ওসমানীয়দের স্বরূপ [পর্ব-তিন]
ওসমানীয় সুলতানরা যুদ্ধে জিতে ফিরে আসার সময় তাদের রাজধানীর রাস্তাগুলো যুদ্ধে মৃত অমুসলিমদের কাটা মাথা দিয়ে সাজানো হতো।
এই সাম্রাজ্যের নিয়ম ছিল স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোনো নারী বাজারের কোনো দোকান থেকে ধার করতে পারতো না।
তাদের সময়ে মুসলিম ডাকাতরা অমুসলিম ধর্মযাজকদের একা পেলে ধর্ষণ করতো।
ঐসময় ভেনিসের টাকশালে ভেজাল মিশ্রিত স্বর্ণমুদ্রা তৈরি করে ২২ ক্যারেট এর ওসমানীয় স্বর্ণমুদ্রা হিসেবে চালানো হতো ওসমানীয় সাম্রাজ্যে, পরে যা ধরা পরে। কম সোনা আর বেশি তামা দিয়ে বানানো এসব ভেজাল মুদ্রা তুলনামূলকভাবে শক্ত হতো। এজন্য ২২ ক্যারেটের মুদ্রা চিনতে দাঁত দিয়ে কামড়ে পরীক্ষা করা হতো।
ওসমানীয়দের সময়ে মুসলিমরা মনে করতো কফি পানের ফলে চোখের দৃষ্টিশক্তি এবং পাকস্থলীর ক্ষতি হয়, বুদ্ধিভ্রষ্ট হয় এবং মানুষ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তাদের মতে ফরাসী দেশের এই বিষ মুহাম্মদ (স:) প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যদিও এক সুন্দরী নারীর রূপ ধরে স্বয়ং শয়তান এসে তাঁকে কফি খেতে অনুরোধ করেছিল।
তাদের সময়ে মুসলমানরা মনে করতো ইউরোপের নারীদের বাহু, গলা এবং সুগঠিত পায়ের একটা অংশও উন্মুক্ত থাকে দেখে ওদের শহরগুলোতে পুরুষদের বাইরে হাঁটা চলা করা মুশকিল ছিল। ওদের পুরুষদের অনেক অস্বস্তি এবং যন্ত্রণা পেতে হতো, কারণ নারীদের এমনভাবে চলাফেরার জন্য তাদের সামনের দিকের উপাঙ্গটি সবসময় দৃঢ় অবস্থায় থাকতো। ওসমানীয়রা আরও ভাবতো এইভাবে তাদের পুরো সমাজ পঙ্গু হয়ে যায়। ফরাসিরা যে ওসমানীয়দের কাছে একটার পর একটা দুর্গ সমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল, এটাই তার কারণ ছিল বলে মুসলিমরা ধরে নিতো।
সুলতান মাহমুদ সমস্ত রকমের শিল্পকলার বিরোধী ছিলেন।
সুলতানের সিংহাসনে বসার তৃতীয় বৎসরে ইংল্যান্ডের রানী তাকে একটা মজাদার ঘড়ি উপহার পাঠিয়ে দেন। ঘড়ির মধ্যে ছিল একটা বাদ্যযন্ত্র এবং অনেকগুলো জানালা। ইংরেজদের একটা দল এসে কয়েক সপ্তাহ পরিশ্রম করে বিশাল ঘড়িটার টুকরো, যন্ত্রপাতি এবং ছবিগুলোকে জুড়লো। তারপর সুলতানের নিজস্ব বাগানের একটা ঢালু জমির চূড়ায় গোল্ডেন হর্ণের দিকে মুখ করে ঘড়িটাকে বসালো। লোকেরা ঢালু জমিতে ভিড় জমাতো, ডিঙিতে চড়ে গোল্ডেন হর্ণের ওপর ভেসে থাকতো ঘড়িটাকে দেখবে বলে। ওরা দেখতো কেমন করে প্রমাণ সাইজের পুতুলগুলো গয়না পরে বিশাল ঘড়ির ঝাঁঝালো, কান ফাটানো অথচ সুরেলা ঘণ্টার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচছে। ঘড়িটা বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনির মাধ্যমে সারা ইস্তাম্বুলে সময় ঘোষণা করতো; দূর থেকে শোনাতো যেন সুরেলা কোনো ঘণ্টার শব্দ। ইস্তাম্বুলের মানুষদের কাছে ঘড়িটা একটা আশ্চর্য যন্ত্র হলেও উগ্র মুসলিমদের এবং সুলতানের জন্য সেটা বড় অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। কারণ, ঘড়িটা ছিল 'বিধর্মীদের' শক্তি এবং বুদ্ধির প্রতীক। একসময় যখন এসব গুজব ক্রমেই বাড়তে লাগলো, সুলতান মাহমুদ একদিন মাঝরাতে তার মুগুর নিয়ে হারেম থেকে নেমে সোজা গেলেন বাগানে। মুগুর দিয়ে ঘড়ি আর পুতুলগুলোকে ভেঙে চুরমার করে দিলেন। এই ঘটনার পর সুলতান নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েন। তারপর স্বপ্নে পয়গম্বর মুহাম্মদের আলোকিত মুখ দেখতে পান। মিথ অনুযায়ী ঈশ্বরের দূত তাকে সাবধান করে দিয়ে বলেন যে, সুলতান যদি তাঁর প্রজাদের ছবি, মানুষের অনুকরণে তৈরি মূর্তি ইত্যাদিকে আল্লাহর সৃষ্টির প্রতিচ্ছবি বলে দেখার অনুমতি দেন তাহলে তিনি ঈশ্বরের পথ থেকে বিচ্যুত হবেন। সুলতান যখন তার মুগুর হাতে তোলেন তখনও তিনি স্বপ্নের ঘোরে ছিলেন। তিনি হস্তলিপিকারদের দিয়ে 'ইতিহাসের সারকথা' বইটি লিখিয়েছিলেন এবং থলি ভরে সোনার মুদ্রা উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু অনুচিত্রশিল্পীদের দিয়ে অলঙ্করণ নিষিদ্ধ ছিল। তার সময়ে পারস্যে লালিত অলঙ্করণ এবং চিত্রশিল্পের শত শত বৎসরের পুরোনো ঐতিহ্য শুকিয়ে গেলো। শিল্পীদের অঙ্কন পদ্ধতি এবং ফরাসি পদ্ধতি নিয়ে বিবাদ তখনকার শিল্পীদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া এবং তুমুল বিশৃঙ্খলার পথ খুলে দিলো। আর সেই বিবাদের কোনো মীমাংসা সম্ভব হয়নি। কারণ, চিত্রকলা বিষযটাই পরিত্যক্ত বিষয় বলে গণ্য করা হলো। শিল্পীরা না তো প্রাচ্যের থাকলো, না পাশ্চাত্যের। অনুচিত্রশিল্পীরা রাগও করতে পারলো না, বিদ্রোহ তো দূরের কথা। বৃদ্ধরা যেমন শান্তভাবে অসুখের কাছে আত্মসমর্পণ করে তেমনি নতমস্তকে, দুঃখে, হতাশায় ওরাও অবস্থাটাকে মেনে নিলো। হেরাট হোক বা তাব্রিজ, প্রাচীন শিল্পীদের মহান সৃষ্টির প্রতি তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না।
...................................................................................
সেলিম সিংহাসনে আরোহণের পরের সময়টাকে বেছে নিলেন আনন্দ, উল্লাস আর পশুশালার বিস্তার ঘটাবার জন্য। বোবা, কালাদের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। উজির ও অন্যান্য সভাসদদের থেকে এই মানুষদের সঙ্গ বেশি পছন্দ করতেন তিনি।
সেলিম একজন ধনুর্বিদ এবং কবি ছিলেন। বেয়াল্লিশ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন। ভাই বায়েজিদকে ইরানে হত্যা করা হয়। ইচ্ছামতো পান মদ করতেন আর সুন্দরী নারীদের সাথে বিছানায় যেতেন। শখ মেটাতে অমূল্য সব পাথর পরিধান করতেন, শরীরে সুগন্ধি মাখতেন। চোখে মাঝে মাঝে সুরমা দিতেন।
তার পত্নীদের গর্ভে অনেক সন্তান জন্মেছে। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে গেল নুর বানু। মা নাম রেখেছিল সিসিলিয়া। বারো বছর বয়সে তাকে প্রাসাদে ধরে নিয়ে আসা হয়েছিল। নুর কখনও তার পরিবার-পরিজনদের চিঠি লেখায় ক্ষান্ত দেয়নি। কফু এবং ভেনিসে নিয়মিত পত্র প্রেরণ করতো। উত্তরে মাঝে মাঝে তাকে মূল্যবান সামগ্রী পাঠানো হতো। সেলিমের মতো সে-ও বিলাস ব্যসনে সময় কাটাতো। ভেনিস থেকে তার জন্য দুটো ছোট ছোট কুকুর এসেছিল। খাবার খাওয়ানোর সময় ভৃত্য দিয়ে সেগুলো পরীক্ষা করানো হতো কেউ বিষ দিয়েছে কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
রাতের বেলা খাবারের পর পশুশালায় কর্মচারীরা গল্প করতে বসতো। সুলেমানের সময় আড্ডা দেয়া যেত না, যেই নিয়ম সেলিমের সময় পরিবর্তন করা হয়।
আবহাওয়া ঠিক থাকলে সেলিম সভাসদদের নিয়ে নৌ ভ্রমণে যেতেন। মিষ্টি লজেন্স চুষতে চুষতে আড্ডা দিতেন।
উলামারা তার হাবভাব পছন্দ করতো না। জেনিসারিরা তার ওপর রুষ্ট ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনী পরিচালনা করার ক্ষমতা সেলিমের ছিল না। লোকজন তাকে সুলতান সুলেমানের সাথে তুলনা করে গালমন্দ করতো। হুররমের আত্মাকে অভিশাপ দিতো তারা। সেলিম তাদের কিছু বলতেন না। উপহার ও পুরস্কার দিতেন যাতে ওরা মুখ বন্ধ করে রাখে।
সভাসদদের মধ্যে ছিল কবি, চারণকবি এবং সঙ্গীতজ্ঞ। এদের মধ্যে একজন নারী কবি ছিলেন হুব্বি হাতুন নামে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Hubbi_Hatun
ঘণ্টার পর ঘণ্টা চোখ বন্ধ করে সে কবিতা আবৃত্তি করে যেতে পারতো। আরও কিছু কবি ছিল যারা নানা ভাষায় কবিতা আবৃত্তি করতো।
সেলিম সিংহাসনে আরোহণের পর ইস্তানবুলের মানুষ তাকে তেমন আপন করে নেয়নি। তিনি যখনই সুযোগ পেতেন, চলে যেতেন আড্রিয়ানোপল এ। ছোটবেলা থেকে বেশ কিছু সময় সেখানে কাটিয়েছেন তিনি। ইচ্ছেমতো খাওয়া, পান করা কিংবা সময় কাটানো যেতো ঐখানে। সেখানকার মানুষগুলোও তাকে বাঁকা চোখে দেখেনি। সিংহাসনে বসার কিছুদিন পর তিনি ঠিক করলেন ইস্তানবুলের মানুষের জন্য মসজিদ নির্মাণ করবেন। নির্দেশ দেয়ার পরপরই আবার কানকথা শুরু হয়ে যায়। সুলতান সুলেমানের মতো তার ছেলে ইস্তানবুলের মানুষের এতটা কাছে যেতে পারেনি। বাবার মতো সেনাবাহিনীর ওপর প্রভাবও নেই তার। ইস্তানবুলে মসজিদ বানানোর জন্য তাই তার জন্য উপযুক্ত শহর হবে না, তা তো বলাই বাহুল্য। সিনান ও তার চার শিষ্য সেলিমীয়া মসজিদের ভিত স্থাপন করলেন। সুলতান বহুমূল্যের আলখাল্লা ও রত্ন উপহার দিলেন স্থপতিকে।
সেলিম রটালেন মসজিদ তৈরির নির্দেশ তিনি নাকি স্বপ্নে পেয়েছেন। নবী নাকি তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন। তিনি নাকি নবীর চেহারা দেখতে পাননি, তবে গন্ধ এবং উপস্থিতিতেই বোঝা হয়ে গিয়েছিল ইনি বিশ্বনবী না হয়েই যান না। সেলিম নাকি নবীকে ওয়াদা করেছিলেন সাইপ্রাসের ভূখণ্ড জয় করবার পর সেখানে শুক্রবারের নামাজ আদায় করার জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করা হবে। এরপর ফেরেশতারা নাকি সুলতান সেলিমকে মসজিদের নকশা দিয়ে যায়।
পরেরদিন সকালে সুলতান প্রধান উজির সোকোলুকে ডাকলেন। সন্ধ্যার মধ্যে সবাই জেনে গেলো সুলতান স্বপ্নে সাইপ্রাসকে খ্রিস্টানদের হাত থেকে রক্ষা করার নির্দেশ পেয়েছেন।
সেলিম তার পূর্বপুরুষদের সমাধিস্থলে আশীর্বাদ আনতে গেলেন। নৌবাহিনীর সাথে যাত্রা করলেন না সুলতান। নিকোশিয়া অঞ্চল জয় করা হলো। কয়েক মাস ধরে ফামাগুস্তা অঞ্চল অবরুদ্ধ থাকার পর তা অটোমানদের করায়ত্ত্বে চলে এলো।
আড্রিয়ানোপলে সিনান তার শিষ্যদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন। অঞ্চলগুলো জয় করার ফলে উপহার ও পুরস্কারের বরাদ্দ বেড়ে গেলো। ফলে আরও রসদ ও কর্মী নিযুক্ত করা হলো মসজিদ তৈরির কাজে।
শরতের এক দুপুরে সিনান তার শিষ্যদের খবর পাঠিয়ে ডেকে আনলেন। সেলিমীয়া মসজিদের আটটি স্তম্ভের কাজ চলছে তখন। এরপর হাজিয়া সোফিয়ার পাশে অবৈধ স্থাপনা ধ্বংস করে সেটি পুন:নির্মাণ করা হলো। সিনান ইস্তানবুলের আরও বেশ কিছু জায়গার অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করেছিলেন। তবে হাজিয়া সোফিয়ার আশেপাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সময় সিনান অনেক বাধার মুখে পড়েছিলেন দখলদার লোকদের দ্বারা। তারা রটিয়ে দিয়েছিল যে, সিনান খ্রিস্টান থেকে মুসলিম হওয়ায় প্রাক্তন ঐ গির্জাটিকে রক্ষা করার চেষ্টা করছিলেন ভালো মুসলিমদের ঘরবাড়ি উজাড় করে এবং সেটি নাস্তিকদের মন্দির। তারা শ্রমিকদের সরঞ্জাম চুরি করে, সাহায্যকারী পশুদের মেরে, সরাসরি বাধা দিয়ে কাজ বন্ধের চেষ্টা করলো। শহরের কাদি সহযোগিতা না করলেও প্রধান মুফতির ফতোয়ায় শেষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু শহরের এক প্রান্তে এমন স্থাপনা ভাঙলে আরেক প্রান্তে সেগুলো আবার গড়ে তুলতো দখলদাররা।
সেলিমীয়া মসজিদের জন্য চিত্রকর নিয়ে আসা হয়েছিল গ্রিসের চিওস দ্বীপ থেকে।
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Chios
আরোহী পিঠে থাকা অবস্থায় ঘোড়া পড়ে গেলে সেটাকে ঐসময় 'দুর্ভাগ্যের লক্ষণ' বলে ধরে নেয়া হতো। সেলিমীয়া মসজিদের কাজের অগ্রগতি দেখতে সুলতান সেলিম যাত্রা করার পথে এমনটা ঘটলে তিনি ঘোড়া থেকে নেমে হাতির পিঠে উঠে শহর ত্যাগ করে আদ্রিয়ানোপলের দিকে যাত্রা করতে মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু হাতিও তাকে ফেলে দেয়। আদ্রিয়ানোপল পৌঁছে সুলতান শুনলেন ওসমানীয় নৌবাহিনীর হারের সংবাদ।
ওসমানীয় সুলতানরা সবার থেকে আলাদা হয়ে একা খেতেন। এটাই ছিল তাদের রীতি। সুলতান সেলিম শেষ সময়ে সারাক্ষণ বমি করতেন। তার রক্তে বিষাক্ত পদার্থ বেড়ে গিয়েছিল। হামামখানায় পড়ে গিয়ে সুলতান মাথায় ব্যথা পেলেন। গোসল করবার সময় তিনি মাতাল ছিলেন। পঞ্চাশ বছর বয়সে মারা গেলেন সুলতান সেলিম। নুর বানু তার শরীরকে বরফে মুড়ে দিলো। মৃত্যুটাকে রহস্য করে রাখলো, যতদিন না তার প্রিয় পুত্র মুরাদ আনাতোলিয়া থেকে ফেরত আসে। সুলতান মুরাদ সিংহাসনে বসলেন। প্রথমে ভাইদের হত্যা করলেন। এরপর বাবাকে কবর দিলেন। অন্যান্য শাসকের মতো মসজিদকে তিনি পছন্দ করলেও দাদার মতো বিশালত্ব কিংবা বাবার মতো সৌন্দর্যপিয়াসু ছিলেন না। তার জন্য শক্তিটাই বেশি পছন্দনীয় ছিল।

Comments