নারীবাদের রকমফের - প্রবীর ঘোষ

 


'FEMINISM' শব্দের আভিধানিক অর্থ - 'নারী অধিকারের সমর্থন', 'নারী জাগরণের সমর্থন'। 'FEMINISM'-এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে 'নারীবাদ', 'নারীমুক্তি', 'নারী স্বাধীনতা', 'নারী প্রগতি' ইত্যাদি শব্দগুলো প্রচলিত রয়েছে।

কোনও দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক বা সমাজবিজ্ঞানের মতকে 'বাদ' বা 'ism' বলা হয়ে থাকে। যেমন বার্কলের 'Solipsism', হিউমের 'Agnosticism'। কোনও দার্শনিক মতের ধরন বা দৃষ্টিভঙ্গিকেও 'ism' বলা হয়। যেমন 'Idealism', 'Realism' ইত্যাদি। আরও বহু অর্থেই 'ism' বা 'বাদ' শব্দটি ব্যবহৃত হয়। 'নারীবাদ' এমনই একটি 'বাদ' বা 'মতবাদ' যা সমাজবিজ্ঞানের অভিজ্ঞতা থেকে সৃষ্ট, যেখানে 'নারী' অধিকারের সমর্থন করা হয়েছে। কি সেই অধিকার? পুরুষের সমান অধিকার; মানুষের অধিকার।

সমাজ অগ্রগতির প্রায় ঊষালগ্নেই নারীসত্তাকে অবদমিত করে শুরু হয়েছে পুরুষতন্ত্রের শোষণ। এই অবদমন নিঃসন্দেহে আমানবিক। এই অমানবিকতা বহু অঞ্চলে বর্বরতার স্তরে এখনও অবস্থান করছে। মানব সমাজের একটা অংশকে (নারীকে) শৃঙ্খলিত করে, অবদমিত রেখে সামগ্রিকভাবে মানব সমাজের উন্নতির চিন্তা অবাস্তব। নারীর প্রতি অমানবিক শোষণ ও মানব সমাজের উন্নতি, এই দু'টি প্রসঙ্গ মাথায় রাখলে নারী-পুরুষের সাম্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের কাম্য হতে বাধ্য। তাই আমরা দেখি নারী-পুরুষ সাম্যের প্রতিষ্ঠায় শুধু নারী নয়, পুরুষদেরও সবল উপস্থিতি।

'নারীবাদ' নারীদের আন্দোলন নয়। নারীদের জন্য আন্দোলন। নারী-পুরুষ সাম্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এই আন্দোলনের মধ্যেই রয়েছে মানুষের সাম্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের শক্তি। নারী-পুরুষে সামনাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তাত্ত্বিক মতবাদ এসেছে, বিভিন্ন আন্দোলনকারীদের প্রভাবিত করেছে। নারীদের প্রকৃত স্বার্থ, প্রকৃত মুক্তি, প্রকৃত সাম্য, প্রকৃত স্বাধীনতা নিয়ে এইসব তাত্ত্বিক মতবাদে স্পষ্টতর কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেসব নারীবাদী মতবাদ আন্দোলনের রূপ পেয়েছে বা বহুর চেতনাকে প্রভাবিত করেছে, সেগুলোকে নিয়ে স্বল্প কথায় একটু আলোচনা সেরে নিই।

উদার নারীবাদ বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নারীবাদ

এই মতবাদের যাত্রা শুরু একটি নারীবাদী বইয়ের দ্বারা প্রভাবিত জনচেতনার উন্মেষ থেকে। বইটির নাম 'ভিন্ডিকেশন অফ দি রাইটস্ অফ ওম্যান'। প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে। লেখিকা মেরি ওলস্টোনক্রাফট্। মেরির বয়স তখন মাত্র বত্রিশ বছর। যিশু খ্রিস্টধর্মের স্রষ্টা, মার্কস স্রষ্টা মার্কসবাদের; তেমনই নারীবাদের অষ্টা মেরি, মেরি ওলস্টোনক্রাফট্। নারী-পুরুষ সাম্যের দাবির স্রষ্টা মেরির 'ভিন্ডিকেশন...' বইটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছে ছিল সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছ থেকে যেমন বিপুল বিদ্রূপ, নিন্দা ও গালাগাল মেরি পেয়েছিলেন; তেমনই প্রগতিশীল একটি অংশ এমন অসাধারণ চিন্তার নায়িকাকে অভিনন্দিতও করেছিলেন। লন্ডনের অদূরে এপিং বনের গায়ে এক গরিব চাষীর ঘরে ১৭৫৯-এ মেরির জন্ম। তিন ছেলে তিন মেয়ের সংসারে মেরিই বড়। বাবা এডওয়ার্ড ওলস্টোনক্রাফট জীবিকার সন্ধানে পরিবার নিয়ে ঘুরেছেন ইংলন্ড ও ওয়েলসের অনেক জায়গাতেই। গরিব এডওয়ার্ড ছিলেন রাগী ও অত্যাচারী পুরুষতন্ত্রের প্রতীক। মা ছিলেন সে সময়কার আর পাঁচটি পরিবারের গৃহবধুর মতোই স্বামীর দ্বারা অত্যাচারিতা, অবদমিতা। উনিশ বছর বয়সে স্বাধীন জীবিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন মেরি। ১৭৮৩-তে বোনদের নিয়ে এবং বান্ধবী ফ্যানি ব্লাডকে নিয়ে লন্ডনের নিউইংটন গ্রিনে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন মেয়েদের জন্য। ১৭৮৭-তে মেরির প্রথম বই প্রকাশিত হলো। বিষয় - কন্যাদের শিক্ষা। ১৭৮৮-তে প্রকাশিত হলো তাঁর প্রথম উপন্যাস - 'মেরি'। এই সময় প্রকাশক জনসনের দোকানে পরিচিত হন উইলিয়ম গডউইন, টমাস পেইন, উইলিয়ম ব্লেকের মতো উদারপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে। মেরি পুরোপুরিভাবে লেখাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। পত্র-পত্রিকায় লেখা ও অনুবাদ থেকে যা পেতেন, তাতে অবশ্য তাঁর গরিবি অবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটে না। মানুষের অধিকার নিয়ে মেরির গ্রন্থ 'ভিন্ডিকেশন অফ দি রাইটস্ অফ ম্যান' প্রকাশিত হয় ১৭৯০ সালে। ১৭৯২-এ প্রকাশিত হয় পুরুষতন্ত্রের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া বই 'ভিন্ডিকেশন......'। প্যারিসে গিয়ে মেরি পরিচিত হন মার্কিন লেখক গিলবার্ট এমল-এর সঙ্গে। বিশ্বাস, বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে যৌন সম্পর্কে বিশ্বাসী এবং প্রথাগত বিয়েতে অবিশ্বাসী মেরি গিলবার্টের সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন। ১৭৯৪-তে জন্ম দেন মেয়ে ফ্যানি'র। ফ্যানির জন্মের পর গিলবার্ট মেরিকে ছেড়ে যান। মেরির লেখা কিন্তু বন্ধ হয়নি। লিখলেন কাল্পনিক প্রেমিকের উদ্দেশ্যে একগুচ্ছ চিঠির ফিচার। পাশ্চাত্যের বিশিষ্ট দার্শনিক উইলিয়ম গডউইনের সঙ্গে এই সময় তিনি গভীর সখ্যতায় আবদ্ধ হন। একত্র জীবনের সূত্রে, ভালোবাসার সূত্রে মা হতে চললেন। এই সময় তিনি লিখেছেন 'রংস্ অফ উইমেন'। ১৭৯৭-তে একটি কন্যার জন্ম দিয়ে শেষ নিশ্বাস ফেললেন মেরি। এই কন্যাই ছিলেন মেরি গডউইন শেলি - এক অসামান্যা ঔপন্যাসিক। মেরির পথ ধরে নারীবাদী আন্দোলনকে পূর্ণ বিকাশের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলো স্টুয়ার্ট মিলের বিখ্যাত বই 'দি সাবজেকশন অফ উইমেন'। মেরি ও স্টুয়ার্টের নারীবাদ 'উদার নারীবাদ' বা 'ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নারীবাদ' নামে পরিচিত এবং নারীবাদী আন্দোলনের শক্তিশালীতম ধারা। উদার নারীবাদের মূল কথা - প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। উনিশ শতকে উদার নারীবাদীদের লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচনে ভোটাধিকার অর্জন। ভোটাধিকার তাঁরা বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত অর্জন করলেও আজও বহু দেশের আইনেই বহু ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের সমান অধিকার অর্জন করতে পারেনি। উদার নারীবাদীরা চান রাষ্ট্রিকভাবে আইন প্রণয়ন করে প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। উদার নারীবাদীরা চান লিঙ্গ বৈষম্য, ধর্ম বৈষম্য, ভাষা বৈষম্য বা বর্ণ বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে যোগ্যতা বিচারের ক্ষেত্রে একমাত্র বিবেচ্য হোক ব্যক্তি প্রতিভা। উদার নারীবাদীরা মনে করেন, মানুষের ব্যক্তি জীবনে রাষ্ট্রশক্তি যত বেশি নাক গলাবে মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতার ক্ষেত্র ততই সংকুচিত হবে - যা মানবতাবিরোধী। এই নারীবাদে রয়েছে নারী ও পুরুষের নিজের ইচ্ছে মতো নিজের ভূমিকা বেছে নেবার অধিকার এবং ইচ্ছে মতো ভূমিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনও আইনি বাধা থাকলে তা বাতিল করার দাবি। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশেগুলোতে এই নারীবাদী ধারাই মূল স্রোত হয়ে ওঠার কারণ, ওদের গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে এই মতবাদ যেমন মিল খায়, তেমনই দৃষ্টিভঙ্গির সাদৃশ্য দেখা যায় ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার জনমানসে সংক্রামিত আত্মকেন্দ্রিক ভাবনার সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ভাবনার, নিজেরটুকু গুছিয়ে নেবার ভাবনার। এই উদার বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নারীবাদের এ যুগের আন্দোলনকারীরা দাবি রেখেছেন - যেসব পেশায় নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ রয়েছে তা বাতিল করতে হবে। এক কাজে এক বেতন চালু করতে হবে। এক্ষেত্রে নারীকে কম বেতন দেওয়া চলবে না। নারী যেহেতু সন্তানের জন্ম দিয়ে মানবজাতিকে বাঁচিয়ে রাখছে, মানবজাতির সেবায় কষ্ট স্বীকার করছে, তাই নারীকে প্রসবকালীন সবেতন ছুটি দিতে হবে। শিশু যেহেতু একা নারীর নয়, তাই শিশু পালনের ক্ষেত্রে পুরুষকে অবশ্যই সহযোগিতা করতে হবে। যেসব দেশে দেশ রক্ষার জন্য সামরিক শিক্ষা পুরুষের জন্য বাধ্যতামূলক, সেসব দেশে নারীদের জন্যেও তা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এই নারীবাদে বৈষম্যমূলক সমাজ কাঠামো উচ্ছেদের কোনও পরিকল্পনা নেই, কোনও প্রয়োজনীয়তা অনুভবের কথা পর্যন্ত নেই। এই নারীবাদ নারী স্বাধীনতা বিষয়ে কোনও সামগ্রিক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে না। ফলে আন্দোলনেও নেই কোনও সুসংহত দর্শনের প্রতিফলন। সুতরাং, স্বাভাবিকভাবেই তা কয়েকটি ইস্যুর সমষ্টিতে পর্যবসিত হয়ে শেষ পর্যন্ত স্থিতাবস্থা বজায় রাখার হাতিয়ার-এ পরিণত হয়েছে। তাই নারীবাদ কখনও সামগ্রিকভাবে নারীদের মুক্তি আনতে পারে না। তাত্ত্বিকভাবেই পারে না। অসাম্যের সমাজ কাঠামোয় মানুষ বঞ্চিত হতে বাধ্য, অবদমিত হতে বাধ্য। তাই নারীও এই বঞ্চনা ও অবদমন থেকে মুক্তি পেতে পারে না।

মার্কসীয় নারীবাদ

মার্কসীয় নারীবাদের উৎপত্তিস্থলও একটি বই। এঙ্গেলস্-এর 'পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি'। প্রকাশ হয়েছিল ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে। মার্কসীয় নারীবাদে বলা হয়েছে - 

পুঁজিবাদ আর পুরুষতন্ত্র অবিচ্ছেদ্য। একটি আর একটিকে শক্তিশালী করে। ব্যক্তিমালিকানাই নারী শোষণের কারণ। ব্যক্তিমালিকানার বিলুপ্তির দ্বারাই নারী শোষণ বন্ধ করা সম্ভব। এই নারীবাদের মতে নারীও শ্রমিকের মতো একইভাবে শোষিত। শোষণের সমাজকাঠামো পালটে মানুষের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলেই সম্ভব নারী-পুরুষে সাম্য।

এঙ্গেলস-এর নারীবাদী চিন্তার সঙ্গে পরবর্তীকালে যুক্ত হয় মার্কস ও লেনিনের নারীবাদী চিন্তা। এই নারীবাদে এ কথাও বলা হয়েছে, এক পতি-পত্নী বিয়ের প্রচলন হয়েছিল কতিপয় পুরুষদের উদ্বৃত্ত ধন জড়ো করার উদ্দেশ্যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। নারীদের অর্থনৈতিক বন্ধন থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব না হলে ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রাম ব্যর্থ হতে বাধ্য। নারী মুক্তি শুধু পারিবারিক জীবনের প্রয়োজনে নয়, সমগ্র মানব সমাজের প্রয়োজনেই কাম্য। মেহনতি জনতার অর্ধেক নারী, তারা যতদিন না পুরুষের সমান অধিকার পায়, যতদিন না তারা সংসারের দাসীর জীবন থেকে মুক্ত হয়, ততদিন সমাজতন্ত্রের জয় অসম্ভব। শ্রমিক শাসিত সরকার এলে আইনের দিক থেকে যেমন নারী-পুরুষের মধ্যে সাম্যের প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, তেমনই মনস্তত্ত্বের দিক থেকেও নারী-পুরুষের সেকেলে সম্পর্কের বিনাশ করা সম্ভব। সমাজ কাঠামোয় সাম্যের প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়েই নারীবাদ সার্থক হতে পারে। সমাজ কাঠামো পালটালে নারী-মুক্তি এমনিই আসবে। এবং শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা দখল ভিন্ন সমাজ কাঠামো পালটে সাম্য প্রতিষ্ঠা - এক অসম্ভব চিন্তা।

এই নারীবাদী চিন্তা থেকে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে ক্ষমতা দখলের তত্ত্বের গুরুভারে নারীবাদের আন্দোলন প্রয়োজনীয় গুরুত্ব পেতে পারেনি কখনও। আমাদের দেশের মার্কসবাদীরা 'মার্কসীয় নারীবাদ'কে নারী নির্যাতন নিয়ে সরবতা ও নারী মঙ্গলে তৎপরতার মধ্যে আবদ্ধ রেখেছে। দলগত বিবাহ প্রথার প্রচলন প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা রয়েছে। এক বিবাহ প্রথার সঙ্গে বক্তিগত সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্ন যেহেতু জড়িয়ে রয়েছে, তাই এঙ্গেলসের পরিবার ও ব্যক্তিগত মালিকানা বিষয়ে রাখা বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতেই হয় - বিশেষ করে মার্কসীয় নারীবাদ এই বক্তব্যের সঙ্গে অনেক বেশি সম্পর্কিত হওয়ার কারণে। এঙ্গেলস-এর মতে এক পতি-পত্নী বিবাহ প্রথার পিছনে ছিল মেয়েদের দলগত বিয়ের প্রতি অনীহা। কারণ, জৈবিকভাবেই নারীর যৌন উত্তেজনা ও উপভোগের ক্ষমতা পুরুষের তুলনায় কম। তাই, পুরুষদের বহু নারীর প্রতি যৌন সম্পর্কে আগ্রহ থাকলেও নারীরা জৈবিক কারণেই একাধিক পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অনাগ্রহী হয়ে পড়েছিল। তাই এক পতি-পত্নী বিবাহ সম্পর্ক স্থাপনে নারীরাই ছিল সক্রিয় ভূমিকায়। 
জৈবিকভাবেই ও স্বাভাবিক কারণেই নারী পুরুষের তুলনায় যৌন উত্তেজনার ক্ষেত্রে দুর্বল - এঙ্গেলস্-এর এই মতবাদ যে ভুল তা স্পষ্ট ও দ্বিধাহীনভাবেই প্রমাণিত হয়ে গেছে ডবলিউ এইচ মাস্টার্স এবং ভি ই জনসনের নারী-পুরুষ যৌন উপভোগের পরিমাপের গবেষণাকর্মের দ্বারা। এঙ্গেলস্ পুরুষতান্ত্রিকতার সর্বগ্রাসিতার স্বীকার হয়েছিলেন বলেই পুরুষ চোখ দিয়ে নারীদের দেখে ধারণা করেছিলেন, পুরুষদের ক্ষেত্রে একাধিক নারীতে অরুচি না থাকলেও নারীদের পক্ষে একাধিক পুরুষে অরুচি থাকাটাই স্বাভাবিক। এঙ্গেলসের এই ভুল আজও সযত্নে, পরম নিষ্ঠার সঙ্গে বহু মার্কসবাদীই বহন করে চলেছেন, তার উদাহরণ পাবেন প্রায় যেকোনও মার্কসবাদীর 'নারীবাদ', 'পরিবারে উৎপত্তি' প্রসঙ্গ নিয়ে লেখাতে চোখ বোলালেই। পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্রবাদ যখন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের অসমান বিকাশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অঞ্চলভেদে হাজির করছে মৌলবাদ, ভোগবাদ, পুরোহিততন্ত্র থেকে পরাবিদ্যা, পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষার জনাই পালটাচ্ছে নিজেদের কৌশল, হাজির করছে আন্দোলন ধ্বংস করতে মেকি আন্দোলন; তখন পুঁজিবাদের মিথ্যে পালটাবার, কৌশল পালটাবার সঙ্গে সঙ্গে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীরা কিন্তু নিজেদের কৌশল পালটাতে চায়নি এবং তথ্যগত ও তত্ত্বগত ভুলকে শুধরে এগোতেও চায়নি। বাস্তব নিয়ে একটু ভাবুন, সচেতন ও সহানুভূতিসম্পন্ন পাঠক-পাঠিকারা একটু ভাবুন, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পরিবেশে পুঁজিবাদ তার 'মহান মিথ্যে' পাল্টায়। এই পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে জিততে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ কখনওই একটা স্তরেই অনড় হায়ে থাকতে পারে না। তাত্ত্বিকভাবেই পারে না। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ তার তথ্য ও তত্ত্ব এবং কৌশলকে আরও সমৃদ্ধ করবে, ধনবাদকে পরাস্ত করার জন্যে। পাশাপাশি ধনবাদ ও তার 'মহান মিথ্যে' পালটাবে। ধনবাদের 'মস্তিস্কের যুদ্ধ'র বিরুদ্ধে 'মস্তিস্কের যুদ্ধ'ই চালাতে হবে। এ ভিন্ন জয় তো দূরের কথা, অস্তিত্ব রক্ষাও সম্ভব নয়। এসব কথা যে নির্মম সত্য, তারই উদাহরণ পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ সমাজতন্ত্রের আদর্শে প্রাণিত, দুই-তৃতীয়াংশ প্রায় হাতের মুঠোয় - এমনই স্বপ্ন দেখা মানুষদের স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে ধনবাদের 'মস্তিষ্ক যুদ্ধ'-এর সঙ্গে প্রাচীন যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে লড়তে যাওয়ার মাশুল হিসেবে। যুক্তিহীন, অন্ধ ভক্তের মতো কোনও তত্ত্বকে আঁকড়ে থাকা সেই তত্ত্বের আদর্শের প্রতি ভালোবাসা প্রমাণ করে না। তত্ত্বের আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতেই, তত্ত্বের মূল সুর বজায় রেখেও অগ্রগমনের স্বার্থে তত্ত্বকে প্রয়োজনে আরও ধারালো, আরও উজ্জ্বল, আরও কুশলী করতেই হবে। জিততে হলে করতেই হবে।

নারী মুক্তির কথা প্রসঙ্গে এঙ্গেলস্ মানুষের সাম্য, নারী-পুরুষের সাম্য প্রতিষ্ঠার পর এমন এক সমাজের কল্পনার ছবি এঁকেছেন, যেখানে একটি নারীর ভালোবাসার পুরুষটির কাছে আত্মসমর্পণে কোনও বাধা থাকবে না। এঙ্গেলস্ এখানেও কিন্তু পুরুষতন্ত্রের দ্বারাই পরিচালিত হয়েছিলেন। তাই স্বনির্বাচিত পুরুষদের কাছে নারীর 'আত্মসমর্পণ'-এর মধ্যে নারী মুক্তির সার্থকতা দেখতে পেয়েছিলেন। 'আত্মসমর্পণ' তার কাছে করবো, সেই নির্বাচনের স্বাধীনতাকেই নারীর স্বাধীনতা বলে ধরে নিয়েছিলেন।

পুরুষতান্ত্রিকতার ধ্যান-ধারণা থেকে মার্কসও যে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারেননি, তার দৃষ্টান্ত হিসাবে আপাত তুচ্ছ একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। মার্কস প্রায়ই তাঁর কন্যার সঙ্গে প্রশ্নোত্তর খেলা খেলতেন, তাতে একে অপরকে একগুচ্ছ প্রশ্ন রাখতেন। দু'জনকেই দ্রুত উত্তর দিতে হতো। মার্কসকে রাখা প্রশ্নগুলো ও মার্কসের দেওয়া উত্তরগুলো এইরকম হতো-

প্রিয় গদ্য লেখক? (-দিদেরো)

প্রিয় কবি? (-শেক্সপিয়ার, ঈস্কাইলাস, গ্যেটে)

প্রিয় রঙ? (-লাল)

প্রিয় নীতি? (-সব কিছুকে সন্দেহ করা)

সবচেয়ে ঘৃণার বিষয়? (-দাসত্ব)

এইরকম ছিল খেলার পদ্ধতি। তার মধ্যেই "নারীর কোন্ গুণটি সবচেয়ে প্রিয়?" এই প্রশ্নের উত্তরে মার্কস বলতেন- "দুর্বলতা"।

মার্কসীয় নারীবাদে পরিবার সংগঠনটির মৌলিক পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। পরিবারের সমস্ত রকম আর্থিক দায়-দায়িত্ব বহনের ভার রাষ্ট্রের। ফলে পতি-পত্নীর সম্পর্ক মালিক ও দাসীর হবে না। সাম্যবাদে এক পতি-পত্নীক পরিবার থাকবে। তবে তা থাকবে 'সামাজিক একক' হিসেবে। সাম্যবাদের বিয়েতে থাকবে না কোনও আর্থিক চুক্তি, কোনও ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেওয়ার চুক্তি, নারী-পুরুষের সম্পর্ক গড়ে উঠবে তাদের স্বাধীন ইচ্ছার উপর নির্ভর করে।

আমূল নারীবাদ

আমূল নারীবাদীরা দ্বিধাহীন ভাষায় ঘোষণা রাখলেন নারী-পুরুষ অসাম্যের মূল কারণ জৈবিক বৈষম্য। এই জৈবিক বৈষম্যের শুরু সেই আদিম যুগে, যখন পুরুষ শারীরিক পীড়ন দ্বারা নারীকে ভোগ করলো, নারীর শরীরকে নিজের অধীনে নিয়ে এলো। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত চলমান লিঙ্গ বৈষম্যের রাজনীতি। এই নারীবাদীদের মতে নারীর শারীরিক বৈশিষ্ট্যই, নারীর সন্তান ধারণের বৈশিষ্ট্যই নারীকে এই অনিবার্য পরিণতির দিকে নিয়ে এসেছে। নারীর অধীনতা যেহেতু জৈবিক কারণে, তাই নারী মুক্তির আবশ্যিক শর্ত হওয়া উচিত নারীদের জৈবিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে জৈবিক বিপ্লব। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কৃত্রিম উপায়ে মানুষের জন্মদান সম্ভব না হওয়া পর্যন্ত চূড়ান্ত জৈবিক বিপ্লব সম্ভব নয়। মানব প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র দায়িত্ব শুধুমাত্র নারীর উপর বর্তানো অমানবিক এবং এটাই নারীকে পুরুষের চেয়ে দুর্বল করে রাখার ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা নেয়, মানব প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব পুরুষেরও। নারী-পুরুষকে একত্রেই সচেষ্ট হতে হবে নারীর গর্ভকে আধার না করে মানুষের জন্ম দেওয়ার উপায় বের করতে। জৈবিক সম্পর্ক থেকে গড়ে ওঠা পরিবার লোপ পাবে কৃত্রিম জন্মের উপায় উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে। আর সেই সঙ্গেই বিলুপ্ত হবে জৈবিক বা যৌন সম্পর্কের ভিত্তিতে বাবা-মা'কে ঘিরে গড়ে ওঠা পরিবার। পরিবার প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের ঘেরাটোপে বন্দি নারীও পাবে মুক্তি। প্রতিটি নারী ও পুরুষের থাকবে পছন্দ মতো যৌন জীবন ও যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলার পূর্ণ স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার মধ্যে সুরক্ষিত থাকবে পুরুষের সঙ্গে পুরুষের, নারীর সঙ্গে নারীর যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলারও স্বাধীনতা। এই সমকামিতাও মানুষের স্বাভাবিক যৌন জীবনেরই আর এক নাম। সমকামিতাকে আইনের স্বীকৃতি দিতে হবে।

আমূল নারীবাদ সাম্য বলতে বোঝে নারী ও পুরুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমূল সাম্য। সে সাম্য প্রতিটি সুযোগ-সুবিধার সাম্য থেকে সন্তান ধারণ না করার সাম্য পর্যন্ত। আমূল নারীবাদী ভাবনার স্রষ্টা সিমোন দ্য বোভোয়ার। তাঁর লেখা 'দ্য সেকেন্ড সেক্স' আধুনিক ফেমিনিস্ট আন্দোলনের গীতা, কোরান, বাইবেল। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। এতদিনকার নারীবাদ ছিল সংস্কার, আইনের পরিবর্তন ও শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠার মতবাদ। এইসব কোনও মতবাদকে গ্রহণ বা সংশোধন না করে লিঙ্গ সম্পর্কের এক আমূল পরিবর্তনের ভাবনাকে রূপ দিলো আমূল নারীবাদ। সার্ত্রের অস্তিবাদের দর্শনের সঙ্গে বোভোয়ার-এর দর্শনের মিল লক্ষণীয়।

বোভোয়ারের আমূল নারীবাদী চিন্তাকে আরও তীব্র গতি দিতে এগিয়ে এলেন কেইট মিলেট। লিখলেন 'সেক্সুয়াল পলিটিক্স'। প্রকাশিত হলো ১৯৬৯-এ। এলেন জার্মাইন গ্রিয়ার তাঁর গ্রন্থ 'দ্য ফিলের ইউনাক' নিয়ে। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭১-এ। এলেন টাইগ্রেস অ্যাটকিনসন ও শুলমিথ ফায়ারস্টোন। এঁদের চিন্তাকে মেনে নিয়ে আমূল নারীবাদীরা জানালেন - সমাজ বৈষম্যের অবসানের জন্য লড়াই করতে হলে সে লড়াই করতে হবে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে, পুরুষ লিঙ্গবাদের বিরুদ্ধে। শোষক-শোষিতের বা কালো-সাদার লড়াই নয়, ওসব লড়াই সমাজ বৈষম্যের অবসানের ক্ষেত্রে গৌণ ভূমিকা নিতে পারে, মুখ্য নয়। তাই সমাজে সাম্যের স্বার্থেই শুরু করতে হবে লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই, মানুষের সাম্য প্রতিষ্ঠার আসল লড়াই।

আমূল নারীবাদীদের সংগ্রাম ভোগবাদ নির্ভর সংগ্রাম, মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক বৈষম্য জিইয়ে রেখে যৌনজীবন যাপনের অবাধ স্বাধীনতা লাভের সংগ্রাম। এই নারীবাদ পুঁজিবাদী বিকৃতিরই স্বরূপ। এই সমকাম ও যৌন যথেচ্ছাচার কোনওভাবেই ধনী-গরিবে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। শোষণমুক্ত সুন্দর সমাজ গড়তে পারবে না। মানুষের প্রগতির চিন্তা, মুক্তির চিন্তা বিকৃত যৌন ভোগবাদের মুঠোবন্দি হবেই। এই নারীবাদ কখনই সামগ্রিকভাবে সমাজের কল্যাণ সাধন করতে পারে না।

সমকামী নারীবাদ

আমূল নারীবাদের সঙ্গে সমকামী নারীবাদের পার্থক্য এই - আমূল নারীবাদীরা মনে করে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন। তবে পুরুষ আধিপত্য শেষ করতে নারীদের পুরুষের সঙ্গে কোনও যৌন সম্পর্ক স্থাপন উচিত নয়। নারীর যৌনসঙ্গী হবে নারী। পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ার অর্থ পুরুষের যৌন পীড়নকে মেনে নেওয়া, পুরুষের আধিপত্যকে মেনে নেওয়া। সমকামিতাই হলো নারী মুক্তির একমাত্র পথ।

এই নারীবাদীদের মধ্যে আবার একটি মত আছে - সমকামিতা প্রায় সব যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হলেও সন্তানের জন্ম দিতে ইচ্ছুক নারী সাময়িকভাবে পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।

আর এক দলের মতে - সমকামিতাই হবে নারী মুক্তির জন্য নারীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী ব্যবস্থা।

আমূল নারীবাদ ও সমকামী নারীবাদ, এই দুই নারীবাদ সম্পর্কে আরও দুই-একটি কথা বলার দরকার আছে।

এক: এটা খুবই স্পষ্ট যে, এই দুই নারীবাদ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নারীবাদের উগ্রতর, অথচ স্বাভাবিক পরিণতি মাত্র।

দুই: কিছু আগে 'মূল্যবোধ' প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনায় বিভিন্ন বাণিজ্যিক পত্র-পত্রিকায় নারীবাদের আকস্মিক ও ব্যাপক প্রচারের পিছনে যে গোপন ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা করেছি, সেগুলোকে আমূল নারীবাদী ও সমকামী নারীবাদী আন্দোলনের আলোকে দেখলে নতুন তাৎপর্য বেরিয়ে আসে। সামগ্রিক শোষণ মুক্তির লড়াইকে চাপা দেওয়ার জন্য যে উগ্র পুরুষবিদ্বেষী নারীবাদ পাশ্চাত্যে চলছে, তাকে সরাসরি গলাধঃকরণ করতে ভারতীয় জনগণ এখনও মানসিকভাবে প্রস্তুত নয় বলেই তাকে একটু 'টোন ডাউন' বা নরম করে ভারতীয় বাজারে ছড়াতে চাইছে এখানকার শোষক-শাসক ও বুদ্ধিজীবীদের আঁতাত।

মানবতাবাদী নারীবাদ

মানুষের সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৌঁছতে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অতি প্রয়োজনীয় গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে তৈরি হয়েছিল ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি, সংক্ষেপে যুক্তিবাদী সমিতি বা র‍্যাশনালিস্টস্ অ্যাসোসিয়েশন। দিনটা ছিল ১ মার্চ, ১৯৮৫। অসাম্যের সমাজ কাঠামো টিকে আছে জনগণের মগজ ধোলাই করে, নানাভাবে মগজ ধোলাই করে। এই সমাজ কাঠামো টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রশক্তি কোথাও গুরুত্ব দিয়েছে ভোগবাদকে, কোথাও ভাববাদকে। সাম্যে পৌঁছতে প্রথমেই যা প্রয়োজন, তা হলো অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে বজায় রাখতে যেসব উপায়ে সাধারণের মগজ ধোলাই করা হচ্ছে, সেগুলোর বিষয়ে সাধারণকে অবহিত করানো। যুক্তিবাদীরা দ্বিধাহীনভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল বিপ্লবের আগে, বিপ্লবের সময়, বিপ্লবের পরে প্রতিটি অবস্থাতেই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কোনও বিকল্প নেই। এই সাম্য মানুষে মানুষে সাম্য, নারী-পুরুষে সাম্য। অসাম্যের কারণেই শোষণ। কিন্তু নারী শোষিত মানুষদের দ্বারাও অবদমিত। নারী-পুরুষের সাম্য আনতে সামগ্রিকভাবে সমাজে সাম্যের কাঠামো তৈরি করতে হবে, এটা আমরা মনে করি। কিন্তু এই সামগ্রিক সাম্য শুধুমাত্র শ্রমিকদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা দখলের পথ ধরে নাও আসতে পারে। লাগাতার সাংস্কৃতিক আন্দোলন না থাকলে; কুসংস্কারমুক্ত, সাম্য চিন্তা করতে পারার মতো স্বচ্ছতা না থাকলে শ্রমিকশ্রেণির ক্ষমতা দখলের পরও নারী-পুরুষে বৈষম্য থাকতে পারে। এতদিনকার নারী-পুরুষ সম্পর্কের সংস্কারের সূত্র ধরে, ঐতিহ্যের সূত্র ধরেই থাকতে পারে। আমাদের ইতিহাস শিক্ষা দিয়েছে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অনুপস্থিতির কারণে কীভাবে স্বজনপোষণ, দুর্নীতি, অসাম্য, শ্রমিক শ্রেণির অনেক রক্ত ঝরানো জয়কে অর্থহীন করে দিয়ে আবার অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে বরণ করা হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি সমাজে সাম্যের কাঠামো প্রতিষ্ঠাই মানুষের চূড়ান্ত মুক্তির পূর্বশর্ত, তাই সেই পূর্বশর্ত নারীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা বিশ্বাস করি সমাজে নারী মুক্তিকে বাস্তবায়িত করতে সেই নারী মুক্তি সম্বন্ধে সচেতন করার কাজ শুরু করতে হবে এখন থেকেই। এই নারী মুক্তির লক্ষ্যকে সামনে রেখেই যুক্তিবাদী সমিতি তাদের একটা 'উইং' খুলতে চাইলো। স্বয়ং পরিচালিত হয়ে এই উইংয়ের কাজ হবে সামগ্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের থেকে কয়েকটি বিষয়কে নিজের কাজের ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নিয়ে সেই সেই ক্ষেত্রে জনচেতনাকে উদ্বুদ্ধ করা।

১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৩ গঠিত হলো যুক্তিবাদী সমিতির সেই কাঙ্ক্ষিত 'উইং' - 'হিউম্যানিস্টস্ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া' বা 'ভারতের মানবতাবাদী সমিতি'। এই সমিতির অন্যতম মূল লক্ষ্য হলো, নারী-পুরুষ বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনমানসকে সংগঠিত করা। মানবতাবাদী নারীবাদের আদর্শে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা। 'মানবতাবাদী নারীবাদ' মনে করে পতি-পত্নী দু'জনেই মানুষ, তাই তাদের সম্পর্ক হোক মানবিক; মালিক-দাসীর নয়। যৌন সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাক পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্ব। মানবতাবাদী নারীবাদ মনে করে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক গড়ে উঠবে নীতিশাস্ত্রের উপর নির্ভর করে নয়; মানবিকভাবে, পারস্পরিক ভালোবাসা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার মধ্য দিয়ে। নীতিশাস্ত্রের ঝোঁকটা বড় বেশি রকমের নেতিবাচক। কী কী করা উচিত নয়, তার একগাদা ফিরিস্তি। নীতিশাস্ত্রের স্থান নিক আদর্শ, সকলের সঙ্গে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার আদর্শ। তাই এই মানবতাবাদী নারীবাদে আত্মত্যাগের মাহাত্ম্য, অবদমনের মাহাত্ম্য, ব্রহ্মচর্যের মাহাত্ম্য, দুঃখবরণের মাহাত্ম্য স্থান পায়নি। সন্তানের জন্য আত্মত্যাগ? স্বামীর জন্য আত্মত্যাগ, কষ্টস্বীকার? দুঃখ বরণের মধ্য দিয়ে পরিবারের অন্যান্যদের খুশি ভাগ করে দেওয়ার কাহিনি? এসবই মর্ষকামী সুখের কথা, জীবনকে সংকীর্ণ করে দেখার কথা। মানবতাবাদী নারীবাদের মূল কথার সঙ্গে, যুক্তিবাদী দর্শনের মূল আদর্শের সঙ্গে এই মর্ষকামী সুখের কথা এক্কেবারেই মানায় না। এই পৃথিবী মানুষেরই পৃথিবী। মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের অসাধারণ উন্নতির সাহায্যে মরুতেও সবুজের বান ডাকিয়েছে। বানভাসিকে রুখেছে বাঁধে। কি শিল্পে, কি খেতে, সর্বত্রই উৎপাদন বেড়েই চলেছে। অসাধারণ শক্তিতে বেড়ে চলেছে। মানুষের সামনে অফুরন্ত শিল্প সামগ্রী, অফুরন্ত ফসল, সমৃদ্ধির হাতছানি। সমস্যাটা উৎপাদন বন্টনের। বন্টনে সাম্য এলে দারিদ্র কোথায়? শুধুই প্রাচুর্য। এমন উজ্জ্বল প্রাচুর্যের জীবনই তো সাম্যের জীবন। এই সাম্যের আনন্দ উৎসবে ত্যাগের মধ্যে সুখের খোঁজ করা মর্ষকামী মানুষদের ঠাঁই কোথায়? মানুষের সাম্যে বিশ্বাসী মানবতাবাদী নারীবাদীদের, যুক্তিবাদীদের বিপ্লবও তো উৎসব। নিজ রক্তপাতের মধ্যে ত্যাগ কোথায়? এও তো প্রাণ নিয়ে হোলি খেলার উৎসব। সাম্য প্রতিষ্ঠার পদধ্বনি শোনার উৎসব। মানবতাবাদী নারীবাদ যুক্তিবাদেরই আর এক পিঠ - সেই যুক্তিবাদ, যার সাহায্যে আমরা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে পালটাতে পালটাতে বুঝি, আর বুঝতে বুঝতে পালটাই। তাই নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক বৈচিত্রের মাঝে সাম্যের সুন্দর সমাজ গড়ার সর্বশেষ দিশা দিতে পারে একমাত্র সর্বকালের আধুনিক নারীবাদ; মানবতাবাদী নারীবাদ।....

Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]