গেরিলা যুদ্ধের প্রয়োগ-পদ্ধতি [প্রবীর ঘোষ]
দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধ থেকেই সাধারণভাবে যুদ্ধে তিনটি শ্রেণির বাহিনীকে কাজে লাগানো হয়। স্থল, বিমান ও নৌ। স্থল বাহিনীর আবার দুটি বিভাগ। পদাতিক ও সাঁজোয়া। পাহাড়ি এলাকায় যুদ্ধ হলে ট্যাঙ্ক কাজে লাগে না। তখন কাজে লাগে পদাতিক সেনা। তাদের এগিয়ে যাওয়া ও অঞ্চল দখলে সাহায্য করে বিমান বাহিনী। কোনও সর্বাত্মক যুদ্ধে শ'য়ে শ'য়ে, হাজারে হাজারে পদাতিক সেনা কখনও এগোয়। কখনও বিভিন্ন স্থানে ঘাঁটি গেড়ে অবস্থান করে। কখনও পাশে সরে, কখনও বা পিছোয়। পদাতিক বাহিনীতে অগ্রভাগ ও পশ্চাৎভাগ থাকে।
গেরিলাবাহিনী গড়ে তোলা:
গেরিলা যুদ্ধ কখনও সর্বাত্মক যুদ্ধ নয়। 'লুকিয়ে থেকে আচমকা আঘাত হানো এবং আক্রান্ত হওয়ার আগেই আত্মগোপন করো' - এই হলো গেরিলা যুদ্ধের মূল কৌশল।
১) যে কোনও কিছুর একটা স্থির লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকাটা প্রয়োজন। গেরিলা যুদ্ধ চালালে, তারও একটা স্পষ্ট উদ্দেশ্য থাকাটা খুবই জরুরি।
২ ) ভৌগোলিক অবস্থানটা জেনে নিতে হবে হাতের তালুর মতো।
৩) যে অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ চালাতে হবে সেখানকার ইতিহাস, মানুষের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, সামাজিক কাঠামো, সামাজিক অবস্থা, শোষণের রূপ, মানসিকতা, কুসংস্কার ইত্যাদি জেনে নিতে হবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। এখানকার মানুষদের সুখ-দুঃখের সাথী হতে হবে। বিপদে বন্ধু হতে হবে।
৪) গেরিলা যুদ্ধে নামার আগে প্রচুর বড় মাপের মিছিল ও সমাবেশ করতে হবে। শোষিত মানুষদের সমাবেশিত করতে হবে এটা খুবই জরুরি।
৫) অবস্থার সঙ্গে বুঝে নিতে হবে যে, আমরা সমাজ সংস্কার করার লক্ষ্যে এগোচ্ছি না। চাইছি, সমাজের একটা উল্লম্ফন, একটা বিশাল অগ্রগতির লাফ। অগ্রগতির লাফ-ই হলো 'বিপ্লব'। তাই মদের ঠেক, ব্লু ফিল্ম, জুয়ার ঠেক ভাঙা। নেশার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা। তাদের জুয়ার আড্ডা বন্ধ করা। বেশ্যাবৃত্তি বন্ধ করা। জ্যোতিষ পেশা বন্ধ করা। তন্ত্র সাধনা বন্ধ করা সহ অলৌকিক উপায়ে রোগ সারানোর পেশা বন্ধ করা। আসল তথ্যকে তুলে ধরা। এরকম সাধারণ দৃষ্টিতে সমাজের ক্ষতিকর বিষয়-বৃত্তিগুলোর বিরুদ্ধে জনসমাবেশিত করে আন্দোলন করা ও তাকে জঙ্গি রূপ দেওয়া। সঙ্গে ডিসকোর্স তৈরি করা দরকার।
৬) জনযুদ্ধের কাজ শুরু করার জন্য বিপ্লবী কমরেডদের আত্মগোপনের নির্দেশ দিতে হবে।
৭) পার্টির সাংগঠনিক কাজ গোপনে চালাবার পরিকল্পনা করতে হবে।
৮) গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলতে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন একটা বিপ্লবী সাম্যকামী সংগঠন। এই বিপ্লবী সংগঠন বিপ্লবের আগে গণসংগঠন রূপে পরিচিত হতেই পারে। এমন একটা সংগঠন বা গণসংগঠন যা শোষিত, অত্যাচারিত, হতদরিদ্র মানুষদের গ্রামগুলোতে তাদের বন্ধু হিসেবে হাজির হবে। বিপদের বন্ধু। এদের সংখ্যা গ্রাম পিছু জনা দুয়েক হলেই ভালো হয়। এরা গ্রামবাসীদের সঙ্গে মিশে থাকবে গ্রামবাসীদের একজন হিসেবেই। বাইরের কেউ এদের হদিশ পাবে না। এরা থাকবে কারও কুঁড়ে বা বস্তিতে আত্মীয়ের পরিচয়ে। এসেছে শ্রমের বিনিময়ে খাবার জোটাতে।
৯) এই সাম্যকামী অগ্রণী সেনারা গ্রামবাসীদের তাদের অধিকার বিষয়ে সচেতন করবে। সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচার কথা শোনাবে। সাম্যের মতাদর্শে দীক্ষিত করবে। ওদের সঙ্গে গল্প করতে করতে বোঝাতে হবে দেশের ইতিহাস, ভূগোল। বোঝাতে হবে কিছু শব্দের অর্থ। যেমন- রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, দেশপ্রেম, নাগরিকের অধিকার, জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ, স্বয়ম্ভর গ্রাম ইত্যাদির অর্থ। লেখাপড়া শেখানো, কুসংস্কার বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা, জাতীয় বীরদের জীবনীর সঙ্গে পরিচয় ঘটানো, ধর্ম শব্দের প্রকৃত অর্থ ও তার মধ্যে দিয়ে শোষণের পদ্ধতি, পূর্বজন্মের কর্মফল যে ভাঁওতা, অলৌকিক ক্ষমতা বলে কিছু নেই, আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র যে মানুষের সমাজের কোনও কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে না - এসব বোঝাতে হবে গল্পের ছলে। বরং এই সমস্ত কুসংস্কার, ঈশ্বর বিশ্বাস যে শোষণ করার জন্যই শোষকরা টিকিয়ে রেখেছে - এসবও জানাতে হবে।
এরপর নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মান দেওয়ার শিক্ষা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার শিক্ষা, আঞ্চলিক-অর্থনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণ করার শিক্ষা দিতে হবে। পরবর্তী পর্যায়ে বোঝাতে হবে, নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবি করলেই শাসক দল বা দেশের সরকার তা দেবে না। এই অধিকার অর্জন করতে না পারলে এমন পশুর জীবনই বয়ে বেড়াতে হবে। যারা আমাদেরকে লুটেই বড়লোক হয়ে শাসক হয়ে বসে আছে, তাদের থেকে নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে আনতে হবে। এজন্য নিজেদেরকে যোগ্য করে তুলতে হবে।
বিভিন্ন দেশের গেরিলা যুদ্ধের কাহিনি উদাহরণ হিসেবে তাদের কাছে তুলে ধরতে হবে। আবার শোষক শ্রেণির শোষণ ক্ষমতা কায়েম রাখার পদ্ধতিগুলো বোঝাতে হবে। এটি হলো সাংস্কৃতিক বাহিনীর কাজ। গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলার গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়।
১০) এভাবে গড়ে তুলতে হবে 'ঘাঁটি অঞ্চল'। 'ঘাঁটি অঞ্চল' তৈরি হয় পুরোপুরি শক্তিশালী পার্টি সংগঠন ও পার্টির গণভিত্তির উপর নির্ভর করে। এখানে গণভিত্তি মানে শুধুমাত্র জনসাধারণের নৈতিক সমর্থন পাওয়া নয়। জনগণ যখন পার্টির নেতৃত্বে যুদ্ধ করার জন্য তৈরি হয়ে ওঠে, তখনই বলতে পারি ঘাঁটি গড়ার মতো গণভিত্তি তৈরি হয়ে গেছে।
যতক্ষণ পর্যন্ত কোনও এলাকায় শত্রু সৈন্যদের পরাস্ত করে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করা না যাচ্ছে, ততক্ষণ বলা যাবে না যে - আমরা 'ঘাঁটি অঞ্চল' স্থাপন করেছি। 'ঘাঁটি অঞ্চল' মানে নিজেদের সরকার স্থাপিত হওয়া।
১১) গড়তে হবে গেরিলা অঞ্চল। গেরিলা অঞ্চল হলো অস্ত্রহীন জনগণকে সশস্ত্র করে তোলা। তাদের সেইসব অস্ত্র ব্যবহারের পদ্ধতি শেখানো। শত্রুর শক্তির সঠিক পরিমাপ করতে শেখানো। তাদের দিয়ে শত্রুর উপর আক্রমণ চালিয়ে সাহসী মানসিকতা গড়ে তোলা। গেরিলা রণকৌশল শেখানো।
১২) গেরিলা বাহিনী হলো কয়েকজনের ছোট ছোট দল। এতে থাকে সাধারণভাবে চার থেকে বড়জোর পনেরো জন। তবে এর ব্যতিক্রম হয়।
১৩) গেরিলা বাহিনীর নেতৃত্ব পরিচালনা করবেন যুদ্ধ থেকে স্বয়ম্ভর গ্রাম, কমিউন থেকে সাংস্কৃতিক আন্দোলন, শিক্ষা বিভাগ থেকে গুপ্তচর বিভাগ ইত্যাদি নানা প্রয়োজনীয় বিভাগ। এইসব বিভাগের নিখুঁত সমন্বয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা সম্ভব হয়। এই সংগঠনই ঠিক করে কারা বিভিন্ন বিভাগে নেতৃত্ব দেবে। কোথা থেকে গেরিলারা ট্রেনিং নেবে। প্রতিবেশী কোনও দেশে গিয়ে? তবে সেই দেশের ট্রেনারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
১৪) এরপর অস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে। হয় অর্থ দিয়ে কিনতে হবে, নতুবা শত্রু সেনাদের কাছ থেকে লুঠ করতে হবে। অস্ত্র, গোলা-বারুদের একটা অংশ কিনতে পারা যায় দুর্নীতিপরায়ণ দেশের সেনা ও পুলিশদের কাছ থেকে। বিভিন্ন বিস্ফোরক মিলবে নানা খনির সিকিউরিটি অফিসার, সেনা অফিসারদের কাছ থেকে।
১৫) এরপর 'মিলিশিয়া' গড়তে হবে। 'মিলিশিয়া' হলো সে-ই সশস্ত্র বাহিনী যা গণমুক্তিফৌজের প্রথম ধাপ। এরা গেরিলা গ্রুপ। প্রতিটি স্বশাসিত অঞ্চলকে 'মিলিশিয়া' গড়ে তোলার অধিকার দেবে পার্টি। 'মিলিশিয়া'র প্রধান কাজ ওই স্বশাসিত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত স্বয়ম্ভর গ্রাম ও সমবায়গুলোকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। একই সঙ্গে ঘাঁটি এলাকা এবং বিভিন্ন স্তরের গণকমিটিগুলোকে নিরাপত্তা দেওয়া, জনগণ জনযুদ্ধের যে সুফল পাচ্ছে তা রক্ষা করা। মিলিশিয়ার সদস্যরা কেউ পুরো সময়ের কর্মী, কেউ আংশিক সময়ের কর্মী। এই মিলিশিয়ার সদস্যরাই পরবর্তীকালে গণমুক্তিফৌজে যোগ দেয়। ওরা স্থানীয় মানুষকে অস্ত্রের ব্যবহার শেখায়, রসদ সরবরাহের কাজ করে।
১৬) গেরিলা বাহিনীকে শক্ত ভিতে দাঁড় করাতে হলে একটি শক্তিশালী গুপ্তচর বাহিনী থাকা খুবই জরুরি। মন্ত্রী, পুলিশ, প্রশাসন, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সেনা সর্বত্র অনুপ্রবেশ ঘটাতে হবে। অথবা বন্ধুত্ব করতে হবে। এই বন্ধুর বা গুপ্তচর বাহিনীর থেকেই হদিশ মিলবে গেরিলা বাহিনীর ভিতরে কারা রাষ্ট্রের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছে।
১৭) মনে রাখতে হবে অপ্রয়োজনীয় আক্রমণ করবে না এই গেরিলা যোদ্ধারা।
গেরিলার আবশ্যিক গুণ:
১) আদর্শে অবিচল থাকা।
২) সমস্ত অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা।
৩) প্রচণ্ড শৃঙ্খলাবোধ।
৪) দৃঢ়চেতা।
৫) নির্ভয়।
৬) আদেশ পালনে দ্বিধাহীন।
৭) শারীরিক সক্ষমতা ও কষ্টসহিষ্ণুতা।
৮) হেতুহীন কৌতূহল আদৌ থাকবে না।
৯) প্রেমিকা-মা-বাবা-ভাই-বোন ইত্যাদিদের সঙ্গে কোনওভাবেই যোগাযোগ রাখা চলবে না। নিজের ও দলের স্বার্থেই এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা প্রয়োজন। এই যোগাযোগই সেনা ও পুলিশকে গেরিলার অবস্থান চিনিয়ে দেবে। আত্মীয়রা অত্যাচারে মুখ খুলবে। যারা জানে না, তারা খোলে না।
১০) যাদের মুক্তির জন্য লড়াইতে নামা, তাদের ভালবাসাকে গ্রহণ করতে হবে, উপভোগ করতে হবে।
১১) গেরিলা যুদ্ধে গিয়ে কোনও স্বার্থ ত্যাগ করছ না। আনন্দ উপভোগ করছ। এটাই হলো গেরিলা যোদ্ধাদের আদর্শ মানসিকতা। 'স্বার্থ ত্যাগ করছি' ভাবলে গেরিলা বাহিনীতে থাকা যায় না। প্রাণ দেওয়া যায় না।
১২) গেরিলারা শত্রুর প্রতি নিষ্ঠুর হবে। মনে রাখতে হবে - 'হয় আমি শত্রুকে মারবো, না হলে শত্রু আমাকে'। একজন গেরিলা যোদ্ধার মৃত্যু মানে গেরিলা বাহিনীর অপূরণীয় ক্ষতি।
১৩) গেরিলা যোদ্ধা অহেতুক ঝুঁকি নেবে না।
১৪) অপ্রয়োজনীয় গুলি-গোলার ব্যবহার করবে না। কারণ বহু কষ্ট করে এই সব যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহ করা হয়।
১৫) অত্যধিক গোপনীয়তা ও সতর্কতা খুবই জরুরি। পেট পাতলা, গল্পবাজ কাউকে গেরিলা বাহিনীতে দেখলে তাকে বহিষ্কার করে দিতে হবে। বহিষ্কারের আগে তাকে জানিয়ে দিন, কেন তাড়ানো হলো। বাইরে গিয়ে গেরিলা বাহিনী নিয়ে কোনও গল্প করলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে - তাও জানিয়ে দিন।
১৬) দলে শত্রুদের গোয়েন্দা থাকতেই পারে। তাদের যতটা সম্ভব অকর্মণ্য করতে কোনও গেরিলাকে কখনও একা থাকতে দেবেন না।
১৭) যে অঞ্চলের জনমুক্তির জন্য যুদ্ধে নামা, সেই অঞ্চলকে, তার ইতিহাস ও ভুগোলকে জানতেই হবে। জানতে হবে ওই অঞ্চলে কোন কোন উপাসনা ধর্মে বিশ্বাসীরা থাকে। তাদের সংখ্যা। আয়ের উৎস। পারিবারিক আয়ের পরিমাণ। পানীয় জলের উৎস। রাস্তা-ঘাট। কৃষি নির্ভর না শিল্প নির্ভর এলাকা। জমি ক'ফসলি। উৎপাদিত ফসল কী। জাত-পাত নিয়ে কুসংস্কার কতটা প্রবল। কী ভাষায় কথা বলে। ওই অঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। মোট কথা নিজের কর্মক্ষেত্রের অঞ্চলকে চিনতে হবে হাতের তালুর মতো।
১৮) অঞ্চলের মানুষদের বিশ্বাস ও ভালবাসা অর্জন করতে হবে। তাদের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখের সাথী হলে, অঞ্চলের উন্নতির জন্য শ্রম দিলে মানুষ ভালবাসবেই, বিশ্বাস করবেই।
১৯) অঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে মিশে থাকতে হবে। এমনভাবে থাকতে হবে যাতে কারও বাড়তি দৃষ্টি আকর্ষণ না হয়।
২০) কারও কোনও ঝগড়ায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলা চলবে না।
২১) দোকান বা বাজার থেকে যা কেনা হবে, তার দাম মিটিয়ে দিতে হবে।
২২) ধার নিলে অবশ্যই শোধ দিতে হবে।
২৩) কোনও পুরুষ গেরিলা তাঁর নেতার নির্দেশ ছাড়া মহিলা বন্দির দেহ তল্লাশি করবে না।
২৪) নারীদের সম্মান জানাবেন। বিনয়ী হবেন।
২৫) নারী-পুরুষ গেরিলা একসঙ্গে থাকলে শোভন ব্যবহার করবেন। প্রেমের সম্পর্ক থাকলেও তার বহিঃপ্রকাশ যেন অশোভন না হয়।
২৬) গেরিলা পুরুষ-নারী দু'জনে জীবনসঙ্গিনী হলেও তাঁদের জীবনযাত্রা হবে শোভন, সুন্দর ও আদর্শ।
২৭) বিপরীত লিঙ্গের প্রতি বাড়তি আকর্ষণ দেখলে নেতা তাকে বারণ করবেন। তারপরও সংশোধনের কোনও চেষ্টা না দেখলে বহিষ্কার করতে হবে। ওর দুর্বলতাই দলের বিপদ ডেকে আনতে পারে। গোপনীয় খবর বাইরে যেতে পারে। কারণ, এমন যৌন দুর্বলতা যে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকাকালীন কোনও কোনও গেরিলার দেখা দিতে পারে - এটা শত্রুপক্ষের অজানা নয়।
২৮) গেরিলা যুদ্ধে কৃতকার্য হওয়ার একটা অন্যতম প্রধান শর্ত গোপনীয়তা।
২৯) বড় মাপের গেরিলা যুদ্ধে গেরিলাদের প্রত্যেককে নিজেদের জিনিস নিজেদের বইতে হয়। বহু পকেটওয়ালা ব্যাগের কোন পকেটে কী রাখা হলো, তা স্পষ্ট মনে রাখতে হবে। এতে থাকবে সমস্ত প্রয়োজনীয় আধুনিক অস্ত্র, মোবাইল ফোন, স্যাটেলাইট ফোন (স্যাটেলাইট ফোনের সাহায্যে পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তের ফোনের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। স্যাটেলাইট ফোন কোনও মোবাইল নেটওয়ার্কের সাহায্যে চালিত হয় না। যোগাযোগ রাখে স্যাটেলাইটের সাহায্যে। জ্যামারের সাহায্যে মোবাইল নেটওয়ার্ক অকেজো করা যায়; কিন্তু স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ককে অকেজো করা যায় না। কোথা থেকে এই ফোন করা হচ্ছে, ধরা যায় না), মিলিটারি ম্যাপ, জিপিএস বা Global Positioning System (জিপিএস হলো স্যাটেলাইটের সঙ্গে যুক্ত একটা ছোট্ট কম্পিউটার, যার স্ক্রিনের আয়তন মোবাইল স্ক্রিনের চেয়ে কিছু বড়। জিপিএস স্যাটেলাইটের সাহায্যে যেখানে যেতে চাওয়া হয়, তার যাত্রাপথ নির্দেশ করবে। 'গুগল আর্থ' (Google Earth) স্যাটেলাইট মানচিত্রের সাহায্যে ভারত, পশ্চিমবাংলা, দমদম এয়ারপোর্ট, মতিঝিলে আপনার বাড়িটি পর্যন্ত খুঁজে তার স্পষ্ট ছবি ও পথনির্দেশ পাওয়া সম্ভব। তারপর সেখানে যাওয়ার পথ দেখাও বললে জিপিএস পথ দেখাতে থাকবে। কোথায় পথ বাঁক নিচ্ছে, কোথায় খানাখন্দ সব গাইড করবে। কেউ জিপিএস নিয়ে লোকসভা কক্ষ থেকে হোটেলের ফ্লোর যেখানেই ঘুরবেন, চাইলে জিপিএস সেখানকার পজিশন ম্যাপ তৈরি করে ফেলতে পারবে। আজকাল অনেক গাড়িতে জিপিএস লাগানো থাকে), দীর্ঘ অতি ধারালো ছুরি, টর্চ, ইনফ্রারেড দূরবিন (অন্ধকারেও সব দেখা যায়), ডিহাইড্রেশন থেকে বাঁচতে ভিটামিন সি, জল, ক্ষত সেলাই করার ছুঁচ ও নাইলন জাতীয় সুতো, ব্যান্ডেজ, ল্যুকোপ্লাস্ট, কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ, লাইটার, দেশলাই, বাদাম, খেজুর, ন্যাপকিন পেপার, মগ, থালা, চামচ ইত্যাদি।
৩০) গেরিলাদের মধ্যে কারও কারও দোষ থাকে, কোনও ঘটনাকে বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলা। এটা অমার্জনীয় অপরাধ। নিজেকে হিরো সাজাবার চেষ্টা করা উচিত নয়। এটা স্কোয়াডের একটা টিমওয়ার্ক। এই বাড়িয়ে বলার প্রবণতাই গেরিলা বাহিনীর ক্ষতি করতে পারে। কোনও নেশায় বশীভূত গেরিলাকে দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে। নেশাগ্রস্ত মানুষ জ্ঞানত জেনে বা না জেনে দলের অনেক গোপন খবর পাচার করতে পারে বা প্রকাশ করতে পারে।
৩১) আন্ডারগ্রাউন্ড থাকাকালীন গেরিলারা বাইরে প্রচার মাধ্যমের প্রচার যেন শুনতে না পায়, পত্র-পত্রিকা পড়তে না পারে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। গেরিলা বাহিনীর মনোবল ভাঙতে সরকারি ও বেসরকারি প্রচার মাধ্যম লাগাতার মিথ্যে প্রচার চালাতে থাকে। এই মিথ্যে প্রচারের প্রভাব থেকে বাঁচতেই এই নির্দেশ।
৩২) গেরিলা যুদ্ধে নারী-পুরুষের ভেদাভেদ নেই। প্রত্যেকেই ভালো যোদ্ধা হতে পারেন। রেসের মাঠে মেয়ে ঘোড়ারা যেমন পুরুষ ঘোড়ার সঙ্গে রেসে লড়ে এবং জেতেও, তেমনই গেরিলা যুদ্ধে নারী একই সঙ্গে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে পারেন। নারী কখনওই পুরুষের চেয়ে দুর্বল নন। লড়া ও সংগঠনের শিক্ষা তাঁদের সবল করে। গেরিলাদের মধ্যে একটু একটু করে গড়ে ওঠা মূল্যবোধ 'গেরিলা বাহিনীর মধ্যে নারী যৌনবিবাদ সৃষ্টি' করবে না এবং ওসব ভাবার কোনও সুযোগই দেবে না। ওরা বন্ধু, ওরা সহযোদ্ধা। ওদের মধ্যে কারও কারও ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব গভীরতর হতে পারে, হয়। গেরিলাদের সামনেই বিয়ে করেন বা যৌথ জীবনে প্রবেশ করেন। এতে কোনওভাবেই কারও মনে কোনও ঈর্ষা কাজ করে না। শত্রু সেনারা নারীলোলুপ। তাঁদের কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করার কাজ নিখুঁতভাবে করে থাকেন মহিলারাই। খবর আদান-প্রদান ও অস্ত্র পাচারে পুরুষদের চেয়ে মেয়েরা অনেক এগিয়ে। সমাজের অর্ধেককে গেরিলা যুদ্ধে কাজে লাগানো সদর্থক কাজ। এতে সংগঠন বাড়বে আয়তনে ও শক্তিতে।
৩৩) প্রতিটি গেরিলাকেই অস্ত্রের ব্যবহার ও শারীরিক ফিটনেসের পাশাপাশি 'প্রাথমিক চিকিৎসা'র ট্রেনিং দেওয়া হয়ে থাকে। শেখানো হয় শরীরের কোন অংশের হাড় ভাঙলে কেমনভাবে গাছের ডাল কেটে ট্রাকশন দিতে হয়। কাটা দেহাংশে সেলাই করতে হয়। কীভাবে 'লোকাল অ্যানেসথেসিয়া'র সাহায্যে দেহ থেকে গুলি বের করতে হয়। কোথায় কীভাবে ব্যান্ডেজ বাঁধতে হয়। গেরিলাদের সঙ্গে রাখতে হয় 'পেইন কিলার' ওষুধ ও অ্যান্টাসিড, অ্যান্টিবায়োটিক। আহত গেরিলা যোদ্ধাকে ওই অঞ্চলের কোনও বন্ধু পরিবারে রাখতে হবে। যে অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ চলে, সে অঞ্চলে এমন বন্ধু পরিবার অনেক জুটে যায়। কারণ বন্ধুত্ব করে নেন গেরিলারা। এমনই কিছু বন্ধুদের আস্তানায় আহত যোদ্ধা থেকে যুদ্ধের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্তর রাখা হয়ে থাকে। এই বন্ধুদেরই কোনও এক পরিবারে একজন ডাক্তারকে রাখার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। তারপর সময়-সুযোগ বুঝে আহত বা অসুস্থ যোদ্ধাকে মুক্তাঞ্চলের হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হবে। মুক্তাঞ্চল যতদিন গড়ে তোলা সম্ভব না হচ্ছে, ততদিন বন্ধুদের বাড়ি বা গেরিলা অঞ্চলের বাইরে কোনও বন্ধুদের বাড়িতে বা ডাক্তার বন্ধুর নার্সিংহোমে রেখে চিকিৎসা চালাতে হয়। গেরিলা যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শল্য চিকিৎসকের, অস্থি বিশেষজ্ঞ ও অ্যানাসথেসিস্টের। গেরিলা 'ঘাঁটি' অঞ্চলে যতদূর সম্ভব আধুনিক সাজ-সরঞ্জাম থাকবে। বিভিন্ন গ্রুপের রক্তের স্টক ও অক্সিজেন অবশ্যই রাখতে হবে। আর মানসিকভাবে উদ্দীপ্ত করার মতো একজন মনোবিজ্ঞানী রাখতে পারলে সোনায় সোহাগা।
এ তো গেলো গেরিলা যুদ্ধের বিস্তারিত তথ্য। চারু মজুমদারের আটটি দলিলে এসব প্রয়োজনীয় বিষয় লেখা নেই। কোনও দিন গেরিলা যুদ্ধ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাও করেননি তিনি ও অন্যান্য কমরেডগণ। নকশালদের কেউই গেরিলা যুদ্ধ জানতেনও না। সাম্যকামীরা প্রথম গেরিলা যুদ্ধ করেন ২০০৫ সালে জেহানাবাদে বন্দিমুক্তির জন্য। তাও এই তথ্যের ভিত্তিতে। ভারতে যেসব জায়গায় গেরিলা যুদ্ধ হচ্ছে, এই পদ্ধতিতেই হচ্ছে। চে গেভারার গেরিলা যুদ্ধের তত্ত্ব অনেকদিন আগেই বাতিল হয়ে গেছে। এই যুদ্ধের পাশাপাশি চলে নির্মাণ। জমি বাজেয়াপ্ত করা। এই জমির দ্বারা 'যৌথ খামার' গড়ে ওঠে। এই জমির মালিক হয় স্থানীয় চাষিরা। চলে সমবায় পদ্ধতিতে। এইসব সমবায় ভিত্তিক চাষে ব্যবহার করা হচ্ছে উন্নত বীজ। নতুন নতুন শস্য ও সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে। অনেক ছোট ছোট সেচ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় বৃষ্টির জলকে ধরে রাখার পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে। জলবিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নতুন নতুন রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। এইসব সমবায় ও কমিউন চালাবার জন্য পার্টি কর্মীদের এক থেকে দু'মাসের প্রশিক্ষণ
দেওয়া হয়। সমবায় ভিত্তিতে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বস্ত্র তৈরি, মোমবাতি, সাবান, কাগজ, চামড়া তৈরির শিল্প ইত্যাদি গঠন করা ও উৎপাদন পরিচালনা চলে। এইসব কৃষি ও শিল্প দ্রব্যের ক্রেতা গণমুক্তিফৌজ ও গণকমিটি। গণমুক্তিফৌজ ও গণকমিটিতে রয়েছে স্থানীয় মানুষ-ই। খোলা হচ্ছে চিকিৎসাকেন্দ্র, শিক্ষাকেন্দ্র, অরণ্যরক্ষক সহ সম্পদ রক্ষক ইত্যাদি। এসব-ই সমবায় ভিত্তিতে গড়া হয়। কোনও ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ নেই। এইভাবেই গড়ে উঠেছে স্বয়ম্ভর গ্রাম। যাঁরা স্বয়ম্ভর গ্রাম চালাবে তাদের নির্বাচিত করেন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষরা। ঠিকমতো কাজ না করতে পারলে বা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা থাকে নির্বাচকদের হাতে। এই নির্মাণের কথাও চারু মজুমদারের আটটি দলিলের কোথাও নেই। এর সঙ্গে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার কোনও পথের দিশা তিনি দেখাননি। কারণ সাংস্কৃতিক বাহিনী হলো বিপ্লবের অগ্রবাহিনী। এসব-ই চারু মজুমদারের চিন্তার সীমাবদ্ধতা।

Comments