সরস্বতী ও শিক্ষা - সুকুমারী ভট্টাচার্য [পর্ব-তিন]

 


শিক্ষকদের এ প্রসঙ্গে দুটো দায়িত্ব আছে। প্রথমত, শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুক্তিমুখী করবার নিরন্তর চেষ্টা করে যেতে হবে। ছাত্র-ছাত্রী যেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে জড়বস্তুর মত গ্রহণ না করে, বুদ্ধি দিয়ে ভেবে, ভালোমন্দ বিচার করে জীবনের মধ্যে তাকে অর্জন করে এবং সর্বদাই তার মূল্যায়ন করে চলে যাতে শ্রেয় থেকে শ্রেয়তর মানে নিয়ে যেতে পারে জ্ঞানকে, যেন জাতির প্রয়োজন যখন পরিবর্তিত হচ্ছে তখন সে অনুযায়ী তারা তাদের লব্ধ জ্ঞানকে পরিবর্তিত করতে পারে। কাজেই জ্ঞান যাতে জড়পিণ্ডমাত্র না হয়ে ওঠে, প্রয়োজনে তার পরিবর্তন ঘটানোর সাধ্যও যেন ছাত্র-ছাত্রীরা অর্জন করে এমন যুক্তিনিষ্ঠ মন তাদের গড়ে দেওয়া শিক্ষকদের কাজের মধ্যে পড়ে। হিন্দুত্বের কল্পনায় যে জড়তা তাকে পরিহার করবার জন্য এই সজীব মন, নিত্য জগৎ, যুক্তি ও পরিবেশের, প্রয়োজনের অভিমুখে জ্ঞানকে নতুনভাবে বিবর্তিত রূপে প্রয়োগ করবার ক্ষমতা ছাত্রদের গড়ে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, চল্লিশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির একটা নির্দেশের কথা মনে পড়ে। প্রত্যেক ছাত্র ও শিক্ষককে চেষ্টা করতে হবে তার বিশিষ্ট ক্ষেত্রে যাতে সে সবচেয়ে উন্নত মানের দক্ষতা অর্জন করতে পারে। প্রত্যেক বিষয়েই যাতে সাম্যবাদী শিক্ষকরা একেবারে সামনের সারিতে থাকতে পারেন সেই চেষ্টা করতে হবে। কারণ একমাত্র অপ্রতিদ্বন্দ্বী যোগ্যতার বলেই তাঁরা বিরুদ্ধ পক্ষকে স্বক্ষেত্রে পরাভূত করে নিজেদের মতাদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করতে পারেন। আজ এটার ভীষণ দরকার। অনেকগুলো ক্ষেত্রে এখন সাম্যবাদী অধ্যাপকরা তাঁদের বিদ্যাগত যোগ্যতা ও গবেষণার মানে অপ্রতিরোধ্য। চেষ্টা করতে হবে সব ক্ষেত্রেই যেন এটা ঘটে, কারণ কেবলমাত্র অবিসংবাদিত যোগ্যতার জোরেই আমরা হিন্দুত্ববাদীদের এত উপযুক্তভাবে খণ্ডন করতে পারবো। কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনদের মধ্যে একটা কথা চালিত আছে, "ওদের অর্ধেক দূর পর্যন্ত পৌঁছতে আমাদের ওদের দ্বিগুণ জোরে দৌড়তে হবে" (We have to run twice as fast to reach half as far)। এ যাওয়া স্রোতের উজানে, কাজেই এখানে পুরো শিক্ষক সমাজের একটি অনস্বীকার্য দায়িত্ব রয়েছে। তা হলো সম্পূর্ণ অতন্দ্র, অনলসভাবে নিজের বিষয়ে পড়াশোনা করে তেমন যোগ্যতার মান অর্জন করা, যাতে প্রতিপক্ষের মুখ বন্ধ হয়। সেই যোগ্যতার সঙ্গে যুক্ত থাকবে আমাদের জীবনমুখী দর্শন, আমাদের সম্মুখ দৃষ্টি, আমাদের বামপন্থা। জ্ঞান ও যোগ্যতার উৎকর্ষের কাছে প্রতিপক্ষ যখন নতি স্বীকার করতে বাধ্য হবে, তখনই হিন্দুত্বের বিষদাঁত ভাঙবে। কৈশোর থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা যেন এই জ্ঞানের উন্নত মান শিক্ষকের মধ্যে দেখে, যে জ্ঞানকে সকল ছাত্র সম্মান করতে বাধ্য হবে, তাহলে সেই জ্ঞান যে মতাদর্শের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাকেও সে সম্মান করতে শিখবে। কাজটা খুবই দুরূহ। চাকরিতে উন্নতির লোভ, টাকার জন্য লোলুপতা, সারা বছর দেশে বিদেশে সেমিনার কনফারেন্স করে সস্তা খাতির পাওয়া, এসব থেকে নিজেকে মুক্ত করে ব্রতের মত করে মতাদর্শকে দৃঢ় রেখে নিজের অধ্যাপনার বিষয়ে যথাশক্তি উৎকর্ষ বাড়িয়ে চলার সাধনা এটা একাগ্রভাবে, অতন্দ্রভাবে করে যেতে হবে। এখানে আত্মতুষ্টির কোন অবকাশ নেই। প্রতিবন্ধকতা বিস্তর, কিন্তু আজ এখানে হার মানলে কাল ভারতে ফ্যাসিবাদ হিন্দুত্বের রূপে দেশকে গ্রাস করবে। এ ব্রতে অতন্দ্র থাকলে জয় হবেই।

সঙ্ঘ পরিবার যে হিন্দুত্বের প্রবক্তা ও প্রচারক তা ভারতীয় ধর্মধারার একমাত্র উপাদান নয় বলেই একান্তভাবে চর্চিত হবার দাবি এর নেই। বেদ সম্বন্ধে এত আগ্রহের একটা কারণ, বেদ নাকি অপৌরুষেয়। তাই এবারে ধুয়া তোলা হয়েছে এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছেন যে, দেশে বেদ বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। এগুলো হবে প্রাচীন বৈদিক সংস্কৃতি সম্বন্ধে নানা আজগুবি কুসংস্কার নির্মাণের ঘাঁটি। এখানে যজ্ঞের অনুষ্ঠান হবে, বেদপাঠ ও গানের ক্যাসেট তৈরি ও বিক্রি হবে, বৈদিক ভারত সম্বন্ধে ছবি তৈরি ও বিক্রি হবে ও প্রদর্শনী হবে; রথ দেখার সঙ্গে কলা বেচাটাও থাকবে। এর বেশি কিছু বলেননি বলে নানা প্রশ্ন সমস্যা আপনিই আসে।

বেদেই নাকি ভারতবর্ষের ঐতিহ্যের সূত্রপাত। এঁরা তো সিন্ধু সভ্যতাকে প্রাগ্‌বৈদিক বলে স্বীকারই করেন না। কাজেই ভারতীয় সংস্কৃতির উৎস বেদ, অতএব ভাবী প্রজন্মের ভারতীয়ত্বে যেন জ্ঞান ও গর্ব জন্মায় তার জন্যেই এ উদ্যোগ। সাধারণভাবে 'ভারতীয়' না হলেও ভারতীয় 'আর্য' সভ্যতার উৎস যে বেদ, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই কারণে উত্তর প্রদেশের মাধ্যমিক স্কুলগুলির ছাত্রদের পড়তে হয় বেদের গণিত। বৈদিক সাহিত্যের শেষ পর্যায়ে রচিত 'অথর্ব পরিশিষ্টে' ষোলোটি সূত্র আছে গণিত সম্বন্ধে, সে যুগের পক্ষে তার গৌরব ছিল, এ যুগের পক্ষে নয়। এ যুগের ছাত্রছাত্রীরা এ যুগের পদ্ধতিতেই গণিত শিখলে সেটা যথার্থ কার্যকরী শেখা হবে, বৈদিক গণিত অতীত সম্বন্ধে কৌতূহল মেটাতে পারে, প্রয়োজন মেটাতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সরকারি অনুদানে জেলায় জেলায় যে বেদ পাঠশালা স্থাপনের প্রস্তাব, তার উদ্দেশ্য বা উপযোগিতা কী? ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য চর্চা এর উদ্দেশ্য হতে পারে না, কারণ সেক্ষেত্রে ফারসি ও আরবি এবং পালি প্রাকৃতও জানতে হবে। তবে এরা বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির স্বতন্ত্র মূল্য দেয় না।

৬ই নভেম্বর (১৯৯৮) বোধগয়াতে যে বৌদ্ধ মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয় তাতে আদভানি বলেন, 'বুদ্ধ নতুন কোনো ধর্ম প্রচার করেননি, সনাতন ইন্দো-আর্য ধর্মকে নতুন করে উপস্থাপিত করেছেন মাত্র'। উত্তরে নালন্দা বৌদ্ধচর্চা কেন্দ্রের ভূতপূর্ব ডিরেক্টার সি এস উপাসক বলেন, 'আদভানির উক্তি রাজনীতি প্রণোদিত, এটির বক্তব্য অস্পষ্ট, উদ্দেশ্য প্রতারণা করা এবং এ উক্তির চেয়ে আর কিছুই সত্যের থেকে দূরতর হতো না' (ambiguous in content, deceptive in intent, could not have been farther from the truth)। বৌদ্ধ ধর্মকে এভাবে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করার অপপ্রয়াস সম্বন্ধে বিখ্যাত বিপশ্যনা ধ্যান শিক্ষক সত্যনারায়ণ গোয়েঙ্কা বলেন, 'এটি, হিন্দু ধর্মের সমর্থকরাও নিঃসন্দেহে স্বীকার করবেন, পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক থেকে পৃথক এবং একটি সম্প্রদায়েরই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষার উদ্দেশ্যে (করা হয়েছে) উদীয়মান বহুধা প্রকাশিত বহু সংস্কৃতির সমন্বয়ে সৃষ্ট রাষ্ট্রনীতির প্রহসন মাত্র।' (...which is, as advocates of Hindutva would no doubt agree, different from mutual respect...and protection of a disting identity knocks at the emerging pluralist multi cultural identity.) এ হলো বৌদ্ধদের সম্বন্ধে অন্তর্নিহিত অবজ্ঞার প্রকাশ, যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রাচীনকালের বেদ বিরুদ্ধ একটি প্রস্থান ছিল। বেদ পাঠশালায় স্বভাবতই বৌদ্ধ ধর্ম-সংস্কৃতির চর্চা হবে না, যদিও তার কাল সীমাটা বৈদিক যুগের মধ্যেই পড়ে। কেবিনেট মন্ত্রী থাম্বি দুরাই নিজেকে এদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেন।

তাহলে চর্চা হবে শুদ্ধ বেদের। বলা হয়েছে, এ পাঠশালা উদ্বোধন করবেন মন্দিরের অছি (trustee) এবং এগুলি হবে গুরুকুল ধরনের। এসব পাঠশালা প্রতিষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ প্রতি জেলায় বেদের পণ্ডিতদের সাহায্য চেয়েছে। ৯-১৩ ডিসেম্বর বিশ্ব বেদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অন্তর্ভুক্ত বিশ্ব বেদ সংস্থানের সঙ্গে সংযুক্তভাবে, বিজেপি এই উপলক্ষে বেদবিদদের যে সভা ডেকেছে তাতে আমন্ত্রণ পেয়েছেন মহারাষ্ট্র থেকে ১৮০ জন, অন্ধ্র থেকে ১৫০, তামিলনাড়ু থেকে ১২৫, কর্ণাটক থেকে ৭০, গুজরাট থেকে ৪০, ওড়িশা থেকে ৩০, কেরল থেকে ২৫, দিল্লি থেকে ২০ ও অসম থেকে ১৫ জন। পশ্চিমবাংলা থেকে কাউকে ডাকা হয়নি, কারণ 'ওখানে কেউ বেদ জানে না'।
এইসব বেদ পাঠশালা কীভাবে ভবিষ্যতের জন্যে ছাত্রদের তৈরি করবে? প্রবীণ অভিজ্ঞ এক বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সমর্থক বলেন, 'কেউ ভবিষ্যতের সন্ধানে বেদপাঠে ব্রতী হবে না। এসব পাঠশালায় ছাত্ররা ভর্তি হবে ধর্মগ্রন্থগুলি সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করতে। এ একরকম সাধনা।' (No one should take up the study of the Vedas thinking of future prospects. Students should enrol in these pathshalas to attain knowledge of these religious scriptures. It's a kind of sadhana)। জম্মু কাশ্মীরসহ সারা উত্তর ভারতেই বিশেষ করে বেদ পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করা দরকার, কারণ বেদের চর্চা 'এখনও দক্ষিণ ভারতে পাওয়া যায়। এটি সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে গেছে কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশে, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার, পশ্চিমবাংলা এবং আর্যাবর্তের অন্যান্য অঞ্চলগুলি থেকে। সময় এসেছে বেদ ও তার শিক্ষা সম্বন্ধে মানুষকে আগ্রহী করে তোলার।' (Vedic study can still be found in the southern parts of the country it has disappeared from Kashmir, Himachal Pradesh, Uttar Pradesh, Rajasthan, Bihar, W. Bengal and other Parts of northern India... the time has come to get people interested in the the Vedas and their teachings) এ পাঠ্যর উদ্দেশ্য সঙ্ঘ পরিবার বহুদিন থেকেই নানা প্রসঙ্গে বারে বারে ঘোষণা করে আসছে: ভারতবর্ষে সিন্ধু সভ্যতা প্রাগার্য নয়, আর্যই এবং বৈদিক সভ্যতা পৃথিবীর প্রাচীনতম 'সভ্যতা'। যাঁদের পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাসে প্রাথমিক জ্ঞান আছে তাঁরাই জানেন প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে বৈদিক সভ্যতা কনিষ্ঠতম - অসিরীয়, সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয়, চীনা ও গ্রিক সভ্যতার তুলনায় বৈদিক সভ্যতা নেহাতই অর্বাচীন। টেনেটুনে যদি খ্রীষ্টপূর্ব দেড় হাজার বছরেও নিয়ে ফেলা হয় বৈদিক যুগের শুরুকে, তাহলেও অন্যগুলির তুলনায় তিন থেকে চার-পাঁচ হাজার বছরের ছোট বৈদিক সভ্যতা। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীরা বরাবর প্রমাণের চেষ্টা করে আসছে যে, বৈদিক আর্য সভ্যতা শুধু প্রাচীনতম নয়, অন্যান্য সব সভ্যতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এতটাই শ্রেষ্ঠ যে, ভারতবর্ষে "যা কিছু খুব প্রাচীন ঠিক সেইটেই বর্তমান জগতে আধুনিকতম" (Whatever is very ancient for India, that precisely is most modern for the world)। একথা বলেছেন উত্তরপ্রদেশের শিক্ষামন্ত্রী, ১৯৯৮-র এপ্রিল মাসে এলাহাবাদে এক শিক্ষক সমাবেশে। এর অর্থ সমাজ-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই তিন সাড়ে তিন হাজার বছরে কোন অগ্রগতি হয়নি। এই ধরনের মনোভাব নিয়েই এরা বলে 'অথর্ব পরিশিষ্টে'র ষোলটি গণিত সূত্র থেকে পৃথিবীর তাবৎ গাণিতিক কাজ ও চর্চার সব সূত্র মেলে। একথা যে মূর্খের, তা শুনলেই বোঝা যায়।

শিক্ষার জগতে যে প্রলয়ঙ্কর তাণ্ডবের সূত্রপাত করেছে এরা, তা আজ নানাভাবে প্রকাশিত। এর প্রধানত দু'টি দিক। প্রথমত, ভারতবর্ষের বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গৈরিকীকরণ। এর মধ্যে পড়ে আই সি এইচ আর ও আই সি এস এস আর এদেশে ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের দু'টি উচ্চতম প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিষ্ঠিত পণ্ডিতদের সরিয়ে এক এক করে সঙ্ঘ পরিবারের অনেক কম যোগ্যতার অখ্যাত ব্যক্তিদের চাকরি দেওয়া হচ্ছে। এই নব নিযুক্তদের যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি হলো রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সদস্যতা, সঙ্ঘ পরিবারের উচ্চশিক্ষা চর্চার মান বেশ নিচু, ফলে কেবলমাত্র গৈরিক রাজনীতির জোরে শিক্ষা জগতে উচ্চপদ লাভ করা গেলে সারা দেশের শিক্ষাগত মানই নেমে যায়। বেদ চর্চা ঐ বেদ পাঠশালায় কীভাবে হবে তা বলা হয়নি। কিন্তু ঐ চর্চা এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে কী কী করা দরকার তার একটা তালিকা দিয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ: যজ্ঞ অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী, বৈদিক সাহিত্যের বিক্রি, বৈদিক গান ও আবৃত্তির ক্যাসেট বিক্রি, ছবি বিক্রি ইত্যাদি। এসব সম্বন্ধে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এক সদস্য বলেছেন, 'যদি কয়েকটি পরিবারেও এসবের কিছু কিছু ঢোকানো যায় তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য কতকটা সিদ্ধ হবে।' যজ্ঞ ও প্রদর্শনী (যদি তাতে প্রবেশ মূল্য না থাকে) বাদে সব কটিরই বাণিজ্যিক দিক একটা আছে। দেশে ছোট ছোট 'মা' ও 'বাবা'দের আখড়ায় ঐসবই অর্থের বিনিময়ে হয়ে থাকে। যজ্ঞ ঐ তালিকার একটি অঙ্গ। ছাত্র-ছাত্রীদের দেখানোর জন্যে যজ্ঞ করা - এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ, এই ধরনের বেদ বিশ্বাসীরা মাঝে মাঝেই ইতস্তত যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে থাকে বেদ কথিত ফল লাভের আশায়।

যজ্ঞ তিন রকমের- পশু, ইষ্টি ও সোম। এর মধ্যে পশু ও সোম যোগে বলদ হত্যা করতেই হয়, অন্যান্য বহু পশুও। এখন এই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও সঙ্ঘ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ভীষণ রব তুলেছেন কোনোমতেই কোথাও গোহত্যা করা চলবে না। নাগপুরের কাছে রামটেকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের যে জমায়েত হয়েছিল সেখানে এক সাধু বলেছিলেন, 'এক ফোঁটা গোরক্ত যারা পাত করবে আমরা তাদের মাথা কেটে ফেলবো।' অশোক সিংঘাল বলেছেন, 'সব নদীর জল গোরক্তে অপবিত্র হয়েছে'। বলা হয়েছে, গোমূত্র পানে আরোগ্য হয় ক্যান্সার, পুরুষত্বহীনতা, যৌন ব্যাধি, যকৃতের রোগ ও হৃৎপিণ্ডে আকস্মিক শ্বাস রোধ। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ দাবি করে যে, হত্যাকালে গরুর কম্পন ও আর্তরবের ফলেই ভূমিকম্প, পোলিও হয়; শরীরে মেদ জমে। চতুষ্পদ প্রাণীর মাংস খেলে অন্ধত্ব, চর্মরোগ ও হৃদরোগ হয়। এর থেকে বিবাহ বিচ্ছেদও হয়, কারণ মাংস ভক্ষণে শিশুদের অকালে যৌন পরিণতি ঘটে। তার থেকে পুরুষত্বহীনতা, ফলে বিবাহ বিচ্ছেদ। বলা বাহুল্য, চিকিৎসা শাস্ত্র এগুলিকে হাস্যকর দাবি বলে মনে করে। প্রাচীন বৈদিক আর্যরা মুখ্যত গোমাংসভোজী। তাঁদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ, যৌনব্যাধি, অন্ধত্ব, চর্মরোগ ও হৃদরোগের প্রাবল্য ছিল - এমন কথা তো বেদে লেখে না। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আরও দাবি করে যে, দেশের গোধন কমে যাচ্ছে, এটাও সম্পূর্ণ মিথ্যে। ১৯৮২ সালে গোধনের সংখ্যা ছিল ২৬ কোটি ২০ লক্ষ, '৮৭-তে ২৭ কোটি কুড়ি লক্ষ, '৯২তে ৩০ কোটি। এর পরে আরও বেড়েছে। দেশের শতকরা যে ৭৪ জন মাংসাশী তাদের মধ্যে ৯১.৫ শতাংশ চতুষ্পদ প্রাণীর মাংস খায়, শতকরা ৮২.৬ শতাংশ মাছ খায়, ৭৬ শতাংশ মুরগি খায় ও ১২.৭ শতাংশ গোমাংস খায়। এই শেষোক্তদের অধিকাংশই মুসলিম, সম্প্রদায়গতভাবে যারা অত্যন্ত দরিদ্র; খাসীর মাংস, মুরগি বা মাছ তাদের অধিকাংশের নাগালের বাইরে। তাই সবচেয়ে সস্তা যে গোমাংস, তাই তাদের প্রোটিন জোগায়। এবং এই মুসলিম সম্প্রদায়টিই বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের ঘোষিত শত্রু। যেদেশে অধিকাংশ গরু রুগণ, বুভুক্ষু ও শীর্ণ; ন্যূনতম যত্ন যাদের ভাগ্যে জোটে না, বুড়ো শীর্ণ গরু সারি সারি কসাইখানায় মৃত্যুর প্রতীক্ষা করে যেখানে, সেখানে দেশের এমন সম্পদ কোথায়, বা কার, যে অর্থনীতির দিক থেকে ক্ষতির খাতায় লেখা ঐ গরুগুলোকে আমরণ খাজনা দিয়ে তদ্বির করবে, রোগে চিকিৎসা করবে, মৃত্যুকালে পরিচর্যা করবে? পাশ্চাত্য গোখাদক দেশে গরু যা যত্ন পায় তা এদেশে এখনো অকল্পনীয়। কাজেই গোমাতার জন্যে উদ্বেগের পেছনে একটি বড় অভিপ্রায় হলো, দরিদ্র মুসলমানকে তার সুলভ প্রোটিন থেকে বঞ্চিত করা।

এই গোহত্যা আবার যজ্ঞে অত্যাবশ্যক। বেদ চর্চায় যে যজ্ঞ হবে তাতে কি মাটির গরু মারা হবে যজ্ঞে? যজ্ঞে বলদ মারা হতো তার নিঃশ্বাস বন্ধ করে (বাংলার রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর 'যজ্ঞকথা'তেও একথা আছে) এবং এ হনন সময়সাপেক্ষ, গরুর ঐ দীর্ঘ মৃত্যুযন্ত্রণা বেদসম্মত, বেদ পাঠশালার ছাত্র-ছাত্রী ঐ যন্ত্রণা দেখে বৈদিক ঐতিহ্য সম্বন্ধে শ্রদ্ধাপ্লুত হবে? যজ্ঞ সম্বন্ধে তো বই পড়েই ধারণা করা যায়, পুনাতে যজ্ঞ করে তার চলচ্চিত্র তোলা হয়েছিল এবং সব রকম 'পাঠ' বেদের আবৃত্তির ক্যাসেট তৈরি হয়েছিল এবং পুনা বিশ্ববিদ্যালয় ও 'বৈদিক সংশোধন মণ্ডলে' যজ্ঞপাত্র নির্মাণ করে রাখা হয়েছে, দেখো শেখার পক্ষে এই যথেষ্ট। তাতে এদের হবে না। এই গরিব দেশে ধুমধাম করে আস্ত যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে টাকা নষ্ট করে কিশোর-কিশোরীদের যজ্ঞ দেখাতে হবে; ছবি, ক্যাসেট পুনাতে থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য যজ্ঞের ছবি, ক্যাসেট তৈরি করে বৈদিক যুগ সম্বন্ধে একটা কৃত্রিম মোহ সৃষ্টি করতে হবে। এরা কি জানে যে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই প্রাচীনকালে কোনো না কোনো রকম যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হতো প্রকৃতিকে, জীবনকে নিজের অনুকূলে আনবার জন্য? জানে কি যে, আয়ারল্যান্ডে খ্রীস্টীয় চতুর্দশ শতকেও অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছিল? এদিকে বৈদিক যজ্ঞের একমাত্র বৈশিষ্ট্য হলো সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত সেটা চালিয়ে যাওয়া। যজ্ঞ করা; ছবি, ক্যাসেট বিক্রি করা ছাড়া আর কী কর্মসূচী বেদ পাঠশালার তা নির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া হয়নি। 'গুরুকুল' ধরনের বিদ্যালয় মানে আচার্য-শিষ্যক্রমে মৌখিক পঠন-পাঠন। শিক্ষাসূচী কী? এরা নীরব সে বিষয়ে। তবে সাধারণ বুদ্ধিতে বোঝা যায় বৈদিক সাহিত্য পুরোটা পড়ানো হবে, অর্থাৎ অন্তত খ্রীস্টপূর্ব দ্বাদশ শতক থেকে খ্রীস্টীয় ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত এই প্রায় দুহাজার বছরের সাহিত্য পড়ানো হবে। কেমনভাবে? অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের পটভূমিকা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ভুঁইফোড় এক সাহিত্য হিসেবে পড়ানো হবে। এর একটা গৌণ কারণ - এইসব বেদ ভক্তরা মনে করে বেদ অপৌরুষেয়, কোনো মানুষ এটা রচনা করেনি। এরা মনে রাখে না পৃথিবীর সমস্ত ধর্মশাস্ত্র সম্বন্ধে সেই সেই সমাজও এ দাবি করেছিল। তারা বলেছিল বাইবেল অপৌরুষেয়, কোরান অপৌরুষেয়; যেমন অপৌরুষেয় অবেস্তা। কেল্টিক দ্রূইদদের শাস্ত্র এবং মেক্সিকোর 'পোপুল হবুহ্'। এ না বললে একের কথা অন্যের কাছে প্রামাণ্য হতো না, ফলে সমাজে কোনো সংহতি থাকতো না। বেদ বিদ্যালয়েও বলা হবে 'বেদ কোনো মানুষের রচনা নয়'; যদিও এর মধ্যে ভাষায় - ব্যাকরণ, শব্দসম্ভার, অন্বয়, ছন্দ সবেরই বিবর্তন অতি স্পষ্ট। বিবক্ষিত বস্তুর বিবর্তনও লক্ষণীয় : কর্মকাণ্ড অর্থাৎ সংহিতাব্রাহ্মণে যজ্ঞই মুখ্য ধর্মাচরণ আর আরণ্যক উপনিষদে আত্মব্রহ্ম-ঐক্য উপলব্ধিই মুখ্য। কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যে ঐহিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, উপায় যজ্ঞ, জ্ঞানকাণ্ডের উদ্দেশ্য জন্মান্তরের নিরবচ্ছিন্ন ধারা থেকে অব্যাহতি, উপায় আত্মব্রহ্ম ঐক্যবোধ। এ বিবর্তনের ব্যাখ্যা ঐ সাহিত্যের অভ্যন্তরীণ কোনো কিছু দিয়েই করা যায় না। সে ব্যাখ্যা সম্ভব পারিপার্শ্বিক ইতিহাসে। এদের শিক্ষাসূচীর মধ্যে অন্যান্য প্রাচীনতম দেশের ধর্মগ্রন্থ, যেমন- মিশর, চীন, এসিরিয়া, ব্যাবিলনিয়া, সুমের, গ্রিস, মেক্সিকো এসবের পাশাপাশি রেখে বেদকে বোঝাবার চেষ্টার কোনো রকম পরিকল্পনাই নেই। আজকের দিনে শুধু বেদ দিয়ে বেদকে বোঝা যায় না, তাই কণ্ঠস্থ করে, ভাষ্যপাঠ করে যেটুকু জ্ঞান জন্মায় ততটুকুই এদের সন্তুষ্ট করে। শ্রুতি শ্রৌতশাস্ত্রই থেকে যাবে, ভারতের ইতিহাসে এর যথার্থ ভূমিকাটি কী তা একটুও বোধগম্য হবে না, এমনকি প্রাচীন সভ্যতাগুলির ইতিহাসের পটভূমিকায় বেদের স্থান কোথায় তাও বোঝা যাবে না। বলা বাহুলা, এমন চর্চায় বেদের যথার্থ গৌরব বাড়ে না; কমে। বেদকে বিশ্বাস করে পড়া মানে বেদোক্ত সব অনুষ্ঠান - উপনয়ন থেকে শ্রাদ্ধ পর্যন্ত মেনে চলা; আর প্রার্থিত বস্তু যজ্ঞ করে পাওয়া যাবে - এ বিশ্বাসে যজ্ঞ করা। মীমাংসা শাস্ত্রের যুগেই বারংবার যজ্ঞকে নিষ্ফল হতে দেখে মানুষ এ বিশ্বাস আর ধরে রাখতে পারছিল না, পুত্রোষ্টি যজ্ঞে পুত্র জন্মাচ্ছিল না। কারীরী ইষ্টিতে বর্ষা আসে না, অশ্বমেধ করেও রাজচক্রবর্তী হওয়া নিশ্চিত হচ্ছিল না। অবিশ্বাস, হতাশা ও কর্মকাণ্ড থেকে জ্ঞানকাণ্ডে উত্তরণের একটা হেতু, একটা স্তরও। কর্মকাণ্ডের নিষ্ফলতার ফলে (জ্ঞানকাণ্ড আরণ্যক উপনিষদ, যেখানে যজ্ঞ প্রতীকী হয়ে উঠেছে) জ্ঞানকাণ্ডের তত্ত্ব সাধারণ মানুষের বোধের অগম্য। যজ্ঞে মন্ত্র অলৌকিক শক্তি উৎপাদন করে ইষ্টসাধন করবে - এ বিশ্বাস আজকের মানুষ করবে না, কারণ বেদে যেসব প্রার্থিত বস্তুর জন্যে যজ্ঞ করা হতো তার অনেকগুলিই এখন বিজ্ঞান মানুষকে জোগাচ্ছে। কাজেই বেদের কর্মকাণ্ড এখন অপ্রাসঙ্গিক, অপ্রযোজ্য। বেদের জ্ঞানকাণ্ড কেবল মনীষীদেরই বোধগম্য হয়। বহু মানুষ জন্মান্তরেই বিশ্বাস করে না, কাজেই মোক্ষ তাদের প্রার্থিতও নয়।

তাহলে বেদ পাঠশালার সার্থকতা কী? বেদে কী আছে তা জানা? এই জানবার জন্যে দরকার বেদের ব্যাকরণে জ্ঞান, কারণ কালিদাসের সংস্কৃত বেদের ভাষা নয়। বেদের ভাষার নাম 'ছান্দস', এর ব্যাকরণ ধ্রুপদী সংস্কৃত থেকে একেবারে ভিন্ন, এ কাব্য স্বরে (উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিত ইত্যাদি) পাঠ করতে হবে। এই ব্যাকরণ ও স্বর প্রকরণ আয়ত্ত করতে অন্তত দু-তিন বছর সময় লাগবার কথা, ততদিন ছাত্ররা কি বেদ ছাড়া অন্য কিছু পড়বে না? ইতিহাস, ভূগোল, গণিত ইত্যাদি। তা যদি পড়ে তাহলে বেদের ব্যাকরণ, স্বর আয়ত্ত করতে আরও বেশি সময় লাগবে। বৃত্তিমূলক যে শিক্ষা; তার মধ্যে এত সময় তো ছাত্ররা পাবে না। যদি অনন্যকর্মা হয়ে শুধু বেদই পড়ে তবে তারা পরে কী করবে? শুধু বেদই পড়াবে। এই গরিব দেশে বেদ বিলাসিতা সময় ও অর্থের অনাবশ্যক অপচয় হবে না? এত সময় দিয়ে, এত কাঠখড় পুড়িয়ে যদি ছাত্ররা বেদে কী আছে জানেও তাহলে সে জ্ঞান তাদের কোন কাজে লাগবে? তুলনামূলক, ঐতিহাসিক ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক রীতিতে পঠন-পাঠন অভিপ্রেত নয়, তা এদের কথাবার্তা শুনে বোঝাই যায়। এই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে বেদ পাঠের যথেষ্ট উপযোগিতা আছে এবং ভারতবর্ষে এবং পৃথিবীর আরও অনেক দেশে একশ বছরের বেশি কাল আগের থেকে সে চর্চা আরম্ভ হয়েছে। এখনও অব্যাহত চর্চা চলছে সর্বত্র। তার সমগোত্রের চর্চা বেদ পাঠশালার উদ্দিষ্ট বা লক্ষ্য নয়।

বেদ পাঠশালায় বেদ পড়ে ছাত্ররা বেদ সম্বন্ধে যা জানবে তা হলো - বেদে কী উদ্দেশ্যে কোন যজ্ঞ কেমনভাবে করা হতো, যজ্ঞ সম্বন্ধে কিছু উপাখ্যান এবং পরে উপনিষদের দার্শনিক চিন্তা, তার সঙ্গেও কিছু উপাখ্যান এবং সেসব সংলাপে বেশ কিছু কাব্যগুণ। সমাজ সম্বন্ধে জানবে প্রথম পর্বে, অর্থাৎ কর্মকাণ্ডে আগন্তুক আর্যদের সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতায় প্রাগার্য অধিবাসীদের সংঘর্ষ এবং আর্যদের নিজেদের মধ্যেও প্রচুর গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ইতিহাস। এসবের মধ্যে দিয়েই জানা যায় সমাজে বর্ণ বিভাগ, ধনী ও দরিদ্রের, নারী ও শূদ্রের সামাজিক অবস্থান। নানাভাবে এসবের ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা চলছে দীর্ঘকাল ধরে, কিছু ছাত্র বেদেই পড়বে 'খেয়ে এঁটোটা স্ত্রীকে দেওয়া উচিত' (ভুক্ত্যচ্ছিষ্টং বধ্বৈ দদ্যাৎ) বা 'যে কাপড়, ছাতা, জুতো ব্যবহারের সম্পূর্ণ অযোগ্য সেগুলো ভৃত্যকে দেবে', 'শূদ্রের কাজ আর তিন বর্ণের সেবা করা'। 'একটি নারীর পক্ষে একটি পুরুষই যথেষ্ট, কিন্তু একজন পুরুষের পক্ষে দুটি স্ত্রী আবশ্যক'। অবশ্য বাস্তব যে চিত্র পাই তাতে দুয়ের অনেক বেশি স্ত্রীরই সন্ধান মেলে। এসব দেখে বেদ পাঠশালার ছাত্রদের প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য সম্বন্ধে শ্রদ্ধা বাড়বে? দাস, শূদ্র বা অসতী নারীর শাস্তি চূড়ান্তভাবে অমানবিক। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে পড়ি; কোনো গুণ বা বিদ্যা নেই এমন ব্রাহ্মণও শুধু জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ হওয়ার গুণেই সকলের ভক্তির পাত্র। সর্বগুণযুক্তা নারীও সম্পূর্ণ গুণহীন পুরুষের অধম - এসব মেনে নেওয়ার মত মানসিকতা তৈরি করবে বেদ পাঠশালা? যদি করে তো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের, ভারতবর্ষের ভবিষ্যতের পক্ষে তেমন নাগরিক বরণীয় না শাস্তিযোগ্য?

বেদ বলছে ঝড় বৃষ্টি ঘটে পর্জন্য দেবের ইচ্ছায়; বৃষ্টিপাতের দেবতা ইন্দ্র, যম মৃত্যুর অধিদেবতা ইত্যাদি। আজকের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ভূগোল ও বিজ্ঞানের সাক্ষ্য অন্যরকম। রাহু, চন্দ্র-সূর্য গ্রহণের দেবতা। বেদ বলে পশুদের প্রজনিকা শক্তি পূষার হাতে, জীববিজ্ঞান বলে অন্য কথা। বেদ পাঠশালার ছাত্ররা হয় বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিধি সম্পূর্ণ পরিহার করবে, নয়তো চরম বিভ্রান্তির সম্মুখীন হবে। কিশোর-কিশোরীদের যথার্থ জ্ঞান থেকে বঞ্চিত করে সাড়ে তিন হাজার বছর আগেকার তথ্যে অবরুদ্ধ রাখবার কোন অধিকার আছে রাষ্ট্রপতিদের? ইতিহাসে ভুরি ভুরি মিথ্যা, ভূগোল, বিজ্ঞান-বিরোধী তত্ত্ব, মাত্র ষোলটি গণিত সূত্রে আধুনিক গণিতশাস্ত্রের সব কথাই বলা হয়ে গিয়েছিল এবংবিধ মিথ্যা দিয়ে গঠিত হবে ভাবী প্রজন্মের জ্ঞান? ঘড়ির কাঁটাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে ইতিহাসের উল্টো মুখে ছাত্র-ছাত্রীদের রওনা করে দেবার এ প্রয়াস তো আত্মঘাতী।

তামিলনাড়ুর দশ-বারোটি কিশোরকে বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতায় এনে দেখানো হয়েছিল। দশ-বারো বছরের সেই ছেলেগুলি প্রত্যেকেই ঋগ্বেদের ১০২৮টি সুক্ত মুখস্থ জানে। বিস্ময়কর কৃতিত্ব, সন্দেহ নেই। কিন্তু সময় ও শক্তির কী নিষ্প্রয়োজন, নিষ্ঠুর, অমানবিক অপচয়। ম্লান, নিভে যাওয়া চোখগুলো নির্জীব, দীপ্তিহীন মুখভাব। ঐ মুখস্থ সংহিতাটি ছাড়া আর কিছুই জানে না তারা। সে যুগে ছাপাখানা ছিল না, তখন মুখস্থ করা ছাড়া উপায় ছিল না, পৃথিবীর সর্বত্রই তখন মুখস্থ করার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু আজ ছাপাখানার দেড়শ বছর পরেও কি আমরা বলবো 'আবৃত্তিঃ সর্বশাস্ত্রাণাং বোধাদপি গরীয়সী'? বোধ, বোঝার চেয়ে কিছুই বড় নয়। গুরুকুলের বিদ্যাদান গ্রহণের পদ্ধতি তো চিন্তা শক্তিকে জড়, পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে রাখবে। প্রতিবাদে বলা হয় ঐ পদ্ধতির মধ্যেও বহু চিত্তাশীল মানুষ তৈরি হয়েছে। প্রথমত, এটা ব্যতিক্রমী। দ্বিতীয়ত, যারা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী তাদের কথা মনে রেখেই তো শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে, ব্যতিক্রমীদের কথা ভেবে নয়।

পরিশেষে প্রশ্ন ওঠে, এরা কীরকম ভারতবর্ষ চায়? যেখানে মানুষ প্রশ্ন করবে না, সন্দেহ করবে না, যাচাই করবে না, যা শুনবে তাই মেনে নেবে, কণ্ঠস্থ করে আত্মসাৎ করবে? তাহলে জীবনের সবচেয়ে বড় যে সমস্যা মূল্যবোধ - সে সম্বন্ধে এদের সিদ্ধান্ত হলো বেদে যা আছে তাই শেষ কথা, সেটা শেখালেই আগামী প্রজন্মের প্রতি আমাদের কর্তব্য করা হয়ে যাবে। ঝাঁকে ঝাঁকে তোতাপাখি তৈরি করার নাম বেদ পাঠশালা, তার শিক্ষণীয় বস্তু ও পদ্ধতি। এরা কী ভয়ঙ্কর সর্বনাশ ডেকে আনছে ভারতবর্ষের জনজীবনে সে সম্বন্ধে অবহিত হবার সময় পেরিয়ে যায়নি। প্রতিবাদের লগ্নভ্রষ্ট হলে ক্ষমা পাবো না ভাবী প্রজন্মের কাছে। বেদ পাঠশালা চলবে সরকারি অনুদানে। যে দেশে কোটি কোটি মানুষ খেতে পায় না, সেদেশে সরকারি খরচে জাদুঘরে রাখার মত নিষ্প্রাণ পুতুল তৈরি করার অধিকার কে দিলো? বেদ অসামান্য একটি সাহিত্য, প্রাচীন একটি যুগের সুরক্ষিত একটি সমাজচিত্র, মননের দলিল। এর ভাষা, ভাষার ইতিবৃত্ত মূল্যবান আলোচ্য বিষয়; এর রাষ্ট্রনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের তৎকালীন বোধ, ধর্মচেতনা ও অনুষ্ঠান, বেদকল্পনা, যজ্ঞপ্রক্রিয়া - এসবের মধ্যে বহু শিক্ষণীয় বস্তু আছে। কিন্তু তার ভার ইতিহাস সচেতন বিজ্ঞানমনস্ক গবেষকের হাতে, যাঁরা আরও বহু প্রাচীন সংস্কৃতির পরিব্যাপ্ত পটভূমিকায় বেদকে স্থাপন করে এর বিচার করতে পারেন, একে এর যথার্থ মূল্যে বুঝতে পারেন। সে কাজ বেদ পাঠশালার দৃষ্টির চক্রবালের ওপারে, ক্ষমতারও বাইরে। এরা বেদ পড়িয়ে ছেলেগুলোকে বোঝাবেন, এই হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি ও প্রাচীনতম শাস্ত্র, এ মত যে কী গভীরভাবে ভ্রান্ত ও কী অপরিমেয় ক্ষতি সাধন করতে পারে তা কি এরা বোঝে না? বোঝে এবং বুঝেই হিন্দুত্বের শ্রেষ্ঠতায় অন্ধবিশ্বাসী একটি সম্প্রদায় সৃষ্টি করতে প্রয়াসী, যারা মুসলিম-খ্রীস্টান-শিখ-বৌদ্ধ-বিদ্বেষী হিন্দু হবে ও এই নারকীয় রাষ্ট্রশক্তিকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখবার জন্যে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত থাকবে। এইরকম যন্ত্র দানবের একটা জনগোষ্ঠী তৈরি করতে পারলে হিন্দু ফ্যাসিবাদ নির্বিঘ্নে ভারতবর্ষের মাটিতে অবতীর্ণ হবে। এ প্রচেষ্টা সর্বশক্তি দিয়ে রুখতে হবে। হাতে সময় বেশি নেই।





Comments

Popular posts from this blog

শিবিরনামা [পর্ব-এক]

চাড্ডিগণ [এক]

পশ্চিমাদের পুতুল সরকার [পর্ব-এক]