প্রবীর ঘোষের চোখে যৌনতা [পর্ব-পাঁচ]
নারী মানুষ হিসেবেই জন্ম নেয়। কিন্তু বর্তমান পুরুষতন্ত্র তাকে একটু একটু করে শুধুমাত্র 'নারী'তে রূপান্তরিত করে। পুরুষতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষাকারী মূল্যবোধ দ্বারা নারীকে আচ্ছন্ন করতে সংস্কৃতির শাখা-প্রশাখায় বিপুল আয়োজন। এই আয়োজন শ্রেণি বিভক্ত সমাজেরই ফলশ্রুতি। যখন সমাজে 'শোষক' আসেনি, 'শোষিত' আসেনি, সমাজ শোষক-শোষিত শ্রেণিতে বিভক্ত হয়নি, তখন সেই আদিম শ্রেণিহীন সমাজে নারী-পুরুষ সমান মর্যাদা পেতো। কেন পেতো? আজকের সমাজে কেন পায় না? কী পরিস্থিতিতে পেতো? কী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পায় না? নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে সমমর্যাদা স্থাপন করতে চাইলে নারী-সম্পর্কের বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে ছোট্ট একটু আলোচনা সেরে নেওয়া বোধহয় খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
বন্য যুগের শুরুতে মানুষ পশুর থেকে নিজেকে পৃথক করেছে দু-পায়ে ভর দিয়ে হেঁটে, হাতিয়ার তৈরি করে। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাবারটুকু জোগাড় করতে শুধু সকাল থেকে সন্ধে পরিশ্রমই শেষ কথা ছিল না, প্রকৃতির উপর নির্ভর করতে হতো, প্রকৃতির মুখ চেয়ে থাকতে হতো। বুনো ফলমূল ও শিকার, শুধু শ্রম দিলেই প্রয়োজনমতো মিলতো না। একসময় শিকার করতে মানুষ দল বাঁধলো। উচ্চারণ করতে শিখলো নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের তাগিদে। আগুনের ব্যবহার শিখলো। দলবদ্ধ শিকারে যা মিলতো, দলের সকলে মিলে তাই ভাগ করে খেতো। শিকার থেকে খাওয়া, সারা দিনের সংগ্রামে দলের সবাই মিলেই সাধ্যমতো খাটতো। কোনও ব্যক্তিরই ছিল না বাড়তি গুরুত্ব। সবাই সমান। ধনী-গরিব, হুজুর-মজুর সম্পর্কহীন এই আদিম সমাজে সমস্ত মানুষেরই ছিল সাম্য। সে সামা ছিল অভাবের সাম্য, নারী-পুরুষের সাম্য, যৌন জীবনের সাম্য। যৌন সম্পর্কটা ছিল দলগত যৌন সম্পর্ক। দলগত পুরুষের সঙ্গে দলগত নারীর যৌন সম্পর্ক। শুধুমাত্র একটি পুরুষের সঙ্গে একটি নারীর যৌন সম্পর্ক নয়। দলের একটি পুরুষের সঙ্গে প্রতিটি নারীর যৌন সম্পর্ক, একটি নারীর সঙ্গে প্রতিটি পুরুষের যৌন সম্পর্ক। সভ্য সমাজের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় দলের প্রত্যেকটি পুরুষের ছিল বহু পত্নী এবং প্রতিটি নারীর ছিল বহু পতি। সে যুগের অবাধ মুক্ত যৌন সম্পর্কের মধ্যে এক লিঙ্গ দ্বারা অন্য লিঙ্গ শ্রেণিকে ভোগ্যপণ্য করার প্রয়াস ছিল না, অবদমিত রাখার প্রচেষ্টা ছিল না, সম্পত্তি করার জন্য ইচ্ছে ছিল না। সময় এগিয়েছে। আদিম মানুষের সমাজও এগিয়েছে। দূর থেকে শিকার করতে বানিয়েছে তির-ধনুক, ভল্ল। বানিয়েছে মাটির বাসনপত্র। বানিয়েছে মাটি দিয়ে বা পাথর সাজিয়ে বাসস্থান। পশুদের বশ করেছে। পালন করেছে। শিখেছে চাষ করতে। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে পুরনো হাতিয়ারকে নতুন চেহারা দিয়েছে। শিখেছে ধাতুর ব্যবহার। মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েছে। এইসময় মানুষের হাতের মুঠোয় এসেছে বেঁচে থাকার প্রয়োজন মিটিয়ে বাড়তি উৎপাদনের ক্ষমতা। গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের জীবনে এসেছে সচ্ছলতা। বাড়তি উৎপাদন সৃষ্টি করেছে সম্পত্তি। এক গোষ্ঠী বেঁচে থাকার প্রয়োজনে অথবা সম্পত্তি বাড়াবার ইচ্ছেয় অন্য গোষ্ঠীর উপর আক্রমণ চালিয়ে পশু হরণ করতে শুরু করেছে, হরণ করেছে অন্যের সঞ্চিত ধন। গোষ্ঠীর জনসম্পত্তি রক্ষার্থে শক্তিমান ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে গোষ্ঠীর নেতা করা হয়েছে। একসময় শক্তিমান হয়েছে শাসক। বুদ্ধিমান হয়েছে রাজার পরামর্শদাতা, ধর্মীয় অনুশাসনের স্রষ্টা। এই দুই নেতাকে ঘিরে রেখেছে গোষ্ঠীর আরও কিছু শক্তিমান ও বুদ্ধিমান মানুষ। এইসব নেতাকে ঘিরে থাকা মানুষরা নিজেরা শ্রম বিনিয়োগ না করে অন্যের শ্রম থেকে উৎপাদিত জিনিসের উপর ভাগ বসাতে লাগলো। শ্রম দানকারীদের উৎপাদনে থাবা বসিয়ে এরা শ্রমিকদের তুলনায় নিজেদের সচ্ছলতাকে বৃদ্ধি করলো। শ্রমিকদের এই শ্রম আত্মসাতের সূচনার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো শোষণেরও সূচনা। আদিম সাম্য ভেঙে সৃষ্টি হলো দু'টি শ্রেণি - শোষিত ও শোষক। উৎপাদন শক্তির অগ্রগতির সূত্র ধরে, সমাজ অগ্রগতির সূত্র ধরে যে শ্রেণি বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছিল গোষ্ঠী সৃষ্টির উষা লগ্নে, আজ এই বিংশ শতাব্দীর অন্তিম লগ্নে পৌঁছে মানুষের সমাজের সেদিনের তুলনায় অবিশ্বাস্য অগ্রগতি সত্ত্বেও শ্রেণিবৈষম্য আজও বর্তমান। শ্রেণি বিভক্ত সমাজের উপস্থিতির জন্যই বর্তমান। তাই উৎপাদন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের অসামান্য উন্নতি সত্ত্বেও এই সমাজে একই সঙ্গে অবস্থান করে আমেরিকা, ইউরোপ কি আমিরশাহির সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো মানুষগুলোর পাশাপাশি সোমালিয়া, কালাহান্ডির কঙ্কালরা।
দলগত যৌন জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে গোষ্ঠী জীবনে আপন ভাই-বোন ও জ্ঞাতি সম্পর্কিত অর্থাৎ মামাতো, মাসতুতো, পিসতুতো, খুড়তুতো ভাই-বোনদের মধ্যে যৌথ বিবাহ বা যৌথ যৌন সম্পর্ক প্রথা চালু হয়। কখনও একদল জ্ঞাতি সম্পর্কিত ভাইয়ের বিয়ে হতো একদল নারীদের সঙ্গে। এক ভাইয়ের প্রতিটি ভ্রাতৃবধূ হতো পত্নী। এবং একটি পত্নীর প্রতিটি ভাইই হতো পতি। এদের সন্তানরা মায়ের প্রতিটি পতিকেই বাবা বলতো। এবং বাবার প্রতিটি পত্নীকেই বলতো মা। এই দলগত বিয়ে বা যৌন সম্পর্কের সময় সন্তানের মা-বাবার মধ্যে একমাত্র মাকেই চিহ্নিত করা বা সুনিশ্চিত করা সম্ভব ছিল। তাই মাতৃসত্তার ছিল বাড়তি কিছু গৌরবময় ভূমিকা। না, একে আমি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা বলে চিহ্নিত করলাম না। কারণ সে যুগে তখনও কোনও তান্ত্রিকতাই মাথাচাড়া দেয়নি। না মাতৃতান্ত্রিকতা, না পিতৃতান্ত্রিকতা। মাতৃসত্তা বলতে অবশ্য সম্পত্তির উত্তরাধিকারের কথাটা বাদ দিয়ে মাতৃ প্রাধান্যের কথা বোঝাতে চাইছি। কারণ তখনও 'ব্যক্তিগত সম্পত্তি' সৃষ্টি হয়নি অথবা ব্যাপ্তি পায়নি। তাই সম্পত্তির উত্তরাধিকারের কথাটাও তখন অপ্রয়োজনীয়। এই সময়কার সমাজে শ্রমের মর্যাদায় নারী-পুরুষে তফাত দেখা হতো না, যদিও নারী-পুরুষে তখন কাজের ধরনে পার্থক্য দেখা দিয়েছে। খাদ্য সংগ্রহের তাগিদে কৃষিকাজ শিখেছে। পশুপালন শিখেছে। পরিধেয় তৈরি করতে শিখেছে। তৈরি করেছে সংসারের প্রয়োজনীয় বাসন, আসবাব। নারী ও পুরুষ উভয়ের শ্রমই সমান মর্যাদা পেয়েছে।
সময় এগিয়েই চললো। উৎপাদনের উন্নতির জন্য নানা উপায় আবিষ্কৃত হতে লাগলো। নিজেদের টিকে থাকার প্রয়োজনে, নিজেদের গোষ্ঠী বাড়াবার প্রয়োজনে, কৃষিকাজ ও পশু পালনে মানুষকে নিয়োজিত করে বাড়তি উৎপাদনের প্রয়োজনে, বিশাল পরিবার দ্বারা গোষ্ঠীতে নিজের প্রভাব বৃদ্ধির প্রয়োজনে মানুষের সরবরাহ জরুরি হয়ে পড়লো। স্বভাবতই 'শত পুত্রের জননী' হওয়াটা সে সময়কার সমাজের কাছে নারীর মহৎ কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হলো। এমনটা হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। এখনকার তুলনায় তখন মৃত্যু হারও ছিল খুবই বেশি। অসুখ, বন্য জন্তর আক্রমণ, বন্যা, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে মানুষ ছিল অনেক বেশি অসহায়। তারই পরিণতিতে মানুষ সংখ্যা বৃদ্ধির উপায় হিসেবে ধীরে ধীরে তৈরি করলো মানুষের জন্য আলাদা নিয়ম। এই নিয়মের ঘেরাটোপের মধ্যে নারী বছর বছর সন্তান উৎপাদনের দায়িত্ব পালন করতে লাগলো। সেই সঙ্গে এসে পড়লো সন্তান পালনের দায়িত্বও। বয়সের ভারে জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা হারালে পুত্র-কন্যা, নাতি-নাতনিদের পালনের মধ্য দিয়েই তারা সমাজের এক দায়িত্ব পালন করতে লাগলো - মানবপ্রজাতি সৃষ্টির দায়িত্ব।
এমন বক্তব্যের সমর্থন মিলবে প্রাচীন মন্দির গাত্রে। আপনি, আমি, অনেকেই জানি কোনারক, পুরী, ভুবনেশ্বর, খাজুরাহো মন্দিরের গায়ে খোদিত মিথুন মূর্তির কথা। কিন্তু এই চার মন্দিরের মধ্যে মিথুন মূর্তি সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে আছে মহারাষ্ট্রের ইলোরা মন্দিরে, কর্নাটকের হরশৈলেশ্বর মন্দিরে, বারাণসীর নেপালি মন্দিরে, হাওড়া ও উত্তর-দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বহু মন্দিরে। মন্দিরে এত বিপুল মিথুন মূর্তি তৈরির কী কারণ থাকতে পারে? এ নিয়ে একটু আলোচনায় যাই, আসুন। ঋগ্বেদ থেকে শুরু করে সেই সময়কার কাছাকাছি পরবর্তী সাহিত্য পড়লে বুঝতে পারা যায় সেই সময়কার সমাজে মানুষ সৃষ্টিই ছিল সবচেয়ে বড় ধর্ম। তারই পরিণতিতে ধর্মস্থানগুলোতে সৃষ্টির প্রতীক হিসেবেই এসেছে মিথুন দৃশ্য।
উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন কাজে নিযুক্ত পুরুষদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বাড়তে লাগলো। এই ক্ষমতাই নারী-পুরুষের শ্রমের মর্যাদার সাম্যে আঘাত হানলো। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করলো পুরুষ প্রাধান্য। উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতি মানুষের সঙ্গে মানুষের পূর্ব সম্পর্কই দিলো পালটে। শুরু হলো ক্রীতদাস প্রথা। শত্রুদের বন্দি করে পশু পালন ও কৃষিকাজে নিয়োজিত করা শুরু হলো। নিয়োজিত করতে লাগলো গোষ্ঠীপ্রভু, তাদের সেনানায়করা ও পুরোহিতরা। সম্পদ বাড়লো। সম্পদ পরিবর্তিত হলো সম্পত্তিতে। পুরুষ চাইলো সম্পত্তির উত্তরাধিকার বর্তাক পিতৃত্বের সূত্র ধরে। শুরু হলো এক পতি ভিত্তিক বিবাহ। কারণ, একজন পতি থাকলে যে পত্নীই সন্তান উৎপাদন করুক বাবাকে চিহ্নিত করা যাবে। সম্পত্তির মধ্যে নিহিত রয়েছে এক পতি ভিত্তিক বিবাহ। এক বিবাহ প্রচলনের আগেই বহু গোষ্ঠীর মধ্যেই দলগত যৌন সম্পর্কের মধ্যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছিল। নির্বিচার যৌন সম্পর্কের মধ্যে এলো নতুন মূল্যবোধ। প্রথম দফায় পিতা-কন্যা এবং মাতা-পুত্রের মধ্যে যৌন সম্পর্ক নিষিদ্ধ হলো। দ্বিতীয় স্তরে নিষিদ্ধ হলো ভাই-বোনের মধ্যে যৌন সম্পর্ক।
সমাজ বিবর্তনের এসব কথা জানতে পারা যায় বহু নৃতত্ত্ববিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীদের লেখা থেকেই। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে লুইস হেনরি মর্গানের 'এনসিয়েন্ট সোসাইটি' প্রকাশের পর থেকেই নৃতত্ত্ব বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ইতিহাসের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর বহু তথ্য প্রকাশিত হতে থাকে। ফলে তার আগেকার প্রচলিত অনেক ধ্যান-ধারণাই ওলট-পালট হয়ে যেতে থাকে। আমরা জেনেছি আদিম সমাজ থেকে বর্তমান সমাজে উত্তরণ ইতিহাস। এইসব ধারণা শুধুমাত্র অনুমান নির্ভর ছিল না। অসংখ্য জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচার-আচরণ বিশ্লেষণ করে প্রমাণ নির্ভর করে তুলেছিলেন নৃতত্ত্ববিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা। এই প্রমাণ নির্ভর বিশ্লেষণের নির্যাসটুকু এখানে হাজির করলাম।
এমন সমাজ চিত্র ভারতবর্ষে আর্য সমাজেও যে প্রচলিত ছিল তার হদিশ মিলবে বহু হিন্দু ধর্মগ্রন্থেই। মৎস্য পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ এবং ঐতরেয় ব্রাহ্মণে আছে ব্রহ্মার সঙ্গে তার কন্যার যৌন সম্পর্ক স্থাপনের কথা, তাকে বিয়ে করার কথা। হিন্দুদের প্রাচীন পুঁথি হরিবংশে আছে প্রজাপতি কন্যা শতরূপাকে প্রজাপতিই বিয়ে করে। জহ্নু বিয়ে করে কন্যা জাহ্নবীকে। মনু বিয়ে করে কন্যা ইলাকে। পিতা-কন্যার এইসব যৌন সম্পর্ককে সম্পূর্ণ টেক্কা মারে প্রচেতা। হরিবংশের এই কাহিনিতে আছে প্রচেতা নামে পরিচিত দশ ভাই মিলে এক পুত্রের জন্ম দেয়। দশ পিতার এই পুত্রের নাম সোম। সোমের বিবাহের পর এক কন্যার জন্ম হয়। নাম মরিশা। মরিশার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে পিতা সোম এবং দশ ঠাকুরদা। এই দশ ঠাকুরদা ও পিতারই সন্তান দক্ষ-প্রজাপতি। সেকালে যেহেতু নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কের প্রতিটি অধিকারীই নারীর সন্তানের পিতা হতো, তাই দক্ষ-প্রজাপতিরও এগারো পিতাকে আমরা পেলাম। দক্ষ-প্রজাপতির বিয়ের পর তিনি সাতাশটি কন্যার জনক হন। এবং দক্ষ-প্রজাপতির ওই সাতাশ জন কন্যার সঙ্গেই কন্যাদের ঠাকুরদা সোম যৌন সম্পর্ক তৈরি করলেন।
ঐতরেয় ব্রাহ্মণে পাই - প্রজাপতির পুত্র সোমের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলে সোমের বীর্যে সন্তান ধারণের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিলেন সোমের আপন বোন সীতাসাবিত্রী। সোম আবার তার অপর বোন শ্রদ্ধার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী হওয়ায় সীতাসাবিত্রী বাবার কাছেই নিজের তীব্র কামনার কথা ব্যক্ত করলেন। বাবা মেয়ের কামনাকে জয়যুক্ত করতে বশীকরণ মাদুলি দিলেন। সীতাসাবিত্রী ভাইয়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলে তাঁর যৌন আকাঙ্ক্ষাকে পরিতৃপ্ত করলেন।
ঋগ্বেদে দেখতে পাই দম্ভ নিজ বোন মায়াকে, লোভ নিজ বোন নিবৃত্তিকে, ক্রোধ নিজ বোন হিংসাকে ও কলি নিজ বোন নিরুক্তিকে বিয়ে করছে।
দশরথ জাতকে আছে দশরথ ছিলেন কোশল বংশের নৃপতি। কৌশল্যা ছিলেন কোশলপতি দশরথের বোন।
ভাই-বোনে বিবাহ প্রাচীন ভারতে প্রচলিত ছিল। তার বহু উল্লেখ বৌদ্ধ জাতক কাহিনি ও জৈন সাহিত্যে রয়েছে। 'মহাবস্তু' নামের বৌদ্ধ গ্রন্থে রয়েছে, রাজা ইক্ষাকুর প্রধানা মহিষীর গর্ভে পাঁচ ছেলে ও চার মেয়ের জন্ম দেন। প্রধানা মহিষীর মৃত্যুর পর রাজা এক যুবতীকে বিয়ে করেন। যুবতীর প্ররোচনায় রাজা তাঁর পাঁচ ছেলে ও চার মেয়েকে নির্বাসিত করেন। কপিলমুনি তাদের একটি নগর স্থাপন করে বসবাস করতে পরামর্শ দেন। এই নগরের নামই কপিলাবস্তু। বড় ভাই অকৃতদার রইলেন। বাকি চার ভাই বিয়ে করলো তাদের আপন চার বোনকে।
বৌদ্ধ সাহিত্যের আর এক কাহিনি 'পরমথজ্যোতিকা'। বারাণসীর রাজার প্রধানা মহিষী প্রসব করেন একটি মাংসপিণ্ড। ওই মাংসপিন্ডকে পেটিকায় ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেন মহিষী। এক মুনি উদ্ধার করেন পেটিকা। মাংসপিণ্ড থেকে জন্ম নেয় একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। এই দুই ভাই-বোন পরে নিজেদের বিবাহ করে, যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। স্থাপন করে বৈশালী রাজ্য।
পরবর্তীকালে পিতা-কন্যার যৌন সম্পর্ক যে নিন্দনীয় হয়েছিল তারও হদিশ মেলে যখন দেখি প্রজাপতি ও তার কন্যা উষা হরিণের রূপ নেন তীব্র কামনা চরিতার্থ করার আগে। হরিণের রূপ নেওয়ার কারণ, পাছে বাবা-মেয়ের সংগম দৃশ্য দেখে দেবতারা ক্রুদ্ধ হন।
ঋগ্বেদে দেখি যমী তার যমজ ভ্রাতার সংগম কামনায় উদ্বেল। যমী যমকে বলছেন - "তোমার সঙ্গে মৈথুনে আমি অভিলাষিণী। তোমাকেই যৌনসঙ্গী চাই, কারণ গর্ভাবস্থা অবধি তুমি আমার সহচর। বিধাতার ইচ্ছে তোমার ঔরসে আমার গর্ভে আমার পিতার নাতির জন্ম হবে।"
যম নীতির প্রশ্ন তুলেছেন, নতুন মূল্যবোধ থেকে সৃষ্ট নীতির প্রশ্ন - "যেহেতু তুমি আমার ভগিনী, তুমি আমার অগম্যা।" যমী বলেছেন - "এই ভাই-বোনের যৌন সম্পর্ক মানুষের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ হয়েছে, দেবতাদের ক্ষেত্রে নয়। দেবতারা ভাইবোনে এ প্রকার সংসর্গ ইচ্ছে পূর্বক করে থাকেন। অতএব আমার যেমন ইচ্ছে হচ্ছে, তুমিও তেমন ইচ্ছে প্রকাশ করো। তুমি আমার প্রতি কামনাযুক্ত হও। এসো আমরা এক সঙ্গে শুই। তারপর পত্নী যেমন পতিকে দেহ সমর্পণ করে, আমি সেইরকম তোমার কাছে আমার দেহ সমর্পণ করি।"
পতি-পত্নী ভিন্ন নিকট আত্মীয়দের মধ্যে যৌন সম্পর্ককে 'অজাচার' এবং পতি-পত্নী নিজেদের মধ্যে ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে আমাদের বর্তমান সমাজ তাকে বলে 'ব্যভিচার'। প্রাচীন ভারতে অতিথির সঙ্গে গৃহবধূর সংগমে রত হওয়া ব্যভিচার বলে গণ্য হতো না। এর ভুরি-ভূরি উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে ভারতের প্রাচীন সাহিত্যগুলোতে। দু'একটি এখানে টেনে আনাই যায়। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে সুদর্শন ও ওঘাবতী'র কাহিনি এমনই এক দৃষ্টান্ত। সুদর্শন ধর্মপরায়ণ। পত্নী ওঘাবতীকে উপদেশ দিয়েছেন গৃহে অতিথির পদার্পণ ঘটলে তার সেবা করতে। অতিথি চাইলে নিজ দেহকেও যেন সমর্পণ করে। একবার যমরাজ এলেন ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে। ওঘাবতীর সংগম কামনা করলেন তিনি। ওঘাবতী অতিথিকে সংগমে তৃপ্ত করতে ব্যস্ত, তখন সুদর্শন ঘরে ফিরে ওঘাবতীকে বারবার ডাকতে থাকেন। সঙ্গম শেষে ব্রাহ্মণ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জানান, ওঘাবতী তাঁর কামনা মেটাতে ব্যস্ত ছিলেন। ওঘাবতীর অতিথিপরায়ণতায় সুদর্শন খুবই প্রীত হন।
মহাভারতের আদিপর্বে উদ্দালক ও শ্বেতকেতুর কাহিনিতে পাই, বালক শ্বেতকেতু দেখে এক পথিক তার মায়ের রূপে মোহিত হয়ে সংগম প্রার্থনা করে। মাকে পথিকের প্রার্থনা পূরণে সচেতন হতে দেখে শ্বেতকেতু পিতা উদ্দালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মুনি উদ্দালক বলেন - "নারীরা গাভীর মতোই। সহস্র পুরুষে উপগত হলেও তাদের অধর্ম হয় না।"
মহাভারত রচনাকালে এদেশের সমাজে অতিথিদের ভোগে পত্নীর নিয়োগ গৌরব বই অগৌরবের ছিল না। শুধু ভারতের ক্ষেত্রে নয়। গোটা পৃথিবীর আদিম সমাজের নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্কটা ছিল বর্তমানের তুলনায় অন্য রকম।
গ্রিক প্রাচীন সাহিত্যেও অজাচারের বহু কাহিনি ছড়িয়ে রয়েছে। গ্রিকদের সবচেয়ে বিখ্যাত দুই দেব-দেবী জ্যুস ও ডিমিত্রাস। এঁরা দুজনে ভাই-বোন। এঁদের মিলনে জন্ম হয়েছিল কৃষি দেবী পারসিফোনের। গ্রিক পুরাণে পাই ইডিপাস তাঁর জন্মদাত্রী মাকে বিয়ে করেছিলেন। এবং মায়ের গর্ভে ইডিপাসের ঔরসে চারটি সন্তানের জন্ম হয়েছিল।
প্রথম শতাব্দীর গোড়ায় পার্থিয়ান রাজা ফ্যাটিসিস তাঁর মা মুসা'কে বিয়ে করেছিলেন। প্রথম খ্রিস্টপূর্বাব্দের শেষভাগে আর্মেনিয়ান রাজা টিগ্রানেস তাঁর বোনকে বিয়ে করেছিলেন।
ভারতের আদিবাসী সমাজে আজও অনেক রকম বিবাহ সম্পর্ক ও যৌন সম্পর্ক প্রচলিত আছে যা আমাদের বর্তমান চোখে অজাচার মনে হতেই পারে।
আসামের গারো সম্প্রদায়ের মধ্যে বিধবা শাশুড়িকে জামাইয়ের বিয়ে করার প্রথা চালু আছে। বাগনী, ডাফলা ও লাখের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিমাতাকে পুত্রের বিবাহ করার প্রথা আজও চলমান। দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত আছে মামা-ভাগনির মধ্যে বিয়ে। ইসলাম ধর্মের বিধান অনুসারে অনায়াসে বিয়ে করা যায় মামার ছেলে, কাকার ছেলে, মাসির ছেলে, পিসির ছেলেকে। তালাক দেওয়ার পর নিকা করা যায় ভাশুর বা দেওরকে।
আজও মধ্যপ্রদেশের সাথিয়া উপজাতির মধ্যে ঋণের জামিন হিসেবে পাওনাদারের কাছে ঋণগ্রহীতা বন্ধক রাখে পত্নী, কন্যা বা অন্য কোনও আত্মীয়াকে। ঋণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত গচ্ছিত নারীকে শারীরিকভাবে ভোগ করার পরিপূর্ণ অধিকার থাকে পাওনাদারের।
ছড়িয়ে দেওয়া আলোচনাকে এবার বরং গুটিয়ে নিয়ে আসি, আসুন। আদিম বন্য যুগ, বর্বর যুগ এবং আর্য সমাজের যৌন জীবনের সঙ্গে পরিচিত হলেন আপনারা। বন্য অবস্থার উন্নতি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে দলগত যৌন সম্পর্কেরও পরিবর্তন হতে লাগলো। সমাজ প্রথমেই মা-বাবার সঙ্গে ছেলে-মেয়ের যৌন সম্পর্ক লজ্জাকর, বর্জনীয় মনে করলো। পরের ধাপেই ভাই-বোনের যৌন সম্পর্ককে অজাচার মনে করলো সমাজ। এই দুই পর্যায়ের সম্পর্ক বর্জন করার পর আদিম সমাজের যৌন জীবনে সম্পর্ক গড়ে উঠলো একদল পুরুষের সঙ্গে একদল নারীর। প্রত্যেকটি পুরুষের পত্নী দলের সব মেয়েরাই। প্রত্যেকটি নারীর পতি সব পুরুষেরাই। বাদ শুধু ভাই-বোন ও মা-বাবা। আদিম যুগের দলগত বিয়ে, দলগত যৌন সম্পর্কের সময় পেরিয়ে বর্তমান যুগের এক পতি বিয়ের প্রচলন হতে বহু সময়, বহু সহস্র বছর কেটে গেছে। সম্পত্তির উৎপত্তি, সম্পত্তি ও উৎপাদনে পুরুষের মালিকানা, পুরুষের প্রাধান্য সমাজে যত স্পষ্টতর হয়েছে ততই এক পতির বিয়ের ভিত্তিতে পরিবারের প্রচলন ব্যাপ্তি পেয়েছে। পুরুষের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পুরুষ তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারীকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করতে যে এক পতি ভিত্তিক পরিবারের সূচনা করেছিল, সেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে আজও সমাজে বয়ে চলেছে। মাতৃসত্তা ভেঙে পিতৃসত্তার এই প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে উড়েছিল পুরুষতান্ত্রিকতার জয়পতাকা।
সময় এগিয়েছে, সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়েছে বিজ্ঞান, যুক্ত হয়েছে উৎপাদনের নানা উন্নততর প্রক্রিয়া। কিন্তু এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারেনি আমাদের সমাজে নারীদের অবস্থান। মানব প্রজাতি রক্ষার জন্য মানুষ উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে নারীদের ব্যাপক ব্যবহারের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, বরং প্রয়োজন দেখা দিয়েছে জন্ম নিয়ন্ত্রণের। আজ বহু সংসারেই সন্তান সংখ্যা এক-দুই-তিনেই সীমাবদ্ধ। তাই নারীর লাগাতারভাবে তার উৎপাদন ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এমনকি একটি সন্তান না হলে জীবনের সার্থকতা অর্থহীন ভাবার দিনও ফুরিয়েছে। তেমন প্রয়োজন অনুভব করলে দত্তক নিয়ে সন্তান পালন নিশ্চয়ই করা সম্ভব। তাই বিয়ের পর সন্তানকে পৃথিবীর আলো না দেখিয়েও সুন্দর পৃথিবী একটি দম্পতি নিশ্চয়ই গড়তে পারে পারস্পরিক প্রেমে, পারস্পরিক মিলনে। পারস্পরিক প্রেম ও মিলনের ক্ষেত্রেও বিয়ে অনিবার্য পরিণতি যে হতে পারে না, 'প্রেম ও বিবাহ' নিয়ে পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা সে আলোচনায় যাব। কিন্তু বর্তমান আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে, সমাজের থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে আমরা নিশ্চয়ই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি - বর্তমান সমাজে নারীদের সন্তান উৎপাদন ও সন্তান পালনের কাজেই সারাটা জীবন ব্যয় করার প্রয়োজনীয়তা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। বহু গৃহবধূর ক্ষেত্রেই একটি বা দুটি সন্তান একটু বড় হয়ে যেতেই অনাবিল অবসর কাটছে ভাত-ঘুম দিয়ে, সিনেমা-তারকাদের কেচ্ছা পড়ে, মার্কেটিং করে, দূরদর্শন বা ডিভিডি-র ছবি দেখে। এমন উৎপাদনহীনভাবে শ্রমশক্তির অপচয় অর্থহীন। তবু এই অর্থহীন ব্যাপারটাই এই সমাজের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের মধ্যে প্রচলিত নিয়ম, মূল স্রোত। আজও তাই দেখা মেলে বিয়ের পর গান ছেড়ে দেওয়া, চাকরি ছেড়ে দেওয়া, নাচ ছেড়ে দেওয়া, আঁকা ছেড়ে দেওয়া - এমনই বহুতর ছেড়ে দেওয়া নারীদের। মাত্র কয়েকটা বছরের দায়িত্ব বা কর্তব্যের অজুহাতে এমনি করে প্রতিভার অপমৃত্যুর যে ধারাবাহিকতা আমাদের সমাজে চলমান, তার দ্বারা কোনওভাবেই সমাজের মঙ্গল হতে পারে না। হতে পারে অমঙ্গল। প্রতিভার অপচয়ের অমঙ্গল।
আসুন, আমরা ফিরে আসি নারী-পুরুষ সম্পর্কের বিবর্তন প্রসঙ্গে আদিম সমাজ নিয়ে, যে অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনায় গিয়েছিলাম, সেখানে। আজকের সমাজে, আজকের মূল্যবোধের মধ্য দিয়ে, সামাজিক পরিবেশের প্রভাবে, আমাদের চেতনা আচ্ছন্ন। এই আচ্ছন্ন চেতনার প্রভাবে আদিম দলগত বিয়েকে কদর্য মনে হতে পারে। কিন্তু ভাবুন তো, আপনি যদি দক্ষিণ ভারতের সমাজ-সংস্কৃতির প্রভাবের মধ্যে বেড়ে উঠতেন, আপনার কি কোনও পুরুষের আপন বোনের মেয়েকে বিয়ে করাটা কাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক স্থাপন মনে হতো না? আপনি ওড়িশার সামাজিক প্রভাবের দ্বারা আচ্ছন্ন থাকলে, দাদা মারা গেলে বৌদিকে যৌন সংসর্গের জন্য ভাই গ্রহণ করলে আপনার সেটাই কি স্বাভাবিক বলে মনে হতো না? হতো, অবশ্যই হতো। কারণ, আমাদের চেতনা সামাজিক প্রভাব ও মূল্যবোধের দ্বারাই পরিচালিত হয়। একইভাবে আদিম দলগত যৌন জীবন বা যৌন মুক্তিকে আমাদের চোখে বীভৎস মনে হতেই পারে। হে প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ, একটু আন্তরিকতার সঙ্গে আদিম সমাজটাকে ভাবতে চেষ্টা করুন, বুঝতে চেষ্টা করুন। আদিম যুগের সম্পত্তিহীন, অভাবী মানুষগুলোর মধ্যে যে যৌন মুক্তি ঘটেছিল তার ভিত্তিমূল ছিল সাম্য। গরিবের সাম্য। আদিম মুক্ত মানুষগুলোর যৌন মুক্তিতে ছিল না কোনও প্রতারণা, অবদমন, ঈর্ষা, লুকোচুরি বা অসুস্থতা। এই যৌন মুক্তিতে ছিল না লাম্পট্য, ব্যভিচার, যৌন উৎপীড়ন, ধর্ষণ বা গণিকা সম্ভোগ। দলের নারী-পুরুষের ভালোবাসা ছিল মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। আজ এই সমাজে থেকেই আপনি তো বহুকেই ভালোবাসেন। ভালোবাসেন মা-বাবাকে, ভাই-বোনকে, আত্মীয়-বন্ধুকে, শিক্ষক থেকে প্রতিভাবানকে। যত বড় হয়েছেন, যত বেশি মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন ততই বেশি মানুষকে ভালোবেসেছেন। বেড়েছে বন্ধু, বেড়েছে আত্মীয়ের গণ্ডি। আপনি একবার ভাবুন তো - আপনার নতুন বন্ধুকে ভালোবাসতে পুরনো বন্ধুদের প্রতি ভালোবাসা কমাতে হয়েছে কী? হতে পারে না। মতাদর্শগত মিলের অভাবে ভালোবাসা কমে, ভালোবাসা ভাঙে - সে কথা স্বতন্ত্র। কিন্তু ভিন্ন নতুন মানুষের প্রতি ভালোবাসায় পুরনো মানুষের প্রতি ভালোবাসা কমে না। এই অকৃত্রিম ভালোবাসা, সাম্যের ভিত্তিতে ভালোবাসা এবং তারই সূত্র ধরে যে যৌন সম্পর্ক প্রচলিত ছিল আদিম সমাজে সে যৌন মুক্তির মূল্যবোধকে বুঝতে আমাদের আন্তরিক হতে হবে, বর্তমান মূল্যবোধ দ্বারা আচ্ছন্ন মনকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে হবে আদিম যুগে। নিয়ে যান। আন্তরিকতার সঙ্গে নিয়ে যান, ফিরে যান আদিম সমাজে; স্বার্থ চিন্তাহীন, ঈর্ষাহীন সাম্যের আদিম সমাজে। দলের প্রত্যেককে স্পর্শ করে দেখুন। হৃদয় দিয়ে, শরীর দিয়ে স্পর্শ করে দেখুন। এবার গভীরভাবে চিন্তায় বসুন। দলগত মিলনকে এবার আর কদর্য, কুৎসিত মনে হবে না। আমার এই বক্তব্যের থেকে আবার কেউ এমন অর্থ করার চেষ্ট করবে না - এর দ্বারা আমি বর্তমান সমাজে দলগত বিয়ের মধ্য দিয়ে যৌন মুক্তি চাইছি। অসাম্যের এই সমাজে দলগত বিয়ে, দলগত যৌনাচার কদাচার আনতে বাধ্য। সে যুগের দাম্পত্যের সমাজচিত্রের সঙ্গে সে যুগের সাংস্কৃতিক চিন্তার মেলবন্ধন ঘটাতে না পারলে কখনও পরিপূর্ণ বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করা সম্ভব নয় - এটাই বলতে চাইছি। আমার বক্তব্যকে কোন দিকে বাঁক নেওয়াতে চাইছি? কোন পথে এগুতে চাইছি? ঠিক কী বলতে চাইছি? নারী মুক্তির জন্য কী পথনির্দেশ দিতে চাইছি? নারী প্রগতি এবং নারীর মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে মনের মিলের বন্ধুদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের সপক্ষেও প্রচার চালাতে চাইছি কিনা। ইত্যাদি বহু প্রশ্ন ভিড় করে আসাটাই স্বাভাবিক। প্রশ্নের উত্তরে এ কথাই বলবো - নারী প্রগতির সমস্যা, নারী মুক্তির সমস্যা, ভালোবাসার ও বিশ্বাসের মানুষের সঙ্গে যৌন প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে তোলার সমস্যা বাকি জীবনের সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। তাই বিচ্ছিন্নভাবে এই সমস্যাগুলোর সামগ্রিক সমাধান সম্ভব নয়। এই সমাজ কাঠামোয় আমাদের জীবন কাঠামোকে বন্দি রেখে আমরা আমাদের আন্তরিকতা দিয়ে, আবেগ দিয়ে, প্রচেষ্টা দিয়ে মুক্তি আনবো নারীর ভালোবাসার - এ হয় না। রোগীর মাথাব্যথার কারণ যখন টিউমার, তখন ব্যথার ওষুধে কাজ হবে কি? ব্যথার থেকে মুক্তি পেতে টিউমারকে সরাতে হবে, এ ছাড়া কোনও পথ নেই। সমাজের এই অসুস্থ বিকাশকে সুস্থ পথে আনতে পারা সম্ভব; অবশ্যই সম্ভব। এই অসম্ভব কাজ সম্ভব করা যে সম্ভব, এটুকু বোঝার জন্যে প্রয়োজন আর কিছু নয়, সামান্য যুক্তিনিষ্ঠা। এমন সমাজ যদি তৈরি করা যায়, যেখানে শোষণ নেই, যেখানে সম্পত্তি নেই, যেখানে ছোট ছোট জমির পরিবর্তে বিশাল বিশাল খেত-খামার, পশুপালন কেন্দ্র, বিশাল বিশাল কারখানা, প্রচুর উৎপাদন এবং মালিক মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি নয়। এসবের মালিকানা ভূখণ্ডের সকলের। মুনাফার প্রশ্ন নেই, ঠকাবার প্রয়োজন নেই, ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে কিছু নেই বলেই নেই, সেখানে সাম্য আসতে বাধ্য। অর্থনৈতিক সাম্য, সামাজিক সাম্য, প্রতিটি কাজের মর্যাদার সাম্য, মেয়েদের ঘরের বা বাইরের কাজের সঙ্গে পুরুষের যে কোনও কাজের মর্যাদার সাম্য। যৌথ মালিকানার সমাজে প্রতিটি মানুষই, শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই সব কিছুর মালিক। সবার জন্যে বাসস্থান, খাদ্য, পানীয়, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রতিভা বিকাশের সমান সুযোগ। সন্তানের শিক্ষা বা চিকিৎসার জন্য দায়িত্ব নেই, অর্থ ব্যয় নেই। সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করতে অর্থ চিন্তা নেই, ডোনেশনের নামে ঘুষ নেই। সম্পত্তির পাহাড় গড়তে দুর্নীতি নেই। এমন সমাজে নারীর শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হতে বাধ্য। পুরুষতন্ত্রের বুনিয়াদ ভেঙে যেতে বাধ্য। শোষিত মানুষের শোষণ শেষ হতে বাধ্য। এমন একটা সুন্দর, সাম্যের সমাজ গড়তে গেলে মনে রাখতে হবে গড়া শুধুই 'নির্মাণ' নয়। অনেক ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়েই, অনেক সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই, অনেক হার-জিতের মধ্য দিয়েই পৌঁছতে হবে প্রার্থিত লক্ষ্যে।....
....শুরুটা আমাদের করতে হবে অবশ্যই চিন্তার ক্ষেত্র সংস্কারের মধ্য দিয়ে। আজন্মলালিত পচনধরা চিন্তাকে বিদায় দিয়ে টাটকা, তাজা, নতুন ও সুন্দর চিন্তার সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে হবে মানুষদের। পুরনো ধারণার প্রতি, পুরনো চিন্তার প্রতি, পুরনো মূল্যবোধের প্রতি স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হয় শ্রদ্ধা ও মমতা। আর এই শ্রদ্ধা ও মমতাই আমাদের ভুল বোঝায়। রাষ্ট্রশক্তি প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা জাগাবার তাই প্রচেষ্টা চালায়, নতুন নতুন পদ্ধতিতে। আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা করাটা এক মহান কর্তব্য - এমন প্রচারে শামিল ডান থেকে বাম প্রতিটি রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রশক্তি, প্রচারমাধ্যম - কে নয়? প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষার কাজে স্বামীজির বাণীকেও বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসে ওরা - "হে ভারত ভুলিও না তোমার নারী জাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী।" প্রাচীন ঐতিহ্যের নামে ওরা আমাদের বস্তাপচা না-মানুষের সংস্কৃতি গেলাতে চায়। গিলি, আমরা অনেকেই গিলি। তাইতেই ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে রক্ষা করার কর্তব্যে চালিত হয়ে আমরা নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা ভাবতে পারি না, নারী মুক্তিকে মেনে নিতে পারি না, নারী পুরুষের প্রথা বহির্ভূত প্রেমের নতুন সম্পর্ককে গ্রহণ করতে পারি না। এই সব মাথায় রেখেই আমাদের মস্তিস্কের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। কারণ, এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই চিন্তার সংস্কার ও চেতনা মুক্তির পথ ধরেই আমাদের এগুতে হবে শেষ লক্ষ্যের দিকে।
- 'যুক্তিবাদের চোখে নারীমুক্তি', প্রবীর ঘোষ

Comments