সরস্বতী ও শিক্ষা - সুকুমারী ভট্টাচার্য [পর্ব-এক]

 

দেশের জনসাধারণকে পুরোপুরি কুক্ষিগত করবার একটা দীর্ঘকালীন কর্মসূচী হলো শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছু গভীর ও ব্যাপক পরিবর্তন প্রবর্তন করা, যাতে পরবর্তী প্রজন্মগুলি কতগুলো ভ্রান্ত ধারণা আত্মসাৎ করে। এই ধারণাগুলি কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত সরকারের অনুকূলে বলে সরকার স্থায়িত্ব পেতে পারে এবং সাধারণ মানুষের মন চিন্তারহিত ও যান্ত্রিক হয়ে ওঠে, যাতে যন্ত্র সরকারেরই স্বার্থ সিদ্ধি করে চলে। এ ধরনের চেষ্টা নাৎসি জার্মানিতে, ফ্যাসিস্ত ইতালিতে করা হয়েছিল। গত কয়েক বছর ধরে ভারতবর্ষে এ চেষ্টা চলছে। মুশকিল দুটো। প্রথমত, দেশবাসীর খুব নগণ্য ভগ্নাংশ মাত্র শিক্ষিত, ফলে ঐ শিক্ষার প্রভাবে সরাসরিভাবে আক্রান্ত হবে সামান্য কিছু লোক। দ্বিতীয়ত একটা ইংরেজি কথা আছে। কিছু মানুষকে কিছুকালের জন্য ধোঁকা দেওয়া যায়, সব মানুষকে চিরকালের জন্য ধোঁকা দেওয়া যায় না। ফলে মানুষকে পুরোপুরি যন্ত্রে পরিণত করা যায় না বলেই কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ বরাবরই প্রশ্ন করবে, অস্বীকার করবে, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করবে। তবু চেষ্টার শেষ নেই। নতুন শিক্ষানীতি প্রবর্তনের জন্য বহু আয়োজন চলছে, নিজেদের খেয়ালখুশিতে পাঠ্যবই রচনা করা হচ্ছে। এখনো গণতন্ত্রের যেটুকু শক্তি অব্যাহত আছে তার ফলে 'শিব ঠাকুরের আপন দেশ' উত্তরপ্রদেশেই সেখানকার সরকারের আপত্তিতে নবম ও দশম শ্রেণীর চারটি পাঠ্যপুস্তক তুলে নেওয়া হয়েছে। কারণ, ন্যাশনাল স্টিয়ারিং কমিটি বলেছিল, এগুলিতে 'আপত্তিজনক বিষয়' অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এর মধ্যে দু'টি ইতিহাসের বই, দু'টি গণিতের। এন সি ই আর টি ১৯৯৬ সালে ৬০০০ স্কুল পরিদর্শন করে। এগুলিতে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ১২,০০,০০০ এবং শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ৪০,০০০। সমীক্ষার আপত্তির কারণ হলো, '(এই স্কুলগুলির পাঠ্যগ্রন্থ) তরুণ মনে জ্ঞান ও সংস্কৃতি সঞ্চার করার নামে সঙ্কীর্ণতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি সঞ্চারিত করার উদ্দেশ্যেই রচিত।' (...desinged to promote bigoty and religious fanaticism in the name of inculcating knowledge and culture in the young minds.) 'বিদ্যাভারতী' নামে সরকার স্বীকৃত যে বিদ্যালয়গুলি চলে সেগুলির জেনারেল সেক্রেটারি দীননাথ বাটরার হিসাব মতে, এ সংস্থার অধীনে ১৪,০০০ স্কুল নার্সারি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের। এগুলির ছাত্র সংখ্যা ১৮ লক্ষ, মিজোরাম ছাড়া অন্য প্রদেশগুলিতে এ স্কুলগুলির শিক্ষক সংখ্যা ৮০,০০০। এদের অধীনে ৬০টি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, এছাড়াও ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের ২৫টি অন্য শিক্ষায়তন। জয়পুর ও আহমদনগরে দু'টি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অনুমোদিত ৫০০০ প্রতিষ্ঠান, বাকি ৫০০০ অনুমোদন পায়নি। এগুলির অধিকাংশই বি জে পি শাসিত রাজ্যে। এসব বিদ্যালয়ে সাধারণ পাঠ্যবই ছাড়াও একটি 'বীজ পাঠ' (core curriculum) অবশ্যপাঠ্য - এর মধ্যে আছে ব্যায়াম, যোগ, সঙ্গীত, সংস্কৃত, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা, সংস্কৃতি জ্ঞান। এর মধ্যে ব্যায়াম ও যোগ স্বাস্থ্যকর, বাকিগুলি সম্বন্ধে নানা সংশয়, পরে আলোচনা করছি। 'সংস্কৃতি জ্ঞান' ও 'সংস্কৃতি জ্ঞান প্রশ্নোত্তরী' নিরীক্ষা করে এন সি ই আর টি অভিমত দিয়েছেন - এতে তথ্য বিকৃতি আছে। এতে আছে ১৫২৮ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে বাবরি মসজিদের স্থানে অবস্থিত রাম মন্দির ৭৭ বার আক্রান্ত হয়েছে। সাড়ে তিন লক্ষ হিন্দু ভক্ত প্রাণ দিয়েছে মন্দির রক্ষার জন্য। এর সবটাই গাঁজাখুরি, তা সকলেরই এমনকী লেখকেরও অজানা নয়। আরও আছে - ১৯৯০ সালের ২ নভেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙার অভিযান পুলিস ব্যর্থ করে, ঐ দিনটি তাই 'কালো দিন'। ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৯২ 'উজ্জ্বল দিন' নিশ্চয়ই? নতুন চমকপ্রদ খবরও আছে: ভারত ভাগ হয়েছিল খ্রীশ্চানদের ষড়যন্ত্রে। এই সবই ছাত্রদের মুখস্থ করতে হয়। ক্রমে তাদের মন এ ধরনের ভ্রান্ত বিশ্বাসে লালিত হয়ে, সত্য ও তথ্য থেকে দূরে সরে যায়। সারা দেশে বিদ্যাভারতীর পাঠক্রম একই। যদিও স্কুলগুলির ভিন্ন ভিন্ন নাম, অঞ্চলের পরিবেশ অনুযায়ী। গোলওয়ালকর ১৯৪৬ সালে কুরুক্ষেত্রে 'গীতা সিনিয়র স্কুল' স্থাপন করেন; ইচ্ছে ছিল, ঐরকম আরও স্কুল করার, কিন্তু '৪৮ সালে গান্ধী হত্যার পর রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ বেআইনি হয়ে যাওয়ায় সেগুলো আর হয়ে উঠলো না।

১৯৫৬ সালে গোরখপুরে 'সরস্বতী বিদ্যামন্দির' স্থাপিত হয়, পরে ক্রমান্বয়ে ইতস্তত নানা অঞ্চলে এই ধরনের স্কুল চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়ে উঠতে থাকে, বেশির ভাগই অনুন্নত অঞ্চলে ও জনগোষ্ঠী প্রধান এলাকায়। এই স্কুলগুলিই হিন্দুত্ব শিক্ষার খাঁটি। 'কালচার অ্যান্ড সিভিলাইজেশন অব দ্য মোগল পিরিয়ড' নামক পাঠ্যগ্রন্থ থেকে বাবরের উদারনীতির ওপরে একটি পুরো পরিচ্ছেদ ছেঁটে দিয়েছে সঙ্ঘ। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের বই 'Vision of Action' বলে যে, খ্রীষ্টানরা এই সব পশ্চাৎপদ ও জনগোষ্ঠী প্রধান এলাকায় বেশি সক্রিয়, তাই এসব অঞ্চলেই সঙ্ঘের ঘাঁটি হওয়া দরকার। খ্রীষ্টান, মুসলিম ও কম্যুনিস্ট - সঙ্ঘ পরিবারের এই তিনটিই প্রধান শত্রু। কাজেই এই ত্রিপুরদহনের উদ্যোগ এদের সমস্ত ক্রিয়াকলাপে সুনিয়ন্ত্রিত। তাই কমিউনিস্ট প্রধান কেরলের কালেক্কাডুতে প্রথমে ১০ হেক্টর জমিতে ও ক্রমে ক্রমে ১৭৪ হেক্টর জমিতে ১২০টি 'সরস্বতী শিশু বিদ্যালয়' স্থাপিত হয়। এগুলিতে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। বাকিগুলো 'ভারতীয় বিদ্যানিকেতন', সেগুলিতে সপ্তম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। কেরলের চারটি জেলায় ৭টি স্কুল। যেহেতু এসব অঞ্চলে খ্রীস্টান ও মুসলমানরাই সংখ্যায় বেশি তাই এ স্কুলগুলিতে ইংরেজি মাধ্যমে CBSE পাঠ্যক্রমই পড়ানো হয়, বাকিগুলোতে মালয়ালম মাধ্যমে রাজ্যের নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম অনুসরণে এগুলিতে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। এসব স্কুলের শতকরা নব্বই জন শিক্ষিকাকেই পাঁচ মাস ধরে একটা পাঠ নিতে হয়: ভারতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং 'হিন্দু শিক্ষাপ্রণালী'তে। এসব স্কুলে ক্লাস শুরু হয় সরস্বতী বন্দনা দিয়ে। আগে যে 'বীজ পাঠ'-এর কথা বলা হয়েছে তার প্রয়োগের জন্যে এসব শিক্ষায় কোন ছাত্র কতটা এগোল তার দৈনিক হিসাব স্কুলে রাখা হয়। স্কুলগুলি রাজ্য সরকার দ্বারা অনুমোদিত নয়, এখানকার ছাত্ররা রাজ্য পরিচালিত স্কুলে বা CBSE'র স্কুলে প্রাইভেট ছাত্র হিসাবে পরীক্ষা দেয়। বিদ্যানিকেতনের মোট ১৩০০ শিক্ষিকার প্রায় সকলেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সদস্যা। তামিলনাডুতে সরাসরি 'বিদ্যাভারতী' স্কুল কমই আছে। সেখানে বেশিরভাগ স্কুলই স্বয়ম্ভর (Autonomous) অস্থির (Trust) অধীন; আর আছে 'তামিল কলবি কাজাগম' বা 'বিবেকানন্দ বিদ্যালয়'। কোথাও কোথাও অঞ্চলের প্রধান জাতি স্কুল তৈরি করে। দ্রাবিড় প্রভাবে কোনো কোনো অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের শক্তি দুর্বল, না হলে হিন্দু দেবমূর্তি ও পূজা পদ্ধতি পুরোপুরিই আছে। লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গণেশের মূর্তি বহু স্কুলে দেখা যায়; এগুলির পূজাও হয়। স্কুলে ধর্মীয় বা ধর্মগন্ধী উৎসবই প্রধান - কৃষ্ণজয়ন্তী, বিনায়ক চতুর্থী, দীপাবলী, পোঙ্গল ও শিবাজি জন্মোৎসব এর মধ্যে প্রধান। অন্যান্য স্কুলে রাধাকৃষ্ণনের জন্মতিথি ৫ই সেপ্টেম্বরে শিশু দিবস পালিত হয়, এসব স্কুলে হয় কৃষ্ণ জয়ন্তীতে। তামিল ভাষায় রচিত 'গুরু' গোলওয়ালকারের জীবনী সপ্তম শ্রেণীতে অবশ্য পাঠ্য। এধরনের স্কুলগুলির ওপরে কর্তৃত্ব করে কন্যাকুমারিকার 'বিবেকানন্দ কেন্দ্র', সেখানে শিক্ষকদের জন্যে 'শিশু বাটিকা ক্যাম্প' হয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের উৎসাহের কেন্দ্রস্থল হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি, যেখানে অপরিণত মনের শিশুরা আসে, তখনই হিন্দুত্বে দীক্ষা দেবার মাহেন্দ্র লগ্ন। এবং এ কাজটি সঙ্ঘ সর্বপ্রয়াসে করে থাকে। ওড়িশা শহরে ও আধা শহরে সঙ্ঘ বহু 'সরস্বতী শিশুমন্দির' স্থাপন করেছে, এগুলিতে ছাত্রদের মাইনে নামমাত্র, শিক্ষার মান অপেক্ষাকৃত উন্নত। স্কুলের শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের মা-বাবার কাছে মাসে অন্তত একবার যান। ওড়িশার স্কুলগুলিতে রাজ্য সরকারের পাঠক্রম মেনে চলতে হয়, ফলে সঙ্ঘনীতির অনুপ্রবেশের অবকাশ কম, তাই এদের পত্রিকা 'রাষ্ট্রদীপ' ডাকযোগে সব মা-বাবার কাছে যায়। ১৯৬৯ সালেই সঙ্ঘ 'ভারতীয় শিক্ষণ মণ্ডল' নামে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করে প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত নৈতিক শিক্ষার পাঠক্রম প্রণয়ন করে রাজ্য সরকারের অনুমোদন পাবার চেষ্টা করেছিল। পায়নি। ১৯৭৭-এ যখন জনতা পার্টি ক্ষমতা পেলো তখন শিক্ষামন্ত্রী সমাবেশে সরকার অনুমোদন পাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, পায়নি, তাই এ শিক্ষাক্রম ওদের নিজেদের স্কুলের মধ্যেই নিবদ্ধ রইলো। তখন তৈরি হলো 'বিদ্যাভারতী'গুলি, যেগুলি পাঠক্রমের তদারক করে ও সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে। ছাত্রপাঠ্য নিরূপণে 'কল্প' নামে নতুন একটি প্রণালী চালু আছে সঙ্ঘ পরিবারের পরিচালিত স্কুলগুলিতে। যার ফলে বাধ্যতামূলক অনুষ্ঠান হিসেবে উদযাপিত হয় রক্ষাবন্ধন, গুরুদক্ষিণা, রামনবমী, দশেরা এবং হেগড়েওয়ার ও শ্যামাপ্রসাদের জন্ম ও মৃত্যু তিথি। এসব স্কুলে দিনের পাঠ আরম্ভের আগেই 'বন্দে মাতরম্' এবং সরস্বতী বন্দনা হয়, পরে সরস্বতী মূর্তিকে প্রণাম করা আবশ্যিক। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো কোনো স্কুলে এসবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ হতে সেগুলিতে আর এসব আবশ্যিক রইলো না।

রাজস্থানে স্কুলপাঠ্য ভূগোলের মানচিত্রে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, তিব্বত এবং ব্রহ্মদেশের কিছু অংশ ভারতবর্ষের অন্তর্গত হিসেবে দেখানো হয়েছে, এদেশের নাম 'পুণ্যভূমি ভারত'। রাজস্থানের ইতিহাসের পাঠ্যগ্রন্থে বলা হয়েছে ইরানের প্রথম অধিবাসীরা ভারতীয় ছিল, বলা হয়েছে চীনদেশে সভ্যতার প্রথম দীপ জ্বালায় ভারতবর্ষ। এদের পাঠ্যগ্রন্থের, প্রশ্নোত্তরীতে আছে 'রাম জন্মভূমিতে প্রথম কোন মুসলিম লুঠ করে।' 'এখানে কতবার লুণ্ঠন হয়েছিল?' উত্তর: ৭৭ বার। ২২-২৩ অক্টোবরের সমাবেশে এখানে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর প্রস্তাব ছিল স্নাতক স্তর পর্যন্ত সংস্কৃত অবশ্যপাঠ্য করতে হবে। সর্বস্তরে বিদ্যাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী বন্দনা অবশ্য করণীয় হবে - ধর্মবিশ্বাস ও সম্প্রদায় ভেদ নির্বিচারে।

প্রথমত, স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত সংস্কৃত অবশ্যপাঠ্য হওয়ার অর্থ বিজ্ঞান, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ের ছাত্রকে সংস্কৃত পড়তে হবে। কেন? হিন্দু সংস্কৃতি জানবার জন্যে। এটা কী তা নিয়ে মতভেদের প্রচুর অবকাশ আছে, এটা জানা অত্যাবশ্যক কিনা সে নিয়েও। তাছাড়া তার জন্যে সংস্কৃত পড়তে হবে কেন? মাতৃভাষাতেও পড়া যায়। সরস্বতী হিন্দু দেবী। কিন্তু হিন্দুর উপাস্য (সব হিন্দু মূর্তি উপাসনায় বিশ্বাসী নয়) মুসলমান, খ্রীস্টান, শিখ, বৌদ্ধের কাছে সরস্বতী হয় বিমূর্ত কল্পনামাত্র নয় মাটি, পাথর বা ধাতুর পুতুলমাত্র। তাছাড়া এইসব ধর্মে মূর্তি উপাসনা নিষিদ্ধ, সেক্ষেত্রে সরস্বতী বন্দনা তাদের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া, বর্বর জুলুম। গণতান্ত্রিক সংবিধানে প্রত্যেক ভারতবাসীর অধিকার আছে আপন মত বা বিশ্বাস অনুসারে জীবনযাপন করবার, অতএব এ জুলুম সংবিধানে স্বীকৃত স্বাধীনতা অপহরণের চেষ্টা এবং সর্বতোভাবে বেআইনি। 

এছাড়া প্রস্তাব আছে, যেসব স্কুল দশ বছর বা তার বেশি চলছে সেগুলি আপনাআপনিই সরকারি অনুমোদন পাবে। এখানে উল্লেখ্য যে, তাহলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বহু বিদ্যালয় এভাবে অনুমোদন পেয়ে যাবে। প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে হিন্দু সংস্কৃতির শিক্ষা দিতে হবে; আবার প্রশ্ন ওঠে, হিন্দু সংস্কৃতিই বিশেষভাবে কেন শেখানো হবে ভারতবর্ষের ভাবী নাগরিককে? তাকে তো জানতে হবে একটি সংমিশ্র সংস্কৃতিকে যার সংমিশ্রণে নিহিত আছে তার গৌরব এবং ঐশ্বর্য। ছাত্রীদের পাঠ্যসূচীতে গৃহকর্মে শিক্ষা একটি আবশ্যিক বিষয় হবে। কেন? সে ভাবী গৃহিণী বলে। ভাবী গৃহকর্তার শিক্ষণীয় কিছু নেই? বর্তমান শতকে গৃহকর্ম শুধু নারী শিক্ষণীয় বা করণীয় হবে কেন? বামপন্থীরা, কংগ্রেস, টি ডি পি, আর জে ডি ও আকালীরা এতে আপত্তি করেন এবং এগুলির মধ্যে অনেকগুলিই বিজেপির সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তির অংশভাক্। এমনকী অটলবিহারী বাজপেয়ীও শিক্ষার এই গৈরিকীকরণে সম্মত ছিলেন না। অন্ধ্রের শিক্ষামন্ত্রী শ্রীমতী প্রতিভা ভারতী 'জনগণমনে'র বদলে সরস্বতী বন্দনা স্থান দিতে আপত্তি করেন। এই ধর্মীয় জুলুমবাজির প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, ত্রিপুরা শুধু নয়; অন্ধ্র, মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ইত্যাদি বিভিন্ন প্রদেশের মোট পনেরোটি রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীরা সরব প্রতিবাদে সভা ছেড়ে চলে যান। ফলে ওদের প্রস্তাবের বেশি বিষাক্ত অংশগুলি আলোচিত হবে না, কেবলমাত্র প্রথম কুড়িটি ধারা আলোচিত হবে এমন আশ্বাস দিয়ে আদভানি আপস করতে চান। ২১ থেকে বাকি ধারাগুলি উপস্থাপনের ভার ছিল কলকাতার এক ব্যবসায়ী আর ডি চিৎলাঙ্গিয়ার উপর, যাঁর সঙ্গে সঙ্ঘের ঘনিষ্ঠতা সুবিদিত। যে প্রস্তাবগুলি বাতিল হয়ে যায় তার মধ্যে হলো, শিক্ষার সব স্তরে শিক্ষা বিষয়ের শতকরা দশ থেকে পঁচিশ শতাংশ হবে ভারতীয় সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ বিষয়ে শিক্ষা: তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সংস্কৃত অবশ্য পাঠ্য। সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন; সব স্কুলের সর্বস্তরে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা আবশ্যিক করা। উচ্চ শিক্ষার সকল পাঠক্রমে ও প্রতিষ্ঠানে ভারতীয় দর্শন পাঠ আবশ্যিক। সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ স্তরে শিক্ষা হবে 'ভারতীয়, জাতীয় এবং আধ্যাত্মিক'। কারিগরি বিদ্যাসমেত সকল পাঠক্রমে ভারতীয় সংস্কৃতির পাঠ দিতে হবে। এগুলি যে শিক্ষার মান উন্নয়নে, নাগরিকের চেতনা বিস্তারে কিছুমাত্র সহায়তা করবে না তা সহজেই বোঝা যায়। উপরন্তু অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরও সংস্কৃতিবোধ, নিজস্ব দর্শন, প্রস্থান, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা সম্বন্ধে স্বতন্ত্র বোধ আছে যা ব্রাহ্মণ্যতার থেকে পৃথক - এ ব্যাপারটা সম্বন্ধে এসব প্রস্তাবকরা আদৌ অবহিত নন। এ কোন ধরনের সংকীর্ণ আত্মকেন্দ্রিক নাগরিক গড়তে উদ্যত এরা?

আই সি এইচ আর এবং আই সি এস এস আর, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান গবেষণায় ভারতের সর্বোচ্চ মানের দুটি প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত পণ্ডিত-গবেষকদের সরিয়ে অখ্যাত ও অল্প পরিচিত 'গবেষক' এনে বসানো হচ্ছে। এঁদের একমাত্র করণীয় হলো, শিক্ষা ও গবেষণার মান নামিয়ে এনে প্রতিষ্ঠান দুটিকে হিন্দুত্ব-ধর্ম-বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত করা। এইসব নবাগতরা আসছেন প্রধানত উত্তরপ্রদেশ ও গুজরাট থেকে, এঁদের বিশেষ যোগ্যতা হলো রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। উত্তরপ্রদেশে সঙ্ঘ পরিচালিত বহু শিশুমন্দির, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দূর-দূরান্তের গ্রামেও। গুজরাটেও এ ধরনের স্কুল চালু আছে অনেক জায়গায়। গুজরাট সরকারের একটি বিজ্ঞপ্তি ২৮/৮/৯৮ তারিখের (Gr No. UMS 1295/emr/63/g-1) তপশিলি জাতি ও গোষ্ঠীর ছাত্রছাত্রীর স্কুলে প্রবেশের জন্যে যে সংরক্ষণ বিধান ছিল তা সম্পূর্ণ নাকচ করে দিয়েছে, প্রত্যেক স্কুলকে ছাত্রছাত্রীদের মাইনে ঠিক করবার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। ছাত্রীদের শিক্ষা যেখানে অবৈতনিক ছিল সেখানে স্কুলগুলিকে অধিকার দেওয়া হয়েছে ইচ্ছামত তাদের বেতন ধার্য করবার ("Each school is free to charge fees for girl students")। বলা বাহুল্য, বাড়ির মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা হলেও অধিকাংশ পরিবারই স্কুলে পাঠাতো না, বেতন দিতে হলে তো একেবারেই পাঠাবে না। আর তপশিলি জাতি ও গোষ্ঠীর শিক্ষার সুযোগ একেবারেই ছিল না, সংরক্ষণে কিছু সম্ভাবনা ছিল তাদের লেখাপড়া শেখার, সংরক্ষণ তুলে দিলে সে সম্ভাবনাও ক্ষীণতর হয়ে গেলো। শিক্ষক নিয়োগের জন্যে শিক্ষা বিভাগ থেকে 'আপত্তি নেই' এই মর্মে একটি চিঠি দরকার হতো এতদিন, এই বিজ্ঞপ্তিতে সেটি তুলে দেওয়া হলো। ফলে অনুন্নত মানের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও সঙ্ঘ পরিবারের লোকেরা শিক্ষক হয়ে আসছে, এতে ছাত্রছাত্রীদের সমূহ ক্ষতি হতে চলেছে। স্বজন-পোষণের মতই এ দুর্নীতি এবং এর প্রভাব সুদূর বিস্তৃত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। বিভাগীয় আয়-ব্যয় তদন্ত (audit) উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, ফলে শিক্ষকরা যে বেতন পান তার চেয়ে বেশি অঙ্কে সই করতে হচ্ছে, এও দুর্নীতির আর একটি ক্ষেত্র। শিক্ষা পুরোপুরি বাণিজ্য হয়ে উঠলো এবং সমাজের নিম্ন বর্ণের মানুষের বঞ্চনা কায়েম হলো।

১৪ই নভেম্বরের স্টেটসম্যানের সংবাদে প্রকাশ সিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ-এ রাধাকৃষ্ণন স্মারক বক্তৃতা দেবার জন্যে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেনকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল, তিনি সে আমন্ত্রণ গ্রহণও করেছিলেন। সহসা কর্তৃপক্ষের মত পরিবর্তন হলো, বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত বক্তার পরিবর্তে বক্তৃতাটি দিতে বলা হলো মুরলীমনোহর জোশীকে, সঙ্ঘ সমর্থিত সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হওয়া ছাড়া সারস্বত জগতে যাঁর আর কোনো পরিচয় নেই; ভারতবর্ষের বাইরে যাঁর নামও 'বিজ্ঞানী' হিসেবে কেউ জানে না। এই বক্তৃতা আগে দিয়েছেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কে এন রাজ, বিখ্যাত দার্শনিক সাইমন ব্ল‍্যাকবার্ন, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীকের অধ্যাপক রিচার্ড সেরাবজি, খ্যাতনামা বিজ্ঞানী এম জি কে মেনন, এঁরা। অর্থাৎ বক্তৃতাটি বিশেষজ্ঞতার সঙ্গে এতকাল বিজড়িত ছিল। এবার তার জাত গেলো। সিমলার ঐ প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান পরিচালক জি সি পাণ্ডের সঙ্ঘের সঙ্গে সম্পর্ক সুবিদিত। সংস্থার বর্তমান ক্রিয়াকলাপও তাই প্রমাণ করে।

এই ধারায় বিদ্যাচর্চার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান ইতিহাসের। ভবিষ্যৎ হিন্দুরাষ্ট্র গড়বার নিরিখ তৈরি করবার জন্যে হিন্দুর গৌরবোজ্জ্বল অতীত দরকার; ইতিহাস যেখানে ভিন্ন রকম সাক্ষ্য দেয় সেখানে ইতিহাসকেই ঢেলে সাজাতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের সেই নির্জলা মিথ্যা গলাধঃকরণ করতে হবে, তবেই তারা সে মিথ্যার ভিত্তিতে সরকার অভিপ্রেত কর্মকাণ্ডে আশানুরূপ ভূমিকা পালন করবে। তাই বিজেপি চালিত স্কুলগুলির ইতিহাস পাঠ্যগ্রন্থে লেখা হয় বাবরি মসজিদের নিচে রাম মন্দির ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন ভিন্ন সাক্ষ্য দেয়। ১৯৬৯-৮০ প্রত্ন উৎখননেও পণ্ডিতেরা রাম মন্দিরের চিহ্নমাত্র খুঁজে পাননি, বরং বাবরি মসজিদ নির্মাণের আগের চারশ বছরে ঐখানে মুসলিম বসবাসের চিহ্নই পেয়েছেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের স্বনিযুক্ত ঐতিহাসিক যিনি মসজিদ ভাঙার সময়ে করসেবক ছিলেন, তিনি দাবি করেন যে ভাঙার পরে পাঁচটি ক্যামেরায় মসজিদের ভগ্নস্তূপে বিস্তর হিন্দু শিল্পের অবশিষ্টাংশ পেয়েছেন। ক্যামেরাগুলো থেকে সম্পূর্ণ ফাঁকা ফিল্মই বেরিয়েছিল। তখন তিনি বলেন ঐ খণ্ডগুলো 'রামকথাকুঞ্জে' আছে, সেখানে যা প্রাচীন হিন্দু প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে সেগুলি সবই মসজিদ ধ্বংসর বহু আগেকার। তাই অত বড় ধ্বংসকার্যের কোনো আঁচড়ও কোনোটিতে দেখা যায়নি। ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক বিখ্যাত এ কে নারায়ণ ও বি বি লাল বলেন, মসজিদের নিচে কোনো হিন্দু প্রত্নবস্তু তো পাওয়া যায়ইনি, বরং ১১শ শতক থেকে ১৫শ শতক পর্যন্ত কালের বহু মুসলিম গৃহস্থালীর চিহ্ন পাওয়া গেছে। তার থেকে বোঝা যায়, মসজিদ নির্মাণের চারশ বছর আগে থেকেই ঐ অঞ্চলে ক্রমাগত মুসলিম বসবাস ছিল। তথাপি বিজেপি স্কুলের পাঠ্যগ্রন্থে ওখানে রাম মন্দিরের কথাই লেখা থাকছে। ছাত্ররা পড়ছে, মনে রাখছে এবং ভুল শিখছে। অন্তত একটা গোটা প্রজন্মকে এই মিথ্যার মধ্যে লালন করা হচ্ছে। ঐতিহাসিক সত্যের জায়গা নিয়েছে হিন্দুত্বের অনুকূলে মিথ্যা।



Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]