যে তাদের মুক্তি ও স্বাধীনতার চরম পূর্ণতাকে অর্জন করলো ভেবে উদ্বেল হয়ে ওঠে, তবে সেই পুরুষদের মানসিক সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ জাগাটাই স্বাভাবিক। এই পুরুষদের বিকৃতকাম ও উচ্ছৃঙ্খল বলে চিহ্নিত করাটা মোটেই অযৌক্তিক বলে বিবেচিত হবে না - একই যুক্তিতে। মূল্যবোধহীন, দর্শনহীন কোনও আন্দোলন কখনও কোনও শ্রেণীরই মুক্তি আনতে পারেনি, পারবেও না।

আজও পৃথিবীর একটা বড় অংশ জুড়েই ভোগবাদের দাপাদাপি। আন্দোলন নারীবাদ ও যৌন মুক্তি নিয়ে। অনেকের চোখেই আজ 'নারীবাদ' ও 'যৌন মুক্তি' সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যৌন মুক্তির এমন উচ্ছ্বাসে আপ্লুত পুরুষরাও। তবে তারা এবিষয়ে সোচ্চার দাবি না তুলেও নারীদের দাবির স্রোতে যৌন উত্তেজনা উপভোগের সুবিধে আদায়ে তৎপরতা দেখিয়ে চলেছে। যৌন মুক্তির দাবিদারদের যুক্তিটা হলো মানুষ খিদে পেলে খায়, তেষ্টায় জল পান করে, ঘুম পেলে ঘুমোয়, বেগ পেলে মলত্যাগ করে, মূত্রত্যাগ করে, ভয়ে ভীত হয়, আনন্দে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে এবং এসবই আমাদের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তি; তেমনই যৌনতাও আমাদের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তিই। নারী-পুরুষে শারীরিক মিলন বা প্রেম অথবা যৌন প্রেম যে নামেই ডাকা হোক না কেন, ব্যাপারটা খাদ্য গ্রহণ, জলপান বা মলত্যাগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। 'কামনা জাগলে সহবাস' - এই দাবি মানুষের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তিকে প্রতিষ্ঠা করার দাবি, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের, মুক্ত জীবনযাপনের দাবি।

এই মতকে যুক্তির নিরিখে আমরা মানি কী করে? এরপরও তো সমাজবদ্ধ মানুষকে আইনের শাসন মানতেই হয়। সেখানে যৌন মুক্তিকামীরা কি মুক্ত জীবনের দাবিতে আইন ভাঙবে আপন খেয়াল-খুশিতে? কারো বুকে ছুরি বসাতে ইচ্ছে হলে বসিয়ে দেবে, কোনও চলন্ত ট্রেনে ঢিল ছুড়তে ইচ্ছে হলে ছুড়ে দেবে ঢিল।

অথবা বিস্ফোরণে বিমান ওড়াবার চিন্তা মাথায় ঢুকলে বিমানে বিস্ফোরণ ঘটাবার দাবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নামবে। শারীরবৃত্তির স্বাভাবিক প্রকাশ হিসেবেই তো ঈর্ষা, হিংসা, ক্রোধ ইত্যাদিও বেরিয়ে আসে। অতএব এক তুড়িতে সমাজের প্রতিষ্ঠিত আইনকে উড়িয়ে দিয়ে ঈর্ষা, হিংসা বা ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে কেউ কি পারে কারও জীবন ও স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে? পারে না। আমাদের মূল্যবোধ, সুন্দর সমাজ গড়ার স্বার্থে চালিত মূল্যবোধই মুক্তির নামে এমনভাবে সমাজের ধ্বংসকে চাইতে পারে না। সমস্ত বাধা-বন্ধন থেকে মুক্ত পুরুষ কি যে সে হতে পারে? হতে পারে শুধু বদ্ধ উন্মাদ।

একটা পরম সত্য আমাদের মনে রাখতেই হবে, সমাজের বহুর সুখের সঙ্গে নিজের সুখের মেলবন্ধন না ঘটালে কোনও মানুষই পরিপূর্ণ সুখের অধিকারী হতে পারে না। এই কথাটা তাত্ত্বিকভাবে সত্য, বাস্তবক্ষেত্রেও চূড়ান্ত সত্য। যারা যৌনতার মধ্যে বেঁচে থাকার শ্বাস-প্রশ্বাস খুঁজে পায়, তারা এক সময় যৌনতার দাসত্ব করতে বাধ্য হয়, যেমন দাসত্বে বাধ্য হয় ড্রাগ অ্যাডিক্টেডরা। মনস্তত্ত্বের দিক থেকে লম্পটরা বিপরীত লিঙ্গের দিকে ছুটবেই। এমন ছোটা থেকেই বর্তমান সমাজে ঘটে চলেছে বাবা-মেয়ে, মা-ছেলে, ভাই-বোনের মধ্যেও যৌন সম্পর্ক। অনেক সময় বাবা বা মায়ের সঙ্গে মেয়ে বা ছেলের যৌন সম্পর্ক থেকে সন্তান প্রাথমিক উত্তেজনা ও ভালো লাগা কাটিয়ে অপরাধবোধ দ্বারা পীড়িত হয়ে মানসিক রোগের শিকার হয়। ভাই-বোনের যৌন সম্পর্ক থেকে মানসিক ভারসাম্য হারানোর বহু ঘটনা মনোরোগ চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে রয়েছে। এমন যৌন মুক্তির নামে লাম্পট্য, সুন্দর সমাজ গড়ার স্বার্থে কখনই কাম্য হতে পারে না।

জানি এতটা শোনার পরেও অনেকে বলবেন, এই ধরনের অজাচার বা নিষিদ্ধ যৌন সম্পর্ক গড়ে ওঠার পিছনে ঘিঞ্জি পরিবেশ, দৈহিকভাবে কাছাকাছি থাকা-শোওয়া, পরিবারের বাইরের লোকদের সঙ্গে মেলা-মেশার অভাব ইত্যাদি কারণগুলো যথেষ্ট ক্রিয়াশীল। যুক্তি মেনে নিচ্ছি। মেনে নিচ্ছি ভোগবাদী সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের প্রভাবের কথা। তার পরেও একথা বলতেই হবে - এমন মূল্যবোধহীন, আদর্শহীন, লুকোচুরির সম্পর্ক, গোপন যৌনতা যৌনত্বের দাসত্বেরই প্রকাশ। যৌনতা নিশ্চয়ই মানুষের জীবনবৃত্তিরই অংশ। কৃচ্ছ্রসাধন বা ব্রহ্মচর্যের নামে যৌনজীবনের প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণের চেষ্টাকে ধামা চাপা দেওয়ার প্রয়াস নিশ্চয়ই ক্ষতিকর। একই সঙ্গে ক্ষতিকর যৌনজীবনকে, সংগমকে অতিমাত্রায় গুরুত্বদান।

- 'যুক্তিবাদের চোখে নারীমুক্তি', প্রবীর ঘোষ 


Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]

দেশ যখন ইসলামাইজেশন এর পথে [পর্ব-এক]