উপমহাদেশের কিছু বস্তুবাদী দর্শন [পর্ব - এক]
সাংখ্য:
সাংখ্য দর্শনকে ভারতের প্রাচীনতম দর্শন বলে মনে করেন ভারতীয় দার্শনিকরা। মানেন তথাকথিত 'পণ্ডিত' দার্শনিকরাও। সাংখ্য দর্শন নিরীশ্বরবাদী দর্শন। এখানেই শেষ নয়। সাংখ্য দর্শন মূলত বস্তুবাদী দর্শন। সাংখ্য যে একটি প্রাচীন মতবাদ, তার প্রমাণ উপনিষদসমূহে ও মহাভারতে সাংখ্য দর্শনের উল্লেখ আছে। গৌতম বুদ্ধ গৃহত্যাগের পর সাংখ্য অধ্যয়ন করেছিলেন বলে মনে হয়। কারণ সাংখ্য দার্শনিক কপিল ছিলেন গৌতম বুদ্ধের উত্তরসূরী এবং বৌদ্ধ ধর্মের উপর সাংখ্যের প্রভাব স্পষ্ট। কপিল তাঁর সাংখ্যে ব্রহ্ম বা পরমাত্মাকে কোনও স্থান দেননি। তাঁর মতে প্রকৃতি নিত্য, সমস্ত জাগতিক পদার্থ তারই পরিবর্তনের ফলে উৎপন্ন। সাংখ্য মনে করে - জড় প্রকৃতির বিবর্তনের মধ্য দিয়েই বিশ্বের সব কিছুর সৃষ্টি। প্রতিটি কাজ বা ঘটনার পিছনেই রয়েছে কারণ। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ সাংখ্য সংস্থাপক কপিলকে ঋষি বলে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল। নিরীশ্বরবাদী কপিল মুনি হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কাছে ঈশ্বরের পরমভক্ত মুনি হিসেবে পুজিত হচ্ছেন - এটাই দুঃখ। ইতিহাস বিকৃতিকে দেখার দুঃখ। প্রচারের দৌলতে বিকৃতিকারীদের আলোকিত হতে দেখার দুঃখ।
মীমাংসা:
ভারতবর্ষের আরও একটি প্রাচীন ও অত্যন্ত শক্তিশালী দর্শন হলো মীমাংসা। মীমাংসাবাদীরা স্পষ্টতই নিরীশ্বরবাদী। মীমাংসক কুমারিল ভট্টের রচিত শ্লোকবাতিক থেকে আমরা মীমাংসা দর্শনের কিছু মতামত এখানে তুলে দিচ্ছি।
এক: কেউ যদি বলেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আগে থেকেই ঈশ্বর ছিলেন, তবে তাকে প্রশ্ন করা যেতে পারে সৃষ্টি না থাকলে স্থান থাকে না। স্থান না থাকলে ঈশ্বর কোন স্থানে থাকতেন?
দুই: ঈশ্বর নিরাকার ছিলেন, নাকি তাঁর আকার ছিল, দেহ ছিল? দেহ থাকলে সেই দেহের নিশ্চয়ই একজন স্রষ্টা ছিলেন?
তিন: ঈশ্বর সৃষ্টির জন্য নিশ্চয়ই আর এক ঈশ্বরের প্রয়োজন হয়েছিল। সেই ঈশ্বরকে সৃষ্টি করতে আরও একজন ঈশ্বরের প্রয়োজন হয়েছিল। এভাবে অনন্ত ঈশ্বরের প্রয়োজন হতেই থাকবে।
চার: কোন উপাদান দিয়ে তিনি বিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন? সেই উপাদানগুলো কি সৃষ্টির আগে থেকেই বর্তমান ছিল? থাকলে সেগুলো কোথায় ছিল?
পাঁচ: সৃষ্টির উপাদানগুলোর স্রষ্টা কে?
ছয়: যদি ঈশ্বর তাঁর দেহ থেকেই এই উপাদান তৈরি করে থাকে - তবুও প্রশ্ন থেকে যায় সেই ঈশ্বরের দেহের স্রষ্টা কে? স্রষ্টা হিসেবে একের পর এক ঈশ্বর আনলেও এর উত্তর পাওয়া যাবে না।
সাত: ঈশ্বর কেন জগৎ সৃষ্টি করলেন? কী অভাববোধ থেকে এই সৃষ্টি? ঈশ্বরের অভাববোধ থাকার অর্থ তিনি পূর্ণ নন।
আট: এই সৃষ্টিকে ঈশ্বরের লীলা বললে, বলতেই হয় ঈশ্বর দায়িত্বজ্ঞানহীন।
নয়: ঈশ্বর যদি করুণা থেকে জগৎ সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে জগতে কেন এত দুঃখ?
দশ: বেদ এ কথাই বলে যে, বাঞ্ছিত ফল পেতে যজ্ঞই একমাত্র সত্য, দেবতার কোনও ভূমিকা নেই। দেবতা ফল দিতেও পারে না, ফল লাভ বন্ধও করতে পারে না। বৈদিক যজ্ঞ নীতি 'ব্রাহ্মণ' তার প্রমাণ। তাহলে দেবতা বা ঈশ্বর সর্বশক্তিমান নন।
ঈশ্বর বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে এমন ভয়ংকর আক্রমণ আর কোনও দর্শন-ই সেই সময় হানতে পারেনি। সত্যি বলতে কী, এযুগের উচ্চ ডিগ্রিধারী অনেকের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিদীপ্ত ছিলেন মীমাংসাবাদীরা। মজার কথা হলো, প্রচারের আলোয় আলোকিত 'বিখ্যাত পণ্ডিত'দেরও শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতে হয়েছে যে, সাংখ্য এবং মীমাংসা নিরীশ্বরবাদী মতবাদ ও মূলত বস্তুবাদী মতবাদ।
স্বভাববাদ:
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের যুগে আরও একটি যুক্তিমনস্ক মতবাদ উঠে এসেছিল। মতবাদটির নাম 'স্বভাববাদ'। স্বভাববাদের উল্লেখ আমরা পাই মহাভারতে, বৌদ্ধ লংকাবতার সূত্রে ও অশ্বঘোষের বুদ্ধ চরিত-এ। স্বভাববাদ স্পষ্টতই একটি যুক্তিমনস্ক মতবাদ। এই মতবাদ অনুসারে-
(১) বিশ্বপ্রকৃতি কার্যকারণের নিয়মশৃঙ্খলে বাঁধা,
(২) একটি বিশেষ ধরনের কাজের বা ঘটনার পিছনে একটি বিশেষ ধরনের কারণ থাকে। যেমন, মাটি থেকে মৃৎপাত্র-ই হতে পারে; পরিধেয় বস্ত্র নয়,
(৩) কারণহীন বা অতিপ্রকৃত ঘটনা ঘটা সম্ভব নয়।
স্বভাববাদীরাও ছিলেন অতিপ্রাকৃতে অবিশ্বাসী, নিরীশ্বরবাদী।
মাধ্যমিক:
নাগার্জুন 'মাধ্যমিক' মতবাদের প্রবক্তা। মাধ্যমিক মতে - আমরা যা দেখি, যা অনুভব করি, সবই আপেক্ষিকভাবে মনে হওয়া, অনুভব করা। আলোয় যে প্রকৃতিকে আমরা দেখতে পাই, অন্ধকারে তা দেখা যায় না। চোখ না থাকলে জগতের বস্তু, রং সবই মিথ্যা। যে দ্রব্য একজন দুর্বল দ্বারা পরীক্ষিত হলে কঠিন মনে হয়, তাই একজন সবলের কাছে কম কঠিন মনে হয়। গুণাবলী স্বয়ং অস্তিত্ববান হতে পারে না। যে খাদ্যবস্তুর স্বাদ একজনের কাছে উপাদেয়, অপরের কাছে তা খারাপ মনে হতে পারে। সুতরাং বস্তুর বাস্তব গুণ নেই। বস্তুগুণ আপেক্ষিক। একটি বস্তুর মধ্যে একই সঙ্গে সৃষ্টি-স্থিতি-লয় থাকতে পারে না। জগতের প্রকৃত কোনও অস্তিত্ব নেই। বস্তুসমূহ চিরস্থায়ীও নয়, ক্ষণস্থায়ীও নয়। বস্তু উৎপন্ন হয় না, বিলুপ্তও হয় না। আমরা যেসব বস্তু দেখছি তা আসলে অলীক।
মাধ্যমিক দর্শন কিছু যুক্তি ও কিছু যুক্তিহীনতায় ভরা 'দর্শন'। বৈদিক যুগের উপাসনা ধর্মীরা মাধ্যমিক দর্শনের যুক্তিমনস্কতাকে ভয় পেয়েছিলেন। তারই পরিণতিতে মাধ্যমিকদের একঘরে করার চেষ্টায় মেতেছিলেন। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এমন কিছু গভীর ও সূক্ষ্ম চিন্তার মানুষ ছিলেন ভাবলে বিস্ময় জাগে। তবে মাধ্যমিক মতবাদকে আমরা 'দর্শন' বলে মেনে নিতে পারি না।
যোগাচার:
'যোগাচার' বা 'বিজ্ঞানবাদ'-এর মতে - চৈতন্য, চেতনা, জ্ঞান ও বিজ্ঞান নিজে থেকেই ক্রিয়াশীল। বাইরের কোনও শক্তির দ্বারাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়নি।
যোগাচার দর্শনে এমন বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার পাশাপাশি কিছু ভ্রান্তিও ছিল। যোগাচারীরা মাধ্যমিকদের মতই মনে করতেন - যেহেতু চৈতন্য ছাড়া আমরা কোনও কিছুই দেখতে পাই না, জানতে পারি না, তাই দৃশ্যমান কোনও বস্তুর বাস্তব অস্তিত্ব নেই।
মাধ্যমিক ও যোগাচার দর্শন দু'টি মহাযানপন্থী বৌদ্ধ দর্শন। একই কারণে যোগাচার বা বিজ্ঞানবাদ কখন-ই খাঁটি দর্শন নয়।
সৌত্রান্তিক:
সৌত্রান্তিকপন্থীরা নিরিশ্বরবাদী। তাঁরা মনে করেন, ঈশ্বর নেই। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, প্রকৃতির কোনও কিছুই ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়। সব কাজের পিছনেই থাকে কারণের বিবর্তনমূলক প্রক্রিয়া। মাটিতে বীজ পুঁতলে অংকুর হয়। অংকুর থেকে শিশু গাছ, কাণ্ড-শাখা-প্রশাখা-পাতা-ফুল-ফল সবই একটা কারণের বিবর্তনমূলক প্রক্রিয়া। সৃষ্টি স্থান-কাল নির্ভর। একটা বীজকে মাটিতে বপন না করে মাটি বা ধাতুর পাত্রে রেখে দিলে, মাটি ও জলের অভাবে বীজ থেকে অংকুর সৃষ্টি হবে না। মৈথুনের ৩০ পক্ষের মধ্যে জন্ম নেবে না একজন সবল শিশু। নারী-পুরুষের মিলন থেকে সবল শিশুর জন্মানোর যে বিবর্তন প্রক্রিয়া, তার জন্য একটা নির্দিষ্ট কালের প্রয়োজন। ঈশ্বর এই স্থান-কালের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সৃষ্টি করতে পারে না। সৌত্রান্তিকরা শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ প্রমাণকে গ্রহণ করতেন না। অভিজ্ঞতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ প্রমাণকে মিলিয়ে বিচার করলে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় বলে মনে করতেন। হীনযানী বৌদ্ধদেরই একটি সম্প্রদায়ের নাম হলো সৌত্রান্তিক।
কিছু তথাকথিত দার্শনিক সৌত্রান্তিক মতবাদকে 'দর্শন' বলে উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু এই মতবাদ যেহেতু একটি সামগ্রিক জীবনদর্শন হয়ে উঠতে পারেনি, তাই আমরা একে 'দর্শন' বলে চিহ্নিত করতে পারি না।
বৈভাষিক:
হীনযানী বৌদ্ধদেরই আরও একটি শাখা বৈভাষিক। বৈভাষিকদের মতে গৌতম বুদ্ধ বৌদ্ধত্ব প্রাপ্তির পর যেসব উপদেশ দিয়েছিলেন, সেগুলি নিয়েই তৈরি সাতটি অভিধর্ম গ্রন্থ। এই অভিধর্ম গ্রন্থই বৌদ্ধদর্শনের প্রামাণ্য উৎসগ্রন্থ।
বৈভাষিকরা প্রত্যক্ষ প্রমাণকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন। মনে করেন সমস্ত বস্তু চারটি ভূত দ্বারা গঠিত। এরা হলো পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু। বৈভাষিকরা 'ন্যায় বৈশাষিকদের' পারমাণবিক তত্ত্বকে স্বীকার করতেন। বৈভাষিক দর্শনে বলা হয়েছে, পরমাণুর ছয়টি কোণ আছে। বস্তুর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, অবিভাজ্য, বিশ্লেষণ অযোগ্য ও অস্থির চরিত্র হলো পরমাণুর গুণ। এককভাবে অদৃশ্য হলেও সমষ্টিগতভাবে দৃশ্যমান।
বৈভাষিকরা নিরীশ্বরবাদী। এমন নিরীশ্বরবাদীদের পরবর্তী জন্ম শেয়াল যোনিতে হবে বলে বৈদিক পুজারীরা গাল পাড়লে, সেটা আদৌ অস্বাভাবিক ঠেকে না। বাঁচোয়া - শকুনের শাপে গরু মরে না। বৈভাষিক দর্শনও কোন অর্থেই সম্পূর্ণ দর্শন নয়।
ভূতবাদ:
'ভূতবাদ' মনে করে পৃথিবীতে মৌল পদার্থের পরিমাণ পাঁচ। আবার কিছু ভূতবাদীদের মতে পৃথিবীতে মৌল পদার্থের পরিমাণ চার। এই মৌল পদার্থ থেকেই পৃথিবীর বস্তু ও প্রাণী, সবেরই সৃষ্টি। ধ্বংসে সব-ই আবার পঞ্চভূতে বা চারভূতে বিলীন হয়। এই মৌল পদার্থগুলো কী কী, তা নিয়ে একটু আগেই আমরা আলোচনা করেছি। কিন্তু এই চারটি বা পাঁচটি মৌল পদার্থের তত্ত্ব মেনে নিতে আমাদের অসুবিধে আছে। এখনও পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি, প্রকৃতিতে মোট মৌল পদার্থের সংখ্যা ১০৫টি। ১০টি মৌল পদার্থ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে কৃত্রিম উপায়ে। অর্থাৎ এই ১০টি গবেষণাগারে তৈরি। সংখ্যা তত্ত্ব ছেড়ে ভূত তত্ত্বে ফিরলে স্বীকার করতেই হয়, দু'আড়াই হাজার বছর আগের কিছু চিন্তাবিদ কী অসাধারণ বিপ্লবাত্মক চিন্তায় পৌঁছেছিলেন - মৃত্যুর পর মৃতদেহ মৌল পদার্থে বিলীন হয়ে যায়। সব শেষ হয়ে যায়। দেহাতীত আত্মা বলে কিছু নেই। এমন চিন্তা মানুষের মাথায় এসেছিল সম্ভবত মৃত্যুর পর দেহের পরিণতি দেখে, অস্ত্র ও তৈজসপত্রের ভঙ্গুরতা দেখে। মৃতদেহকে পচে-গলে মাটিতে মিশতে দেখেছে। পুড়ে শেষ হতে দেখেছে। দেখেছে আগুনের শিখাকে বাতাসে লাফিয়ে উঠতে। দেখেছে ধোঁয়াকে বাতাসবাহী হয়ে আকাশে মিলিয়ে যেতে। নদীতে ভাসমান দেহকে জলেই বিলীন হতে। ভাঙা হাঁড়ি-কুড়ি, মরা গাছকে দেখেছে একসময় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে। অনুমান করা যেতে পারে, তাদের এসব প্রত্যক্ষ প্রমাণ চতুর্ভূত বা পঞ্চভূত তত্ত্বে পৌঁছে দিয়েছিল। সেসময়ের প্রেক্ষিতে চতুর্ভূত বা পঞ্চভূত তত্ত্বকে অবশ্যই অসাধারণ বলতেই হয়। দুঃখ এই, আজকের যুগে মৌল পদার্থ নিয়ে বিজ্ঞান গবেষণা যখন বিশাল রকম এগিয়ে গেছে, এগিয়েছে শরীর বিজ্ঞান, তখনও এদেশের বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর দেহ মাটিতে পুঁতে ফেলার পর বা আগুনে পুড়িয়ে দেবার পরও সব শেষ হয় না। বেঁচে থাকে আত্মা; অর্থাৎ চিন্তা, চেতনা, চৈতন্য বা মন। আড়াই হাজার বছরে বিজ্ঞান অনেক এগোল, কিন্তু আমাদের চেতনা এগোল কই! আমরা তো যুক্তিহীনতার আবর্তে তলিয়ে যাচ্ছি। এই অধঃপাতকেই কি মেনে নেবো আমরা?
- অলৌকিক নয়, লৌকিক (৫ম)

Comments